কে পাবেন ২০২১ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল?

বছর ঘুরে আবার এলো অক্টোবর মাস। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ঘোষণা হবে পাঁচটি বিষয়ে এ বছরের নোবেল বিজয়ীদের নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত এই পুরস্কার কাদের হাতে যাবে, তা নিয়ে সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি কৌতূহল থাকে। নোবেল পুরস্কারের পুরো প্রক্রিয়াটিই সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় ঢাকা। কোন কোন বিজ্ঞানী মনোনীত হয়েছেন তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় অন্তত পঞ্চাশ বছর। তবুও আমাদের কৌতূহল তো থেমে থাকে না। তাই আমরা এই লেখায় দেখে নিবো সম্ভাব্য কাদের হাতে যেতে পারে চলতি বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।

পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ যে কাজগুলো এখনো নোবেল জেতেনি সেগুলো প্রতিবারই সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুরষ্কার যেমন উলফ প্রাইজ, ব্রেকথ্রু প্রাইজ, ডিরাক মেডেল, নিউটন মেডেল ইত্যাদি পুরস্কারও ভবিষ্যত নোবেলবিজয়ী হবার ভালো পূর্বাভাস দেয়। যেমন ১৯৭৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেয়া ২৬টি উলফ প্রাইজ বিজয়ীদের ১৪ জনই পরে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তাছাড়া গবেষণা পত্রের সাইটেশন, এইচ-ইনডেক্স ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বোঝার একটি ভালো উপায়। আবার অনেক বছরেই দেখা যায় আলোচনার বাইরে কোনো একটা পুরনো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছে। এইসব বিষয় মাথায় রেখেই এ বছরে ৫ অক্টোবরে ২০২১ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে দেখে নেয়া যাক সম্ভাব্য বিজয়ীদের।

বেল ইনেকুয়ালিটির পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ: অ্যালান আসপেক্ট, জন ক্লাউসার, আন্টন জেইলিঙ্গার

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম বিস্ময়কর বিষয় হলো কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট - যা ছিল কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরুদ্ধে আইন্সটাইনের সবথেকে বড় অভিযোগ। ১৯৩৫ সালে আইন্সটাইন, পোডলস্কি ও রোসেন মিলে একটি গবেষনাপত্রে তাদের অভিযোগ একটি থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে তুলে ধরেন। তার অনেক বছর পরে ১৯৬৪ সালে জন স্টুয়ার্ট বেল এই গবেষণাপত্রের অভিযোগের উপর আরো কাজ বেল থিওরেম প্রকাশ করেন। বেল থিওরেমের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ হলে সেটা হবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সেরই প্রমাণ। ১৯৭২ সালে ক্লাউসার ও ফ্রিডম্যান, ১৯৮০-৮২ সালে আস্পেক্ট ও ১৯৯৮ সালে জেইলিঙ্গার তাদের পরীক্ষায় বেল থিওরেমের প্রমাণ দেন। তাদের এই কাজ কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। এদের মধ্যে ফ্রিডমান ২০১২ সালে মারা যান। বাকি তিনজন ২০১০ সালের উলফ প্রাইজও পেয়েছেন। তাই অনেক বছরের মত এবারো তারা আছেন বিবেচনায়।

অ্যালান আসপেক্ট, জন ক্লাউসার ও আন্টন জেইলিঙ্গার

কম্পলেক্স সিস্টেম: জর্জো পারিসি, আলেক্সেই কিতায়েভ, মার্ক ই জে নিউম্যান

জর্জো পারিসি কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স থেকে শুরু করে কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স, ডাইনামিক সিস্টেম ইত্যাদি ফিল্ডে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। পেয়েছেন উল্ফ প্রাইজ, ডিরাক মেডেল, ম্যাক্স প্লাঙ্ক মেডেল ইত্যাদি। আলেক্সেই কিতায়েভের কাজের মূল ক্ষেত্র হলো টপোলজিকাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার - পেয়েছেন ব্রেকথ্রু প্রাইজ ও ডিরাক মেডেল। মার্ক নিউম্যান নেটওয়ার্ক থিওরির একজন মহীরুহ। তার একটি গবেষণাপত্র ২০০১ থেকে ২০১১ তে প্রকাশিত গণিতের সবথেকে বেশি সাইটেশন প্রাপ্ত গবেষণা ছিলো। নেটওয়ার্ক সিস্টেম বিষয়ক নানান ক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ পেয়েছেন লাগ্রাঞ্জ প্রাইজ ও অয়লার অ্যাওয়ার্ড। তাছাড়া গবেষণাপত্রের সাইটেশন ও h-index এর ভিত্তিতেও তাদেরকে অনেকেই শীর্ষ সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বিবেচনা করছেন।

জর্জো পারিসি, আলেক্সেই কিতায়েভ ও মার্ক ই জে নিউম্যান

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: চার্লস এইচ বেনেট, জিলে ব্রাসা, পিটার শর, ডেভিড ডয়েচ

গত দশক ও সামনের কয়েক দশকের জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হতে যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। চার্লস বেনেট ও জিলে ব্রাসা মিলে আবিষ্কার করেন কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির BB84 প্রোটোকল। দুজন মিলে ২০১৮ সালে পেয়েছেন উল্ফ প্রাইজ। ২০১৭ সালে বেনেট পান ডিরাক মেডেল যাতে তার সঙ্গী ছিলেন পিটার শর ও ডেভিড ডয়েচ। পিটার শর তার শর অ্যালগোরিদমের জন্য বিখ্যাত যা ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে সাধারণ কম্পিউটারের থেকে অনেক অনেকগুন দ্রুত ক্রিপ্টোগ্রাফি ভাংতে পারে। ডেভিড ডয়েচ কোয়ান্টাম টিউরিং মেশিন ও বেল ইনেকুয়ালিটি নিয়ে কাজ করেছেন। এই চারজনের মধ্যে দুই বা তিনজনকে (সর্বোচ্চ তিনজনকে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে দেয়া হয়) একসাথে নোবেল পুরস্কার পেতে দেখা যেতে পারে।

চার্লস এইচ বেনেট ও জিলে ব্রাসা
পিটার শর ও ডেভিড ডয়েচ

মেটা-ম্যাটেরিয়াল: স্যার জন পেন্ড্রি ও ডেভিড স্মিথ

এমনিতে সোনা দেখতে সোনালি। কিন্তু ঠিকঠাক প্যাটার্নে সোনার পরমানু সাজালে তাকে লাল বা সবুজ বা অন্য রঙও বানিয়ে দেয়া যায়। এরকম অবস্থায় সোনাকে বলা হয় মেটাম্যাটেরিয়াল- অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে এই ম্যাটেরিয়াল (বস্তু) এর নতুন ধর্ম তৈরি করা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম দ্রুত বর্ধমান গবেষণাক্ষেত্র হলো মেটাম্যাটেরিয়াল যার দুজন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গবেষক হলেন জন পেন্ড্রি ও ডেভিড স্মিথ। পেন্ড্রি ও স্মিথ মিলে ২০০৬ সালে আলোকে কোন বস্তুর পাশে বাকিয়ে অদৃশ্য করে দেয়া নিয়ে তাদের গবেষণা প্রকাশ করেন। স্মিথ এই অদৃশ্য করার ধর্মটি মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের জন্য পরীক্ষালব্ধ প্রমাণও দেন। এছাড়া তারা কাজ করেছেন নিখুত লেন্স, ঋণাত্মক প্রতিসারণাঙ্কের বস্তু তৈরি ইত্যাদি নিয়ে। জন পেন্ড্রি ইতোমধ্যে জিতেছেন আইজ্যাক নিউটন মেডেল, কাভলি প্রাইজ ও ডেভিড স্মিথ জিতেছেন দেকার্ত প্রাইজ।

কসমোলজি: চার্লস এল বেনেট, লাইম্যান এ পেজ জুনিয়র, ডেভিড স্পার্গেল

আধুনিক কসমোলজির জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি অবজার্ভেশন স্যাটেলাইট ছিল উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব (WMAP)। বিগ ব্যাং এর পরে মহাবিশ্বের সবথেকে পুরনো যেই আলো আমাদের কাছে এসে পৌছে তার নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMBR)। এটির আবিস্কার ছিল বিগ ব্যাং এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। WMAP স্যাটেলাইটের কাজ ছিল মহাবিশ্বের সিএমবি রেডিয়েশনের নিখুঁত ম্যাপিং করা যেন মোটামুটি সমান উজ্জ্বলতার মাঝে ছোট ছোট পার্থক্য খুজে পাওয়া যায়। এই কমবেশি উজ্জ্বল অংশগুলোর আকারের উপর নির্ভর করবে মহাবিশ্বের মডেল কেমন হবে সেটা - যেই কাজটি অনেক সাফল্যের সাথে করা সম্ভব হয়। এক কথায় বলা যায় আধুনিক কসমোলজির স্টান্ডার্ড মডেল (ল্যামডা-সিডিএম মডেল) প্রমাণিত হয়েছে WMAP স্যাটেলাইটের উপাত্তের উপর ভিত্তি করে। WMAP স্যাটেলাইটে অবদানের জন্য ২০১৮ সালের ব্রেকথ্রু প্রাইজ, ২০১০ সালের শ' প্রাইজ পেয়েছিলেন বেনেট, পেজ ও স্পার্গেল। এছাড়া বেনেট ও পেজ আলাদা ভাবে গ্রুবার প্রাইজ এবং বেনেট ২০১৭ সালের নিউটন মেডেলও পেয়েছেন। তবে গত চারবছরে তিনবারই জ্যোতিপদার্থবিদরাই নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন এবার পদার্থবিজ্ঞানের অন্য কোনো শাখায় নোবেল দেয়া হতে পারে।

চার্লস এল বেনেট, লাইম্যান এ পেজ জুনিয়র ও ডেভিড স্পার্গেল

আলোকতত্ত্ব: লেনে হাউ

১৯৯৯ সালে লেনে হাউ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পরম শুন্যের সামান্য উপরে ঠান্ডা সোডিয়াম পরমানুকে বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট অবস্থায় নিয়ে তার মধ্যে আলো পাঠিয়ে আলোর গতিকে মাত্র ১৭ মিটার/সেকেন্ড বা ঘন্টায় প্রায় ৬০ কিমিতে নামিয়ে ফেলেন। উল্লেখ্য, স্বাভাবিক অবস্থায় বাতাসে বা শুন্যে আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। এর মাত্র দুই বছর পর আলোকে সম্পূর্ণ থামিয়ে দিতে সক্ষম হন। এভাবে আলোকে থামিয়ে দিয়ে সেই তথ্য সোডিয়াম পরমাণুতে সংরক্ষণ করে আবার পরে তা আলোতে পরিণত করেন। এই পদ্ধতি কোয়ান্টাম ইনফরমেশন টেকনোলজির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। হাউ পরবর্তীতে কিউবিট ট্রান্সফার, কোল্ড অ্যাটম, ন্যানোস্কেল সিস্টেম, ফোটোনিক্স ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। লেনে হাউ ইতোমধ্যে পেয়েছেন জর্জ লেডলি প্রাইজ ও ওলে রোমার মেডেল।

টুইস্টেড বাইলেয়ার গ্রাফিন: রাফি বিস্ট্রিজার, অ্যালান ম্যাকডোনাল্ড, পাবলো জারিয়ো-হেরেরো

একুশ শতকের সবথেকে চমকপ্রদ আবিস্কারের একটি ছিলো গ্রাফিন। ২০০৪ সালে আন্দ্রে গাইম ও কন্সটান্টিন নোভোসেলোভ মাত্র এক স্তরের গ্রাফিন খুবই সহজে এবং প্রথমবারের মতো আলাদা করতে সক্ষম হন যা তাদের এনে দেয় ২০১০ সালের নোবেল প্রাইজ। এর পর থেকে গ্রাফিন নিয়ে সারাবিশ্বে গবেষণার জোয়ার চলে আসে। ২০১১ সালে অ্যালান ম্যাকডোনাল্ড ও রাফি বিস্ট্রিজার থিওরেটিকাল মডেল দেখান যে দুইটি স্তর বিশিষ্ট গ্রাফিন যদি ঠিকমত একটার উপর একটা না রেখে বিশেষ একটি কোণে (মোটামুটি ১ ডিগ্রির মতো) রাখলে ইলেকট্রনের এই দুই লেয়ারের মাঝে টানেলিং করে চলার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়। ২০১৮ সালে পাবলো জারিয়ো-হেরেরো এই ভবিষ্যতবাণীর পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ দেন। তিনি দেখান যে ১.১ ডিগ্রিতে ইলেক্ট্রন খুব সহযে দুই লেয়ারে চলাচল করতে পারে এবং সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শন করে। এই তিনজন মিলে ২০২০ সালের উল্ফ প্রাইজও অর্জন করেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (KAIST)