ন্যানোফোটনিকসের বিস্ময়

প্রাচীন মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় প্রথম লেন্সের ব্যবহার শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু অপটিকসের ধারণাও। যুগে যুগে এর বিকাশ ঘটেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলোর আচরণের বিভিন্ন তত্ত্ব। আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তিতে অপটিকস বহুল ব্যবহৃত এবং এর মূলনীতিগুলোর সঙ্গে আমরা সাধারণভাবে পরিচিত। অপটিকসের একটি সুপরিচিত প্রয়োগ হচ্ছে চশমা। চশমা আলোর প্রতিসরণ তত্ত্ব অনুসরণ করে আলোর গতিপথকে পরিবর্তন করে এবং আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে তীক্ষ্ণ করে। অপটিকসের বহুল প্রায়োগিক ব্যবহারের মধ্যে আরও রয়েছে অণুবীক্ষণ যন্ত্র, যা আমরা ব্যবহার করি অত্যন্ত ক্ষুদ্র বস্তু পর্যবেক্ষণ করতে এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্রে যা ব্যবহার করি সুদূর মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতে।

অন্যদিকে ফোটনিকসের যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। আমরা সাধারণভাবে ফোটনিকসের সঙ্গে কম পরিচিত। এর তত্ত্ব ও প্রয়োগ এখনো বিকাশমান। ফোটনিকসের অন্তর্ভুক্ত ফোটন জেনারেশন, ডিটেকশন ও নিয়ন্ত্রণ। ফোটন হচ্ছে আলোর একক বা আলোককণা। ফোটনিকসের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ শুরু হয় ১৯৬০-এর দশকে, লেজার ও ফাইবার অপটিকস উদ্ভাবনের পর। মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই ফোটনিকসের শাখাগুলো উল্লেখযোগ্য বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং একটি সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় আলো ও আলোর ওপর নির্ভরশীল প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করতে ইউনেসকো ২০১৫ সালকে আন্তর্জাতিকভাবে আলোর বছর (ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব লাইট) ঘোষণা করে। প্রযুক্তিক্ষেত্রে নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করায় একুশ শতককে বলা হচ্ছে ফোটনিকস এবং ন্যানোটেকনোলজির শতক। ন্যানোটেকনোলজিতে ফোটনিকসের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ নিয়ে যে নতুন শাখার আবির্ভাব, তা-ই ন্যানোফোটনিকস নামে পরিচিত। ন্যানোফোটনিকস বা ন্যানোঅপটিকস হচ্ছে ন্যানোমিটার স্কেলে (১ ন্যানোমিটার হচ্ছে ১ মিটারের ১ বিলিয়ন বা এক শ কোটির ভাগের ১ ভাগ) আলোর আচরণ এবং ন্যানোমিটার আকারের বস্তুর সঙ্গে আলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। ন্যানোফোটনিকসকে অপটিকস, অপটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ন্যানোটেকনোলজির একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। ন্যানোফোটনিকসে প্রায়ই ধাতব উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকে। ফলে আপতিত আলোকরশ্মি ধাতব উপাদান এবং ডাইইলেকট্রিক ইন্টারফেসে সারফেস প্লাজমন সৃষ্টি করে ন্যানোমিটার স্কেলে বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্ষুদ্র স্থানে কেন্দ্রীভূত হতে পারে।

যদিও একুশ শতকে ন্যানোফোটনিকসে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে, বিস্ময়করভাবে ন্যানোফোটনিকসের প্রয়োগের উদাহরণ সুদূর অতীতে রোমান সাম্রাজ্যের শৌখিন জিনিসপত্রাদিতে পাওয়া যায়। উদ্ধার করা চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের রোমান সাম্রাজ্যে তৈরি কাচের লাইকারগাস কাপ ডাইক্রোইক আচরণ দেখায়। অর্থাৎ এই কাপ আপতিত আলোক রশ্মির দিকের ওপর নির্ভর করে রং বদলায় (ছবি ১.ক)। যখন আলো সামনের দিক থেকে আপতিত হয়, লাইকারগাস কাপ নীল রং ধারণ করে। আর যখন আলো পেছনের দিক থেকে আপতিত হয়, লাইকারগাস কাপ লাল রং ধারণ করে। লাইকারগাস কাপে এই ডাইক্রোইক এফেক্ট পাওয়া যায় কাচ তৈরির সময় অল্প পরিমাণে গোল্ড এবং সিলভারের ন্যানোস্কেল বস্তুকণা মিশিয়ে দেওয়ার কারণে। সামনের দিক থেকে কাপে আলো আপতিত হলে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল রঙের আলোকরশ্মি ন্যানোস্কেল বস্তুকণাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পর্যবেক্ষকের চোখে পৌঁছায়। অন্যদিকে তুলনামূলক বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল রঙের আলোকরশ্মি অতিক্রম করে চলে যায়। ফলে পর্যবেক্ষক কাপের রং নীল দেখে। অন্যদিকে যখন আলোকরশ্মি পেছনের দিক থেকে কাপে আপতিত হয়, তুলনামূলক বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল রঙের আলোকরশ্মি পর্যবেক্ষকের চোখে পৌঁছালেও ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল রঙের আলোকরশ্মি কাচের ভেতরের ন্যানোস্কেল বস্তুকণাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে পর্যবেক্ষকের চোখে পৌঁছায় না। তাই পর্যবেক্ষক কাপের বর্ণ লাল দেখে।

অন্যদিকে প্রকৃতিতে রয়েছে ন্যানোফোটনিকসের নানা উদাহরণ। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রজাপতির ডানা থেকে বিচ্ছুরিত আকর্ষণীয় রঙের সমাহার। প্রজাপতি যখন উড়ে বেড়ায়, মনে হয় উজ্জ্বল বর্ণের ডানাগুলো ঝিলমিল করছে এবং রং পরিবর্তন করছে। প্রজাপতির ডানার রং পরিবর্তনের রহস্য লুকিয়ে আছে ন্যানোফোটনিকসের তত্ত্বের ভেতর। প্রজাপতির রং ডানায় থাকা রঞ্জক পদার্থ ছাড়াও নির্ভর করে ডানার অতি সূক্ষ্ম গঠনশৈলীর ওপর। প্রজাপতির ডানার গঠনে থাকে বিভিন্ন পদার্থের ন্যানোমিটার স্কেলের অনেকগুলো স্বচ্ছ স্তর। এ ধরনের গঠনকে ক্ষেত্রবিশেষে ফোটনিক ক্রিস্টাল বলে। প্রজাপতির ডানায় আপতিত আলোকরশ্মি স্তরগুলোর ভেতর বারবার প্রতিফলিত হয়। প্রতিফলনের মাত্রা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এবং আপতিত রশ্মির দিকের ওপর নির্ভর করে। ফলে বিভিন্ন রং যেমন উজ্জ্বল দেখায় তেমনি উজ্জ্বলতা পরিবর্তন করে যখন প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। একইভাবে ময়ূর ও ঝিনুকের মুক্তা উজ্জ্বল রং ধারণ করে এবং রঙের আভার পরিবর্তন হয়।

সাধারণ অপটিক্যাল কম্পোনেন্টস যেমন লেন্স ও মাইক্রোস্কোপ সাধারণত আলোকে ন্যানোমিটার স্কেলে বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অর্ধেকের চেয়ে ছোট স্থানে কেন্দ্রীভূত করতে পারে না। অপটিকসের এই সীমাবদ্ধতা ডিফ্র্যাকশন লিমিট বা রেলেহ স্ক্যাটারিং নামে পরিচিত। ন্যানোফোটনিকস এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আলোকে ন্যানোস্কেল আয়তনে সংকুচিত করতে পারে। এ জন্য সাধারণত ব্যবহৃত হয় ন্যানোমিটার স্কেলের ধাতব বস্তু বা আকৃতি। ধাতব বস্তুর পৃষ্ঠদেশে আলোকশক্তি ইলেকট্রনের তরঙ্গে বা সারফেস প্লাজমনে সঞ্চালিত হয় এবং খুব ছোট স্থানে সংকুচিত হয়। ন্যানোফোটনিকসে আলোকে প্লাজমনে রূপান্তর করে ডিফ্রাকশন সীমার অনেক নিচে সীমাবদ্ধ করা যায় বলে এর চিপ-স্কেল ফোটনিক কম্পোনেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার অজস্র সুযোগ রয়েছে। প্লাজমনিক স্ট্রাকচারগুলো বিদ্যমান ইলেকট্রনিক এবং ডাই-ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উদিত করতে পারে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত। পরবর্তী অংশে আমরা আলোচনা করব ন্যানোফোটনিকসনির্ভর কয়েকটি সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি ক্ষেত্র নিয়ে।

ন্যানোলেজার এবং ন্যানোডিটেকটর

১৯৬০–এর দশকে উদ্ভাবিত হওয়ার পর লেজার সায়েন্স সময়ের সঙ্গে সামনে এগিয়েছে। অন্যান্য অনেক সাফল্যের সঙ্গে লেজারের আকার কমিয়ে মাইক্রোমিটার স্কেলে শক্তিশালী লেজাররশ্মি পাওয়া সম্ভব হয়েছে আজ থেকে অনেক আগেই। কিন্তু ডিফ্রাকশন সীমার কারণে প্রচলিত লেজারের শারীরিক আকার লেজাররশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অর্ধেকের চেয়ে ক্ষুদ্র হতে পারে না। এ জন্য ন্যানোমিটার আকারের লেজার অর্জন করা একটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ। তবে বিগত এক দশকে এ চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। ন্যানোফোটনিকস টেকনিক ব্যবহার করে ন্যানোমিটার আকারের লেজার তৈরি সম্ভব হয়েছে। এই অতি ক্ষুদ্র আকৃতির ন্যানোলেজারগুলোকে খুব দ্রুত মডুলেট করা যায় এবং এদের সহজে চিপের ওপর স্থাপন করা যায়। ফলে এই লেজারগুলো অন-চিপ অপটিক্যাল কম্পিউটিংয়ে ব্যবহারের জন্য আদর্শ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। ন্যানোলেজার ব্যবহারে ডেটা ট্রান্সমিশন রেটও বাড়ানো যায়। এরা খুব ক্ষুদ্রাকৃতির বলে অপারেট করতে খুব কম কারেন্ট লাগে, ফলে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। চিত্র ২-এ দেখানো ন্যানোলেজারে একটি CdS সেমিকন্ডাক্টর ন্যানোওয়্যার থেকে লেজিং পাওয়া যায়। ন্যানোওয়্যারটি একটি সিলভার সাবস্ট্রেট-এর ওপর অবস্থিত। ন্যানোমিটার স্কেলের MgF2 স্তর ন্যানোওয়্যারকে সিলভার সাবস্ট্রেট থেকে পৃথক করেছে। এই গঠনে আলো প্লাজমোনিক মোড-এ আবদ্ধ হয়ে ডিফ্রাকশন সীমা থেকে প্রায় এক শ গুণ সংকুচিত হতে পারে। ইনসেটে একটি ন্যানোলেজারের স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ চিত্র দেখানো হয়েছে।

একইভাবে যেহেতু প্লাজমনিক স্ট্রাকচারে খুব ছোট আয়তনের স্থানে আলো সংকুচিত হতে পারে, একটি ন্যানোস্কেল ডিটেকটর দিয়েই আলো শোষণ ও ডিটেকশন করা সম্ভব। ন্যানোডিটেকটরকে খুব কম ইনপুট শক্তি দিয়েই চালানো সম্ভব। এ ছাড়া যেহেতু এ ডিটেকটরগুলোর আকার ডিফ্রাকশন সীমার নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব, ডিটেকশন গতি যেমন অনেক গুণ বাড়ানো যাবে তেমনি কমানো যাবে অনাকাঙ্ক্ষিত সিগন্যাল নয়েজ।

সোলার সেল

জীবাশ্ম জ্বালানির স্বল্পতা এবং পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে নবায়নযোগ্য সূর্যরশ্মি থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করার কোনো বিকল্প নেই। তবে সোলার সেলের দক্ষতা এখনো পিছিয়ে আছে এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তির দাম তুলনামুলক বেশি। তুলনামূলক দামে সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে হলে দাম ২-৫ গুণ কমাতে হবে। সোলার সেলে আপতিত সৌরশক্তির পুরোটা শোষণের জন্য সোলার সেলের কার্যকর স্তর যথেষ্ট পুরু হওয়া প্রয়োজন। বাণিজ্যিকভাবে তৈরি সোলার সেলের বেশির ভাগই ১৮০-৩০০ মাইক্রোমিটার পুরু সিলিকন স্তর দিয়ে তৈরি। সোলার সেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের বেশির ভাগ নির্ভর করে পুরু সিলিকন স্তর এবং এই স্তরের প্রসেসিংয়ের ওপর। ফলে প্রচলিত সোলার সেলের দাম বেড়ে যায়। এ ছাড়া পুরু সিলিকন স্তর সূর্যরশ্মি শোষণের জন্য কার্যকর হলেও শোষিত সূর্যরশ্মির দ্বারা সৃষ্ট ইলেকট্রিক্যাল চার্জগুলোর অনেকই সোলার সেলের প্রান্তে সংগৃহীত হওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে যায়। সোলার সেলের মূল্য কমাতে এবং সৃষ্ট চার্জ সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য সোলার সেলের পুরুত্ব কমিয়ে পাতলা (থিন ফিল্ম, ১-২ মাইক্রোমিটার পুরু) বা অতি পাতলা (আলট্রা থিন ফিল্ম, ১ মাইক্রোমিটারের চেয়েও কম পুরু) করার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। তবে পাতলা বা অতি পাতলা সোলার সেলে আলোর শোষণ একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়, যদিও সৃষ্ট চার্জ সহজেই সংগৃহীত হতে পারে। বিশেষ করে ৬০০-১১০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সৌরশক্তি পাতলা সোলার সেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে শোষিত হয় না। কিন্তু সোলার সেলের দক্ষতা বাড়াতে হলে সৌরশক্তির শোষণ যেমন বাড়াতে হবে তেমনি বাড়াতে হবে সৃষ্ট চার্জের সংগ্রহ। এ দুই আবশ্যিক শর্ত পূরণ করা যায় ন্যানোফোটনিকসের কৌশল ব্যবহার করে, যেমন আপতিত আলোকরশ্মিকে সারফেস প্লাজমনে রূপান্তর করে।

পাতলা বা অতি পাতলা সোলার সেলে ধাতব ন্যানোস্কেল কাঠামো ব্যবহার করে ধাতব কাঠামো এবং সোলার সেলের ডাইইলেকট্রিক ইন্টারফেসে সারফেস প্লাজমন সক্রিয় করে আপতিত সৌরশক্তিকে এমনকি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়েও পাতলা স্তরে সংকুচিত এবং শোষণ করা যায়। ধাতব ন্যানোস্কেল স্ট্রাকচারগুলো অন্তত তিনভাবে সোলার সেলের পুরুত্ব কমাতে পারে। প্রথমত, ন্যানোস্কেল বস্তুকণা আলোকরশ্মি আপতনের তলে বা সোলার সেলের ওপরের দিকে ব্যবহার করলে আপতিত আলোকরশ্মি ধাতব বস্তুকণা দ্বারা বিভিন্ন কোণে বিক্ষিপ্ত হয়ে সোলার সেলের কার্যকর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে। ফলে আলোকরশ্মি পাতলা বা অতি পাতলা সোলার সেলেও বেশি পরিমাণে শোষিত হতে পারে (চিত্র ৩.ক)। দ্বিতীয়ত, ন্যানোস্কেল ধাতব বস্তুকণাগুলো সোলার সেলের মাঝামাঝি ব্যবহৃত হতে পারে। আপতিত আলোকরশ্মি ধাতব বস্তুকণাতে স্থানীয় (লোকালাইজড) সারফেস প্লাজমন সক্রিয় করে। সেটা অ্যানটেনার মতো বস্তুকণার নিয়ারফিল্ডে আলোকরশ্মির শক্তি বৃদ্ধি করে এবং আপতিত আলোকরশ্মির শোষণকে বৃদ্ধি করে (চিত্র ৩.খ)। তৃতীয়ত, একটি ঢেউখেলানো ধাতব কাঠামো সোলার সেলের পেছনের প্রান্তে ব্যবহার করলে আপতিত আলোকরশ্মি সারফেস প্লাজমন পোলারিটন সক্রিয় করে ডাইইলেকট্রিক এবং ধাতব স্ট্রাকচারের ইন্টারফেসে সংকুচিত হয়ে শোষণ বাড়াতে পারে (ছবি ৩.গ)।

বিকিরিত আলোর পরিবর্তন

ধাতব ন্যানোস্ট্রাকচারের নিকটে আবদ্ধ উচ্চশক্তির ইলেকট্রিক ফিল্ড ভীষণভাবে বদলে দিতে পারে কাছে অবস্থিত বিকিরণ উৎসের বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, যেহেতু প্লাজমনিক স্ট্রাকচারের কাছে আলোকরশ্মির শক্তি অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়, আলোর বিন্দু উৎস বেশি পরিমাণে আলোকরশ্মি শোষণ করে ফটোলুমিনেসেন্স ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বেশি পরিমাণে আলো বিকিরণ করে। এ ক্ষেত্রে ধাতব ন্যানোস্কেল বস্তুকণাগুলো অপটিক্যাল অ্যানটেনার মতো কাজ করে। দ্বিতীয়ত, আলোর উৎসের পাশে কোনো ধাতব ন্যানো কাঠামো (স্ট্রাকচার) থাকলে আলোর বিকিরণের দিক আলোর উৎসের অরিয়েন্টেশনের ওপর নির্ভর না করে ধাতব ন্যানো কাঠামোর আকৃতির এবং গঠনের ওপর নির্ভর করে। যেমন বিন্দু উৎসের নিয়ারফিল্ডে ন্যানোমিটার স্কেলের পুরু একটি ধাতব স্তর থাকলে বিচ্ছুরিত আলো ধাতব স্তরে সারফেস প্লাজমন সৃষ্টি করে। ধাতব স্তরের অন্য পাশ থেকে সারফেস প্লাজমন সৃষ্টি হওয়ার বিপরীত প্রক্রিয়ায় শুধু একটি নির্দিষ্ট কোনো আলো বিচ্ছুরিত হয় (ছবি ৪.ক)।

তৃতীয়ত, প্লাজমনিক ন্যানোস্ট্রা কাঠামো রেডিয়েটিভ এবং নন-রেডিয়েটিভ উপায়ে আলোর উৎসের শক্তি হারানোর হার পরিবর্তন করে। এই স্ট্রাকচারগুলো একটি উত্তেজিত আলোক উৎসকে অনুত্তেজিত অবস্থায় নিয়ে আসে এবং উৎসের জীবনকাল হ্রাস করে। যখন একটি উত্তেজিত বিন্দু উৎস ধাতব ন্যানো কাঠামোর খুব কাছে অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে নিকটে থাকে, বিকিরিত আলো ধাতব ন্যানো কাঠামোতে সারফেস প্লাজমন সৃষ্টি করে এবং দ্রুত শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়। সৃষ্ট সারফেস প্লাজমনগুলোর জীবনকালও সংক্ষিপ্ত। এরাও রেডিয়েটিভলি বা নন-রেডিয়েটিভলি শক্তি হারিয়ে নিঃশেষ হয়। তবে কৌশলী এবং উপযোগী ধাতব ন্যানো কাঠামো থেকে সারফেস প্লাজমন পুনরায় আলো হিসেবে খোলা জায়গায় বিকিরিত হতে পারে (চিত্র ৪.খ)।

এ ছাড়া ন্যানোফোটনিকস বিশেষভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বর্ণালিবীক্ষণ (স্পেকট্রোস্কোপি) এবং আণুবীক্ষনিক জগতে (মাইক্রোস্কোপিতে)। নিয়ারফিল্ড স্ক্যানিং অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপে ন্যানোস্কেল রেজল্যুশন পাওয়া সম্ভব। প্লাজমনিক ন্যানো কাঠামোগুলো তীব্রভাবে আলো শোষণ করে উষ্ণ হয়ে ওঠে। এই তাপীয় প্রভাব বিভিন্ন কাজে যেমন ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহার করতে গবেষণা হচ্ছে।

পরিশেষে, ন্যানোফোটনিকসে আলোর বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করার বিস্ময়কর ক্ষমতা খুলে দিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনার দ্বার। প্রযুক্তিক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই একুশ শতক হবে ন্যানোফোটনিকসের শতক।

লেখক: অধ্যাপক, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়