কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান ২

গত সংখ্যায় লিখেছিলাম, কৃষ্ণগহ্বর বোঝার জন্য আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা ব্যবহার করতে হয়। সাধারণ আপেক্ষিকতার মূল নীতি সম্পর্কে সামান্য আলোচনাও করেছিলাম। এর পাশাপাশি সমতুল্যতার নীতি (Equivalence Principle) বর্ণনা করেছিলাম। এর সাহায্যে আমরা আলো কেন মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে বেঁকে যাবে, এর একটা সরল ব্যাখ্যাও আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর কোনো কাজ করতে গেলে আমাদের টেন্সর (Tensor) নামের একটা বাধার সম্মুখীন হতে হবে। এটা মূলত গাণিতিক। এর সামনে এসে অনেকে সাধারণ আপেক্ষিকতা সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এই সমস্যা শুধু সাধারণ পাঠকের নয়, স্বয়ং আইনস্টাইনও এর সম্মুখীন হয়েছিলেন। সমতুল্যতার নীতি প্রণয়ন করার পর কীভাবে সামনে এগোবেন, তা বের করতে আইনস্টাইন বেশ সময় নিয়েছিলেন। এটার কারণ ছিল। আইনস্টাইন টেন্সর রাশি ও তাদের ক্যালকুলাসের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। এ ব্যাপারটিতে খুব আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, টেন্সরের ক্যালকুলাস তখন সবে আবিষ্কৃত হয়েছে আর সে সময়কার প্রায় সব পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে এটা অপরিচিত ছিল। আইনস্টাইনের সাহায্যে তখন এগিয়ে এলেন তাঁর গণিতবিদ বন্ধু মারসেল গ্রোসম্যান। তিনি নন-ইউক্লিডীয় এবং ডিফারেনশিয়াল জ্যামিতির ওপর কাজ করতেন। এ ধরনের জ্যামিতির মাঝেই আইনস্টাইন শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন তাঁর অভীষ্ট পথ। গ্রোসম্যানের এই অবদানের কারণ, সাধারণ আপেক্ষিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল সম্মেলন দুই বছর পরপর হয়। এর নাম মারসেল গ্রোসম্যানের নামানুসারেই করা হয়েছে।

আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাফল্যের কারণে আজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে টেন্সরীয় ক্যালকুলাস ডাল-ভাতের মতো গণিতে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানচিন্তার পাতায় আমরা বিশদ গাণিতিক আলোচনা করার সুযোগ পাব না, কিন্তু আপেক্ষিকতার জন্য কেন প্রয়োজন, সেটার ব্যাখ্যা দিলে ভালো বৈ মন্দ হবে না।

বিজ্ঞানচিন্তার আগের এক সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম, সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রতিদ্বন্দ্বী আরও একটি তত্ত্ব ছিল। কিন্তু সেই তত্ত্বটির গঠন আইনস্টাইনের তত্ত্বের তুলনায় অনেক সরল ছিল এবং এর জন্য ডিফারেনশিয়াল জ্যামিতির ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমরা জানি, বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব সঠিক কি না, তা পরিমাপের কষ্টিপাথর হলো পরীক্ষণ। এই প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব অনুসারেও ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলো বাঁকে। কিন্তু এই বাঁকের পরিমাণ আইনস্টাইনের তত্ত্বে পাওয়া হিসাবের অর্ধেক। পরীক্ষায় দেখা গেল যে আইনস্টাইনের তত্ত্বই সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। সে কারণে তুলনামূলক বিচারে আইনস্টাইনের তত্ত্বের গঠন গাণিতিকভাবে বেশি জটিল হলেও প্রকৃতির কাছে সেটাই বেশি গ্রহণযোগ্য। এ রকম অভিযোগ অনেকে গ্লাশ্যাও-সালাম-ভাইনবার্গের দেওয়া স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ক্ষেত্রেও করে থাকেন। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে জটিল মনে হলেও এর একটা জ্যামিতিক ভিত্তি আছে, এ জন্য এটা তুলনামূলক সহজ। এ কারণে যাঁরা মাধ্যাকর্ষণের জ্যামিতিভিত্তিক এই বিবরণকে মৌলিক মনে করেন—স্ট্রিং তত্ত্বের দেওয়া মাধ্যাকর্ষণের বিবরণকে গ্রহণ করেন না। কারণ, স্ট্রিং তত্ত্বের ভিত্তির সঙ্গে দেশকাল (Spacetime) জ্যামিতির কোনো আপাত যোগসূত্র নেই। একদিক থেকে আইনস্টাইনের এই জ্যামিতিক চিন্তাভাবনা সফল। কারণ, আমরা পরিচিত সব মৌলিক মিথস্ক্রিয়াকে বর্তমানে জ্যামিতিক কাঠামো দিয়েই বর্ণনা করছি।

তবে এখন থেকে আমাদের আলোচনা শুধু মাধ্যাকর্ষণ ও সাধারণ আপেক্ষিকতার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখব। একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক চলে আসে, এখানে জ্যামিতি আসে কীভাবে?

এটা বোঝার জন্য আমাদের হালকা কিছু গণিত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। ধরা যাক, আমরা একমাত্রিক একটি রেখায় বসবাস করি এবং আমরা ‘সময়’ নামে একটা জিনিসের সঙ্গে পরিচিত। তাহলে আমাদের দেশকাল মাত্রা হবে ১+১ = ২ (দুই) যেটা একটা সমতল হিসেবে প্রকাশ করা যাবে। আর সব ঘটনাকে এই সমতলে একেকটা বিন্দু হিসেবে দেখানো যাবে। অবশ্য শেষের এই ব্যাপার অন্য সব মাত্রাতেও প্রযোজ্য হবে। এই তলে যেকোনো বস্তুর ইতিহাস একটি রেখা দ্বারা প্রকাশ করা যাবে। এটাকে আমরা বিশ্বরেখা (Worldline) বলে ডাকি (চিত্র ১)।

যদি আমরা সব দূরত্বকে আলোক সেকেন্ড, আলোক মিনিট ইত্যাদি এককে মাপি, তাহলে এই তলে আলো সব সময়ই ৪৫০ কোণে চলাচল করবে, এটা আপেক্ষিকতার দ্বিতীয় স্বীকার্য থেকেই পাওয়া যায়। (চিত্র ২-এ এটা দেখানো হয়েছে)

এই দেশকাল চিত্রকাঠামোর (Spacetime diagram) মাধ্যমে আপেক্ষিকতার বেশ কিছু জিনিস আমরা সহজে বুঝতে পারি। যেমন চলমান ঘড়িকে স্থির ঘড়ির সাপেক্ষে ধীরে চলতে দেখা যাবে। এই ব্যাপারকে কাল দীর্ঘায়ন (Time dilation) বলে অভিহিত করে থাকি। এটা এই দেশকাল চিত্রকাঠামো দিয়ে সহজেই বোঝানো যায়। তবে তার আগে ঘড়ি কী জিনিস, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, ঘড়ি বরাবরই হচ্ছে এমন একটা বস্তু, যার মাঝে একটা পর্যায়বৃত্তিক কোনো ঘটনা ঘটছে। সেটা আমরা গণনা করে সময় মাপতে পারি। তাহলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকার মানে, একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ঘড়ি থেকে আমরা একটা আলোর সংকেত বা সিগন্যাল পাব। এই ব্যাপার এখানে চিত্র ৩-এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।

ধরা যাক, দুজন পর্যবেক্ষক পরসপরের সাপেক্ষে সমবেগে চলমান। একজনকে (B) আমরা স্থির ধরে অন্যজন (A)-কে গতিশীল হিসেবে চিত্র ৩-এ দেখানো হয়েছে। আরেকজন রেফারেন্স পর্যবেক্ষক (C)-কে আমরা চিত্রে রেখেছি, যার বিশ্বরেখাটি রেখচিত্রের উলম্বরেখার বা t অক্ষের সাথে মিশে গেছে। B এবং C এর মাঝে কোনো আপেক্ষিক বেগ নেই। আর অ এবং C-এর মাঝে একটি আপেক্ষিক বেগ আছে (যার মান শূন্য নয়)। C, B এবং A প্রত্যেকের কাছে একই ঘড়ি রয়েছে। এর মানে দাঁড়াবে যে, প্রত্যেক পর্যবেক্ষকের ঘড়ি হতে তাদের বিশ্বরেখা বরাবর একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব যাবার পর একটা আলোক সংকেত বের হবে, যেটা অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা দেখতে যাবে। এখানে মনে রাখা দরকার যে B, C-এর ঘড়িকে স্থির দেখবে, কিন্তু C এর H একই ঘড়িকে A চলমান হিসেবে দেখতে পাবে। ছবিতে C (এর ঘড়ি) থেকে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে নির্গত চারটি আলোক রশ্মি দেখানো হয়েছে যেগুলোর নির্গমনকে আমরা 1, 2, 3, 4 দিয়ে চিহ্নিত করেছি। 1 ও 2 এর রশ্মিগুলিকে অ যখন দেখে তখন সেই ঘটনা দুটো আমরা 1’, 2’ দিয়ে প্রকাশ করেছি। C এর ব্যবহূত ঘড়ি অনুযায়ী ঘটনা 1 ও 2 এর মাঝের সময়ের ব্যবধান হলো C-এর বিশ্বরেখা বরাবর 3 ও 4-এর মাঝের দূরত্বের সমান, যা কিনা ই এর বিশ্বরেখার 3’ আর 4’ মাঝের দূরত্বের সমান। এ থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, ঘড়ি যত দূরেই থাকুক না কেন, সেটা যদি পর্যবেক্ষকের (Observer) সাপেক্ষে স্থির থাকে তাহলে তার সময়ের মাপ সবক্ষেত্রে একই থাকবে। এটা কোনো আশ্চর্যজনক আবিষ্কার নয়। কিন্তু চলমান পর্যবেক্ষকের ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্নরূপ।

অন্য দিকে যখন 1 আর 2 থেকে পৌঁছানো আলো অ দেখবে, সেই ঘটনাগুলো তার বিশ্বরেখার 1’ আর 2’ বিন্দু দিয়ে নির্দেশিত হবে। অ যখন তার হাতের ঘড়ির হিসাবে 1 ও 2 এর মাঝের সময়ের পার্থক্য মাপবে তখন তার পরিমাপে সেই সময়ের ব্যবধান হবে অ-এর বিশ্বরেখা বরাবর 1’ আর 2’-এর মাঝের দূরত্ব। ছবি থেকে এটা সপষ্ট যে এই দূরত্বের মান, 1 ও 2 এর মাঝের দূরত্বের মানের চেয়ে বেশী। অর্থাত্ অ দেখবে যে ঈ-এর হাতের ঘড়ি ধীরে চলছে! এর কারণ তাদের মাঝের আপেক্ষিক গতি। আর এই ব্যাপারটিক আমরা কাল দীর্ঘায়ন (Time dilation) বলে অভিহিত করি। ব্যাপারটি ত্বরণবিশিষ্ট গতির ক্ষেত্রে আরো জটিল আকার ধারণ করে এবং এই ঘটনাটি কৃষ্ণ গহ্বরের ফিজিক্স বোঝার ব্যাপারে বেশ একটা গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে। (চলবে)

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত

কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান ১