কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান-৩

আলোর বেগ ধ্রুব হওয়ার কারণে সময়ের ব্যবধান যে দীর্ঘায়িত হয়, তা স্থানকাল চিত্রের মাধ্যমে গত পর্বে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। আর তার আগের আলোচনায় মহাকর্ষ ক্ষেত্রে আলো বেঁকে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কথা হয়েছিল। যদিও এই আলো বাঁকার ঘটনাটা অনেকেই আলোর কণা বা ফোটনকে ভরযুক্ত কণা হিসেবে ধরে নিয়ে নিউটনীয় কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। যেমন নিউটনীয় চিন্তা ব্যবহার করতে হলে আলোর বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের কোয়ান্টাম কণা, যাকে আমরা ফোটন বলে জানি-তার একটি ভর থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ফোটনের কোনো ভর নেই। এটা নির্মাণকাজে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করার মতো (সম্প্রতি সংবাদপত্রে আসা)। ফোটনের কোনো ভর থাকলে আমাদের স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থা, ফোন, ইন্টারনেট, ওয়াই-ফাই ব্যবস্থা একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের পর আর কাজ করত না। আমরা দূরদূরান্তের গ্যালাক্সি ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম না। আরও একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞানীরা অপ্রয়োজনে কোনো তত্ত্ব দাঁড় করান না। পুরোনো তত্ত্বের করা ভবিষ্যদ্বাণী যদি পরীক্ষার সঙ্গে না মেলে, তবেই তাঁরা নতুন তত্ত্ব বের করার চেষ্টা চালান। তবে আইনস্টাইন নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের অসংগতি বের করার অভিপ্রায় নিয়ে আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রণয়ন করেনইি—বরং তিনি ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুত্চুম্বকীয় তত্ত্ব আর নিউটনীয় বলবিদ্যাকে একই ছাঁচে ফেলতে গিয়ে আপেক্ষিকতা আবিষ্কার করেন। লরেন্স ও পয়েনকার বিশেষ আপেক্ষিকতা নিয়ে কাজ করলেও আইনস্টাইনের হাতেই নিউটনীয় বলবিদ্যার রূপান্তর ঘটে। এ জন্যই আপেক্ষিকতার জনক হিসেবে আইনস্টাইনের নামই আমাদের মুখে সবার আগে আসে। আর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব পুরোপুরি আইনস্টাইনের একার হাতেই গড়া।

Abdul Gaffar

এবার আগের আলোচনায় ফিরে আসি। কাল দীর্ঘায়ন (Time dilation) প্রমাণ করতে স্থানকাল চিত্রে আলোর ৪৫০ কোণে চলাচল করার ধর্মটি আমরা ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু মহাকর্ষ বলক্ষেত্রে আলো বাঁকা পথে চলার কারণে এটা আর প্রযোজ্য হবে না। তবে এটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একটা উপায় আছে। সেটা করার জন্য আমাদের আপেক্ষিক তত্ত্বের একটা অনুসিদ্ধান্তের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হতে হবে। আর সেটা হচ্ছে স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা (Coordinate system) দাঁড় করানোর স্বাধীনতা। আপেক্ষিক তত্ত্বের কাঠামোতে পর্যবেক্ষক গৌণ-পর্যবেক্ষিত ঘটনাগুলো ও তাদের মধ্যের কার্যকারণ সম্পর্কটাই আসল। তাহলে স্থান-কাল বা দেশকালের একই অংশকে বর্ণনা করার জন্য আমরা যেকোনো স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারব। এখানে অবশ্য বড় একটা কিন্তু আছে। সেটা কী? কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক ছাড়া অন্যান্য স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা সব স্থানে বিশ্বস্ত নয়। ব্যাপারটা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। চিত্র ১ক-তে একটি কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে। তলের প্রতিটি বিন্দুকেই দুটো সংখ্যা (x, y) দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। এই স্থানাঙ্ক ব্যবস্থাটিকে আমরা কাজে লাগাব, এটা অনেক বিশ্বস্ত। কারণ, স্থানাঙ্কের রাশি x বা y যেকোনোটির পরিবর্তন করলে আমরা বরাবরই ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু পাব।

এখন আমরা একটি অবিশ্বস্ত স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার উদাহরণ দেখি। আমাদের অনেকেরই পরিচিত পোলার স্থানাঙ্ক, যেখানে আমরা স্থানাঙ্কের কেন্দ্র (Origin) থেকে বিন্দুর দূরত্ব r এবং x অক্ষ থেকে ө কোণ দিয়ে বিন্দুকে চিহ্নিত করব (চিত্র ১খ)। একটু খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাব যে অন্যান্য বিন্দুতে (r, θ) প্রতিটি মানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু পেলেও যখন r=0 (অর্থাত্ কেন্দ্রে) θ-এর মান যতই পরিবর্তন করা হোক না কেন, আমরা একই বিন্দুতে (কেন্দ্রে) রয়ে যাব। এই ব্যাপারটাকেই আমরা বলি যে r=0 বিন্দুতে (r, θ) স্থানাঙ্ক ব্যবস্থাটি অবিশ্বস্ত। কার্তেসীয় বাদে বাকি সব স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা কোনো না কোনো বিন্দুতে অবিশ্বস্ত হয়ে দেখা দেবেই। এই বৈশিষ্ট্যটি কৃষ্ণগহ্বরের কোয়ান্টাম বর্ণনায় একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যখন আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর প্রথম সমাধান শোয়ার্জশিল্ড দেন, ঠিক তখন সেই সমাধানের মানে কেউই বুঝে উঠতে পারেননি। যদিও গোলকীয় প্রতিসাম্যের কৃষ্ণগহ্বরের বিবরণ, দেখতে সহজ এই সমাধানটির মধ্যে সেটা লুকিয়ে আছে, কিন্তু এর পদার্থবিজ্ঞানীয় অনুধাবন এসেছে অনেক অনেক পরে। এর কারণ কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হওয়ার জন্য কোনো নক্ষত্রের যে পরিমাণ ঘনত্ব থাকা প্রয়োজন, তার কোনো প্রমাণ ছিল না আগে। যদি আমরা রডের পরিবর্তে বাঁশজাতীয় যুক্তি দিই, তাহলে দুই লাইনেই এটার মান বের করা সম্ভব। নিউটনীয় চিন্তায় তারা থেকে নির্দিষ্ট্র দূরত্বে কোনো কণার সর্বোচ্চ গতিশক্তির মান তার মহাকর্ষীয় বিভবশক্তির চেয়ে কম হয়, তাহলে সেটা মহাকর্ষের টান ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে না-এভাবেই নিউটনীয় বলবিদ্যায় আমরা মুক্তিবেগ নির্ণয় করি। কোনো কণার ভর যদি স হয়, তবে নিউটনীয় কাঠামোতে তার সর্বোচ্চ গতিশক্তি হবে 1/2mc2। কেননা, আলোর বেগই হচ্ছে পরম বেগ। নক্ষত্রের ভর যদি M হয়, তবে তার কেন্দ্র থেকে r দূরত্বে কণার মাধ্যাকর্ষণের স্থিতিশক্তির মান হবে GMm/r। আর কণাটি নক্ষত্রের টান থেকে নিস্তার না পাওয়ার শর্ত হবে-

GMm/r > 1/2 m c2

বা, r < 2 GM/c2.................(1)

এই দূরত্বের কমে কণাটির (হোক সেটা আলোর কণা) পক্ষে মহাকর্ষের প্রভাব কাটিয়ে বেরোনো সম্ভব নয়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো শোয়ার্জশিল্ডের সমাধান থেকেই এই উত্তরই বেরিয়ে আসে।

এই যুক্তিটি ১৭৮৩ সালেই ইংরেজ যাজক জন মিশেল দিয়েছিলেন। আর একই যুক্তি বিখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ ল্যাপ্লাসের লেখায়ও পাওয়া যায়। কিন্তু এই যুক্তিকে অনেকেই সে সময় পাত্তা দেননি। শোয়ার্জশিল্ডের হিসাবমতে, সূর্যের মতো নক্ষত্রের (যার ভর ২ x ১০৩০ কিলোগ্রাম) জন্য এই দূরত্ব হতো প্রায় ৩ কিলোমিটার এবং তার ভর প্রতি ঘনমিটারে ১.৯ x ১০১৯ কিলোগ্রাম! এই মানের ঘনত্ব ওই সময়ে বিজ্ঞানীদের জন্য চিন্তা করা অসম্ভব ছিল। এ জন্য তাঁরা এই রকম নক্ষত্র মহাবিশ্বে থাকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

একই কারণে ১৯২০-এর শেষ দিক পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা, যাঁরা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের মতো ভুতুড়ে ব্যাপার নিয়ে খেলছিলেন, তাঁরাও এটাকে কোনো গুরুত্বই দেননি। কিন্তু নিউট্রন আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারায় একটা বড় পরিবর্তন এল এবং এটার পেছনে মার্কিন পরমাণু বোমা নিয়ে যার নাম প্রায়ই আমরা উচ্চারণ করি, সেই রবার্ট ওপেনহাইমারের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এবারের আলোচনা শেষ করার আগে ওপরের জন মিশেলের যুক্তির দুর্বলতার ওপর দৃষ্টি দিতে চাই। কারণ, এটা থেকে আমরা অল্প হলেও বুঝতে পারব যে বিজ্ঞান তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে আলাদা নয়। মিশেল যখন তাঁর আইডিয়া প্রকাশ করেন, তখনো ফ্রেনেলের হাতে আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব পূর্ণতা পায়নি। তিনি সে জন্য নিউটনের করপাসকুলার বা আলোর কণা তত্ত্বের কাঠামোতেই তাঁর যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। তা ছাড়া আলোর ভর নেই, এ কারণে m=0 বসালে (1) নম্বর সমীকরণের প্রথম ধাপেই আমরা দুদিকেই শূন্য পাই। এ জন্য পরবর্তী ধাপটি অর্থহীন হয়ে যায়। একই সঙ্গে আলোর বেগ ধ্রুবক হওয়ার কারণে তার গতিশক্তির পরিবর্তন হওয়ার কোনো মানে হয় না। কিন্তু একটা তত্ত্বে শুধু কতগুলো ফলাফল নয়, সেটার একটি কাঠামোও থাকে। এদিক থেকে সাধারণ আপেক্ষিকতা একটি পরিপূর্ণ কাঠামো-এটা বলে দেয় কীভাবে আমরা আমাদের সমীকরণগুলো লিখব। শুধু স্বল্পস্থায়ী ফলাফল দিয়ে কাজ হলে আমরা সব জায়গায় রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করতাম। কিন্তু বিজ্ঞান সেভাবে কাজ করে না-এখানে শর্টকাট দিয়ে সব সময় টেকা যায় না।

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

**লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত

এই সিরিজের আগের লেখা:

কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান ১

কৃষ্ণগহ্বর উপাখ্যান ২