কোয়ান্টাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক। নিলস বোরের স্বপ্নের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পাশেই ছোট্ট একটা পার্ক। পদার্থবিদ্যার জটিল জগতের ভাবনা-জট ছাড়াতে মাঝেমধ্যে এই একখণ্ড সবুজে আসেন বোরের শিষ্যরা। ১৯২৫ সালের এক রাত। পার্কের আশপাশে গাঢ় অন্ধকার। শুধু অনেক দূর পরপর স্ট্রিট ল্যাম্পের ম্লান আলো সেই জমাট অন্ধকারে ফুটে আছে, মহাসমুদ্রের বুকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো।

রহস্যময়, ভুতুড়ে সেই দৃশ্যপটে বিভোর তাকিয়ে সেই রাতে পার্কের নির্জন এক কোণে বসে ছিলেন বোরের তরুণ শিষ্য ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে রাস্তায় এক ছায়ামূর্তিকে হেঁটে যেতে দেখলেন তিনি। গাঢ় অন্ধকারের কারণে লোকটিকে সব সময় দেখা যাচ্ছিল না। শুধু স্ট্রিট ল্যাম্পের কাছাকাছি এলেই লোকটার অবয়ব বোঝা যাচ্ছিল। স্ট্রিট ল্যাম্প থেকে দূরে সরে যেতেই হুট করে যেন গায়েব হয়ে যাচ্ছিল লোকটা। বেশ কিছুটা অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে লোকটা পরের স্ট্রিট ল্যাম্পে আবারও উদয় হচ্ছিল। তারপর আবারও গাঢ় অন্ধকারে গায়েব...আবারও উদয়...পুরোপুরি ভুতুড়েই দৃশ্য বটে।

হাইজেনবার্গ ভাবলেন, লোকটা আসলে পুরোপুরি হারিয়েও যাচ্ছে না কিংবা নতুন করে উদয়ও হচ্ছে না। এক স্ট্রিট ল্যাম্প থেকে আরেকটি পর্যন্ত লোকটার গমনপথ বা গতিপথ মনে মনে হিসাব করতে পারছিলেন তিনি। আসলে মানুষের মতো এ রকম ভারী ও বড় বস্তু এভাবে কখনো হারিয়ে যায় না বা হুট করে উদয়ও হয় না। কিন্তু ইলেকট্রনের মতো হালকা ও অতি খুদে কণার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী? এসব কণার আচরণ কি এমন হতে পারে? ইলেকট্রন যদি সত্যিই অন্ধকারে ওই লোকটার মতোই একবার গায়েব হয়ে যায়, তারপর আবার উদয় হয়, তাহলে? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন হাইজেনবার্গ। আর এই গায়েব ও উদয় যদি পারমাণবিক বর্ণালি গঠনের জন্য দায়ী বোরের বর্ণিত ইলেকট্রনের সেই রহস্যময় লাফ হয় তাহলে? যদি কোনো কিছুর সঙ্গে ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়া থেকে অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সময়টুকু ছাড়া ইলেকট্রন আক্ষরিক অর্থেই কোথাও যদি না থাকতে পারে, তাহলে? যদি এমন হয় যে ইলেকট্রন শুধু তখনই প্রকাশিত হয়, যখন তারা অন্য কিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং এক মিথস্ক্রিয়া থেকে আরেক মিথস্ক্রিয়ার মধ্যবর্তী সময়ে এর আসলে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান থাকে না? এমন যদি হয়, যেসব বস্তু যথেষ্ট বড় বা ভারী, কিছুক্ষণ আগে রাস্তা দিয়ে ভূতের মতো রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া লোকটার মতো হয়, শুধু তাদেরই নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান থাকে?

শুধু জলজ্যান্ত তারুণ্যেই বুঝি এমন উন্মত্তের মতো বিপ্লবী সিদ্ধান্তে আসা যায়। আইনস্টাইনও তাঁর ২৫ বছর বয়সে বুঝতে পেরেছিলেন, সময় সবার জন্য একইভাবে প্রবাহিত হয় না। তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আমাদের চিরপরিচিত জগৎ ভেঙেচুরে দিয়েছিল, তা তো সবারই জানা। সেই রাতে কোপেনহেগেন শহরে তরুণ হাইজেনবার্গও আমাদের চিন্তার জগৎ ভাঙচুরের আরেকটি মন্ত্র পেয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর হাতে জন্ম নিয়েছিল কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কণাবাদী বলবিদ্যা, যা বিশ শতকের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান দুটি ভিত্তির অন্যতম। আরেকটি প্রধান ভিত্তির নাম সাধারণ আপেক্ষিকতা, যার জন্ম আইনস্টাইনের হাতে, যেটি আগেই বলেছি।

স্বাভাবিকভাবেই এ দুটি ভিত্তির পরস্পরের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকার কথা নয়। দুটি তত্ত্বই শিক্ষা দেয়—প্রকৃতির সূক্ষ্ম কাঠামোকে আমরা চর্মচোখে যে রূপে দেখি, তা তার চেয়েও অনেক বেশি সূক্ষ্ম। সাধারণ আপেক্ষিকতা মহাকর্ষ, স্থান ও সময় সম্পর্কে এক সরল ও যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ। অন্যদিকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব এরই মধ্যে সব পরীক্ষণে অতুলনীয় সফলতা অর্জন করেছে, যা প্রায়োগিক দিকেও সফল। সে জন্যই আমাদের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে (যেমন: কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি)। কিন্তু তারপরও এই তত্ত্ব জন্মের পরও প্রায় এক শ বছরেরও বেশি সময় ধরে রহস্য ও অস্পষ্টতায় ঢাকা রয়েছে।

প্রায় এক শতাব্দীর চিন্তা-ভাবনার পর ১৯০০ সালে জন্ম হয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের। সে সময় জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক একটি উত্তপ্ত বাক্সের ভেতরের সাম্যাবস্থায় বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র নির্ণয় করছিলেন। কাজটি করতে তিনি এক বিশেষ কৌশল কাজে লাগিয়েছিলেন। কৌশলটি এ রকম: তিনি ধরে নিলেন, ওই ক্ষেত্রের শক্তি কোয়ান্টা আকারে বণ্টিত হয়। অর্থাৎ, শক্তি প্যাকেট বা গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে বণ্টিত হয়। এই পদ্ধতিতে পাওয়া ফলাফল পরীক্ষার সঙ্গে যথার্থভাবে মিলে গিয়েছিল। তবে ঝামেলা বাধল অন্য সবকিছুর সঙ্গে, অর্থাৎ যাকে আমরা সময় নামে জানি। শক্তিকে এমন এক বিষয় বলে ধরা হলো, যা অনবরত পরিবর্তিত হয়। অবশ্য এটি অনেকগুলো ছোট ছোট কোনো মৌলিক উপাদানে গঠিত এমনটি ভাবার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু তারপরও শক্তিকে সসীম প্যাকেট দিয়ে গঠিত বলে ধরে গণনার এই অদ্ভুত কৌশলের আশ্রয় নিলেন প্ল্যাঙ্ক। তবে কৌশলটি কেন কার্যকর হলো, তা তিনিও সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। পাঁচ বছর পর আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন শক্তির প্যাকেটের অস্তিত্ব সত্যিই আছে। তিনি প্রমাণও দেখালেন, আলো গুচ্ছ গুচ্ছ প্যাকেট দিয়ে গঠিত, যা আসলে আলোর কণা। বর্তমানে একে আমরা বলি ফোটন। এক গবেষণা প্রবন্ধে আইনস্টাইন লিখলেন:আমার ধারণা, কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সাথে সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণগুলো, ফ্লুরোসেন্স (প্রতিপ্রভা), অতিবেগুনি রশ্মির দ্বারা উত্পন্ন ক্যাথোড রশ্মি ও অন্যান্য পরিঘটনা আলোর নিঃসরণ বা রূপান্তরের সঙ্গে জড়িত। আলোক শক্তি স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বণ্টিত হয়, ধরে নেওয়া হলে এসব ঘটনা বোঝা যায়। এই অনুমান অনুযায়ী বিবেচনা করলে, একটি উত্সবিন্দু থেকে একটি আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়লে সেটি একটি প্রসারণমান স্থানে একটানা বণ্টিত হয় না। বরং সেটি সসীমসংখ্যক ‘শক্তিগুচ্ছ’ হিসেবে বিদ্যমান, যা স্থানের বিন্দুগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকে। পাশাপাশি এগুলো বিভক্ত না হয়েই চলাচল করে এবং সেটি শুধু সম্পূর্ণ একক হিসেবে উত্পন্ন বা শোষিত হতে পারে।

এই লাইনগুলোই কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্মসনদ। আইনস্টাইনের এ গবেষণাকে শুরুতে তাঁর সহকর্মীরা এক মেধাবী যুবকের কাঁচা বয়সের অযৌক্তিক কাজ বলে মনে করেছিলেন। অথচ এই কাজের জন্যই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। প্ল্যাঙ্ককে যদি এই তত্ত্বের জনক বলা হয়, তাহলে আইনস্টাইন এর অভিভাবক। কারণ তিনিই তত্ত্বটিকে প্রতিপালন করেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অন্য সব সন্তানের মতোই এ তত্ত্বও একসময় স্বাধীনভাবে চলতে শুরু করেছিল। তখন স্বয়ং আইনস্টাইনও তাকে আর চিনতে পারেননি। বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে এ তত্ত্বটি এগিয়ে নিতে প্রধান পথপ্রদর্শক ছিলেন দিনেমার নিলস বোর। তিনিই বুঝতে পেরেছিলেন, আলোকশক্তির মতোই পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের শক্তিও শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ হওয়া সম্ভব। তিনি বুঝেছিলেন, ইলেকট্রনগুলো এক পারমাণবিক কক্ষপথ থেকে আরেকটিতে সুনির্দিষ্ট মানের শক্তি নিয়ে লাফ দিতে পারে। এই লাফের সময় ইলেকট্রন একটি ফোটন নিঃসরণ কিংবা শোষণ করে। এটিই সেই বিখ্যাত কোয়ান্টাম লাফ বা কোয়ান্টাম লিপ। পারমাণবিক জগতের এই হতবুদ্ধিকর আচরণকে বুঝতে এবং তাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধতে কোপেনহেগেনে বোরের ইনস্টিটিউটে ওই শতাব্দীর সবচেয়ে মেধাবী আর প্রতিভাবান তরুণেরা জড়ো হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯২৫ সালে এই তত্ত্বের কাঙ্ক্ষিত সেই সমীকরণের দেখা মিলেছিল, যা নিউটনের পুরো বলবিদ্যা হটিয়ে দিয়েছিল। এই সমীকরণটি লিখেছিলেন হাইজেনবার্গ। হাইজেনবার্গ কল্পনা করেছিলেন, ইলেকট্রন সব সময় অস্তিত্বশীল নয়। কেউ বা কোনো কিছু যখন তাদের দেখে, শুধু তখনই তাদের অস্তিত্ব থাকে। কিংবা আরও ভালোভাবে বলা যায়, অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে ইলেকট্রন ক্রিয়াশীল হলেই কেবল তাদের মূর্ত হতে দেখা যায়। কোনো কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে তারা নির্ণয়যোগ্য সম্ভাবনাসহ একটি জায়গায় মূর্ত (বা বাস্তবে পরিণত) হয়। এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে ‘কোয়ান্টাম লাফ’-এর একটিই অর্থ যে তারা ‘বাস্তবে’ পরিণত হয়। অর্থাৎ একটি ইলেকট্রন হচ্ছে এক মিথস্ক্রিয়া থেকে আরেকটি মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার এক সেট লাফ। যখন কোনো কিছু এদের বিরক্ত বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না, তখন এর অবস্থানও কোনো জায়গাতেই সুনির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ তখন এটি কোনো ‘স্থানেই’ থাকে না।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় কোনো কিছুরই কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নেই। শুধু অন্য কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেই তার অবস্থান তৈরি হয়। একটি মিথস্ক্রিয়া থেকে আরেকটি মিথস্ক্রিয়ার মধ্যবর্তী অবস্থানে একে বর্ণনা করতে আমরা একটি বিমূর্ত বা তাত্ত্বিক গাণিতিক সূত্র ব্যবহার করি। কিন্তু বাস্তব স্থানে এর কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু তাত্ত্বিক গাণিতিক স্থানেই সেটি অস্তিত্বশীল। তবে এর চেয়েও খারাপ বিষয়টি হচ্ছে এই মিথস্ক্রিয়া লাফ, যার মাধ্যমে কোনো কিছু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা অতিক্রম করে, তা আগে থেকে অনুমানের কোনো উপায় নেই। বরং এই লাফের পুরো বিষয়টিই দৈবচয়নভিত্তিক। তাই আগেভাগে কখনোই বলা সম্ভব নয় যে একটি ইলেকট্রনকে কোথায় আবারও দেখা যাবে। তবে ইলেকট্রনটি এখানে নাকি অন্য কোথাও আবারও উঁকি দেবে, তার সম্ভাবনাই শুধু গণনা করা যায়। এভাবে পদার্থবিদ্যার অনেক গভীরে পরিসংখ্যানের সম্ভাব্যতা ঢুকে গেছে। অথচ একসময় পদার্থবিদ্যার সবকিছুই অনমনীয় আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করা হতো। আর এই আইনগুলোকে তখন সর্বজনীন ও অলঙ্ঘনীয় বলে মনে করা হয়েছিল।

তাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই বিষয়টি অনেকের কাছেই পাগলামি বলে মনে হতে পারে।

খোদ আইনস্টাইনের কাছেও তা-ই মনে হয়েছিল। অথচ তিনিই নোবেল পুরস্কারের জন্য হাইজেনবার্গের নামটাই প্রস্তাব করেছিলেন। এ মহাবিশ্ব সম্পর্কে কিছু মৌলিক বিষয় হাইজেনবার্গ বোঝেন বলেও মন্তব্য করেছিলেন আইনস্টাইন। আবার এর যে কোনো অর্থ হয় না, সেই অসন্তোষ প্রকাশের কোনো সুযোগও তিনি হাতছাড়া করেননি। তাতে কোপেনহেগেনের তরুণ সিংহরা হতাশ হয়েছিলেন। তাঁদের প্রশ্ন ছিল, আইনস্টাইন এটা কীভাবে ভাবতে পারলেন? তাঁদের এই আধ্যাত্মিক গুরু একসময় অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন। সেই তিনিই কিনা এখন পিছু হটছেন এবং অজানার পথে নতুন পদক্ষেপ নিতে ভয় পাচ্ছেন। অথচ এ ধরনের কাজে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি নিজেকে একসময় প্ররোচিত করেছিলেন। যে আইনস্টাইন একদিন প্রমাণ করেছিলেন, সময় কোনো সর্বজনীন বিষয় নয়; প্রমাণ করেছিলেন, স্থান বক্র—সেই আইনস্টাইনই কিনা এখন বলতে লাগলেন, মহাবিশ্ব এ রকম অদ্ভুত ধরনের হতে পারে না।

তবে বেশ ধৈর্যের সঙ্গে আইনস্টাইনকে এই নতুন ধারণা ব্যাখ্যা করে যেতে লাগলেন নিলস বোর। আইনস্টাইনও পাল্টা আপত্তি জানাতে লাগলেন। তিনি অনেকগুলো মানস পরীক্ষার (থট এক্সপেরিমেন্ট) পরিকল্পনা করলেন, যার মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব হবে, এই নতুন ধারণা আসলে পরস্পরবিরোধী। সেই মানসিক পরীক্ষার একটা ছিল অনেকটা এ রকম: কল্পনা করা যাক, একটি বাক্স আলো দিয়ে পরিপূর্ণ। সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি একক ফোটন কণা বের হতে পারে। এর মাধ্যমেই সেবার জন্ম নিল ‘আলোর বাক্স’ (বক্স অব লাইট) নামের মানস পরীক্ষা। পরীক্ষাটি আইনস্টাইনের দেওয়া বিখ্যাত উদাহরণগুলোর একটি। তবে সবশেষে দেখা যেত, বোর সব সময়ই আইনস্টাইনের প্রশ্নের কোনো না কোনো জবাব খুঁজে পেতেন, যার মাধ্যমে এসব আপত্তি খণ্ডন করতে পারতেন তিনি। অনেক বছর ধরে তাঁদের যুক্তিতর্কবিষয়ক এসব কথোপকথন লেকচার, চিঠি কিংবা গবেষণা প্রবন্ধে অব্যাহত ছিল। তবে এই বিতর্কে দুই মহান বিজ্ঞানীকেই কখনো না কখনো পিছু হটতেই হয়েছিল; নিজেদের চিন্তা-ভাবনাও পরিবর্তন করতে হয়েছিল। তাই আইনস্টাইন একবার বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, এই নতুন ধারণায় কোনো অসংগতি নেই। আবার বোরও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি প্রাথমিকভাবে বিষয়টি যতটা সহজ ও সুস্পষ্ট বলে ভেবেছিলেন, সেগুলো আসলে তা নয়। তবে এই বিতর্কের একটি বিষয়ে আইনস্টাইন কখনো সদয় হতে চাননি। সেটি হচ্ছে: যে কেউ যা কিছুর সঙ্গেই মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হোক না কেন, তার একটি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা স্বাধীনভাবে বিরাজমান। অন্যদিকে বোরও আইনস্টাইনের কথা মানতে নারাজ। অবশেষে আইনস্টাইন স্বীকার করেছিলেন, এই মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য এই তত্ত্ব অনেক বড় একটি পদক্ষেপ। তবে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, এই তত্ত্ব যেমন প্রস্তাব করে, সবকিছু আসলে তেমন অদ্ভুত হতে পারে না। তার মতে, এরপরও নিশ্চয়ই আরও কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে।

এক শতাব্দী পার হলেও আমরা এখনো সেই জায়গাতেই রয়ে গেছি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সমীকরণগুলো এবং তার পরিণতি দৈনন্দিন জীবনে পদার্থবিদ থেকে শুরু করে প্রকৌশলী, রসায়নবিদ ও জীববিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছেন। আধুনিক সব প্রযুক্তিতে এ সমীকরণগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ছাড়া আজ ট্রানজিস্টর নামে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকত না। তবুও এ সমীকরণগুলো এখনো রহস্যময়। কারণ একটি ভৌত সিস্টেমে কী ঘটে, তারা তা ব্যাখ্যা করে না, বরং একটি ভৌত সিস্টেম আরেকটি ভৌত সিস্টেমকে কীভাবে প্রভাবিত করে, শুধু সেটুকুই বর্ণনা করে এই সমীকরণগুলো।

সত্যিকার অর্থেই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে। এর মাধ্যমে আমরা নতুন কিছু করতে পারছি, যা আগে কখনো কল্পনাই করা যায়নি। কিন্তু জ্ঞানের এই বিকাশ আমাদের নতুন নতুন সব প্রশ্নের এবং নতুন রহস্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে এই তত্ত্বের এসব সমীকরণ পরীক্ষাগারের চেয়ে গবেষণা প্রবন্ধ আর কনফারেন্সে ব্যবহার অনেক বেড়েই চলেছে। জন্মের প্রায় এক শ বছর পরও পদার্থবিজ্ঞানী আর দার্শনিকেরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন: কোয়ান্টাম তত্ত্ব আসলে কী? প্রকৃতির বাস্তবতার অতল গভীরে ব্যতিক্রমী এক ডুব? নাকি বিশাল কোনো ভুল, যা ভাগ্যক্রমে বেশ ভালোভাবে কাজ করছে? কোনো অসম্পূর্ণ ধাঁধার অংশবিশেষ? নাকি এই মহাবিশ্বের গভীর কোনো কাঠামোর একটি ক্লু, যাকে আমরা এখনো যথাযথভাবে হজম করতে পারিনি? সে কারণেই পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান একবার বলেছিলেন, ‘আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি, কেউই কোয়ান্টাম মেকানিকস বোঝে না।’

আইনস্টাইন মারা গেলে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বোর শ্রদ্ধা জানালেন। ক’বছর পর মারা গেলেন বোরও। সে সময় তাঁর স্টাডি রুমের ব্ল্যাকবোর্ডের একটি ছবি তোলা হয়েছিল। ছবিতে এক ড্রয়িং দেখা গেল, যা ছিল আইনস্টাইনের সেই ‘আলোপূর্ণ বাক্স’ মানস পরীক্ষার। আসলে বোরের ইচ্ছা ছিল একজনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর এবং প্রকৃতির রহস্যটা উদঘাটনের, আরও একটু বেশি বুঝে দেখার। তারও আরও পরে ছিল সংশয়। আর এ চিরস্থায়ী সংশয় বা সন্দেহ থেকেই জন্ম নেয় নতুন বিজ্ঞান; পথ দেখায় নতুন বিজ্ঞানীদের।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: রিয়েলিটি ইজ নট হোয়াট ইট সিমস, সেভেন ব্রিফ লেসন অন ফিজিক্স/ কার্লো রোভেলি

* লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত