নিউক্লিয়ার শক্তি ও আইসোটোপ

সাত সুরে বাঁধা আমাদের বিশ্ব। সে মোজার্টের সিম্ফনিই হোক কিংবা বিসমিলস্নাহ খাঁর বাঁশি, সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি সপ্তকের বাইরে গিয়ে ওস্তাদি করার সাধ্য নেই কারও। হারমোনিয়ামে সুর তোলেন যিনি কিংবা বাবলা বনের ধারে ধারে যে রাখাল বাঁশের বাঁশরিতে লহরি তোলে, তাদের সবার ভাগ্য ওই সাত সুরে বাঁধা। যতটা রহস্যময় ভাবি আমরা, প্রকৃতি তার চেয়েও রহস্যময়। কোন্ আদি যুগে কোন্ শিল্পী ইতিহাসের প্রথম গান গেয়েছিলেন, সাত সুরের ক্যারিশমা হয়তো তিনি জানতে পারেননি। ধীরে ধীরে সভ্যতা এগিয়েছে, শিল্পীরা, বাদকেরা প্রকৃতির ভেতর থেকে সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনার মতো করে একে একে তুলে এনেছেন সাত-সাতটি স্বরলিপি। কত মহাজন এলেন-গেলেন, কতজন আসবেন অনাগত ভবিষ্যতে, সুরের লহরি থেকে একটি সুর বাদ দেওয়ার ক্ষমতা কারও অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও এই সাত সুরের সঙ্গে নতুন একটি স্বরলিপি যোগ করার ক্ষমতাও হবে না কারও।

দুই

বাদ্যযন্ত্র কিংবা গলার স্বর, প্রকৃতির এই নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম তো শুধু সুর আর বাদ্যযন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, মহাবিশ্বের মহাসংগীত আরও বড়, আরও বিশাল, আরও মায়াবী। সেই সুর বাঁধা আছে পদার্থবিদ্যার মেকানিজমে। আর গণিত নামের সর্বজনীন ভাষায় লেখা সেই সুর, যার শুরুটা হয়েছিল নিউটনের হাতে। আর পূর্ণতা দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। মাঝখানে তাপগতিবিদ্যার নায়কেরা, বিদ্যুত্গতিবিদ্যার পুরোধারা সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছেন দুই প্রজন্মের দুই মহানায়কের মাঝখানে। নিউটন প্রকৃতির সূত্রগুলোকে ছন্দোবদ্ধ করেছিলেন, ভাষা দিয়েছিলেন, সবশেষে গণিত নামের ঠুমরি আর গজলের দ্যোতনায় মোহিত করে রেখেছেন প্রকৃতিবিজ্ঞানের মর্মকথা। কিন্তু এই যে সাত সুরের মতো প্রকৃতিবিজ্ঞানের সূত্রগুলো, সেগুলো যে স্থান-কালের নিরিখে সব জায়গায় একই রকম হতে পারে, সে কথা আইনস্টাইন জানিয়েছিলেন গত শতাব্দীর প্রথম দশকেই। রিলেটিভিটির ভেতর থেকেই বিজ্ঞান নামের মহাসংগীতের স্বরলিপি তুলে এনে বলেছিলেন, আলোর গতি মহাবিশ্বের সব জায়গায় সব কাঠামোতে স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই মানে স্থির থাকে। তেমনি পদার্থবিদ্যার মৌলিক সূত্রগুলো স্থান-কাল-পাত্রভেদে মহাবিশ্বের সব জায়গায় একই আচরণ করে। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলো আপনি সমাধান করে পৃথিবীতে বসে বসে যে ফলাফল পাবেন, দুর্বার গতিতে চলা মহাকাশযানে বসেও একই ফল পাবেন। তার মানে, মহাবিশ্বের মহাসংগীতের দুটি অবিনশ্বর সুর আমরা পেলাম। যে সুর গণিতের সিম্ফনিতে বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কের নিউরনে মহাবিশ্বের মহাসংগীতের মতো লহরি তোলে। আইনস্টাইন বলেছিলেন, নিউটনের সূত্রগুলোর মান সব জায়গায় এক। কিন্তু সেগুলোর অনেক চেহারা আছে। কয়েকটির চেহারা চাইলেই আপনি পরিবর্তন করতে পারেন।

কিন্তু সাত সুরের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর কোনো হেরফের হবে না। এখানেই আসলে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। দশকের পর দশক পেরিয়েছে, বিজ্ঞানের স্বরলিপি নড়চড় হয়নি একটুও। সেই কবে তাপগতিবিদ্যার বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, মহাবিশ্বের এনট্রপি বাড়ছে। এ কথার যেমন নড়চড় হয়নি, শতাব্দী পেরিয়ে এসেও মহাবিশ্বের যেখানেই যে প্রান্তেই খোঁজ করুন, এনট্রপি কমছে এমনটা কোথাও পাবেন না।

তেমনি আরেকটি মূল সূত্র হলো শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি। এই নীতি বলে, মহাবিশ্বের মোট শক্তি সব সময় একই থাকবে। একে যেমন বাড়ানো যাবে না, তেমনি কমানোও যাবে না কিঞ্চিৎ পরিমাণ। তবে চাইলে আপনি এক ধরনের শক্তিকে রূপান্তর করে আরেক ধরনের শক্তিতে পরিণত করতে পারেন।

এই নীতি যুগে যুগে বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সূত্রটি বুক চিতিয়ে লড়াই করে ঊর্ধ্বে উড়িয়েছে নিজের জয়পতাকা। যাঁরা বলেছিলেন, কখনো কখনো সংরক্ষণশীলতা নীতি কাজ করে না, দেখা গেছে রণে ভঙ্গ দিয়ে তাঁরাই বারবার হার স্বীকারে বাধ্য হয়েছেন। পদার্থবিজ্ঞানে যখনই নতুন কোনো বৈপ্লবিক তত্ত্বের আবির্ভাব হয়, তখনই প্রশ্ন ওঠে শক্তি সংরক্ষণশীলতা ঠিকঠাক কাজ করছে তো?

ঠিক এই প্রশ্নই উঠেছিল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরপর। যেমনটা ঘটেছিল ইলেকট্রন আবিষ্কারের পরও।

রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত পরীক্ষাই গড়ে দিয়েছিল নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের ভিত
সংগৃহীত

তিন

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, ধর্মে-ভরে-চরিত্রে মহাবিশ্বের প্রতিটি ইলেকট্রন আসলে একই রকম। একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো পার্থক্য নেই। এটা বরং মূল সূত্র হিসেবে কাজ করে, এতে কোনো সমস্যা দেখা যায় না। সমস্যাটা আরেকটু গভীরে। ইলেকট্রনগুলো সব এক রকম দেখতে, কিন্তু পরমাণুগুলো সব এক রকম দেখতে নয়। এক মৌলের পরমাণুর সঙ্গে আরেক মৌলের পরমাণুর বিস্তর ফারাক। সে যেমন ভরের কারণে ফারাক, তেমনি চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অনেক তফাত। এর কারণ কী?

পরমাণুদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় এদের ভেতরকার ইলেকট্রন সংখ্যার ওপর। তার মানে পরমাণুটি লোহার নাকি নিকেলের, সেটা ঠিক করে দেয় এর ভেতরের ইলেকট্রনের সংখ্যা। একটা মৌলের জন্য তার পরমাণুতে ইলেকট্রন সংখ্যা নির্দিষ্ট।

কেমন হয় যদি একই মৌলের বিভিন্ন পরমাণু বিভিন্ন রকম হয়? প্রথম দিকে এটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল বিজ্ঞানীদের জন্য। কিন্তু আইসোটোপের ধারণা পোক্ত হওয়ার পর এ নিয়ে কারও আর দ্বিধা ছিল না।

গত শতাব্দীর শুরুর দিকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁরা কারা?

সে গল্প আগেই করেছি। তাঁদের মধ্যে রাদারফোর্ডের ভাবনা অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ছিল। তিনি নিউক্লিয়াসের সঙ্গে বিজ্ঞানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর পরমাণুবিষয়ক গবেষণার বেশির ভাগই ছিল নিউক্লিয়াসকেন্দ্রিক। নিউক্লিয়াসের আরও গভীরে সন্ধান করতে চেয়েছিলেন তিনি। কারণ, শক্তির সংরক্ষণশীলতার হিসাব মিলছিল না।

বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না এই শক্তি কোথা থেকে আসে? রন্টজেন বলেছিলেন, তেজস্ক্রিয় পদার্থ তাপ শোষণ করে, সেই তাপ বিকিরণ আকারে নির্গত হয়।

কিন্তু তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শুধু আলোর মতো ভরহীন, চার্জহীন হলে হতো। কিন্তু আলফা ও বেটা রীতিমতো ভর ও চার্জযুক্ত কণা। সুতরাং তাপ গ্রহণ করে আলফা বা বেটা কণা বিকিরণ করা রীতিমতো অসম্ভব মনে হলো বিজ্ঞানীদের কাছে।

শক্তির হিসাব মিলছিল না আরও এক জায়গায়। সেগুলো হলো আলফা ও বেটা কণার উচ্চ গতিশক্তিতে। এত উচ্চ গতিশক্তি কণারা পায় কোথা থেকে? মোট কথা, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শক্তির উত্স সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীরা আরেকটা ব্যাপারও লক্ষ করেছিলেন। ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে না। বরং দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখলেন, ইউরেনিয়ামে তেজস্ক্রিয় ক্ষয় চলতেই থাকে দিনের পর দিন। দীর্ঘসময় অবিরাম শক্তির জোগান কোথা থেকে আসে?

অনেকের কাছে ব্যাপারটা আজগুবি মনে হচ্ছিল। তাহলে কি শূন্য থেকেই ভূতের মতো শক্তির জন্ম হচ্ছে। নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আর সেই অন্য ব্যাপারটাই আবিষ্কার করেছিলেন রাদারফোর্ড।

তার আগে অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতিতে বোধ হয় গলদ আছে। হয়তো সময় এসেছে এটাকে ছুড়ে ফেলার। অনেকে আবার এতটা আগ্রাসী ছিলেন না। তাঁরা বললেন, শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি হয়তো সর্বজনীন নয়। সব ক্ষেত্রে এটাকে না মানলেও চলবে। কিন্তু একটা নীতি যখন বারবার প্রমাণ করেছে নিজেকে, একের পর এক পরীক্ষায়, তাতে কোনো খুঁত বের করা যায়নি, চাইলেই সেই তত্ত্বকে ছুড়ে ফেলা যায় না। আবার এর সর্বজনীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। সুতরাং একে রেখেই তেজস্ক্রিয়তার শক্তির হিসাব করতে হবে।

শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতিকে অমান্য না করেই রাদারফোর্ড চেষ্টা করেন এই সমস্যা সমাধানের। ১৯০৩ সালে তিনি বলেন, অলৌকিকভাবে নতুন শক্তির জন্ম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তেজস্ক্রিয় শক্তির নিশ্চয়ই একটা উত্স আছে। আর সেটা হলো পরমাণু। তার মানে পরমাণুর ভেতর থেকেই নির্গত হচ্ছে তেজস্ক্রিয় রশ্মি। অর্থাৎ পরমাণুর নিজস্ব শক্তি আছে। সেই শক্তির পরিমাণ বিশাল। সেখান থেকেই কিছু শক্তি বেরিয়ে আসছে তেজস্ক্রিয় রশ্মির আকারে।

রাদারফোর্ডের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা আছে। যদি পরমাণুই শক্তির উত্স হয়ে থাকে, তাহলে তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের ফলে পরমাণুর শক্তি ক্ষয় হবে। সেটা কি সম্ভব?

একবিংশ শতাব্দীতে এসে একজন স্কুলছাত্রও জানে, এটা সম্ভব। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিজ্ঞানীদের কাছে এটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। কারণ, পরমাণুর গঠন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের তখনো তেমন ধারণা ছিল না। পরমাণুকে স্রেফ একটা বস্তুকণাই মনে করতেন। বস্তুর ভেতরে শক্তি কীভাবে জমা থাকে, তা নিয়েও ছিল ধোঁয়াশা। কিন্তু সেই ধোঁয়াশা দূর করতে হাজির হলেন এক অখ্যাত ম্যাজিশিয়ান। তাঁর প্যান্ডোরার বাক্স থেকে একের পর এক বের করলেন অবিশ্বাস্য সব সত্য।

ফ্রেদেরিক সদি
সংগৃহীত

চার

১৯০৫ সালের কথা। আইনস্টাইন সর্বকালের অন্যতম সেরা পাঁচ-পাঁচটি বৈজ্ঞানিক পেপার লিখলেন, যার একটি হলো ভরশক্তির সমীকরণ নিয়ে লেখা। যে বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে বিসস্তারিত আলোচনা করেছি। সেই প্রবন্ধে আইনস্টাইন দেখান, ভর আর শক্তি আলাদা কিছু নয়। ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। ভরশক্তির যে সমীকরণ আইনস্টাইন দিয়েছিলেন, যাকে সর্বকালের সেরা বৈজ্ঞানিক সমীকরণ মনে করা হয়, সেই E=mc2 সমীকরণ থেকে দেখা যায়, খুব সামান্য ভরও যদি শক্তিতে রূপান্তর করা হয়, তাহলে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে। তাই পরমাণুর ভর যত সামান্যই হোক, এর ভেতর বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত থাকে। তার মানে ভর হলো শক্তির জমাট রূপ।

আইনস্টাইনের এই ভরশক্তির সমীকরণ দুই বছর আগে দেওয়া রাদারফোর্ডের তেজস্ক্রিয়তার উত্স সম্পর্কে দেওয়া মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।

তখন রাদারফোর্ড নড়েচড়ে বসেন এবং বলেন, নিশ্চয়ই পরমাণুতে ভাঙন ধরে যে শক্তি উত্পন্ন হয়, সেগুলোই তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্য দায়ী। কিন্তু এই শক্তি পরমাণুর কোথায় থাকে? তখনো পরমাণুর গঠন সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা স্পষ্টভাবে কিছু জানেন না। ইলেকট্রন আবিষ্কার হয়েছে পদার্থের ভেতর থেকে। সেই ইলেকট্রন কোথায় থাকে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল। কিন্তু নাগাওয়াকা আর টমসন বলেছিলেন, ইলেকট্রনেরা পরমাণুর ভেতরেই থাকে। কিন্তু কীভাবে থাকে, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

বেশ কয়েক বছর পর এই রাদারফোর্ডই স্বর্ণপাত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, পরমাণু আসলে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস আর ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি। নিউক্লিয়াসগুলো পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে। আর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে ইলেকট্রনগুলো। তার সেই পরীক্ষা থেকে আরেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছিল। একটা পরমাণুর তুলনায় ইলেকট্রনগুলো এত হালকা, পরমাণুর মোট ভরে এদের অবদান খুবই সামান্য। সুতরাং রাদারফোর্ড তখন আরেকটু নিশ্চিত করে জানালেন, তেজস্ক্রিয় শক্তির উত্স কেবল পরমাণু নয়, পরমাণুর ভেতরের ওই নিউক্লিয়াস। তার মানে নিউক্লিয়াসের কিছুটা ভর শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। সেই শক্তিই আসলে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণে ভূমিকা রাখছে।

রাদারফোর্ড তেজস্ক্রিয় শক্তির উৎসের সমাধান করলেন বটে, কিন্তু তখনই নতুন একটা সমস্যা দেখা দিল। এভাবে ভর থেকে শক্তি পরিণত হয় যদি, তাহলে নিউক্লিয়াসের ভর কমতে থাকবে সেটা নিশ্চিত। তারপর কী হবে? অর্থাৎ তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসের শেষ পরিণতি তাহলে কী হবে? আজীবনই কি একটা পরমাণু তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করবে? কিন্তু তা-ও তো হওয়ার কথা নয়। এভাবে চিরদিন রশ্মি বিকিরণ করে গেলে নিউক্লিয়াসের সবটুকু ভর একসময় ফুরিয়ে যাবে! তা-ও কি সম্ভব?

পাঁচ

নতুন এই সমস্যাগুলো বছর কয়েক আগে ১৯০০ সালে উইলিয়াম ক্রুকসের করা গবেষণাটিকে নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসে। ক্রুকস ধৈর্যশীল বিজ্ঞানী। তিনি একটা সিদ্ধান্ত্ম নিয়েছিলেন। তেজস্ক্রিয় বস্তুকে বিশুদ্ধ করার কাজে হাত দিয়েছিলেন তিনি। দেখতে চেয়েছিলেন, কতক্ষণ ধরে একটা তেজস্ক্রিয় বস্তু রশ্মি বিকিরণ করে। যতক্ষণ না তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়, ততক্ষণ সেটিকে বিশুদ্ধ করে যাবেন। তিনি সেই কাজে সফল হয়েছিলেন, সে গল্প আমরা আগেই বলে এসেছি। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা ভেজালযুক্ত ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি। কিন্তু বেকরেল দেখান, বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামকে যদি যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়, তাহলে সেটা আবার তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করবে।

১৯০২ সালে রাদারফোর্ড ও ফ্রেডেরিখ সদি দেখেছিলেন, ইউরেনিয়ামের মতোই আচরণ করে তেজস্ক্রিয় থোরিয়ামও। অর্থাৎ থোরিয়ামসমৃদ্ধ যৌগের চেয়ে বিশুদ্ধ থোরিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের হার অনেক কম।

তখন রাদারফোর্ড আর সদি এক অভূতপূর্ব প্রস্তাব দিলেন। বললেন, কোনো একটি ইউরেনিয়ামের নমুনায় তেজস্ক্রিয় ভাঙনের ফলে ইউরেনিয়াম মৌল পরিবর্তিত হয়ে অন্য মৌলে পরিণত হয়। সেই নতুন মৌলটি আবার ইউরেনিয়ামের চেয়ে অনেক বেশি তেজস্ক্রিয়। হিসাব দাঁড়ায়, কম তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের সঙ্গে বেশি তেজস্ক্রিয় মৌল যোগ হওয়ার নমুনাটির তেজস্ক্রিয়তা অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় নমুনা থেকে বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামকে আলাদা করে ফেললে স্বাভাবিকভাবেই এর রশ্মি বিকিরণের হার অনেক কমে যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ শুরু করবে। ফলে উত্পন্ন হবে নতুন মৌলটি। ফলে বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাড়বে আরও সক্রিয় নতুন মৌলটি। ফলে বাড়বে তেজস্ক্রিয়তাও।

রাদারফোর্ড আর সদি দেখালেন, তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণের ফলে ইউরেনিয়াম ভেঙে প্রথমে পোলেনিয়াম উত্পন্ন। তারপর সেই পোলেনিয়াম তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে রেডিয়ামে পরিণত হয়।

রেডিয়ামও তেজস্ক্রিয় মৌল। তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে এটাও আরেকটা মৌলে পরিণত হয়। এভাবে একসময় একটা অতেজস্ক্রিয় পরমাণুতে এসে শেষ হয়। সিসা-ই এ প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ। সিসা অতেজস্ক্রিয় মৌল। তাই এটা তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে পারে না। মোদ্দা কথা হলো, সব তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের শেষ পরিণতি হলো সিসা।

এখন আসি সেই পুরোনো প্রশ্নে। তেজস্ক্রিয়তার শক্তির উত্স কোথায়? যদি পরমাণুই হয়, তাহলে পরমাণুকে তো আর মূল কণা বলা যাচ্ছে না। তেমনি এক ধরনের পরমাণু আরেক ধরনের পরমাণু হওয়া মানে মৌলটাই আমূলে বদলে যাওয়া। তখন একটা বিষয় আবার নতুন করে সামনে চলে আসে। মধ্যযুগে আরব ও ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীরা যে আলকেমির চর্চা করতেন, যাকে ইতিমধ্যে অবৈজ্ঞানিক বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেই বিজ্ঞানই কি আবার চলে এল না? আলকেমিস্টরা তো লোহাকে সোনায় পরিণত করার পেছনেই ছুটেছিলেন!

ছয়

তেজস্ক্রিয় শক্তির উত্স সম্পর্কে জানা শুরু হলো পারমাণবিক মডেল আবিষ্কার হওয়ার পর। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করে জানতে পারলেন, পরমাণুতে যে ইলেকট্রন আছে, তাকে ভাঙা সম্ভব নয়। তাই ইলেকট্রন থেকে শক্তি নির্গত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বর্ণপাত পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, একটা পরমাণুর মোট ভরের পুরোটাই জমা থাকে তার নিউক্লিয়াসে। তাই নিউক্লিয়াস থেকে খুব সামান্য ভর ভেঙে শক্তিতে পরিণত হয়, তাহলে হিসাব মেলানোটা সহজ হয়ে যায়।

নিউক্লিয়াস আবিষ্কৃত হয় ১৮০৩ সালে, একই সঙ্গে প্রোটনও আবিষ্কৃত হয় রাদারফোর্ডের সেই স্বর্ণপাত পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু তখনো নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়নি। নিউট্রনের কথা ভাবার সময় আসেনি তখনো। তবে সেই সময় পরমাণুর কিছু বৈশিষ্ট্য চমকে দেয় বিজ্ঞানীদের। তখন চারদিকে বিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে কাজ করছেন। তাই একের পর এক নতুন মৌলের হদিস পাওয়া যেতে লাগল। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর রশ্মি বিকিরণের ফলে মধ্যবর্তী তেজস্ক্রিয় মৌলের সন্ধান পাওয়া যেতে লাগল। শুধু পোলিয়াম আর রেডিয়াম নয়। এ ধরনের আরও আরও তেজস্ক্রিয় পদার্থ। আর তখনই বাধল গোলটা। মোসলে যে পরমাণবিক সংখ্যার ভিত্তিতে পর্যায় সারণি তৈরি করেছিলেন, তাতেই সমস্যাটা তৈরি হলো।

হেনরি মোসলের পর্যায় সারণিতে ৯২টা মৌলের স্থান ছিল। কিন্তু সব কটির হদিস তখনো মেলেনি। তাই পারমাণবিক সংখ্যার ভিত্ততে সেগুলোকে অজ্ঞাত মৌল হিসেবেই পর্যায় সারণির ঘরগুলো খালি রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে ৯২ নম্বরটি হলো ইউরেনিয়ামের। সিসা বা লেডের ৮২, থোরিয়ামের ৮৩। তাহলে হিসাবটা দাঁড়ায়, থোরিয়াম থেকে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত পর্যায় সারণিতে মোট ঘর ১০টি(৮৩, ৮৪, ৮৫, ৮৬, ৮৭, ৮৮, ৮৯, ৯০, ৯১, ৯২। এর মধ্যে রেডিয়ামে ৮৩, পোলোনিয়ামের ৮৪, রেডিয়ামের ৮৮ এবং ইউরেনিয়ামের ৮২ (চারটি ঘর এই চারটি পরমাণুই দখল করে নিল। বাকি থাকে আর ছয়টি।

এখানে একটি বিষয় বলে রাখা দরকার, পর্যায় সারণির ৮৩, অর্থাৎ থোরিয়াম থেকে পরের মৌলগুলো তেজস্ক্রিয় গুণসম্পন্ন। ৮৩-র নিচের ঘরগুলো স্থায়ী অতেজস্ক্রিয় মৌলে ভরা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় নমুনা বিশ্লেষণ করে ৩০টির বেশি তেজস্ক্রিয় মৌলের খোঁজ পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে কোনো কোনোটার পারমাণবিক সংখ্যা ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি নয়, আবার থোরিয়ামের চেয়ে কমও নয়। ব্যাপারটা কিন্তু আজও সত্যি। পর্যায় সারণিতে এখন মৌলের সংখ্যা ১১৯। ৮৩-র পরে সব মৌলই তেজস্ক্রিয়। কিন্তু প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, এমন কোনো মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৯২-এর বেশি নয়। তাহলে ৯২-এর পরের মৌলগুলো এল কোত্থেকে। আসলে এগুলো প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে সব কটি।

সাত

এ ঘটনার পর একটা ঝামেলা তৈরি হলো। ৩০টির বেশি তেজস্ক্রিয় মৌলের জন্য কোনো মাত্র দশটি ঘর বরাদ্দ! কীভাবে সম্ভব? মোসলের একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল পর্যায় সারণির ব্যাপারে। একটা মৌলের জন্য কেবল একটা ঘরই বরাদ্দ থাকবে। পরে প্রোটন আবিষ্কারের পর নিশ্চিত হওয়া গেল, কোনো মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ভগ্নাংশ হতে পারে না। যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যতটি প্রোটন আছে, তার পারমাণবিক সংখ্যা তত।

তেজস্ক্রিয়তায় যে ৩০টির বেশি মধ্যবর্তী মৌল পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো আলাদাভাবে শনাক্ত করলেন কীভাবে বিজ্ঞানীরা?

পারমাণবিক ভর পরিমাপের ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিল, সে কথা আমরা পর্যায় সারণি অধ্যায়েই জেনে এসেছি। তো এই পারমাণবিক ভরের হিসাব থেকেই ৩০টির বেশি মৌলের হদিস পাওয়া যাচ্ছিল। তা ছাড়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণের হার কার কত বেশি, তা-ও বোঝা যচ্ছিল এদের পার্থক্য থেকে।

আবার কোনো মৌল আলফা কণা বিকিরণ করে তো কোনোটা করে বেটা কণা বিকিরণ। এসব সমস্যার সমাধানে উঠেপড়ে লাগলেন সদি। অবশ্য তখনো পারমাণবিক সংখ্যা গণনা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়নি। মোসলের আইনটা তৈরি হয় ১৯১৪ সালে। কিন্তু তার আগেই সদি সমস্যাটা আঁচ করতে পেরেছিলেন এবং সমাধান বের করেছিলেন। তা না হলে পারমাণবিক সংখ্যা ও পর্যায় সারণির যে জটিলাতার কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, সে সমস্যা ভালোই ভোগাত বিজ্ঞানীদের। সদি দুই বছর আগেই সমাধানটা করে রেখেছিলেন বলে রক্ষা।

সদি আপাদমস্তক রসায়নবিদ। তাই রাসায়নিক ধর্মের দিকেই তিনি বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সময় মধ্যবর্তী যেসব মৌল তৈরি হয়, তাদের অনেকগুলোর মধ্যে রাসায়নিক ধর্মে অনেক মিল আছে।

সদি বললেন, রাসায়নিক ধর্ম যাদের এক, কিন্তু তেজস্ক্রিয় ধর্ম আলাদা, তারা আসলে আলাদা মৌল নয়। একই মৌলের ভিন্ন রূপ। তাই এদেরকে পর্যায় সারণির একই ঘরে স্থান দেওয়া হোক। পরে প্রোটন গণনা করে যখন পারমাণবিক সংখ্যা গণনা শুরু হলো, তখন দেখা গেল সদির কথাই ঠিক, রাসায়নিক ধর্ম যেসব মধ্যবর্তী মৌলের খুব কাছাকাছি, কিন্তু তেজস্ক্রিয় ধর্ম আলাদা, তাদের নিউক্লিয়াসে আসলে প্রোটনের সংখ্যা একই থাকে। তার মানে এদের পারমাণবিক সংখ্যাও একই।

তখন মোসলের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। মধ্যবর্তী একাধিক মৌলের জন্য পর্যায় সারণিতে একই ঘর ছেড়ে দিতে তাঁর মোটেও বেগ পেতে হয়নি। অন্যদিকে সদিও এই কাজের পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯২১ সালে তাঁর ঝুলিতে ওঠে রসায়নের নোবেল। সদির কাজে খুঁত ছিল না। একই মৌল কিন্তু তেজস্ক্রিয় ধর্ম আলাদা, এদের কী নামে ডাকা হবে? সদি আর রাদারফোর্ডই বাতলে দিলেন সমাধান। বললেন, এদের মূল নাম একই থাকবে। কিন্তু এরা একে অন্যের আইসোটোপ নামেই পরিচিত হবে। অর্থাৎ তখন থেকেই আইসোটোপ শব্দটা পরিচিত হয়ে গেল নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানে। যেমন হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ। এদের আলাদা-আলাদা নাম আছে (হাউড্রোজেন, ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। এদের তিনটিরই পারমাণবিক সংখ্যা ১। কিন্তু এদের পারমাণবিক ভর আলাদা। হাইড্রোজেনের ১, ডিউটেরিয়ামে ২ ও ট্রিটিয়ামের ৩।)

আট

সদির এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই আলকেমিস্টদের সেই পুরোনো গবেষণার গন্ধ খুঁজতে লাগলেন অনেকে। পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা মনোযোগ দিলেন কীভাবে একটা পরমাণু সম্পূর্ণ আলাদা পরমাণুতে পরিণত হয়, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে। কে জানে হয়তো, আলকেমিস্টদের চির অধরা লোহাকে সোনা তৈরির ফর্মুলাও পাওয়া যেতে পারে।

শুরম্নটা হলো ইউরেনিয়ামকে দিয়ে। ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৯২। পারমাণবিক ভর U-২৩৮। তখনো নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু পারমাণবিক ভরের হিসাবটা ছিলই। ইউরেনিয়ামকে তাই U-২৩৮ নামে ডাকা হত। ইউরেনিয়াম আলফা কণা বিকিরণ করে। আলফা কণার পারমাণবিক সংখ্যা ২ এবং ভর ৪। তাই আলফা কণা বিকিরণের ফলে ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক ভর কমে যায় ৪ এবং পারমাণবিক সংখ্যা কমে ২। ফলে আমূল বদলে যায় ইউরেনিয়ামের পরমাণু। আসলে এটা পরিণত হয় মধ্যবর্তী মৌলে। ক্রুকস এর নাম দিয়েছিলেন ইউরেনিয়াম এক্স (Ux)। পরে যখন পারমাণবিক সংখ্যার ভিত্তিতে পর্যায় সারণি তৈরি হলো, তখন এটাকে বসানো হলো ৯০ তম ঘরে। সদি থোরিয়াম আবিষ্কারের পর দেখা গেল, ক্রুকস যেটাকে Ux নামকরণ করেছিলেন, সেটাই আসলে থোরিয়াম। এর পারমাণবিক ভর যেহেতু ২৩৪, তাই এর সাংকেতিক নাম হলো Th-234।

এখানে আরেকটা ব্যাপার চলে আসে। পর্যায় সারণি অনুযায়ী থোরিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৯০ হলেও এর পারমাণবিক ভর ২৩২। কিন্তু ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয় ভাঙনের ফলে যে থোরিয়াম উত্পন্ন হয়, এর পারমাণবিক ভর ২৩৪। কিন্তু পারমাণবিক সংখ্যা যেহেতু একই, তাই দুটোই থোরিয়াম হিসেবে রায় দিলেন বিজ্ঞানীরা। এখানে Th-232 ও Th-234 হলো থোরিয়ামের দুটো আইসোটোপ। রাসায়নিকভাবে এদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। কারণ, এই দুই পরমাণুতেই ইলেকট্রন ও প্রোটন সংখ্যা সমান। কিন্তু পামাণবিক ভর আলাদা, তাই তেজস্ক্রিয় ধর্মে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। Th-232 প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। এরা আলফা কণা বিকিরণ করে। কিন্তু Th-234 শুধু ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয় ভাঙন থেকেই পাওয়া যায় এবং এরা বেটা রশ্মি বিকিরণ করে। Th-234-এর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের হার Th-232-এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। প্রায় দুই শ বিলিয়ন গুণ! থোরিয়ামের কিন্তু আরও আইসোটোপ আছে। Th-227, Th-228, Th-229, Th-230 এবং Th-231।

এই হলো ইউরেনিয়ামের আইসোটোপের গল্প। তা ছাড়া তেজস্ক্রিয়তার শক্তির উত্স কোথায়, সেটাও জানা গেল।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র:

ইনসাইড দা অ্যাটম/আইজ্যাক আসিমভ

কোয়ান্টাম জগৎ/হায়দার আকবর খান রনো

আধুনিক নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান/এ. এম. হারুন অর রশীদ

ফিজিকস ওয়ার্ল্ড, ব্রিটানিকা ডট কম, উইকিপিডিয়া