জগৎজুড়ে আলোর খেলা

কোথায় যেন পড়েছিলাম—মানুষের চোখ এবং মস্তিষ্ক যৌথভাবে আলোকে অনুবাদ করে রঙে পরিণত করে। কথাটা মনে ধরেছিল খুব। সত্যিই তো, আমরা যে আমাদের চারপাশে এত এত রং দেখি, যেন রঙের মেলা, তার কারণ কী? কারণ তো ওই আলো, অতিপরিচিত ‘সাদা’ আলো! রং যেন আলোর ভাষা, আলো নিজেকে প্রকাশ করে নানান অপরূপ রঙে। শুধু রঙে রঞ্জিত করাই নয়, আরও অনেক ব্যাপারেই আমাদের সঙ্গে সে জড়িয়ে থাকে সর্বক্ষণ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমরা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখি কেন? বৃষ্টির পর আকাশে রংধনু দেখা যায় কেন? আকাশ নীল দেখায় কেন? মরুভূমিতে মরীচিকা দেখা যায় কেন? এ রকম নানা প্রশ্ন তুলে ছোটরা ব্যতিব্যস্ত করে রাখে বড়দের। প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গেলে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হয়, তার নাম আলো। এর আগের একটি লেখায় আমি শব্দ আর তাপের কথা বলেছিলাম। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই শক্তিগুলো কীভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, তার কিছু উদাহরণও দিয়েছিলাম। আলোও আমাদের তেমনই এক বন্ধু, যাকে ছাড়া আমরা জীবনযাপনের কথা ভাবতেই পারি না। শুধু আমাদের জীবনযাপনই নয়, এই মহাবিশ্বকে আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান করে তোলে আলো। সত্যি বলতে কি, আলো না থাকলে আসলে আর কিছুই থাকত না, কিংবা থাকলেও সেগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠত না। এক কথায় বলা যায়, আলো নেই তো জগত্ই নেই। এ কথা অবশ্য অন্যান্য শক্তির ব্যাপারেও বলা যায়। মোটকথা, প্রকৃতির এই শক্তিগুলো সম্মিলিতভাবেই এই জগেক এ রকম অপূর্ব রূপে সাজিয়েছে। অবশ্য মৌলিক বলগুলোও এ কাজে সমানভাবে অংশ নিয়েছে, সে কথা আরেক দিন বলব।

আমাদের চোখ আর মস্তিষ্ক যে আলোকে অনুবাদ করে রঙের ভাষায় প্রকাশ করে, সেটি কীভাবে? আমাদের চোখের রেটিনায় আছে তিন ধরনের রং—গ্রহীতা কোন কোষ, তারা হলো—লাল, নীল ও সবুজ গ্রহীতা। কারণ তারা এই তিন ধরনের রঙের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। অর্থাৎ এই তিন ধরনের রঙের প্রতি তারা সবচেয়ে বেশি সাড়া দেয়। এই গ্রহীতাগুলো মস্তিষ্কে একটা সিগন্যাল বা মেসেজ পাঠায়, যা বিশ্লেষণ করে আমাদের মস্তিষ্ক তৈরি করে রং দেখার অনুভূতি। নিউটনই এ সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে কোনো বস্তুরই সহজাত রং নেই; বরং বস্তুর পৃষ্ঠ থেকে যে রঙের আলোটি প্রতিফলিত হয়ে আসে, আমরা সেটিকেই দেখি। বলা বাহুল্য এক-দুটি রং প্রতিফলিত হয়ে আসে বাকি রংগুলো ওই বস্তু শোষণ করে নেয়। এই গ্রীষ্মকালে বাইরে বেরোলে লাল রঙের কৃষ্ণচূড়া বা হলুদ রঙের সোনালু ফুল ফুটে থাকতে দেখে আমরা চোখ ফেরাতে পারি না। এই অপরূপ সৌন্দর্যও তৈরি হয় ওই আলো আর রঙের খেলায়। কৃষ্ণচূড়া লাল রংটিকে প্রতিফলিত করে, বাকিগুলোকে শুষে নেয় আর সোনালু ফুল হলুদ রংটিকেই প্রতিফলিত করে। মনে হতেই পারে, এসবই যদি রঙের খেলা হবে, তাহলে সাদা আর কালোর মানে কী? ওগুলোও কি কোনো রং? ওগুলোকে রং বলুন আর না বলুন, ঘটনা হলো, কোনো বস্তু যদি সবগুলো রংকে প্রতিফলিত করে তাহলে সেই বস্তুটিকে সাদা দেখায়। আর সে সবগুলো রংকে শোষণ করে নিলে কালো দেখায়। কোনো বস্তু কোন রংটিকে শোষণ করবে আর কোনটিকে প্রতিফলিত করবে, তা নির্ভর করে ওই বস্তুর বৈশিষ্ট্যের ওপর।

আমাদের চারপাশের নানা ঘটনায় আলোর খেলা দেখা যায়, তার দু-একটা উদাহরণ ছোটদের প্রশ্নের আকারে দিয়েছি। এবার দেখি সেসবের উত্তর পাওয়া যায় কি না! অনেক রকম বৈশিষ্ট্য আছে এই শক্তিটির। যেমন ধরুন, প্রতিফলন। অবশ্য শুধু আলোই প্রতিফলিত হয় না, শব্দ বা তাপও হয়। তবে আলোর প্রতিফলনে যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো আমাদের খুব চোখে পড়ে। তবে এ নিয়ে কথা বলার আগে আরেকটি বিষয় মনে করিয়ে দিই—প্রাকৃতিক শক্তিগুলো স্থির অবস্থায় কোথাও জমা হয়ে থাকতে পারে না, তাকে সব সময়ই প্রবহমান থাকতে হয়, এটাই তার চরিত্র। তবে তাপপ্রবাহের জন্য যেমন একটি শর্ত পূরণ করতে হয়, দুটো স্থানের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য থাকার শর্ত, আলোকে এ ধরনের কোনো শর্ত পূরণ করতে হয় না। কোনো উত্স থেকে আলো উত্পন্ন হওয়ার পর থেকে সে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, এ চলার শেষ নেই। আপনি ভাবতেই পারেন, যদি চলার পথে একটা ইটের দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিই বা নিদেনপক্ষে একটা ভারী কাপড়ের পর্দা, তাহলে কী হবে? থেমে যাবে না সে? না, যাবে না, বাধা পেয়ে ফিরে যাবে ও উল্টো দিকে চলতে শুরু করবে এবং চলতেই থাকবে। এই যে বাধা পেয়ে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটা—একেই প্রতিফলন বলে, আমরা জানি। সাধারণত আলো চলাচল করে শূন্য মাধ্যমে, আমরা যদি তার চলার পথে আরেকটা মাধ্যম বসাই (যেমনটি বলেছি একটু আগে, দেয়াল বা পর্দা), তাহলে আলোর প্রতিফলন ঘটবে। কতটুকু প্রতিফলন হবে, তা নির্ভর করবে মাধ্যমের ধরনের ওপর। যদি স্বচ্ছ মাধ্যম হয়, যেমন কাচ বা পানি, তাহলে এর কিছু অংশ প্রতিফলিত হবে বাকি অংশ ওই মাধ্যমের ভেতর দিয়ে চলে যাবে। তবে যাওয়ার সময় তার দিক ও বেগ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আর এই দ্বিতীয় ঘটনাটিকে বলা হয় আলোর প্রতিসরণ। এ বিষয়গুলো এখন স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও জানে। তবে এই ব্যাপারগুলো কীভাবে আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তা নিয়ে খুব একটা ভাবি না আমরা। এই যে প্রতিফলিত এবং প্রতিসরিত আলোর কথা বললাম, এদের জন্যই প্রতিবিম্ব তৈরি হয়, যা আমাদের চোখে দেখার অনুভূতি তৈরি করে। কোনো বস্তুকে যদি একটা আয়নার সামনে রাখা হয় তাহলে তাকে ছুঁয়ে যেসব আলোকরশ্মি আয়নার ওপরে পড়ে প্রতিফলিত হবে, সেগুলো কোথাও মিলিত হলে সেখানে ওই বস্তুটির প্রতিবিম্ব গঠিত হবে। অর্থাৎ প্রতিফলিত রশ্মিগুলোর মিলিত হওয়ার একটা শর্ত এখানে আছে। কিন্তু আয়নায় প্রতিফলিত রশ্মিগুলো মিলিত হয় কোথায় এবং কীভাবে? সাধারণত আয়নার কাচগুলো সমতলীয় হয় এবং রশ্মিগুলো বাস্তবে কোথাও মিলিত হয় না, মিলিত হয় কাল্পনিকভাবে, আয়নার পেছনে। সে জন্য আমরা নিজেদের যে প্রতিবিম্ব দেখি, সেটি আসলে কাল্পনিক প্রতিবিম্ব। তরে আয়নার কাচ যদি বক্রতলীয় হয়, তাহলে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে বাস্তব প্রতিবিম্ব গঠিত হতে পারে। এ তো গেল আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখার ব্যাপার, কিন্তু আয়না ব্যবহার না করেও তো আমরা কোনো বস্তুকে দেখি, সেটি ঘটে কীভাবে? সেটিও ঘটে প্রতিফলনের কারণেই। কোনো বস্তুর ওপর আলো পড়লে সেটি প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখের ক্যামেরায় প্রতিবিম্ব তৈরি করে, আমরা সেটিই দেখি। অর্থাৎ আমরা আসলে বস্তুকে দেখি না, দেখি এর ছবি বা প্রতিবিম্ব! শুনতে একটু অদ্ভুত লাগে না? আরেকটা কথা বলি। কোন জিনিসটি দেখা যাবে, কোনটি যাবে না বা কোনটি দেখতে কেমন লাগবে—এগুলো বস্তুর গঠনের ওপর অনেকখানিই নির্ভরশীল। যেমন কাচকে স্বচ্ছ দেখায়, কাঠকে তা দেখায় না, আর গ্যাসীয় পদার্থগুলো দেখাই যায় না।

এর কারণ হলো, কাঠের ভেতরে যে অণুগুলো থাকে, তাদের ভেতরকার দূরত্ব (মানে আন্তঃআণবিক দূরত্ব) আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়েও কম, ফলে আলো অণুগুলোর ভেতর দিয়ে পার হয়ে আসতে পারে না, পুরোটাই প্রতিফলিত হয় এবং অস্বচ্ছ দেখায়। অন্যদিকে কাচের ভেতরে আন্ত-আণবিক দূরত্ব আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি, ফলে আলো কাচ ভেদ করে চলে আসতে পারে। অর্থাত্ কিছুটা আলো প্রতিফলিত হয়, বাকিটা প্রতিসরিত হয়। ফলে কাচকে স্বচ্ছ দেখায়। গ্যাসের অণুগুলো থাকে মুক্ত অবস্থায়, তাদের ভেতরে আন্ত-আণবিক দূরত্ব এতই বেশি যে আলো প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগই পায় না। ফলে ওগুলো দেখা যায় না। এ ঘটনাগুলো ঘটে আলোর তরঙ্গ-ধর্মের কারণে। আলোর কণা-ধর্মও আছে। সে কারণেই বলা হয় আলোর রয়েছে তরঙ্গ-কণা দ্বৈত সত্তা। তবে ও প্রসঙ্গ আপাতত মুলতবি থাকুক। আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো। আলো আসলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ আর আমরা কথা বলছি কেবল দৃশ্যমান আলো নিয়ে। আসলে দৃশ্যমান আলোর চেয়ে ‘অদৃশ্য’ আলোর পরিমাণ অনেক বেশি। তবে সেগুলো আমরা ‘আলো’ না বলে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকি। আমরা যদি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাপেক্ষে (বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিকে) সব ধরনের আলোকে সাজাই, তাহলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় বর্ণালিটি হবে এ রকম: রেডিও-তরঙ্গ, মাইক্রো-তরঙ্গ, অবলোহিত রশ্মি, দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে ও গামারশ্মি।

শুধু যে আলোর প্রতিফলন থেকেই প্রতিবিম্ব তৈরির ব্যাপার ঘটে তা নয়। প্রতিসরিত রশ্মিগুলো মিলিত হয়েও প্রতিবিম্ব গঠিত হতে পারে। আগেই বলেছি, প্রতিসরণ মানেই আলো চলাচলের মাধ্যম পরিবর্তিত হওয়া, যার ফলে আলোর বেগ এবং দিক দুটোই পরিবর্তিত হয়। আমরা যে চশমা ব্যবহার করি, তা আসলে আলোর প্রতিসরণ ঘটানোর জন্য। চশমায় যে লেন্স ব্যবহার করা হয়, সেটি যদি উত্তল বা অভিসারী লেন্স হয়, তাহলে কোনো বস্তু থেকে আসা আলোর রশ্মিগুলো লেন্সের ভেতর দিয়ে ঢুকে (অর্থাৎ প্রতিসরিত হয়ে) একটা বিন্দুতে মিলিত হবে এবং আমরা ওই বস্তুটিকে দেখতে পাব। অবতল বা অপসারী লেন্স হলেও একই ঘটনা ঘটবে, তবে প্রতিবিম্বটি গঠিত হবে উল্টো দিকে। সে জন্যই যাঁরা দূরের জিনিস দেখতে পান না আর যাঁরা কাছের জিনিস দেখতে পান না, তাঁদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের লেন্স ব্যবহারের ব্যবস্থাপত্র দেন চক্ষুবিশেষজ্ঞরা।

বৃষ্টির পর যে রংধনু দেখা যায় তার কারণও এই প্রতিফলন-প্রতিসরণ এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয় আলোর বিচ্ছুরণ বৈশিষ্ট্য। আলো এসে যখন বৃষ্টির ফোঁটার ওপর পড়ে, তখন কিছুটা প্রতিফলন হয় আর বাকিটা প্রতিসরিত হয়ে ফোঁটার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফোঁটার যে প্রান্ত দিয়ে আলো প্রবেশ করে তার অপর প্রান্তে পৌঁছালে সেখান থেকে কিছু অংশ আবার প্রতিফলিত হয়ে প্রবেশ-প্রান্তে ফিরে আসে। বাকি অংশ অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিসরণ ঘটে। যে অংশটা ফোঁটার অভ্যন্তরে প্রতিফলিত হলো, সেটা আবার প্রবেশ-প্রান্তে ফিরে এলে ফের প্রতিফলন-প্রতিসরণের ঘটনা ঘটে। বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে এভাবে প্রতিফলিত-প্রতিসরিত হতে হতে আলো নানা রঙে বিশ্লিষ্ট হয়, যেমনটি হয় প্রিজমের ভেতর দিয়ে আলো পাঠালে। এই রংগুলোই একটা বৃত্তচাপের আকার ধারণ করে আকাশে দেখা দেয়। একটা মজার ব্যাপার হলো, রংধনু সব সময়ই দেখা যায় সূর্যের বিপরীত দিকে। আর সে জন্যই সকালের রংধনু দেখা যায় পশ্চিম আকাশে আর বিকেলের রংধনু ওঠে পুব আকাশে। আরেকটি মজার ব্যাপার আছে। রংধনুতে লাল রংটি থাকে বৃত্তের বাইরের দিকে, বেগুনি থাকে ভেতরের দিকে। কিন্তু কখনো যদি আকাশে দুটো রংধনু একসঙ্গে দেখা দেখা যায়, তাহলে দ্বিতীয়টিতে রঙের সন্নিবেশ ঘটে ঠিক উল্টোভাবে। মানে লাল রং থাকবে ভেতরের দিকে, বেগুনি থাকবে বাইরের দিকে।

আকাশ নীল দেখায় আলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য বিক্ষেপণের কারণে। আমাদের বায়ুমণ্ডলে যে গ্যাসীয় অণুগুলো আছে (অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি), সেগুলোর দ্বারা আলোর বিক্ষেপণ ঘটে। আমরা জানি, সূর্যের সাদা আলোতে সাতটি রং আছে, সংক্ষেপে সেটিকে বেনীআসহকলা বা ঠওইণেঙজ বলে। বেনীআসহকলা মানে বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লাল । এর মধ্যে বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম আর লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি।

লর্ড র্যালে নামের একজন বিজ্ঞানী দেখিয়েছিলেন, কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর বিক্ষেপণ ঘটে সবচেয়ে বেশি। ফলে আলো এসে যখন গ্যাসীয় অণুগুলোতে পড়ে, তখন নীল রঙের আলো লাল রঙের আলোর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি বিক্ষেপিত হয়। আর আমরা সেই রংটিকেই দেখি।

সত্যি বলতে কি, আকাশ বলে আসলে কিছু নেই। আমরা যা দেখি তা হলো আলোর রং। এও আলো আর রঙের খেলা। একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর বিক্ষেপণ যদি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আকাশ বেগুনি দেখি না কেন? কেন নীল দেখি? এর কারণ একাধিক। প্রথমত, সূর্যের সাদা আলোতে সব রঙের আলো যে সমপরিমাণে আছে, তা নয়; বেগুনির চেয়ে নীল রঙের আলো বেশি থাকে। দ্বিতীয়ত, বেগুনি রঙের আলো বায়ুমণ্ডলে বেশিমাত্রায় শোষিত হয়। তৃতীয়ত এবং প্রধানত, আমাদের চোখের বৈশিষ্ট্য। আমাদের চোখ বেগুনি রঙের চেয়ে নীল আলোর প্রতি বেশি সংবেদনশীল। ফলে সব মিলিয়ে নীলটিই আমাদের চোখে পড়ে। তবে যেভাবে বললাম, ব্যাপারটা তার চেয়ে আরেকটু জটিল। আগেই বলেছি, আমাদের রেটিনায় আছে তিন ধরনের রংগ্রহীতা কোন (পড়হব)। এই কোনগুলো আসলে খুব ক্ষুদ্র আকারের কোষ, যা আলোতে সাড়া দেয়। আমাদের চোখে প্রায় ৬-৭ মিলিয়ন কোন আছে, যারা জমা হয়ে আছে রেটিনার শূন্য দশমিক ৩ মিলিমিটার স্পটের মধ্যে। কোনগুলো আবার একই রকম নয়। প্রায় ৬৪ ভাগ কোন লাল আলোতে উদ্দীপ্ত হয়, এক-তৃতীয়াংশ উদ্দীপ্ত হয় সবুজ আলোতে, মাত্র দুই ভাগ উদ্দীপ্ত হয় নীল আলোতে। তবে নীল আলোর প্রতি উদ্দীপনা অন্য আলোর চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। সূর্যের সাদা আলো তো আমাদের বায়ুমণ্ডলে এসে বিক্ষেপিত হয়। আমরা যখন ওপরের দিকে তাকাই, তখন লাল-গ্রহীতা কোনগুলো বিক্ষেপিত লাল রঙে উদ্দীপ্ত হয়, তবে তা অল্প পরিমাণে। যেহেতু লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, তার বিচ্ছুরণ কম, সে কথা তো আগেই বলেছি। কমলা বা হলুদ রঙের প্রতি এই সাড়া হয় আরও কম। নীল-গ্রহীতা কোনগুলো বিক্ষেপিত নীল রঙের আলোতে উদ্দীপ্ত হয় এবং এর পরিমাণ হয় বেশি, আগেই বলেছি, নীল আলো বেশি বিক্ষেপিত হয়। যদি বেগুনি ও ইনডিগো না থাকত তাহলে এই সাড়ার কারণে আকাশকে দেখাত খানিকটা সবুজাভ নীল। বেগুনি ও ইনডিগো যেহেতু তীব্রভাবে বিক্ষেপিত হয়, তাই তারা চোখের নীল-গ্রহীতাকে তো বটেই, লাল-গ্রহীতাকেও খানিকটা প্রভাবিত করে। এ রকম একটা জটিল প্রক্রিয়া শেষে সব মিলিয়ে দেখা যায় লাল এবং সবুজ-গ্রহীতা কোনগুলো প্রায় সমানভাবে উদ্দীপ্ত হয়, কিন্তু নীল উদ্দীপ্ত হয় আরও তীব্রভাবে। এই সম্মিলিত উদ্দীপনার ফলে আকাশকে আমরা ঠিক গাঢ় নীল রঙে দেখি না, দেখি যাকে বলে আসমানি নীল রঙে। বুঝতেই পারছেন, আলো সর্বদা কী এক মজার খেলা খেলে যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা