দুঁদে গোয়েন্দা নিউটন

স্যার আইজ্যাক নিউটন। তাঁকে চেনে না এমন মানুষ খুঁজে বের করতে দুঁদে গোয়েন্দা শার্লক হোমসকে ডেকে আনলেও খুব বেশি লাভ হবে না। নিউটনের প্রধান পরিচয় তিনি পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু কজন জানি নিউটন একজন দুঁদে গোয়েন্দাও ছিলেন? খুব কম লোকই জানে তাঁর অপরাধী পাকড়াওয়ের কথা

বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনকে চেনেন না এমন বোধ হয় কেউ নেই। তাঁকে চেনা ওই আপেলের গল্প দিয়ে। একদিন আপেলগাছের নিচে বসে ছিলেন। চিন্তামগ্ন। হঠাত্ গাছ থেকে একটা আপেল পড়ল। চিন্তাসূত্র ছিন্ন হলো। না, ভুল হলো। নতুন চিন্তায় ঢুকে গেলেন। সেই চিন্তার ফলাফল মাধ্যাকর্ষণ বা মহাকর্ষ তত্ত্ব আবিষ্কার। এই আবিষ্কারই তাঁকে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান করে দেয়। যদিও আপেল পড়ার গল্পটা যেভাবে আমরা শুনি সেটা ঠিক নয় বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু আমরা কজন জানি নিউটন একজন দুঁদে গোয়েন্দাও ছিলেন? খুব কম মানুষই জানি তাঁর অপরাধী পাকড়াওয়ের কথা।

১৬৯৬ সাল। তত দিনে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হয়ে গেছে। এর সুবাদে নামধাম কামিয়েছেন বেশ। পরিচিত-অপরিচিত সব মহলে খ্যাতিও পান। কিন্তু এই পরিচিতিকে থোড়াই কেয়ার করে চাকরি নিলেন রয়্যাল মিন্ট-এ। রয়্যাল মিন্ট হলো তখনকার ইংল্যান্ডের টাকা ছাপানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান টাওয়ার অব লন্ডনে। নিউটন দায়িত্ব নিলেন রয়্যাল মিন্টের প্রধান হিসেবে। মূলত দায়িত্ব ছিল কেউ যেন মুদ্রা নকল করতে না পারে, সেটা দেখা।

যে সময়ের কথা বলছি, তখন লন্ডনে টাকা জাল হওয়ার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। মোট টাকার ১০ শতাংশই নকল টাকা ছিল। বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। এ জন্য অনেক সরকারি কর্মকর্তা তদন্তে নেমে গিয়েছিলেন। এদিকে কেমব্রিজে বসে বসে বোরড হয়ে গিয়েছিলেন নিউটন। ঠিক করলেন, নকল টাকার পেছনের লোকদের ধরতে তিনি তদন্তে নামবেন। তাই চাকরি পেয়েই জোর তদন্তে নেমে পড়লেন।

তবে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীর গোয়েন্দা হওয়ার পেছনে যে মানুষটি দায়ী, তিনি হলেন উইলিয়াম চালোনার। চালোনারের জন্ম উইকশায়ারের একটি গ্রামে। পেরেক বানানোর কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে জীবন শুরু। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারলেন, মুদ্রা জাল করার দক্ষতা তাঁর রয়েছে। আর এই দক্ষতা নিয়েই তিনি ১৬৮০ সালে লন্ডনে পা রাখেন। বনে যান ভুয়া ওষুধবিক্রেতা। কিন্তু ঠগবাজিতে তিনি এত চতুর ছিলেন যে কেউ ধরতেই পারত না। পুলিশও কম চেষ্টা করেনি। ধরতে না পেরে পুরস্কারের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিল। তবে সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও নিউটনকে ফাঁকি দিতে পারেননি চালোনা। সেই গল্পটাই বলছি শুনুন।

টাওয়ার অব লন্ডন, একসময় রয়্যাল মিন্ট নামে পরিচিত ছিল

নিউটন তখনও রয়্যাল মিন্টের দায়িত্ব নেননি। এর আগের একটি ঘটনা। চালোনার বিচারক ও কাউন্সিল পরিষদে একটি চিঠি লিখলেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, মুদ্রা জাল করার কাজে মিন্টের লোকেরাই জড়িত। এ বিষয়ে তাঁর কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। চালোনারের দাবির কয়েক মাস পরে মিন্টের দায়িত্ব নিয়ে নিউটন লন্ডন এলেন। এসেই ৩০ জনের মতো সন্দেহভাজন ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাত্কার নেন। আর এ কাজে তিনি ব্যবহার করেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা তখনকার দিনে ছিল বিরল।

সে সময়ে জালিয়াত চক্রের কাউকে ধরতে পারলে সোজা চালান হয়ে যেত কোর্টে। আর বিচারে নির্ঘাত ফাঁসিদণ্ড পেত। তবে নিউটন ফাঁসিকাষ্ঠে তোলার ব্যাপারে অতটা উদ্গ্রীব ছিলেন না। কারণ, তাঁর কাছে তথ্যের মূল্য ছিল অনেক বেশি। তিনি জানতেন, ছিঁচকে অপরাধীদের ছেড়ে দিলে তারা আবার তাদের আগের কাজে ফিরে যাবে। আর তখন তাদের থেকে মিলবে মহামূল্যবান সব তথ্য। নিউটন এভাবে লন্ডনের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব তথ্য পাওয়ার একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে নিয়েছিলেন।

চালোনার ছিলেন লন্ডনের মুদ্রা জালিয়াতকারী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মুদ্রা জাল করেছেন। তাই তিনি একটি মোক্ষম খেলা খেললেন। দাঁড় করালেন এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। চিঠি লিখলেন মিন্টকে। তাতে আবদার করলেন, তিনি দায়িত্ব নিতে চান এর। খুঁজে বের করতে চান টাকাপয়সা যারা জাল করে, তাদের চৌদ্দগুষ্টিকে।

নিউটনের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে টমাস লিভেনসনের লেখা বই নিউটন অ্যান্ড দ্য কাউন্টারফেইটার

বিষয়টি নিয়ে নিউটন আর চালোনারের মধ্যে চলতে থাকল বিড়াল-ইঁদুর খেলা। সে খেলায় অবশ্য শেষে জিতেছিলেন নিউটনই। এর আগে অবশ্য জেল পলাতক চালোনার জনসাধারণের কাছে নিজের একটি চমত্কার ইমেজ দাঁড় করে নিয়েছিলেন। কারণ, মুদ্রা জাল করে তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছিলেন। খুব দামি জামাকাপড় পরতেন। নিজের গাড়িতে চলতেন। চিঠি লিখে, লিফলেট বিলি করে সবাইকে বলতে লাগলেন, তিনি মুদ্রা জালের বিষয়টির একটি সমাধান করতে পারবেন। তিনি ধাতব কাজের চমৎকার টেকনিক ব্যবহার করে এমন মুদ্রা বানাবেন, যা জাল করা সাধারণ অপরাধীদের পক্ষে অসম্ভব।

চালোনারের কথায় চিড়ে ভিজল। কর্তৃপক্ষ নিউটনকে আদেশ দিলেন, নমুনা তৈরি করতে চালোনারের যা যা দরকার, তা যেন সরবরাহ করা হয়। তবে নিউটন সেটা দিতে অস্বীকার করলেন। নিউটন চালোনারের পূর্ব ইতিহাস জানতেন। তবে তাঁর কাছে জোরালো প্রমাণ ছিল না। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন, চালোনার সুচ হয়ে ঢুকে মুদ্রা তৈরির যাবতীয় কিছু হাতিয়ে নেবেন, পরে যা তাঁকে আরও সহজে মুদ্রা জাল করার সুযোগ করে দেবে।

এর মধ্যেই এসে গেল সেই মোক্ষম সুযোগ। চরদের কাছ থেকে নিউটন খবর পেলেন, লন্ডন থেকে কয়েক মাইল দূরে চালোনারের গ্রামের বাড়িতে জাল মুদ্রা বানানোর কাজ চলছে। খবর পাওয়ামাত্রই ফোর্স নিয়ে ছুটলেন। হাতেনাতে ধরে ফেললেন চালোনারকে। মামলা উঠল আদালতে। তবে প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী পালিয়ে গেলেন স্কটল্যান্ডে। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। কারণ, গ্রেপ্তার করার আগে থেকেই নিউটন ১৮ মাস ধরে চালোনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ফলে ফাঁসিতে ঝুলতেই হয় চালোনারকে। ১৬৯৯ সালে মার্চের একদিন টাইব্রানে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নিউটন হলেন দ্য মাস্টার অব দ্য রয়্যাল মিন্ট। ১৭২৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: নিউটন অ্যান্ড দ্য কাউন্টারফেইটার: টমাস লিভেনসন

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত।