তবে কি পাওয়া গেল পঞ্চম বলের সন্ধান?

পঞ্চম আরেকটি মৌলিক বলের সম্ভাব্য চিহ্ন শনাক্ত করেছেন বলে ধারণা করছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। বলে রাখা প্রয়োজন, পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত মডেল অনুযায়ী প্রকৃতিতে ৪ ধরনের মৌলিক বল আছে। মহাকর্ষ, তড়িৎচৌম্বক বল, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বল।

মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বলের মধ্যবর্তী আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলে। এটি আমাদের খুবই পরিচিত। মৌলিক বলগুলোর মধ্যে মহাকর্ষ বল সবচেয়ে় দুর্বল। এর পাল্লা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। পাল্লা মানে, যে সীমার মধ্যে একটা বল কাজ করতে পারে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বলে, মহাকর্ষ আসলে বল নয়। বস্তুর ভর এবং শক্তির জন্য স্থান-কালের বেঁকে যাওয়ার ফলে কম ভারী বস্তু বেশি ভারী বস্তুর দিকে বক্র স্থান-কালের মধ্য দিয়ে পড়তে থাকে। এই পড়তে থাকার ব্যাপারটিই মহাকর্ষ। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, গ্রাভিটন নামের একটি কণা এই বলের বাহক। তবে, এই কণাটি আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

এদিকে, দুটি চার্জিত বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলকে বলে বিদুৎ-চুম্বকীয় বল। এই বলের বাহক হচ্ছে আলোর কণা ফোটন। এই দুটি বল আমাদের বেশ পরিচিত। দৈনন্দিন জীবনে এদের ব্যবহার যেমন নিয়মিত চোখে পড়ে, তেমনি স্কুল-কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বইতে এই বল দুটি নিয়ে বিস্তারিত পড়ানোও হয়।

বাকি দুটি বলের মধ্যে প্রথমে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের কথা বলা যাক। এটির পাল্লা খুবই অল্প, কিন্তু শক্তি প্রচণ্ড। এই বলের কারণেই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যকার প্রোটনেরা পরষ্পর বিকর্ষণ করলেও, নিউক্লিয়াস ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে না। এই বলের বাহক কণার নাম গ্লুয়ন। আর, নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল খুবই দুর্বল। আসলে, এটি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল থেকে প্রায় ট্রিলিয়ন গুণ দুর্বল, তবে মহাকর্ষের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। পরমাণুর তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের পেছনে এই বল দায়ী। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস ক্ষয় হয়ে, সেখান থেকে যে বিটা ইলেকট্রন বের হয়, তার কারণ এই দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। এই বলের বাহক কণা ৩টি—W+, W এবং Z0

পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে শক্তিশালী ও মূলত দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের একটি চমৎকার উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আগেই বলেছি, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরের গাঠণিক উপাদানগুলোকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে ফেলে। সেই সঙ্গে এদেরকে আরো স্থায়ী কিছুতে পরিণত করে। এজন্যই সূর্যের ভেতরে, যেখানে জ্বালানী হিসাবে প্রোটন ব্যবহৃত হয়, এই বল ধীরে ধীরে চারটি প্রোটনকে এক করে একটি বান্ডেলে পরিণত করে, যার পেছনে আঠা হিসেবে কাজ করে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। তৈরি হয় হিলিয়াম নিউক্লিয়াস।

কিন্তু আমাদের পরিচিত হিলিয়াম নিউক্লিয়াস কি আসলে এরকম হয়? এর মাঝে তো দুটো প্রোটন আর দুটো নিউট্রন থাকার কথা! মূলত এই কাজটিই করে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল যখন চারটা প্রোটনকে একসঙ্গে বেঁধে বান্ডেলে পরিণত করে, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল তখন দুটো প্রোটনকে ধীরে ধীরে নিউট্রনে পরিণত করে ফেলে, সরিয়ে নেয় এদের ধনাত্মক চার্জকে, মানে, পজিট্রনকে। পাঁচ বিলিয়ন বছর ধরে সূর্যের ভেতরে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত প্রোটন এভাবেই পরিবর্তিত হয়ে পরিণত হচ্ছে নিউট্রনে।

এ থেকে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের শক্তির ব্যাপারে একটুখানি ধারণা পাওয়া যায়। পাশাপাশি বোঝা যায় দুর্বল নিউক্লিয়ার বল আসলে কতটা দুর্বল। সূর্যের কেন্দ্রের চুলার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে এটি এত সময় লাগিয়ে দেয় যে সূর্যের অর্ধেক জ্বালানী ক্ষয় হতে হতেই পেরিয়ে গেছে পাঁচ বিলিয়ন বছর। আমাদের অবশ্য সেজন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ। এই বল এত ধীরে কাজ করে দেখেই সূর্য এখনো টিকে আছে। আবার এই বল এতটুকু দ্রুত কাজ করে যে এর ফলে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগেই জীবনের উৎপত্তি হওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অবস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীতে।

পঞ্চম বলের সম্ভাব্য চিহ্নের কথায় ফিরি। মিউয়ন জি-২ নামের এই এক্সপেরিমেন্টটি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মি ন্যাশনাল অ্যাকসিলারেটর ল্যাবরেটরিতে (ফার্মিল্যাব)। যুক্তরাজ্যের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফ্যাসিলিটিজ কাউন্সিল বলছে, ‘এই এক্সপেরিমেন্ট থেকে পাওয়া প্রমাণ অনাবিষ্কৃত কোনো অতিপারমাণবিক কণা কিংবা নতুন আরেকটি মৌলিক বলের দিকে জোর ইঙ্গিত করছে।’ যদিও পরীক্ষণটির ফলাফল থেকে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

এমনকি এটি পরিসংখ্যানগত ভুলও হতে পারে। এই সম্ভাবনার মান ১/৪০,০০০। তবে বিজ্ঞানে কোনো কিছুকে নতুন আবিষ্কার বলে ঘোষণা দিতে হলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আরও অনেক কম হতে হয়। এর মান সর্বোচ্চ ১/৩.৫ মিলিয়ন হতে পারে। অর্থাৎ, সাড়ে তিন মিলিয়নের কেবল এক ভাগ পর্যন্ত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা হাতে রেখে কোনো ফলাফলকে নতুন আবিষ্কার বলে ঘোষণা দেওয়া যায়। এরচেয়ে বেশি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।

কথা হলো, মিউয়ন জি-২ এক্সপেরিমেন্টে আসলে কী পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা? এই এক্সপেরিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত যুক্তরাজ্যের প্রধান বৈজ্ঞানিক অধ্যাপক মার্ক ল্যাঙ্কেস্টার বিবিসি নিউজকে বলেন, ‘এ এক্সপেরিমেন্টে মিউয়নের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া দেখা গেছে, তা পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান প্রমিত মডেলের সঙ্গে মেলে না।’

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পরীক্ষাগারে চালানো বেশ কিছু গবেষণা এবং কিছুদিন আগে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের একটি একটি এক্সপেরিমেন্টও একই ইঙ্গিত দিয়েছে। ফার্মিল্যাবের এই পরীক্ষণটি এর মধ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করল।

মিউয়ন জি-২ নামের এই এক্সপেরিমেন্টটি মূলত মিউয়নদের বিভিন্ন আচরণ ও বৈশিষ্ট্য বোঝার উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে। মিউয়ন ইলেকট্রনের চেয়ে ২০০ গুণ ভারী এক ধরনের মৌলিক অতিপারমাণবিক কণা (মানে, পরমাণুর চেয়ে ছোট কণা)। ভর ছাড়া আর সবদিক থেকে এটি হুবহু ইলেকট্রনের মতোই। এর স্পিনও ১/২।

পরীক্ষণটিতে ১৪ মিটার দীর্ঘ একটি রিংয়ের ভেতরে মিউয়নদের ছুঁড়ে দেওয়া হয়। তারপর এর ওপর চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয়। চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করে অতিপারমাণবিক কণাদের গতিপথ বাঁকিয়ে দেওয়া যায়, তাদেরকে নির্দিষ্ট হারে কাঁপানো যায়, লাফালাফি করানো যায়। পদার্থবিজ্ঞানের প্রমিত মডেল অনুযায়ী এই পরীক্ষণে মিউওনদের যে হারে কাঁপাকাঁপি করার কথা, দেখা গেছে, মিউয়নগুলো তারচেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে কাঁপছে, লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই দ্রুত কাঁপাকাঁপি-লাফালাফির পেছনে কারিকুরি করছে পঞ্চম কোনো মৌলিক বল। এই বল এ ছাড়া আর কী করতে পারে বা এর বৈশিষ্ট্য কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে কিছুই জানেন না বিজ্ঞানীরা।

এদিকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের ধারণা, এর সঙ্গে নতুন ও অনাবিষ্কৃত কোনো অতিপারমাণবিক কণাও জড়িত থাকতে পারে। এই কণাটি কী ধরনের কণা হতে পারে, এ নিয়ে দুটো প্রস্তাবনা দিয়েছেন তারা। সে হিসাবে এটি হতে পারে লেপটোকোয়ার্ক বা Z বোসন।

যেসব হাইপোথেটিক্যাল কণা শুধু লেপটন ও কোয়ার্কের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, তাদের বলে লেপটোকোয়ার্ক। প্রশ্ন আসে, লেপটন ও কোয়ার্ক কী?

কোয়ার্ক একটি মৌলিক কণা। নিউট্রন, প্রোটনের মতো কণারা এই কোয়ার্ক দিয়েই গঠিত। বিজ্ঞানী মারে গেল-মান কোয়ার্ক আবিষ্কার করেন। মোট ছয় ধরনের কোয়ার্ক আছে। আপ, ডাউন, টপ, বটম, চার্ম এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক। এদের চার্জ হয় ভগ্নাংশে। আপ, চার্ম ও টপ—এই তিনটি কোয়ার্কের চার্জ ২/৩। আর, ডাউন, বটম ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্কের চার্জ -১/৩।

কোয়ার্কের মতোই লেপটনও একটি মৌলিক কণা। এদের স্পিন সবসময় ১/২ হয়। আমাদের বহুল পরিচিত ইলেকট্রন একটি চার্জিত লেপটন কণা।

আর, দ্বিতীয় হাইপোথেটিক্যাল Z বোসন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আসলে এটি দুর্বল-তড়িৎ বলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বলে রাখা ভালো, বিদ্যুৎ-চুম্বক বল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের একীভূত রূপকে বলা হয় তড়িৎ-দুর্বল বল।

পঞ্চম আরেকটি মৌলিক বল সত্যি সত্যি আবিষ্কৃত হলে বদলে যাবে পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান প্রমিত মডেল। নতুন করে লিখতে হবে অনেক কিছু। তবে এ নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা বরং খুশি ও আশাবাদী। অনেকের ধারণা, মহাবিশ্বের বিস্তৃতির হার সময়ের সঙ্গে যে বেড়ে যাচ্ছে, এর পেছনে আছে ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি। যদিও এটি আজও ধারণা পর্যায়েই আছে। এ রহস্যের কোনো সমাধান আজও হয়নি। হবে কীভাবে, ডার্ক এনার্জির দেখা পাওয়া গেলে তো! বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পঞ্চম এই বলের হাত ধরে হয়তো ধরা যাবে ডার্ক এনার্জিকে। ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক রহস্যের।

আসলেই কি তা-ই হবে? দেখা যাক!

লেখক: শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া