একটি অলীক বিড়ালের কাহিনি

একটা নচ্ছার বিড়াল তাঁকে জ্বালাচ্ছে। রাতদুপুরে মিউ মিউ ডাকে ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে বিড়ালটা। প্রতিদিন। ব্যাটার সময়জ্ঞানও আছে। সারা দিন খাটাখাটুনি তো কম নয়। খাতা-কলম আর মগজের পরিশ্রম। পদার্থবিদ্যা আর গণিতের মিশেলে নানা রকম হিসাব-নিকাশ করতে হয়। তার ওপর নিজের তত্ত্বই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে বারবার। তিনি নিমিত্তবাদী। অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ করে পদার্থবিজ্ঞানের ক্রিয়া-কর্মের যে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা, সেটাতেই আস্থা রাখছেন তিনি। পাশে পেয়েছেন আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো মহারথীকেও। হাইজেনবার্গের যন্ত্রণা তো আছেই, নিজের তত্ত্বও যে পক্ষ নিচ্ছে অনিশ্চয়তাবাদীদের। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত সব আইন নিয়ে তাই চিন্তিত না হয়ে উপায় আছে? কিছুতেই এমনটা হওয়ার নয়। সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায় যে নতুন এই তত্ত্ব, এটা মানা কঠিন। ওদিকে নীলস বোর আবার ঘোষণা করেছেন, ‘কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়তে গিয়ে যে শক খাবে না, বুঝতে হবে এই তত্ত্ব সে বোঝেইনি।’ তার মানে কী?

আপনি যদি বোঝেন, তাহলে চিন্তা-ভাবনার জগত্টা ওলট-পালট হবে। আর যদি না বোঝেন, তাহলেই ভাবনার জগত্টা ঠিক থাকবে। চরম মাত্রার হেঁয়ালি!

ঘুমটা ভালোমতো হচ্ছে না। বিছানায় গড়াগড়ি দিতেও সমস্যা। কোয়ান্টামের সমীকরণগুলো গুলিয়ে দিচ্ছে মাথাটা। নিজের সমীকরণ তো ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়েছে। কেন বানাতে গিয়েছিলেন এই তত্ত্ব। তিনি কেবল ইলেকট্রনের জন্য একটা গতিপথ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জটিল গণিতের ম্যারপ্যাঁচে পড়ে খেই হারাবেন এমনটা তো ভাবেননি। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে জগ আছে, পানিও আছে। এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে নিলেন। তাঁর মনে হল, শুধু পানিতে কাজ হবে না।

ওয়ার্ডরোবের ভেতর স্লিপিং পিল রাখা আছে। ইনসমনিয়ার রোগী তিনি। তাই স্লিপিং পিল রাখতে হয়। পিলে কাজ হয়েছে। তন্দ্রা এসে গেছে শ্রোডিঙ্গারের দুচোখে। কিন্তু ঘুমটা গভীর হওয়ার আগেই আবার মিউ মিউ ডাক। প্রথমে টের পাননি শ্রোডিঙ্গার। বিড়ালটাও বুঝতে পেরেছে সেটা। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বিছানায়। শ্রোডিঙ্গারের কাছে এসে গলা ছেড়ে গর্জে ওঠে কালো বিড়ালটা। এবার হয়েছে। শ্রোডিঙ্গার বিদ্যুবেগে ডান হাতটা বাগিয়ে ধরে ফেলেন বিড়ালের গলাটা। ‘ব্যাটা পাজি, বদমাশ!... এবার!... কোথায় যাবি! খুব জ্বালিয়েছিস কটা দিন। এবার বাগে পেয়েছি তোকে!’ উত্ফুল্ল শ্রোডিঙ্গার।

বিড়ালটাও নাছোড়বান্দা। ঘাড় চেপে ধরেছেন শ্রোডিঙ্গার। দাঁত বাগিয়ে হাতে কামড়ানোর উপায় নেই। শরীরটা মুচড়ে পেছনের পা দিয়ে আঁচড় কাটার চেষ্টা করতে গেল বিড়ালটা। শ্রোডিঙ্গার বুঝে ফেলেছেন মতলবটা। উঠে বসে অন্য হাতটা দিয়ে বিড়ালের কোমর শক্ত করে ধরলেন। নইলে আবার জলাতঙ্কের চোদ্দটা ইনজেকশন নেওয়া লাগবে। বিড়ালটা ধরলেন, এটা আসলে প্ল্যান করাই ছিল। সপ্তাহখানেক ধরে জ্বালাচ্ছে বিড়ালটা। তাই ঠিক করেছিলেন ধরবেন ওটাকে। তাই একটা খাঁচাও কিনে এনেছেন বাজার থেকে। বিড়ালটাকে খাঁচাবন্দী করলেন। ভাবলেন সকালে একটা বিশেষ শাস্তি দেবেন বিড়ালকে।

আবার বিছানায় ফিরে এসেছেন। ভেবেছিলেন এবার ঘুমিয়ে পড়বেন। কিন্তু হঠাৎ একটা ভাবনা খেলে যায় মগজে। সিনেমার ভিলেনের মতো হেসে ওঠেন। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে হবে। বোর এখন জার্মানিতে, আইনস্টাইনকেও ডেকে নেওয়া যেতে পারে। হাইজেনবার্গ তো থাকবেনই। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার হবে। বিড়ালটাকে সাজা দেওয়া তো হবেই, কে জানে হয়তো ব্যাটা মারাও পড়তে পারে। সঙ্গে ঘায়েল হবেন হাইজেনবার্গ আর বোরও।

পরদিন সকালে শ্রোডিঙ্গার বাজারে গেলেন। কিনলেন বেশ কয়েকটা জিনিস। একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স, একটা কাচের পাত্র, হাইড্রোসায়ানায়িক বিষ, একটা ইলেকট্রিক হাতুড়ি, একটা গাইগার কাউন্টার। কাচের পাত্রে বিষ ভরলেন। সেটা আটকে দিলেন বাক্সের ভেতরের একটা দেয়ালে। তার পাশেই হাতুড়িটা লাগিয়ে দিলেন। তারপর সেটা যুক্ত করলেন একটা বিদ্যুৎ-চালিত সেন্সরের সঙ্গে।

তারপর বাক্সের আরেক প্রান্তে রাখলেন একটা তেজস্ক্রিয় পদার্থের পরমাণু। আগামী এক ঘণ্টায় তেজস্ক্রিয় পরমাণুটা ভেঙে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে পারে। আবার না-ও করতে পারে। আর যদি ভাঙে পরমাণুটা, তাহলে সেটা গাইগার কাউন্টারে ধরা পড়বে। সেটিই সেন্সর শনাক্ত করতে পারবে, যার ফলে নড়ে যাবে হাতুড়িটা। নড়ে ওঠা হাতুড়িটা তখন আঘাত করবে বিষপাত্রের গায়ে। পাত্র যাবে ভেঙে, বিষক্রিয়ায় মারা পড়বে বিড়ালটা।

শ্রোডিঙ্গার বিড়ালটাকে বাক্সে বন্দী করে ফিরে এলেন বিজ্ঞানীদের কাছে। বললেন, ‘এক ঘণ্টা পর বাক্সটা খোলা হবে। তখন বলতে পারবেন, বিড়ালটা জীবিত না মৃত? পারবেন না। কারণ তেজস্ক্রিয় উত্স থেকে একটা পরমাণু ভাঙবে কি না সেটা আপনারা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। তাই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না হাতুড়িটা নড়েছে কি না। তাই আপনারা নিশ্চিত নন গ্যাসপাত্র অক্ষত আছে কি না। গ্যাসপাত্রের অবস্থা নিশ্চিত নয় বলে নিশ্চিত হতে পারবেন না বিড়ালটা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। আপনার জন্য এখন দুটো সম্ভাবনাই সমান। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটেছে অথবা ঘটেনি। হাতুড়ি নড়েছে অথবা নড়েনি। বিষপাত্র ভেঙেছে অথবা ভাঙেনি। বিড়ালটা জীবত অথবা মৃত। অর্থাৎ একটা বিড়াল এখন আপনার কাছে দুটো হয়ে গেছে। একটা জীবিত, একটা মৃত। এখানে তৈরি হয়ে গেছে একটা এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট। যখনই আপনি বাক্সের ডালাটা আলগা করবেন, তখন আবার বিড়াল একটা হয়ে যাবে। শুধু জীবিত অথবা শুধু মৃত। এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের হিসাবটা এখানে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর সঙ্গে হাতুড়ির। হাতুড়ির সাথে বিষপাত্রের। বিষপাত্রের সাথে বিড়ালের। আপনি যদি নিশ্চিত হন, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটেছে, তাহলে সাথে সাথেই নিশ্চিত হয়ে যাবেন বিড়ালটিও মৃত।

শ্রোডিঙ্গার বললেন, ‘যখনই আপনি সুনির্দিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তখনই বিড়ালটার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ছে। কোয়ান্টাম কণিকাদের ক্ষেত্রেও হিসাবটা এ রকম। কোয়ান্টাম কণাদের কোনো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করতে গেলে কণাগুলো সেই চরিত্রই আপনাকে দেখাবে। বাস্তবে কি এমনটা হওয়া সম্ভব? আপনারাই বলুন। এটা কি পর্যবেক্ষণযোগ্য বিজ্ঞানে সম্ভব? এমন অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার কি বিজ্ঞান সমর্থন করে?’

আইনস্টাইন বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছ শ্রোডিঙ্গার। অনিশ্চয়তাবাদীরা, এই যে এখানে বোর আছেন, হাইজেনবার্গ আছেন, এঁরা তো এমনটাই বলতে চাইছেন। এমন কথা বলছেন যা বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করা যায় না!’

এবার হালকা কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নীলস বোর বললেন, ‘বিচারবুদ্ধি গুলিয়ে যায় বলেই যে কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা ভিত্তিহীন, এমনটা বলার সময় আসেনি। বিশুদ্ধ গণিতই কিন্তু এমন কথা বলছে। চাইলে আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’

‘কিন্তু মিস্টার বোর,’ বিরক্ত আইনস্টাইন বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই ঈশ্বর পাশা খেলেন না।’

‘মিস্টার আইনস্টাইন,’ ঝাঁজের সঙ্গে বলে উঠলেন নীলস বোর। ‘আপনাকে বলে দিতে হবে না ঈশ্বর কী করবেন না করবেন।’

হতাশার চরম সীমায় পৌঁছে আইনস্টাইন বললেন, ‘তা-ই যদি হয়, আগে জানলে বিজ্ঞানী হতাম না। হতাম ছুতোর মিস্ত্রি অথবা করপোরেশনের মেথর।’

'সে সুযোগ এখনো ফুরিয়ে যায়নি মিস্টার আইনস্টাইন।’ কফিনে শেষ পেরেক ঠুকলেন বোর।

হাইজেনবার্গের মুখে ফিচেল হাসি। ম্যাক্স বর্ন থ মেরে গেছেন। এবার শ্রোডিঙ্গারের মনে হলো, বাক্স, খাঁচা, বিষ, হাতুড়ি কেনার টাকাটাই জলে গেছে। এগুলো এখন কাজে লাগবে না। এবার বিড়ালটাকে কী শাস্তি দেবেন, সেটা ভাবলেন। কিন্তু মনটাই খারাপ, তার এত আয়োজন বুমেরাং হয়ে গেছে। এখন বিড়ালটা সত্যিই যদি মরে যায়, তাহলে তিনি শান্তি পান। বাক্সের ডালাটা খুলে হতবাক। সত্যিই সত্যিই বিষপাত্র ভেঙে বিড়ালটা মারা গেছে! মনের ভেতর একটা দোলাচল শুরু হলো। তাহলে কি হাইজেনবার্গের কথাই ঠিক। আমি মৃত দেখতে চাইছিলাম বলেই কি বিড়ালটা মারা পড়েছে!

হাইজেনবার্গকে শত্রু-প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন তিনি। তাঁর কাছে এমন হার, মানা যায় না। ভাবলেন, তিনি যে বাক্সের ডালা খুলেছেন, এটা কেউ দেখেনি। তার মনে যে দোলাচল চলছে, সেটা অন্যদের বুঝতে দেওয়া যাবে না। ডালাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু বিধি বাম! হাইজেনবার্গ পুরোটাই দেখেছেন। কিন্তু বিড়ালটা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, সেটা দেখার সুযোগ পাননি। তিনি এবার কথা বলে উঠলেন, ‘মিস্টার শ্রোডিঙ্গার, ডালাটা বন্ধ করলেন কেন? আমরা দেখি বিড়ালটার কী হলো। জানেনই তো, আমি বিড়াল ভালোবাসি, সত্যি সত্যি যদি বিড়ালটা মারা যায়, তাহলে মামলা ঠুকে দেব আপনার নামে। একটা প্রাণ নিজের খেয়ালে এভাবে মারার অধিকার নেই আপনার।’

হাইজেনবার্গ শ্রোডিঙ্গারকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন বাক্সটার পাশে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুললেন ডালা। ভেতর থেকে একটা কালো বিড়াল এক লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। দরজা খোলা পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল ঘর থেকেও। শ্রোডিঙ্গার হতবুদ্ধি। তিনি নিজে কী দেখলেন, আর হাইজেনবার্গ কী দেখলেন। বিচারবুদ্ধি দিয়ে এ ঘটনার ব্যাখ্যা করবেন কীভাবে?

বিশেষ দ্রষ্টব্য : এই গল্পটা কাল্পনিক। কিন্তু মূল ভাবটা সত্যি

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র:

কোয়ান্টাম জগৎ/হায়দার আকবর খান রনো

কণা কোয়ান্টাম/রেজা এলিয়েন

কোয়ান্টাম রাজ্যে ডালিমকুমার/খন্দকার রেজাউল করিম