কোয়ান্টামের আশ্চর্য জগৎ

অতি ক্ষুদ্র কণার জগতে আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণা হোঁচট খায়। এটা আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু কেন? আর সমস্যাই বা কোথায় যে এত আপত্তির কথা শোনা যায়? অথচ অনেকেই বলছেন, অতি ক্ষুদ্র বা কোয়ান্টাম জগতের ব্যাপার-স্যাপার বুঝতে যেয়ো না, থই পাবে না। অকালে মাথা নষ্ট হবে। যেটা বোঝা যায় না তার পেছনে এত ছোটার দরকারই বা কী? এটা কি আদৌ কোনো কাজের বিষয়? কোয়ান্টাম জগতের এসব কারসাজি বুঝতে হলে আমাদের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মূল বিষয়টি একটু বোঝা দরকার। বলবিদ্যা হলো অনেকগুলো তত্ত্বের বিস্তার, যেখানে সব ক্রিয়াশীল বলের সমাপতনে বস্তুর গতির গাণিতিক বর্ণনা পাওয়া যায়। বস্তু কোন বলের অধীনে কখন কোথায় যাবে তার হদিস বলবিদ্যার অঙ্ক কষে জানা যায়। বলবিদ্যা একটা খুব বড় ব্যাপার। তার মধ্যে অনেক তত্ত্ব থাকে, অনেক মানুষের চিন্তার ছোট ছোট ঝরনাধারা মিলে একটা বড় নদী সৃষ্টি করে। তখন সে নদী বেগবান হয়, মানুষ সেই চিন্তানদীতে অবগাহন করে অপার আনন্দ লাভ করে। এই আনন্দ জানার আনন্দ, এই আনন্দ প্রকৃতিকে ঠিক ঠিক বোঝার আনন্দ।

বিশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তির এক মহত্তম সৌধ কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান। চিন্তা ও গণিতের এমন অভূতপূর্ব সমাবেশ খুব কমই ঘটে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কী জিনিস? এটি অতি ক্ষুদ্রের বিজ্ঞান অর্থাত্ ইলেকট্রন-প্রোটন পরমাণুতে কীভাবে সজ্জিত থাকবে, কোন আরোপিত বলের অধীনে একটি ক্ষুদ্র কণা কেমন আচরণ করবে, তার গতিপথ কী হবে—এসবই এখানে আলোচনা করা হয়। অতি ক্ষুদ্রের জগতে ক্রিয়াশীল বলগুলো এবং তাদের অধীনে ক্ষুদ্র কণার আচরণ ব্যাখ্যাই কোয়ান্টাম মেকানিকসের উদ্দেশ্য। দেখা যায়, এই বলবিদ্যা এমন সব ঘটনার কথা বলে যা কাণ্ডজ্ঞানবিরোধী। একটা টেনিস বল দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারলে সে কোথায় আঘাত করবে সেটা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। কিন্তু বল যে দেয়াল ফুঁড়ে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে না, তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আবার তার গতিবেগ ও ভর একই সঙ্গে মাপা সম্ভব।

কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস বলে, এই টেনিস বলটি যদি ইলেকট্রনের আকারের হয়, তাহলে এর কোনোটিই হবে না। তখন দেখা যাবে অদ্ভুতুড়ে সব ব্যাপার-স্যাপার। অতি ক্ষুদ্রের কোয়ান্টাম জগতে টেনিস বল, দেয়াল-সবই হবে অতি ক্ষুদ্র মাত্রার। কাজেই এ জগতে অতি ক্ষুদ্র টেনিস বলটি তথাকথিত কোয়ান্টাম দেয়ালে অপবর্তন নকশা (ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্ন) তৈরি করবে, সে দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারে। এমনকি তার অবস্থান ও ভরবেগ একই সঙ্গে মাপা যাবে না। উপরন্তু এই ইলেকট্রন আকৃতির টেনিস বলটিও ভ্যানিশ হয়ে যাবে। তার জায়গায় থাকবে একগুচ্ছ তরঙ্গ, যাদের বিস্তারের বর্গ কোনো বিন্দুতে ওই বলটিকে পাবার সম্ভাবনা বলে দেয়। এসব ঘটনাই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিপরীত। তাই কোয়ান্টাম জগতের নিয়মাবলি শেখার সময়ে কাণ্ডজ্ঞান বন্ধ রাখাই ভালো। আরও ভালো হয় যদি অন্ধভাবে কেবল গাণিতিক যুক্তি অনুসরণ করা যায়। শেষতক যে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে, সেটা অবশ্য পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মেলে। না মিললে মানুষ কোয়ান্টাম মেকানিকসে বিশ্বাসই করত না।

অতি ক্ষুদ্র কণার জগতে আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণা হোঁচট খায়। সেখানে কাজ করে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা

কোয়ান্টাম মেকানিকসের শুরু ১৯০০ সালে, ম্যাক্স প্ল্যাংকের প্রস্তাবনা দিয়ে। প্ল্যাংকের তাত্ত্বিক প্রস্তাবের পরপরই হাইড্রোজেন পরমাণু নিঃসৃত বর্ণালির বামার সিরিজ ব্যাখ্যা করার জন্য পরমাণুর এমন এক মডেল দাঁড় করেন নিলস বোর। সেই মডেলে ইলেকট্রনের কক্ষপথ খণ্ডিত হয়ে যায়। অর্থাত্ কয়েকটি অনুমোদিত কক্ষপথের বাইরে ইলেকট্রন আর থাকতে পারে না। এভাবে ইলেকট্র্রনের কক্ষপথ কোয়ান্টায়িত হয়ে যায়। এটাকে বলে বোর মডেল। বোর মডেল মোটামুটি সুন্দরভাবেই সব ব্যাখ্যা করছিল। তবু প্রশ্ন ছিল অনেক, আর সবকিছু মিলছিলও না ঠিকঠাক। শেষ পর্যন্ত ১৯২৫ ও ১৯২৬ সালে দুজন বিজ্ঞানীর বিশেষ অবদানে কোয়ান্টাম মেকানিকসের যাত্রা শুরু।

ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ছিলেন তরুণ জার্মান ও মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি পরমাণুর বর্ণালি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সে সময়ে বর্ণালিবিজ্ঞান (Spectroscopy) খুব গুরুত্ব পেত। কারণ, বর্ণালি রেখার কম্পাঙ্ক খুব নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যেত এবং এসব পর্যবেক্ষণ প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক খুঁটিনাটি জানাতে সচেষ্ট ছিল বর্ণলিবিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞানীরাও বর্ণালির বিভিন্ন রেখার উত্পত্তি ও ব্যাখ্যায় ব্যস্ত থাকতেন। তাই আধুনিক পদার্থবিদ্যার জগতে বর্ণালিশাস্ত্রের খুব কদর ছিল। যেমন হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালিতে বামার রেখার উত্পত্তি ব্যাখ্যা করতে বোর মডেল ব্যবহার করতে হলো। হাইজেনবার্গ এসব নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত ছিলেন। তিনি চাইছিলেন আলোকীয় ধর্মাবলির এক সাধারণ ব্যাখ্যা উপস্থাপনের, যাতে বস্তুর ভেতরকার গঠন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানা যায়। বিশ্রী একটা জ্বর থেকে সদ্য সেরে উঠতে তিনি উত্তর মহাসাগরের একটি দ্বীপে যান। সে সময় তিনি এসব জটিল গণনা নিয়ে বসলেন। দেখা গেল, তিনি এমন সব গাণিতিক পদ নিয়ে এসেছেন, যেগুলো ম্যাট্রিকস নামে পরিচিত। ম্যাট্রিকস হলো সংখ্যার একরকম সারণি।

ম্যাট্রিকসের গুণন প্রচলিত গুণন থেকে আলাদা। এরা অবিনিময়ী বা ননকমুটেটিভ। অর্থাত্ সাধারণ যেমন দেখি 2×3 = 3×2, মেট্রিকস কিন্তু তেমন নয়। দুটি ম্যাট্রিকসের গুণন ab-ba≠0। অর্থাৎ মেট্রিকসের গুণনের ক্ষেত্রে কোন পদটি আগে আসছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। গণিতের এই অবিনিময়ী ধর্মের কারণেই কোয়ান্টাম মেকানিকসে যা কিছু দেখি তা কাণ্ডজ্ঞানবিরোধী হয়। দেখা গেল, এ ধরনের গুণনের ফলে এমন কিছু পরস্পর পরিপূরক ভৌত রাশি আছে যাদের একত্রে পরিমাপ করা যায় না। যেমন কণার অবস্থান ও ভরবেগ একই সঙ্গে সমান নিশ্চয়তায় পরিমাপ সম্ভব নয়। এটাই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির মূলকথা। ম্যাট্রিকস নিয়ে করা গণিতের এই কারবারিকে তাই অনেকে ‘ম্যাট্রিকস বলবিদ্যা’ বলে সম্বোধন করেন। এখনকার বিজ্ঞানের ছাত্ররা যেমন উচ্চমাধ্যমিকেই ম্যাট্রিকসের যোগ-বিয়োগ-গুণন শেখে বা স্নাতক ক্লাসে উচ্চতর ম্যাট্রিকসবিদ্যা শেখে। কিন্তু ১৯২০-এর দশকে এমনটি ছিল না। সেকালে তরঙ্গ সম্পর্কিত বিশ্লেষণ বেশি জনপ্রিয় ছিল। কারণ কদিন আগেই ম্যাক্সওয়েল তাঁর বিখ্যাত বিদ্যুত্চুম্বকীয় তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বে দেখান, বিকিরণ তরঙ্গাকারে এগিয়ে চলে।

অন্যদিকে হাইনরিখ হার্জ সাহেব বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ আবিষ্কারও করেছেন। কাজেই তরঙ্গবিদ্যা তখন বড় প্রিয় বিষয়। তরঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে পার্শিয়াল ডিফারেনসিয়াল ইকুয়েশন। এই তরঙ্গবিদ্যা-সহযোগে একটি পরিপূরক বিশ্লেষণ এসে হাজির হয় হাইজেনবার্গের পিছু পিছু। দ্বিতীয় বিদ্যা হিসেবে তরঙ্গের সুরলহরি তুলে যে বিকল্প গাণিতিক সূত্রায়ণ এল, তার জন্মদাতা এরউইন শ্রোডিঙ্গার। শ্রোডিঙ্গারের জন্ম অস্ট্রিয়ায় এক অভিজাত ঘরে। তিনি লুই দ্য ব্রগলির চিন্তা নিয়ে এগোলেন। দ্য ব্রগলির চিন্তা ছিল এ রকম—যদি দোদুল্যমান আলোর ঢেউ কণাধর্মিতা দেখায়, তাহলে যেকোনো বস্তুকণারও তরঙ্গধর্মিতা থাকার কথা। আইনস্টাইনের শক্তি-সংক্রান্ত সূত্রটি (E=hv) যেমন কোয়ান্টায়িত থাকে, দ্য ব্রগলির তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সূত্রটিও কোয়ান্টায়িত থাকে। কোয়ান্টায়নের মূল লক্ষণই হলো সমীকরণে ‘h’ রাশির উপস্থিতি। প্ল্যাংকের ধ্রুবক নামে পরিচিত h-রাশিটির মান অত্যন্ত ক্ষুদ্র (৬.৬২৬১৭৬ × ১০-৩৪ জুল/সেকেন্ড)। এর মান অতি ক্ষুদ্র বলেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের জগতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কাজ করে। এর মান বড় হলে কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেই প্রভাব ফেলত। সেটা কেমন হতো সেটা জানতে পাঠককে জর্জ গ্যামোর মিস্টার টমকিনস ইন পেপারব্যাক বইটি পড়ে দেখতে হবে।

১৯২৪ সালে লিখিত পিএইচডি ডিসার্টেশনে দ্য ব্রগলি এই তত্ত্ব প্রকাশ করেন। বস্তু একই সঙ্গে তরঙ্গ এবং কণা-এমন অদ্ভুত তত্ত্ব দেখে তার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেননি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকেরা। তখন তাঁরা আইনস্টাইনের কাছে ধরনা দিলেন। আইনস্টাইন সায় দেওয়ার পরেই দ্য ব্রগলিকে ডিগ্রি দেওয়া হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই প্রমাণ পাওয়া গেল, ইলেকট্রন বিম কঠিন পদার্থের ল্যাটিসের সঙ্গে অপবর্তন ঘটায় এবং ব্যতিচার নকশার সৃষ্টি করে। এই পরীক্ষা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিসন ও গারমার এবং বিলেতের জর্জ টমসন। এই টমসন সুবিখ্যাত জে জে টমসনের সুযোগ্য ছেলে। জ্যেষ্ঠ টমসন দেখান যে ইলেকট্রন একটি কণা, আর তাঁরই ছেলে দেখালেন যে ইলেকট্রন একটি তরঙ্গও বটে। সুতরাং ব্রগলির তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া গেল। সে জন্য ১৯২৯ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ব্রগলির আইডিয়াটি ছিল শূন্যস্থানে বাধাহীনভাবে চলনশীল একটি কণিকার ভরবেগ ও তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মধ্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। কিন্তু একে আরও ব্যাপক ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন আরোপিত বল বা শক্তির সঙ্গে এই কণিকার মিথস্ক্রিয়া পর্যালোচনা করা। আরোপিত বিভব শূন্য করে দিলেই দ্য ব্রগলির সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে। অর্থাৎ এমন একটি গতিময় সমীকরণ বা সমীকরণগুচ্ছ পাওয়া সম্ভব, যা অত্যন্ত ব্যাপক ক্ষেত্রে সাধারণভাবে তরঙ্গকণিকার আচরণ ব্যাখ্যা করবে এবং যার বিশেষ সমাধান হবে দ্য ব্রগলির সমীকরণ। ১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গার ঠিক এই কাজটিই করে দেখালেন। তিনি মুক্তভাবে সঞ্চারমান একটি তরঙ্গকে সুপরিচিত হেলমহোলত্জ তরঙ্গ-সমীকরণের আকারে লিখতে চাইলেন। সেটা করতে ব্যবহার করলেন গিয়ে দ্য বগলির সূত্র এবং অনিশ্চয়তার নীতির ভাষ্য।

ফলে তরঙ্গ-সমীকরণের স্পেস-ডেরিভেটিভ ((d/dx) ) ও টাইম ভেরিভেটিভের (d/dt) জায়গায় এনার্জি ও হ্যামিলটনিয়ান অপারেটরের আমদানি ঘটে। এভাবে শ্রোডিঙ্গার সমীকরণটি পাওয়া যায়। এর সংক্ষিপ্ত সুপরিচিত রূপটি হলো: Hψ = Eψ। এটাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের মৌলিক ডায়নামিক ইকুয়েশন। এটা একটা আংশিক অন্তরক সমীকরণ (পার্শিয়াল ডিফারেনসিয়াল ইকুয়েশন) এবং এটি সমাধান করা গণিতবিদদের জন্য খুব সহজ।

এই সমীকরণকে বিভিন্ন বাস্তব সিস্টেমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া গেল। সাধারণ বিভব-বাধা অতিক্রমের সমস্যায় দেখা যায়, ইলেকট্রন জাতীয় একটি কণিকা সহজেই দেয়াল ফুঁড়ে চলে যেতে পারে। এটা টানেলিং প্রক্রিয়া। শ্রোডিঙ্গার সাহেব নিজে হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে তাঁর সমীকরণের সমাধান নির্ণয় করে হাইড্রোজেন বর্ণালির বামার সিরিজ সমাধান করতে সক্ষম হন। ফলে দেখানো সম্ভব হয়, বোরের মডেল একাধারে কোয়ান্টাম তত্ত্বের কত কাছে থাকা সত্ত্বেও কত অসম্পূর্ণ ছিল। মূল সমস্যাটা হলো ভরবেগের প্রকৃত কোয়ান্টায়ন বোর যেমন মনে করেছিলেন তেমনি হয় না, হয় দ্য ব্রগলির নিয়মে।

মনে রাখতে হবে, শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের কোনো নির্ধারণ নেই, এটি একটি সজ্ঞাত অনুমান। একটা অনুমান কত শক্তিশালী হতে পারে সেটা শ্রোডিঙ্গার সমীকরণের সাফল্য থেকে বোঝা যায়। প্রফেসর এ এম হারুন-অর-রশীদ লিখেছেন কোয়ান্টাম মেকানিকস ২য় সং, ২০০৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা]:

‘এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে শ্রোডিঙ্গার সমীকরণের কোনো নির্ধারণ নেই। এটা কেবলি একটি অনুমান। এই অনুমানের বিবিধ প্রাসঙ্গিক ফলাফল আমরা গণনা করতে পারি এবং তারপর সেসব ফলাফল পরীক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারি। আমরা দেখি যে শ্রোডিঙ্গার সমীকরণের সাফল্য এত বেশি যে তা নেহাত কাকতাল বলে প্রতীতি হয় না। এটি অবশ্যই সেই মৌলিক সমীকরণ যা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের জগতের নন-রিলেটিভিস্টিক ভৌত প্রপঞ্চকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।’

শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ বলবিদ্যা এবং হাইজেনবার্গের ম্যাট্রিকস বলবিদ্যা প্রকাশের (হাইজেনবার্গের প্রকাশের কয়েক মাস পরে শ্রোডিঙ্গার তাঁর সমীকরণ প্রকাশ করেন) কিছুদিন পরে ম্যাক্স বর্ন ও পল ডিরাক প্রমাণ করেন, প্রকৃতপক্ষে এ দুটো বলবিদ্যাই একই প্রপঞ্চের দুটি ভিন্ন গাণিতিক প্রতিরূপ। আসলে এরা প্রত্যেকে কোয়ান্টাম তত্ত্বকেই বর্ণনা করে, কিন্তু তাদের গাণিতিক প্রকাশভঙ্গি আলাদা।

স্থানকালজুড়ে তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়া কোনো ভৌতরাশির মানকে একগুচ্ছ রাশি-কলামে সাজিয়ে লিখলেই তা ম্যাট্রিকস হয়ে যায়। এক অর্থে ম্যাট্রিকস বলবিদ্যা গাণিতিকভাবে আরও বেশি সমর্থবান, কারণ ম্যাট্রিকসের ক্ষেত্রে অধিকতর শক্তিশালী গাণিতিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যায়। গণনার ক্ষেত্রেও তা সুবিধাজনক, কারণ কম্পিউটারের কোড ম্যাট্রিকস অনেক সহজে বোঝে।

শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের সাই-ফাংশন বা তরঙ্গটি আসলে কিসের তরঙ্গ? এটি কি কণিকা-তরঙ্গ? না, ম্যাক্স বর্ন বললেন যে এটা আসলে একটি বিমূর্ত গাণিতিক নির্মাণ। এর প্রকৃত অর্থ তখনই প্রতীয়মান হয়, যখন এর বর্গমান গণনা করা হয়। সাই-ফাংশনের বর্গমান (|ψ|2) কোনো স্থানে ওই কণাটিকে পাওয়ার সম্ভাবনা নির্দেশ করে। এটাই কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা নামে পরিচিত। যাঁরা কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা বলেন, এর বেশি জানতে-বুঝতে না চেয়ে চুপ করে গণনা করাই শ্রেয় (শাট আপ, অ্যান্ড ক্যালকুলেট)! তাহলেই তুমি পরীক্ষণযোগ্য সমাধান পাবে। ফাইনম্যানও বলেছিলেন, কোয়ান্টাম মেকানিকস কেউই বোঝে না।

বুঝুক আর না বুঝুক, কোয়ান্টাম মেকানিকস এখন আধুনিক শিক্ষার এক মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়েছে। এটি না জানলে সলিড স্টেট ডিভাইস কেউ বানাতে পারে না, সেই ডিভাইসের গতি-প্রকৃতিও কেউ বুঝতে পারে না। তাই তড়িত্ কৌশলের ছাত্রদেরও এটা শিখতে হয়। এটা না জানলে মৌলের বন্ধন বোঝা যায় না, তাই রসায়নের ছাত্রও এটা পড়ে। ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং, ফোটোনিকস, কনডেনসড ম্যাটার-বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের হেন শাখা নেই যেখানে কোয়ান্টাম মেকানিকস প্রয়োজন পড়ে না।

লেখক: অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: জর্জ গ্যামো-মিস্টার টম্পকিনস ইন পেপারব্যাক, ১৯৬৫; ব্রায়ান কক্স ও জেফ ফোরশো-দ্য কোয়ান্টাম ইউনিভার্স, ২০১৩।