আইনস্টাইন, আলোক-তড়িৎক্রিয়া ও ফোটন নামের গোলা

উজবেকিস্তান থেকে ভাগ্যহত এব যুবক বেরিয়েছিলেন দক্ষিণের পথে। সদ্যই নিজের পৈত্রিক সিংহাসন খুঁইয়ে বসেছেন। যাযাবরের মতো ঘুরেছেন ফারগানার পথে-প্রান্তরে, জঙ্গলে-পাহাড়ে। এক-দুজন করে সঙ্গী জুটেছে, তৈরি হয়েছে ছোটখাটো একটা দস্যুদল। কিন্তু রাজরক্ত যাঁর গায়ে বইছে, তাঁকে তো দৈস্যুর মতো আচরণ করলে চলবে না। ছোট্ট দলটা নিয়ে বার বার ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে, ছোট খাটো রাজ্য জয় করতে করতে, এক সময় নিজের রাজ্য তো ফিরে পেয়েছেনই, সৈন্য-সামন্তের বিশাল বহর নিয়ে চলে এসেছেন সিন্ধু নদের কিনারায়। ভারতবর্ষের মসনদে তখন ইব্রাহিম লোদী। ডাকসাইটে সম্রাট। তাঁকে পরাস্ত করতে তাই বিশেষ কিছুর দরকার ছিল। সেই বিশেষ কিছু যুবকটি পেয়েছেন তুর্কিদের কাছ থেকে। বিশাল এক লোহার পাইপ। দুপাশে দুটি চাকা। পাইপের পেছনে বারুদ ঠেসে অগ্নিসংযোগ করলে বিস্ফোরিত বারুদ জলন্ত গোলার রূপ নিয়ে পাইপের মুখ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় দুরন্ত বেগে। লক্ষ্যে গিয়ে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত করে দেয় সামনে যায় পায়- সৈন্য, ঢাল-তলোয়ার, হাতি-ঘোড়া এমনকী বিশাল বিশাল ইমারত- সবকিছুকে। তো এই ভয়ানাক যন্ত্রের খবর ভারতবর্ষের শাসক তখনো পাননি। ঘোড় সওয়ার আর হস্তিবাহিনীর বিশাল এক বহর সিন্ধুর এপারে জমায়েত হয়েছে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং সম্রাট ইব্রাহিম লোদী। ভাবখানা এমন, তরুণদের দলটা নদী পেরুলেই কচুকাটা করবেন। তার আগেই তির-ধনুকের নিশানা করে যতগুলো পারা যায় শত্রুসেনা খতম করার সব রকম ব্যবস্থাই করা করে রেখেছেন। কিন্তু উজবেক তরুণ সে ফাঁদে পা না দিয়ে গোলান্দাজ বাহিনিকে নির্দেশ দিলেন গোলা ছুড়তে। প্রথম আঘাতেই কেল্লাফতে। স্বয়ং ইব্রাহীম লোদীকেই আঘাত করে প্রথম গোলা। নেতা মারা যাওয়াই দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ল লোদীর বাহিনী। মাত্র দশ মিনিটের যুদ্ধে ভারত দখল করে নিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর।

ধান ভানতে শীবের গীত যেমন, কোয়ান্টামের গল্পে বাবরের প্রসঙ্গটা কি তেমন নয়?

না, কারণ ওই কামানের গোলা। কামানের গোলায় কী থাকে? বারুদ, যার ভেতরে নাইট্রোজেনসহ নানারকম দাহ্য পদার্থ থাকে। বারুদ জ্বলে উঠলে এমনিতেই তার শক্তির অভাব হয় না। বিস্ফোরোতি হয়ে ধ্বংস করে দেয়, আশপাশে যা পায়, সবকিছুকে। সঙ্গে যদি আবার গতিশক্তি থাকে, যেমনটা থাকে কমানের গোলায়, সেটা তখন আরও বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। বড় বড় স্থাপনা, এমনকী পাহাড়-পর্বত পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে পারে। আইনস্টাইন খুদে এক কামানের গোলার কথাই বললেন ১৯০৫ সালে, যার জন্য তিনি পরে নোবেল পেয়েছিলেন। অথচ এর জন্য সে-সময়ের বিজ্ঞান মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

দুই

১৮৩৯ সাল। ফরাসী বিজ্ঞানী এডমন্ড বেকরেল এক আশ্চর্য ঘটনা লক্ষ করলেন। তিনি সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করছিলেন। দেখেন বৈদ্যুতিক কোষের ওপর আলো একটা ভালো প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ ঘটনার ব্যাখ্যা তাঁর কাছে ছিল না। আর এটা নিয়ে তিনি খুব বেশি মাথাও ঘামাননি। কিন্তু এটাই ছিল কোনো বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণ করা প্রথম আলোক-তড়িৎক্রিয়া বা ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট। এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি, এডমন্ড বেকরেল হলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ও তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক হেনরি বেকরেলের বাবা।

বেকরেলের পর এ ঘটনা নিয়ে আর কেউ মাথায় ঘামাননি। তিন দশক পর ১৮৭৩ সালে ব্যাপারটা আবার সামনে চলে আসে। বিট্রিশ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার উইলাফবি স্মিথ। তিনি টেলিফোন অপারেটে হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রান্স আটলান্টিক অঞ্চলে। টেলিফোন ক্যাবলের রোধ পরীক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। এজন্য তিনি রোধক পরিমাপের একটা যন্ত্র ব্যবহার করতেন। রোধকটা ছিলি সেলিনিয়ামের। একদিন তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করেন, বৈদুতিক রোধকের নতুন এক ব্যাপার। আগে কেউ জানতেন না এ ব্যাপারটা। তিনি লক্ষ করেন, সেলিনিয়াম রোধকের ওপর সূর্যের আলো পড়লে বেড়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ প্রবাহ। অর্থাৎ কমে যাচ্ছে রোধকের মান। অনেকে ভাবতে পারেন, সূর্যের তাপের কারণে এমনটা হচ্ছে। তড়িৎগতিবিদ্যা কিন্তু উল্টো কথা বলে, তাপ বাড়লে বেড়ে যায় রোধেকের রোধকত্ব। ফলে বিঘ্ন ঘটে স্বাভাবিক তড়িৎ প্রবাহে। তাহলে স্মিথের এ ঘটনার ব্যাখ্যা কী? তাপ এখানে মূল ফ্যাক্টর নয়। মূল ফ্যাক্টর আলো। কিন্তু কেন, কীভাবে এই ঘটনা ঘটছে সে ব্যাখ্যা ছিল না স্মিথের কাছে।

১৮৭৮ সাল। জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিখ হার্জ এই ঘটনা একটু অন্যভাবে লক্ষ করেন। অদৃশ্য আলোক তরঙ্গ অর্থাৎ বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু সেই আলোর সন্ধান তিনি পাননি। পরে সেই অদৃশ্য আলোক তরঙ্গের হদিস দেন হার্জ এবং বাঙালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। হার্জই প্রথম বেতার তরঙ্গ শনাক্ত করেন। এজন্য তিনি ব্যবহার করেন বায়ুশূন্য ক্যাথোড টিউব। এ ধরনের একটা টিউবেই পরে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন স্যার জে জে টমসন।

ক্যাথোড টিউবের ভেতর যে ক্যাথোড পাত থাকে সেটা ধাতুর তৈরি। পাতটা ওপর তিনি অতি বেগুনি রশ্মি বা আল্ট্রাভায়োলেট রে দিয়ে আঘাত করেন। এর ফলে পাত থেকে উৎপন্ন হয় আলোর ঝলক। ক্যাথোড টিউবে যে ক্যাথোড রশ্মি দেখা যায়, সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। একদল বিজ্ঞানী মনে করতেন ক্যাথোড রশ্মি হলো একধরনের কণাদের প্রবাহ। কণারা উচ্চগতিতে প্রবাহিত হয় বলে এরা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই উজ্জ্বল আলোই আমরা দেখি ক্যাথোড রশ্মি হিসেবে। অন্যদিকে হার্জসহ কিছু বিজ্ঞানী মনে করতেন, ক্যাথোড রশ্মি আসলে এক ধরনের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। এর ভেতর কণা-টনা বলে কিছু নেই।

হার্জ ১৮৯৪ সালে মারা যান। আর কয়েক বছর বাঁচলে দেখে যেতে পারতেন, তাঁর ধারণা কত ভুল। দেখে যেতে পারতেন, স্যার জে জে টমসন প্রমাণ করে দিচ্ছেন, ক্যাথোড রশ্মি আসলে ইলেকট্রন নামে এক ধরনের ক্ষুদে কণাদের স্রোত, যে কণাটি ঋণাত্মক চার্জযুক্ত।

১৮৮৮ সালে আরেক জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম হলকওয়াস ফটোতড়িৎক্রিয়ার পরীক্ষাটা আরেকটু গুছিয়ে করেন। তিনি দেখান এক আশ্চর্য ঘটনা। ক্যাথোডের ওপর অতি বেগুনি রশ্মি দিয়ে আঘাত করলে ক্যাথোড দ্রুত চার্জ হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ ক্যাথোডের ঋণাত্মক চার্জ দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়। যতক্ষণ ক্যাথোডে চার্জ থাকে, ততক্ষণ আলোর ঝলকানি দেখা যায়। কিন্তু অ্যানোডের ওপর বেগুনি রশ্মি দিয়ে আঘাত করলে কোনো ঘটনা ঘটেনা। অর্থাৎ আন্যোডের ধনাত্মক চার্জের কোনো নড়চড় হয় না। এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি। ব্যাটারি বা ড্রাইসেলের যে প্রান্ত ধনাত্মক চার্জযুক্ত, সে প্রান্তকে বলে ক্যাথোড। আর যে প্রান্ত ঋণাত্মক চার্জযুক্ত সে প্রান্তকে বলে অ্যানোড। ক্যাথোড টিউবে ব্যাপারটা ঠিক উলটো। একটা ব্যাটারিকে সঙ্গে ক্যাথোড টিউবের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। যে প্রান্ত ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত, সেই প্রান্তকে ক্যাথোড বলে। অর্থাৎ যে প্রান্ত থেকে ক্যাথোড রশ্মি অর্থাৎ ঋণাত্মক চার্জের কণারা নির্গত হয়, সেটাকে বলে ক্যাথোড পাত বা ক্যাথোড দণ্ড। উলটো দিকের পাত বা দণ্ডকে বলে অ্যানোড। এটা ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

যাই হোক, হলকাওয়াসের পরীক্ষাটা ছিল এমন, ধনাত্মক চার্জের কোনো ধাতব পাতের ওপর অতিবেগুনি রশ্মি ফেললে কোনো স্ফুলিঙ্গই দেখা যায় না। কিন্তু ঋণাত্মক পাতে ফেললে স্ফুলিঙ্গ দেখা যায় এবং দ্রুত পাতের ঋণাত্মক চার্জ কমতে থাকে। একসময় ঋণাত্মক চার্জ শূন্য হয়ে যায়।

হলকাওয়াস পর্যবেক্ষণটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু কেন এই ঘটনা ঘটে তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। এরপর ১৮৯৯ সালে টমসন দেখালেন, ক্যাথোড টিউবের ক্যাথোড পাত থেকে নির্গত যে আলোক রশ্মি অ্যানোডের দিকে প্রবাহিত হয়, সেই রশ্মি আসলে ইলেকট্রনের স্রোত। টমসন তখন আরেকটা ব্যাখ্যাও দিতে সক্ষম হন৷ অতিবেগুনি রশ্মির আঘাতে যে স্ফুলিঙ্গ বা আলোর ঝলক দেখা যায়, সেই স্ফুলিঙ্গও আসলে ইলেকট্রনের ঝলক। তার মানে, ক্যাথোড পাতে অতি বেগুনি রশ্মির আঘাত করে, এর ফলে পাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় ইলেকট্রন।

তখনই বাধে আসল বিপত্তি। তখন আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব ছড়ি ঘোরাচ্ছে প্রবল বিক্রমে। কণা তত্ত্ব বাতিল হয়ে গেছে বহুদিন আগেই, টমাস ইয়ংয়ের পরীক্ষার মাধ্যমেই। অন্যদকিকে ইলেকট্রন যে বস্তু কণা, তার ভর আছে। আলোর আবার ভর নেই। তার ওপর এর প্রকৃতি তরঙ্গের মতো। একটা তরঙ্গের পক্ষে কীভাবে সম্ভব ইলেকট্রনের মতো ভরযুক্ত বস্তুকণাকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে বের দেওয়ার?

একথা ঠিক, ধাতব পদার্থের সক্রিয়তা অনেক বেশি। এদের পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনগুলো অনেকটাই আলগা থাকে। তাই পদার্থের ইলেকট্রন শেয়ার করার প্রবণতা অনেক বেশি। শেয়ার করার প্রবণতা যেমন বেশি, ইলেকট্রনের ওপর নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ তুলনামূলক কম বলেই এদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া সহজ। কিন্তু সেই ধাক্কা দিচ্ছে কে সেটাও তো একটা ব্যাপার!

তিন

আলোক-তড়িৎক্রিয়ার সমস্যার সমাধান লুকিয়ে ছিল প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বে। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেননি। ভেবেছিলেন সুইজ্যারল্যান্ডের বার্ন শহরে পেটেন্ট অফিসের সেই কেরানিটি, যিঁনি কাজের ফাঁকে লুকিয়ে বিজ্ঞানচর্চা করতেন। সেই তরুণের নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। কোনো ল্যাবরেটরি, অবজারভেটরির সাহায্য ছাড়াই স্রেফ কিছু থট এক্সপেরিমেন্ট করে মহাবিশ্বের এক মহারহস্য উন্মোচনের খসড়া তিনি করেন মগজ ব্যবহার করে।

১৯০৫ সাল নাগাদ সকল প্রস্তুতি শেষ করে ফেলেন তিনি। প্রকাশের অপেক্ষায় আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, বা স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি। রিলেটিভিটি থেকেই বেরিয়ে এসেছে পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা সমীকরণটি। ভর শক্তির সমীকরণ, E = mc2। আর এই সমীকরণ বলছে একটি বিশেষ কথা। সেই বিশেষ কথাটি নিয়ে আইনস্টাইন থিওরি অব রিলেটিভিটির ছাড়াও আরেকটা প্রবন্ধ লিখলেন। সেই প্রবন্ধে দিলেন আলোক-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা। এজন্য তিনি ধার করলেন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মেনে নিয়ে আইনস্টাইন বললেন, আলোর পক্ষেও সম্ভব ইলেকট্রনের মতো ভরযুক্ত বস্তু কণাকেও স্থানচ্যূত করা, যদি সেটার আচরণ কণার মতো হয়। হ্যাঁ, আলোর কণাতত্ত্ব অনেক আগেই খারিজ করে দিয়েছিলেন টমাস ইয়াং, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তরঙ্গ তত্ত্ব। তরঙ্গ তত্ত্ব প্রমাণিত সত্য। আইনস্টাইন বললেন আলোর নতুন কণা ধর্ম আসলে নিউটনের পর্যবেক্ষণ করা কণার মতো নয়। আইনস্টাইন এই কণা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের আলোকে। প্ল্যাঙ্ক যেমন বলেছিলেন, আলো আসলে শক্তির গুচ্ছ গুচ্ছ প্যাকেটের সমষ্টি। আইনস্টাইন সেই প্যাকেটকে তুলনা করলেন শক্তির কণা হিসেবে। বহু পরে শক্তির এই কণার নামকরণ করা হয় ফোটন নামে।

আইনস্টাইন শক্তির এই কণাকে তুলনা করলেন কামানের গোলার সঙ্গে। কামানের গোলা ছুটে গিয়ে যেমন ধ্বংস করে দিতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সৈন্যদের। তেমনি আলোর এই কণার যদি পর্যাপ্ত শক্তি থাকে, সেটি গিয়ে আঘাত করবে ধাতব পদার্থের ইলেকট্রনকে। সেই আঘাতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে যাবে ধাতব পরমাণুর শেষ শক্তিস্তর থেকে। ছুটে বেরিয়ে যাওয়া এসব ইলেকট্রনের গতিশক্তি থেকেই আলোর ঝলকানি দেখা যায়।

আইনস্টাইন বললেন, ভর না থাকলেও আলোর কণার গতিশক্তি আছে, অর্থাৎ এর মোমেন্টাম আছে, সরল বাংলায় আমরা যেটাকে ভরবেগ বলি। সেই ভরবেগের কারণেই আলো এভাবে ইলেকট্রনকে ছিটকে বের করে দিতে পারে। আইনস্টাইন আরও দেখালেন, সব আলোর পক্ষে এভাবে ইলেকট্রনকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য থাকতে হবে পর্যাপ্ত শক্তি। অতি বেগুনি রশ্মির পক্ষে ব্যাপারটা সহজ, কারণ এদের কম্পাঙ্ক অনেক বেশি, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম, তাই শক্তিও অনেক বেশি। অন্যদিকে আমাদের দৃশ্যমান আলোগুলোর অত শক্তি নেই। তাই এদের দিয়ে আলোক-তড়িৎক্রিয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ইনফ্রারেড কিংবা বেতার তরঙ্গের পক্ষেও। এদের শক্তি দৃশ্যমান আলোর চেয়েও অনেক কম। অন্যদিকে গামা রশ্মি কিংবা এক্স-রের কম্পাঙ্ক অতি বেগুনি রশ্মির চেয়েও বেশি। তাই আলোক-তড়িৎক্রিয়ায় এদের সক্রিয়তা অনেক বেশি।

আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে আলোক-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা যেমন দিলেন, আলোর কণার নানা চরিত্র ও ধর্মের ব্যাখ্যাও এলো এই কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে। পরে ১৯১৪ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট অ্যান্ড্রুজ মিলিক্যান পরীক্ষাগারে আইনস্টাইনের ব্যাখ্যার প্রমাণ দিলেন।

অন্যদিকে ৫ বছর পেরিয়ে এসেও প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মহলে তেমন আলোড়ন ফেলতে পারেনি। কিন্তু আইনস্টাইন যখন এর ব্যবহার একবার দেখিয়ে দিলেন, তখন এটা নিয়ে হৈ চৈ শুরু হলো। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে নীলস বোর পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়েও আশ্রয় নিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের। তখন থেকেই মূলত পদার্থবিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটির পরিপূর্ণতার দিকে যাত্রা শুরু হয়।

চার

আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব ব্যবহার করে করে যদি আলোক-তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে কিছু ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। আলোক-তড়িৎক্রিয়া সংঘঠিত হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন, অনন্ত আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব সে কথাই বলে। কারণ আলো নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির হলে অনেক্ষণ ধরে ইলেকট্রনের ওপর পড়লে হয়তো ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে এক সময় ছিটকে বেরিয়েও যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আলোক-তড়িৎক্রিয়া মুহূর্তের মধ্যেই সংঘঠিত হয় এবং ন্যানো সেকেন্ড সময় লাগে। এত কম সময়ে তরঙ্গের পক্ষে সম্ভব নয় আলোক-তড়িৎক্রিয়া ঘটানো।

আলো যদি কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী ফোটন কণা হয়, তাহলে একটা ফোটন একটা মাত্র ইলেকট্রনকে আঘাত করবে। ইলেকট্রন ফোটন থেকে কিছু শক্তি ধার করে প্রবল বেগে বেরিয়ে যাবে ধাতব পরমাণু থেকে। এক্ষত্রে একটা ফোটনের শক্তি মাত্র একটা ইলেকট্রনই গ্রহণ করবে। অন্যকোনো ইলেকট্রনকে সেই শক্তির ভাগ সে দেবে না। তাই ইলেকট্রন সেই শক্তি নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারবে। অন্য দিকে আলো যদি ফোটন কণা না হয়ে শুধু তরঙ্গ হয়, তাহলে তার নির্দিষ্ট কোনো আকার থাকে না। তরঙ্গের শক্তি ভাগ হয়ে যায় পরমাণুর সব ইলেকট্রনে। এর ফলে নির্দিষ্ট একটা ইলেকট্রন পরমাণুর বন্ধন মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার জন্য পারে না পর্যাপ্ত শক্তির জোগান দিতে। সবগুলো ইলেকট্রনই শক্তিস্তরভেদে কমবেশি আলগা হয়ে যাওয়ার। তখন সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনকে অপেক্ষা করতে হয় আরেক ঝাঁক তরঙ্গ আসার অপেক্ষায়। এভাবে ক্রমাগত একের পর এক আলোর ঝাঁক এসে ধাতুর পৃষ্ঠতলের প্রতিটা পরমাণুর প্রতিটা ইলেকট্রনকে শক্তি জোগাতে লেগে যেত বহু সময়। সুতরাং তরঙ্গ তত্ত্বের সাহায্যে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে আলোক-তড়িৎক্রিয়ার কালক্ষেপন না করার বৈশিষ্ট্য আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়েই শুধু ব্যাখ্যা করা যায়।

আলোকে শুধু তরঙ্গ ধরে হিসাব করলে ইলেকট্রনের গতিশক্তি বাড়ানোর জন্য আলোর তীব্রতাও বাড়ানোর দরকার হবে। ধরা যাক, একটা ধাতুকে বেগুনি আলো দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। আলোটা অত জোরালো নয়। তাই আলোক তরঙ্গ গিয়ে ইলেকট্রনকে আঘাত করবে, তারপর সেটা বেরুবে, এর জন্য সময় লাগবে, একসময় ধীরে ধীরে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে নির্গত হবে। যেহেতু তরঙ্গের শক্তি সব ইলেকট্রনের ভেতর ভাগ হয়ে যাচ্ছে, তাই একটা সময় এক সাথে অনেকগুলো ইলেকট্রন মুক্ত হবে। তরঙ্গের শক্তি ভাগ হয়ে যাচ্ছে বলে ইলেকট্রন অনুজ্জ্বল বেগুনি আলো থেকে। খুব দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি পায় না। তাই অনুজ্জ্বল বা কম তীব্রতার আলোতে ইলেকট্রনের বেগ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ায় সেটা ঘটে না।

নির্গত ইলেকট্রনের গতিবেগ বাড়াতে হলে, তরঙ্গ তত্ত্ব মতে আলোর উজ্জ্বলতা অর্থাৎ তীব্রতা বাড়াতে হবে। একই রঙের আলোর কম্পাঙ্ক সবসময় এক। সে অনুজ্জ্বলই হোক আর তীব্রই হোক। অর্থাৎ আলোর তীব্রতার সাথে কম্পাঙ্কের সম্পর্ক নেই। তাহলে তরঙ্গ তত্ত্ব অনুযায়ী ইলেকট্রনের গতিশক্তিও আলোর কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভর করার কথা নয়। কিন্তু আলোক-তড়িৎক্রিয়ার পরীক্ষা বলছে ভিন্ন কথা। দেখা যায়, আলোর কম্পাঙ্ক বাড়ালেই কেবল ইলেকট্রনের গতিশক্তি বাড়ে। অর্থাৎ বেগুনি আলোর চেয়ে অতি বেগুনি আলোয় ইলেকট্রনের গতিশক্তি বেশি হয়। আলো উজ্জ্বল কি অনুজ্জ্বল, তার ওপর নির্ভর করে না ইলেকট্রনের গতিশক্তি।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে, একটা ফোটন যেহেতু একটা ইলেকট্রনকেই আঘাত করে। সুতরাং ফোটনের শক্তি যত বেশি হবে ইলেকট্রনের গতিশক্তি তত বেশি হবে। আলোর কম্পাঙ্ক বাড়লেই কেবল ফোটনের শক্তি বাড়ে। তাই ইলেকট্রনের গতিশক্তি নির্ভর করে আলোর কম্পাঙ্কের ওপর। অন্যদিকে আলোর তীব্রতা বাড়লে ফোটনের পরিমাণও বেশি হয়। আলোও তত উজ্জ্বল হয়। বেশি বেশি ফোটন বেশি বেশি ইলেকট্রনকে আঘাত করতে পারে। তাই নির্গত ইলেকট্রনের সংখ্যাও বাড়বে আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে। কিন্তু তরঙ্গ তত্ত্বে বলা হচ্ছে উল্টো কথা।

এটাই ছিল আলোক-তড়িৎক্রিয়ার জন্য আইনস্টাইনের দেওয়া ব্যাখ্যা। আর এই ব্যাখ্যা প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকেই শুধু শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়নি, আজ যে আমরা ডিজিটাল জীবন-যাপন করছি, এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে আলোক-তড়িৎক্রিয়া। টেলিভিশনে আমরা যে ছবি দেখি তা আলোক তড়িৎ-ক্রিয়ারই ফল। আজকের স্মার্টফোন, কম্পিউটার সবকিছুতেই আলোক-তড়িৎক্রিয়ার জয়জয়কার। আর এগুলো সম্ভবই হতো যদি না শুধু থট এক্সপেরিমেন্ট করেই আইনস্টাইন নামের সেই কেরানি যুবকটি আলোক-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা না দিতেন।

সেই আইনস্টাইন ৬৬ বছর আগে আজকের দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। প্রয়াণ দিবসে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানীর প্রতি বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা