কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা

‘তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা

মন জানো না।’

আমার ঘরে বসত করে অনিশ্চয়তা। আমার চেতনায়, আমার ভালবাসায়, আমার ইচ্ছায়, আমার মগজের নিউরনে বাস করে অনিশ্চয়তা। অস্তিত্বের কেন্দ্রে বাস করে অনিশ্চয়তা। এমন কী শূন্যতার মাঝেও বাস করে অনিশ্চয়তা। পদার্থ এক সম্ভাবনার ঢেউ। পদার্থ এক নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার ঢেউ। পদার্থ কখনো কণা, কখনো ঢেউ। কণা হিসাবে পদার্থকে শুধু একটি স্থানে দেখি, ঢেউ হিসাবে ওকে সর্বত্র খুঁজে পাই। ঢেউ এবং কণার দ্বন্দ্ব অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এই অনিশ্চয়তার তত্ত্ব অনেকভাবে লেখা যায়। শ্রোডিঙ্গার লিখেছেন কোয়ান্টাম ঢেউয়ের সমীকরণে, হাইজেনবার্গ লিখেছেন বস্তুর অবস্থান এবং ভরবেগ মাপার অনিশ্চয়তার সমীকরণে।

ছেলেবেলায় এক পান্তা বুড়ির গল্প শুনেছিলাম। এক চোর প্রতিরাতে বুড়ির পান্তা চুরি করে খেয়ে পালিয়ে যায়। চোরকে শায়েস্তা করার জন্যে এক রাতে বুড়ি পান্তার বদলে পানিভর্তি হাড়িতে রাখলো জ্যান্ত শিং গাছ। পাশের গরম চুলাতে রাখলো এক পাকা বেল। রাতের অন্ধকারে পান্তার হাড়িতে হাত দিতেই চোর খেলো শিং মাছের গুঁতো। প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে চোর বসলে চুলার ধারে। চুলার আগুনে একটু সেঁক দিয়ে নিলে হাতের যন্ত্রণা যদি কিছু কমে! চুলায় হাত দিতেই পাকা বেল ফেটে চৌচির। এক টুকরা বেল চোখে এসে লেগে চোরের চোখটা অন্ধ হয়ে গেল। এমনও তো হতে পারত যে সে রাতে চোরের হাত আগে থেকেই ব্যাথা করছিল। তাই হাড়িতে হাত দেওয়ার আগেই সে চুলায় হাত সেঁকতে গিয়েছিলো! তাহলে তো অন্ধ হয়ে সে আর পান্তার হাড়িতে হাত দিতো না, শিং মাছের গুঁতো আর খেতে হতো না। দুটি ঘটনা পরপর ঘটছে, এই ঘটনাক্রম পাল্টে গেলে শেষ ফলাফল এক হবে না। এই কার্যক্রম উল্টে দিলে চোর আগেই অন্ধ হয়ে যাবে, হাড়িতে হাত ঢোকানোর সুযোগ পাবে না।

পান্তা চোরকে ধরতে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের গরজ নেই, বিজ্ঞানীরা ধরতে চান ইলেকট্রন, ফোটন, পরমাণু, অণু ইত্যাদি পারমাণবিক কণিকা। মাপতে চান ওদের অবস্থান, ভরবেগ, এনার্জি, চক্কর (Spin), আয়ু, ইত্যাদি। এরকম দুটো জিনিস পরপর মাপতে গেলে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা পান্তাবুড়ির মতো একই ঝামেলায় পড়েন। যেমন, একটা ইলেকট্রনের অবস্থান জানতে হলে ইলেকট্রনের গায়ে আলো ফেলতে হবে। সেই আলোর ধাক্কায় ইলেকট্রন সরে যাবে এবং ওর ভরবেগ যাবে বেড়ে। তাই ইলেকট্রনের অবস্থান এবং ভরবেগ দুটোই একসাথে নির্ভুলভাবে মাপা সম্ভব নয়। ভরবেগ এবং অবস্থান মাপে সবসময় একটা অনিশ্চয়তা থাকবে। একটা মাপতে গেলে আরেকটি বদলে যায়৷

এই অনিশ্চয়তার সমীকরণ কী হবে? সেটাই তো কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্বে জানার চেষ্টাকে অপারেটর (Operator) হিসাবে লেখা হয়। শ্রোডিঙ্গার এই অপারেটর খুঁজে পেয়েছিলেন ক্যালকুলাস থেকে, আর হাইজেনবার্গ হাত দিয়েছিলেন মেট্রিক্স মেকানিক্সের (Matrix mechanics) ঝুড়িতে৷ তবে সত্যিকার অর্থে কোন গণিত দিয়ে এদের খোঁজ পাওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন, এসব এসেছে বিজ্ঞানীদের মন থেকে!

কোয়ান্টাম তত্ত্বে অবস্থান (x) এবং ভরবেগ (p) মাপার চেষ্টা হলো দুটি অপারেটর৷ অবস্থান মাপার পরে ভরবেগ মাপার অপারেটর হবে px, তেমনি ভরবেগ মাপার পরে অবস্থান মাপার অপারেটর হবে xp, এবং সেই পান্তা বুড়ির গল্পের মতো xp এবং px সমান না-ও হতে পারে। ১৯২৭ সালে হাইজেনবার্গ অবস্থান এবং ভরবেগ সময়ানুক্রমিক ভাবে মাপার এই সমীকরণটি দেন,

xp – px = i h/2π .

একটু অংক করে এই সমীকরণটি দাঁড়ায়: ∆x ∆p ≥ h/4π

এখানে i হলো -১ এর বর্গমূল যা একটি কাল্পনিক (Imaginary) সংখ্যা এবং h হলো প্লাঙ্কের (Planck) কোয়ান্টাম ধ্রুব, ∆x এবং ∆p হলো অবস্থান এবং ভরবেগ মাপার অনিশ্চয়তা৷ প্লাঙ্কের ধ্রুব খুব ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তাই পান্তা বুড়ির বেলায় এই সমীকরণকে অনায়াসে অবহেলা করা যায়। কিন্তু একটি ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এই সমীকরণকে আমলে আনতেই হবে। ইলেকট্রনের অবস্থান বা ভরবেগ জানার অনিশ্চয়তা একে অপরের ওপরে নির্ভর করে, একটাকে কমাতে গেলে অন্যটা বেড়ে যায়।

কেন এমন হয়? ঝামেলাটা ইলেকট্রনের অবস্থান বা গতির মাপামাপি নিয়ে নয়। ইলেকট্রনের প্রকৃতি বা অস্তিত্ব নিয়ে। ইলেকট্রন একই সাথে ঢেউ এবং কণা। পুকুরে ঢেউ ছুড়লে ঢেউ উঠে। এই ঢেউয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমরা মাপতে পারি। কিন্তু এই ঢেউ পুকুরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, কোনো বিশেষ স্থানে নেই। কোয়ান্টাম তত্ত্বে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে ঢেউয়ের ভরবেগের সম্পর্ক আছে। তাই ঢেউয়ের ভরবেগের অনিশ্চয়তা নেই, কিন্তু অবস্থানের অনিশ্চয়তা ষোলআনা। একটি ইলেকট্রন ঠিক কোথায় আছে এবং ওর বেগ কত তা সঠিক ভাবে জানা সম্ভব নয়। অবস্থান জানার চেষ্টা যত বেশি করবো, ইলেকট্রনের ভরবেগ ততই কম জানতে পারবো। পুকুরে একটা ঢিল ছুড়লে ঢেউ একটা বিন্দু থেকে সবদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পুকুরের বিভিন্ন স্থানে যদি এক সাথে দশটি ঢিল ছুড়ি, তবে ঢেউগুলি কাটাকুটি খেলা খেলবে। কোনো স্থানে ওরা বড় ঢেউ তুলবে, কোনো স্থানে ঢেউ থাকবে না। এর সাথে ইলেকট্রনের সম্ভবনা বা অনিশ্চয়তার ঢেউয়ের তুলনা করা যায়। যেখানে বড় ঢেউ সেখানে ইলেকট্রনের থাকার সম্ভবনা বেশি, যেখানে ঢেউ নেই সেখানে কম। এই ধরনের ঢেউকে ঢেউয়ের বান্ডিল (Wave packet) বলে। অনেকগুলো ঢেউ এক সাথে মিলিয়ে এমন ঢেউয়ের বান্ডিল সৃষ্টি করা যায়। যত বেশি ঢেউ হাত লাগবে, বান্ডিল ততই সংকীর্ণ এবং তীক্ষ্ণ হবে, ইলেকট্রন কোথায় আছে তা আমরা ততই বেশি জানতে পারব। কিন্তু প্রতিটি ঢেউয়ের আলাদা ভরবেগ। যেন একটা চলন্ত ইলেকট্রন শুধু একটা বেগে চলে না!

প্রকৃতির ঢেউ এবং কণা রূপ একই সাথে দেখতে গেলে কী হবে? বিজ্ঞানী টেলর (Geoffrey Taylor) প্রথম আলো এবং ছবি নিয়ে এমন একটি এক্সপেরিমেন্ট করেন। ইলেকট্রনের মতো আলোও কখনো ঢেউ কখনো কণা। টেলার চাচ্ছিলেন আলোর কণা এবং ঢেউ রূপ এক সাথে ক্যামেরায় বন্দি করতে। আলোর কণা এবং ঢেউ রূপ একসঙ্গে দেখবার জন্যে টেলর কয়েক মাস ধরে আঁধার ঘরে দিন কাটান। দুটো রূপ এক সাথে দেখা হয় নি বটে, তবে টেলার যা দেখেছিলেন তা এক অবিশ্বাস্য গল্প!

একটি বাতির চারিদিকে একের পর এক কালিমাখা কাঁচের আবরণ দিয়ে ঢাকা শুরু করলে আলোর জ্যোতি ক্রমশ কমে আসবে৷ আলো যদি কণা হয়ে থাকে তবে হয়তো শেষ পর্যন্ত আলোর কণা একটি একটি করে এই আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসবে৷ টেলার এভাবে আলোর উজ্জ্বলতা ভীষণ কমিয়ে এনেছিলেন৷ এ আলো মাপা সহজ নয়৷ এমন আলোয় ছবি তুলতে গিয়ে টেলার এক অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেন। ফোটন কণিকারা একটি একটি করে ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপরে আঘাত করছে। সব যেন ঘটছে কাকতলীয় ভাবে। কোনো কণা কোথায় এবং কেন পড়ছে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তবে ধীরে ধীরে প্লেটের উপরে ছবি আবছা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রতিটি কণা যেন জানে কোথায় তার স্থান! আরও অদ্ভুত একটা ব্যাপার। আলোর কণিকা কোন পথে ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপরে যেয়ে পড়ছে তা জানার চেষ্টা করলে, ছবিটি নষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতির মনের কথা জানার চেষ্টা করার খেসারত!

কোনটা সত্য কোনোটা মিথ্যা? যে ছবিটি রয়ে গেল, না যে ছবিটি মুছে গেছে? আমরা কোন চরিত্রে অভিনয় করছি? কোয়ান্টাম বাস্তবতা নিয়ে অনেকেই এখন মাথা ঘামাচ্ছেন। এর মূলে আছে কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা!