জেগে উঠছে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার

সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি উল্টেপাল্টে ঠিক করে রাখলে পরে রাজকন্যার ঘুম ভাঙবে। রাজপুত্রের উদ্দেশ্যও ছিল সেটা। সে জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়া থেকে শুরু করে রাক্ষসদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া, কোনোটাতেই তার আপত্তি ছিল না। বাস্তবতা কখনো কখনো রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারকে (LHC) জাগিয়ে তোলার জন্য বিজ্ঞানীরা দিনরাত খাটছেন, রাক্ষসদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সঙ্গে যার খুব বেশি পার্থক্য নেই!

২০১২ সালে এই এলএইচসির হাত ধরেই হিগস–বোসন আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রমাণ মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্নের। তবে এখনো সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজ মেলেনি। বর্তমানে প্রমাণিত স্ট্যান্ডার্ড মডেল প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের তিনটিকে—বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল এবং সবল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল—একীভূত করতে পারলেও, মহাকর্ষ এখনো আলাদাই রয়ে গেছে। তা ছাড়া বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের কণা ফোটন, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের কণা গ্লুয়ন এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের কণা W-, W+ এবং Z0 আবিষ্কৃত হলেও, বিজ্ঞানীদের ধারণাকৃত মহাকর্ষ বলের কণা গ্র্যাভিটন এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যোগ হয়েছে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু।

পুরো মহাবিশ্বে বর্তমানে যে পরিমাণ মহাকর্ষ আছে, তার মাত্র ১০ শতাংশ আমাদের জানা পদার্থের জন্য সৃষ্টি হয়। বাকি ৯০ শতাংশই হয় অজানা কিছুর জন্য। আমরা জানি না, জিনিসটা কী, সেটা কেমন কিংবা কীভাবে কাজ করে। জিনিসটা যা-ই হোক, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, একটা কিছু অবশ্যই আছে। যেহেতু জিনিসটি লুকিয়ে আছে, এখনো ধরা দেয়নি, কিন্তু এটি মহাকর্ষ সৃষ্টি করতে পারছে (এবং মহাকর্ষ সাধারণত পদার্থের জন্যেই সৃষ্টি হয়), সে জন্যই এর নাম দেওয়া হয়েছে গুপ্তবস্তু বা ডার্ক ম্যাটার।

এসব সমস্যার সমাধান পেতে হলে আমাদের এমন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে হবে, যেটি চারটি বলকেই একীভূত করতে পারবে, ব্যাখ্যা করতে পারবে মহাবিশ্বের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা গুপ্তবস্তুর রহস্য। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সবকিছুর সেই তত্ত্ব হবে সুপারসিমেট্রিক স্ট্রিং থিওরি, সংক্ষেপে সুপারস্ট্রিং থিওরি। তবে এই তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য নতুন এক ধরনের কণার অস্তিত্ত্ব প্রমাণ করতে হবে। এর নাম টুইন পার্টিকেল। তাত্ত্বিক হিসাব বলছে, এই টুইন কণারা বেশ ভারী এবং অদৃশ্য প্রকৃতির হবে। এবং এরা সহসা আমাদের জানা পদার্থদের সঙ্গে আমাদের জানা কোনো উপায়ে মিথস্ক্রিয়া করবে না (মহাকর্ষ সৃষ্টি করা ছাড়া)। হয়তো, এরাই সেই গুপ্তবস্তুর কণা। মহাবিশ্বের ৯০ শতাংশ ভরের পেছনে হয়তো এরাই কলকাঠি নাড়ছে। তবে, এই কণাদের শনাক্ত করার জন্য প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োজন।

এলএইচসি মূলত ১৪ টেরা ইলেকট্রন ভোল্ট (TeV) শক্তি উৎপন্ন করার জন্য বানানো হয়েছিল। (বলে রাখা ভালো, ১ ভোল্ট বিভব পার্থক্যের ফলে ইলেকট্রনের মধ্যে ত্বরণ (বা মন্দন) সৃষ্টি হলে ইলেকট্রন যতটুকু গতিশক্তি পায় (বা হারায়), তা-ই ১ eV।) কিন্তু ২০০৮ সালে ঘটে যাওয়া মারাত্মক এক দুর্ঘটনার ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই প্রকাণ্ড যন্ত্রটিতে ৮ TeV–এর বেশি শক্তি উৎপন্ন করা হয়নি। আসলে, দুটি সুপারচার্জিং চুম্বকের মধ্যকার বৈদ্যুতিক সংযোগে একটুখানি ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। ফলে মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয় এবং চুম্বকগুলো তাদের সুপারচার্জিং ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ সময় সেখানে প্রবল এক বিস্ফোরণ হয়, এবং তা জমানো ছয় টন হিলিয়ামের মধ্যে গিয়ে আঘাত করে। তখন যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, সেটি সারিয়ে তুলতে সময় লেগে গিয়েছিল এক বছর। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫২ মিলিয়ন ডলার।

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। রাক্ষসদের সঙ্গে রাজপুত্রের পাল্লা দেওয়ার দশাই হয়েছে বিজ্ঞানীদের। সে জন্যই বিজ্ঞানীরা প্রথম দফা কাজের সময় (২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত) ৮ TeV–এর বেশি শক্তি আর উৎপন্ন করেননি। কিন্তু এখন সেটা করা লাগবে। যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে এত দিন সেই প্রস্তুতিই নেওয়া হয়েছে। সেই প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলার আগে একটুখানি বুঝে নেওয়া যাক, এলএইচসি আসলে কীভাবে কাজ করে।

মূলত আর্নেস্ট লরেন্স এবং রল্ফ ওয়েইডেরো নামের দুজন বিজ্ঞানী কণা-ত্বরক যন্ত্রের মূল আইডিয়া দিয়েছিলেন। সহজ ভাষায় ব্যাপারটা এমন—

তুলনামূলক কম ত্বরণের ভোল্টেজ দিয়ে কোনো কণাকে একটু পরপর কয়েকবার ধাক্কা দিলে কণাটির ত্বরণ হবে। অর্থাৎ প্রতিবার ধাক্কা দিলে এর বেগ বেড়ে যাবে। ওয়েইডেরোর পরীক্ষায় দেখা গেল, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র কণাদের সরল রেখায় ত্বরিত করে। এর পরের কাজটা করলেন আর্নেস্ট লরেন্স। চুম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে কণাদের ছোটার পথটাকে তিনি বৃত্তাকার পথে রূপ দিলেন। ফলে বৃত্তের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ধাক্কা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেই হবে। কণারা একই পথ ধরে বারবার ঘুরবে এবং প্রতিবার ধাক্কা খেয়ে তার ত্বরণ বাড়তে থাকবে।

কথা হচ্ছে, আপনি যদি দুটো কণাকে পরস্পরের দিকে ছুড়ে দেন, সংঘর্ষ করার চেয়ে এদের আসলে মিস করার সম্ভাবনা বেশি। তাহলে উপায়?

আবারও ওয়েইডেরো এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, যদি অনেকগুলো কণাকে কোনোভাবে একত্রে সংরক্ষণ করে রেখে দিতে পারেন এবং প্রয়োজনমতো সময়ে এই দুই তীব্র রশ্মিকে (অনেকগুলো কণা গুচ্ছাকারে একসঙ্গে মিলে রশ্মি তৈরি করে) পরস্পরের দিকে ছুড়ে দেন, তাহলে পরস্পরের বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা রশ্মির মধ্যেকার কিছু কণার মধ্যে হলেও সংঘর্ষ ঘটবে। বানানো হলো বিশাল ‘সংরক্ষণাগার রিং’। চুম্বক ব্যবহার করে বানানো এই রিংগুলোতে চৌম্বকক্ষেত্র ইলেকট্রনের পথকে বাঁকিয়ে দেবে। ফলে ইলেকট্রন রিংয়ের মধ্যে বৃত্তাকার পথে ঘুরবে। দুটো রিংয়ের একটায় ইলেকট্রন ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আরেকটার মধ্যে ঘুরবে এর বিপরীত দিকে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু করা লাগবে না। চৌম্বকক্ষেত্রের দিকটুকু উল্টে দিলেই হবে। কী সহজ না!

এলএইচসিও এভাবেই কাজ করে। পার্থক্য বলতে, এলএইচসিতে ইলেকট্রন নয়, প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। প্রোটনরা হলো হ্যাড্রন প্রজাতির কণা। সে জন্যই এই কণা–ত্বরক যন্ত্রটির নাম রাখা হয়েছে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার। এর মধ্যকার প্রতিটা চুম্বক দৈর্ঘ্যে ১৬ মিটার লম্বা এবং ৯ মিমি প্রস্থ ধরে বাঁকানো। এভাবে সব কটি চুম্বকের একটা পুরো সেট একসঙ্গে মিলে তৈরি করে ২৭ কিমি পরিধির একটি বৃত্ত। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এলএইচসির পরিধি হচ্ছে ২৭ কিমি।

নতুন করে এলএইচসিকে জাগিয়ে তোলার আগে প্রস্তুতি হিসেবে বিজ্ঞানীরা চুম্বকগুলোর মধ্যে ১০ হাজার নতুন বৈদ্যুতিক কাপলিং লাগিয়েছেন। যথাসম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সার্নে কর্মরত বিজ্ঞানীরা জানান, শুধু সফটওয়্যার এবং কম্পিউটারের হাতে তাঁরা এই বিশাল কণা-ত্বরকটির নিরাপত্তা ছেড়ে দিতে রাজি নন। কোনো দুর্ঘটনা যদি ঘটেই যায়, সঙ্গে সঙ্গে যেন যন্ত্রটা বন্ধ করে দেওয়া যায়, সে জন্য ম্যানুয়্যাল বা হাতে হাতে পুরো এলএইচসি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আগেই বলা হয়েছে, প্রতিবারে যখন এ ক্ষেত্রে প্রোটনদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়, তখন একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ প্রোটন ছুড়ে দিতে হয়, যেন তারা ঠিকভাবে সংঘর্ষ করতে পারে। আসলে যথাসম্ভব ঘনভাবে প্রোটনদের একসঙ্গে প্যাকেট করে ছুড়ে দিলেও, পারমাণবিক হিসাব করলে, এক প্যাকেটের মধ্যেকার প্রোটনগুলোর মধ্যেও বেশ বড়সড় একটা দূরত্ব রয়েই যায়। সেই হিসাবে ছুড়ে দেওয়া প্রোটনের কেবল ১ শতাংশ সংঘর্ষ করে। তারপরও বিশাল এই কণা-ত্বরক যন্ত্রে প্রতি সেকেন্ডে বিলিয়নখানেক করে সংঘর্ষ ঘটে। কথা হলো, এত তথ্য ধরে রাখার উপায় কী?

সার্ন নিজে মোটামুটি কয়েক শ পেটাবাইট তথ্য ধরে রাখতে পারে। ১ পেটাবাইট মানে ১০ লাখ গিগাবাইট। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হয় না। কারণ, প্রতিমুহূর্তে মিলিয়ন মিলিয়ন বাইট তথ্য যুক্ত হয়েই চলেছে। এত তথ্য সার্ন একা ধরে রাখতে পারে না। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ১০০–এরও বেশি গবেষণা সংস্থা সার্নকে তাদের স্টোরেজ দিয়ে সাহায্য করে। এবং এসব তথ্য পৃথিবীর দুটো ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদা করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। যাতে এক জায়গার সবকিছু নষ্ট হয়ে গেলেও আরেক জায়গায় ব্যাকআপ হিসেবে সব পাওয়া যায়। এই স্টোরেজগুলো সার্নের সঙ্গে ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল দিয়ে যুক্ত। কিন্তু অন্তর্জাল নিজেও যেহেতু বিশাল সব ফাইবার অপটিক কেব্‌ল দিয়ে যুক্ত এবং টর্নেডো, ভূমিকম্প ইত্যাদি ভয়াবহ কোনো দুর্যোগে এই কেব্‌ল যেকোনো সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে, সে জন্যেই এই ব্যাকআপ ব্যবস্থা। তারপরও ‘কিন্তু’ রয়েই গেছে।

এলএইচসিতে ডিটেক্টর আছে মোট চারটি। সব কটিই বিশাল। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটার ভরই হচ্ছে ৫ হাজার ৬০০ টন। তারপরও এত এত সংঘর্ষের সব কটির তথ্য এরা ধরে রাখতে পারে না। প্রতি সেকেন্ডে ১ বিলিয়ন সংঘর্ষের মধ্যে মাত্র ১০০০টা সংঘর্ষের তথ্য সে ধরে রাখতে পারে। এখন এই ১০০০টা বাছাই করার উপায় কী?

বেশির ভাগ সংঘর্ষের সময়ই আসলে সাধারণ কণা উৎপন্ন হয় (এবং এটাই স্বাভাবিক)। অর্থাৎ একমাত্র উপায় হচ্ছে, এমন সব সফটওয়্যার এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্র তৈরি করা লাগবে, যারা সাধারণ কণা ছাড়া, বিচিত্র কিছু উৎপন্ন হলে সেটা বুঝতে পারবে। সে জন্য তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ফলে কী উৎপন্ন হচ্ছে, সেটা দেখতে হবে এবং আমাদের জানা কিছুর সঙ্গে না মিললে সেটা সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। সে জন্য আবার উল্টো দিকে হিসাব করতে হয়।

একটা উদাহরণ দিলে জিনিসটা বোঝা যাবে। দুটো গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে জিনিসগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও, ধ্বংসাবশেষ দেখে, হিসাবনিকাশ, সিমুলেশন ইত্যাদি ব্যবহার করে জিনিসগুলো আগে কী ছিল বা কী রকম ছিল, সেটা ঠিকই বোঝা সম্ভব। এখানেও বিজ্ঞানীরা তা-ই করেন।

তবে আসলেই কী ঘটেছে, সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অ্যাটলাস এবং সিএমএস নামে ভিন্ন দুই ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয় এলএইচসিতে। ডিটেক্টরগুলো ‘তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ফলে কী উৎপন্ন হচ্ছে’—সেটাই হিসাব করে। কিন্তু এদের কর্মপদ্ধতি আলাদা। অ্যাটলাস ক্ষয়ের ফলে উৎপন্ন অনেকগুলো ভগ্নাংশ নিয়ে একই সঙ্গে কাজ করে। আর সিএমএস সময়ের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে ধারাবাহিকভাবে পুরো ব্যাপারটা হিসাব করে ফলাফলে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। ডিটেক্টরগুলো আলাদাভাবে কাজ করেও যদি একই ফলাফলে পৌঁছায়, তখন বিজ্ঞানীরা ধরে নেন, ফলাফল ঠিক আছে। ২০১২ সালে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই হিগস-বোসন আবিষ্কৃত হয়েছে।

অনেকেই হয়তো ভেবেছেন, অনেকগুলো সাদা-কালো কণার ঝাঁকে একটা লাল রঙের কণা যেমন চোখে পড়ে যায়, বিজ্ঞানীরা তেমনিভাবে হিগস কণা দেখেছিলেন। আসলে তা নয়। বিজ্ঞানীরা প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, ধ্বংসাবশেষ দেখে বুঝেছেন, এখানে হিগস কণা তৈরি হয়েছিল। এভাবেই টুইন পার্টিকেল শনাক্ত করার পরিকল্পনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। ঠিক কীভাবে সেটা করা হবে, তা জানার আগে টুইন পার্টিকেল কী তা একটুখানি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কণাদের কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট নামে একটা অবস্থার কথা বলে। এ অবস্থায় দুটো করে কণা বিচিত্র এক উপায়ে একসঙ্গে যুক্ত থাকে। এদের কোনো একটিকে শনাক্ত করার আগে কণাদ্বয়ের যেকোনোটি যেকোনো অবস্থায় থাকতে পারে। সহজ উদাহরণ হিসেবে আমরা জিনিসটা এভাবে ভাবতে পারি যে একটা আবদ্ধ বাক্সে একটা লাল আর একটা সবুজ বল আছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, বাক্স খোলার আগে বল দুটি একই সঙ্গে সবুজ এবং লাল (অর্থাৎ কোনটা কোন রঙের, তা আগে থেকে বলার উপায় নেই)। যখনই একটা বলের রং ‘সবুজ’ বলে জানা যাবে, সঙ্গে সঙ্গে অন্যটির রং হয়ে যাবে লাল। এবং এই ব্যাপারটার জন্য বল দুটো একসঙ্গে থাকারও কোনো দরকার হয় না।

ধরা যাক, কেউ একজন আবদ্ধ বাক্স খুলে, চোখ বন্ধ করেই বল দুটোর একটা পকেটে ভরে ফেলে আবারও বাক্সটার ঢাকনা বন্ধ করে দিল। এবং পকেটের বলটা কী রঙের—সেটা না দেখেই বাংলাদেশ থেকে বিমানে করে কানাডা চলে গেল। এখন বাংলাদেশে রয়ে যাওয়া বাক্সটা খুলে আপনি দেখলেন, বাক্সের ভেতরের বলটা সবুজ। ঠিক যেই মুহূর্তে আপনি এটা দেখবেন, তখনই তার পকেটের বলটা হয়ে যাবে লাল। এর আগ পর্যন্ত তার পকেটের বল এবং বাক্সের ভেতরের বল দুটোর কোনটা কী রঙের—এ নিয়ে আমরা কিছুই বলতে পারব না। এখানে উদাহরণ দেওয়ার জন্য ‘বল’ এর কথা বলা হয়েছে। বল যেহেতু পরমাণুর চেয়ে অনেক অনেক গুণ বড়, তাই এ ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আসলে খাটে না। কিন্তু পরমাণুর চেয়ে ছোট কণাদের কোয়ান্টাম জগৎ আসলেই বড় অদ্ভুত। বিজ্ঞানীরা হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে এ রকমটা আসলেই হয়! তবে আমাদের বিশাল এই জগতের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এই ব্যাপারটা অনুভব করা বেশ কঠিন।

সব কণারই টুইন কণা আছে। তা সেটা পদার্থের কণাই হোক, আর শক্তি। পদার্থের কণাদের টুইন কণাদের নামকরণ করার সময় নামের সঙ্গে একটা ‘এস’ যুক্ত হয়। যেমন: ইলেকট্রনের টুইন কণা এস-ইলেকট্রন কিংবা কোয়ার্কের টুইন কণা এস-কোয়ার্ক। আর শক্তি বা বলবাহী কণাদের নামের শেষের ‘টন’ এর জায়গায় ‘টিনো’ যুক্ত হয়। যেমন: ফোটনের টুইন কণা ফোটিনো কিংবা গ্লুয়নের টুইন কণা গ্লুইনো।

যা–ই হোক, টুইন কণাদের যেহেতু সরাসরি দেখা যায় না, তাই তাদের শনাক্ত করতে হয় শক্তির পরিবর্তন (আরও সঠিকভাবে বললে, শক্তির অনুপস্থিতি) দেখে। প্রোটনের ঝাঁকের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ ঘটালে সাধারণত যেসব কণা তৈরি হয় এবং যেটুকু শক্তি আলো হিসেবে বেরিয়ে যায়—সে রকম না হয়ে যদি বিপুল পরিমাণ শক্তি মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যায়, তাহলে বোঝা যাবে, এই শক্তি নিশ্চয়ই অন্য কোনো কাজে খরচ হয়েছে। কাজটি আর কিছু নয়, ভরশক্তির রূপান্তরের পেছনের রেসিপি E = mc2 ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে প্রোটনের অদৃশ্য টুইন পার্টিকেল।

সেই ২০১২ সালে হিগস কণা আবিষ্কৃত হয়েছে। এত দিন পর এসে অনেকের কাছেই এটি পুরোনো খবরে পরিণত হয়েছে। কিন্তু হিগস কণা নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। টুইন পার্টিকেল শনাক্ত করার কাজে হিগস কণার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে মনে করছেন তাঁরা। কারণটা সহজ।

একটু আগেই বলেছি, কণা সাধারণত দুই ধরনের হয়। পদার্থের কণা আর বলবাহী কণা। আসলে পদার্থের (মানে, যাদের ভর আছে) যত ধরনের কণা আছে, তাদের সবার ভরের জন্য দায়ী এই হিগস কণা। তার মানে, কোনো কিছুর ভর থাকলে সে জন্য মহাকর্ষ যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি হিগসের সঙ্গে তার কোনো ধরনের সম্পর্ক অবশ্যই থাকবে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। অন্তত তাত্ত্বিক হিসাব তা-ই বলে। এদিকে, হিগস নিজেও যেহেতু ভরবিশিষ্ট কণা, ফলে তার নিজেরই ‘হিগসিনো’ নামে এক ধরনের টুইন কণা থাকার কথা। বিজ্ঞানীরা মূলত এই টুইন কণাগুলোকেই শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন। যদি এদের কোনোভাবে শনাক্ত করা যায়, তাহলে অন্যান্য টুইন কণাকে আলাদা আলাদা করে শনাক্ত করার কথা বরং পরে ভাবা যাবে। কিন্তু তত দিনে আমরা নিশ্চিত হয়ে যেতে পারব, টুইন কণাদের অস্তিত্ব আসলেই আছে।

যদি ১৩ TeV–তেও টুইন কণাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করা না যায়, তাহলেও ‘তাদের অস্তিত্ব নেই’—এমনটা বলা যাবে না। হয়তো তাদের শনাক্ত করার জন্য আরও বেশি শক্তির প্রয়োজন হতে পারে। সেই লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা আবারও কাজে নামবেন। চেষ্টা করবেন সত্য উদঘাটনের। এখন কেবল অপেক্ষা।

সূত্র: সায়েন্স ইলাস্ট্রাটেড