পদার্থবিদ্যার দৈত্য

কত-না পুরানো কথা, কত-না হারানো গান,

শরমের আধো হাসি, সোহাগের আধো বাণী,

সন্ধ্যা, তোর ওই অন্ধকারে, হারায়ে গিয়েছে একেবারে।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পদার্থবিদ্যার নিয়মকে মেনে আমাদের পুরোনো দিনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর খোঁজ পাওয়া যাবে কি? আমি এখানে টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে পাড়ি দেওয়ার কথা বলছি না, আমি শুধু অতীতের ঘটনাগুলো জানতে চাই। নাট্যশালায় বসে আমরা একটি নাটকের শুরু থেকে শেষ দেখি। আমি দেরি করে এসেছিলাম, শুধু নাটকের মাঝের একটি দৃশ্য দেখেছি, এই নাটকে আগে যা ঘটেছে তার খবর মিলবে কি? ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগের সেই মহাবিস্ফোরণ (Big Bang) থেকে আজ পর্যন্ত যা ঘটেছে, তাকে যদি একটা নাটক বলে ধরি, তবে এই নাটকে মানুষ এসেছে অনেক পরে, লাখ দুয়েক বছর আগে। ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছরকে যদি এক বছর ধরি, তাহলে মানুষ জন্মেছে মাত্র ৭ মিনিট আগে। এই ৭ মিনিটের দেখাদেখি থেকে ও এই নাটকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তার কতটুকু জানা সম্ভব?

একটি কাচের পেয়ালা টেবিল থেকে মেঝেতে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই টুকরোগুলো নিজ থেকে আর জোড়া লাগে না। পেয়ালাটি নিজে থেকে লাফ দিয়ে আবার টেবিলের ওপর ওঠে না। কেন? বাধাটা কিসের? বাতাসের অণুগুলো সব সময় ছুটছে, ওদের মাঝে অনেক শক্তি লুকিয়ে আছে।

সেই শক্তি দিয়ে ওরা কেন ভাঙা পেয়ালা জোড়া দেয় না, কেনই বা পেয়ালাটিকে ধাক্কা দিয়ে টেবিলের ওপর উঠিয়ে দেয় না?

আসুন, পদার্থবিদ্যার দুটি দৈত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই: ল্যাপলাসের দৈত্য এবং ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য। ওরা নাকি আমাদের মুছে যাওয়া দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে পারে! বাতাসের শক্তিকে ব্যবহার করে একটি পেয়ালাকে ধাক্কা মেরে মেঝে থেকে টেবিলের ওপর উঠিয়ে দিতে পারে, শীতের রাতে বিনা পয়সায় ঘরবাড়ি গরম করে দিতে পারে! আলাউদ্দিনের চেরাগে যে দৈত্য বাস করে, তার কাজ মালিকের ইচ্ছা পূরণ করা। পদার্থবিদ্যার দৈত্যদের কাজ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকে ফাঁকি দিয়ে মজার মজার সব কাজ করা।

ল্যাপলাস ও ম্যাক্সওয়েল ছিলেন দুই নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী এবং অঙ্কবিদ। এসব কাল্পনিক দৈত্যের গল্প এদের কাছেই প্রথম শোনা। আপনি কি প্রতিদিন হরোস্কোপের পাতায় চোখ রাখেন? ল্যাপলাসের দৈত্য শুধু আপনার নয়, আর সব প্রাণীর, এমনকি সমগ্র মহাবিশ্বের ভূত-ভবিষ্যত্ জেনে বসে আছে! ওদিকে ম্যাক্সওয়েলের দৈত্যের গল্প অলস লোকদের খুব পছন্দ হবে। এই দৈত্য নাকি শীতকালে বিনে পয়সায় বা কোনো খাটুনি না করেই আপনার ঠান্ডা ঘর গরম করে দেবে, পেট্রল ছাড়াই গাড়ি চালাবে! ল্যাপলাস ১৭৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ১৮২৭ সালে মারা যান। সে আমলে পরমাণুকে মৌলিক কণা ধরা হতো, তবে পরমাণু কী দিয়ে তৈরি তা কারও জানা ছিল না। ল্যাপলাস মনে করতেন যে মহাবিশ্বের সব পরমাণুর অবস্থান এবং গতিবেগ যদি এই মুহূর্তে জানা থাকে তবে পদার্থবিদ্যার নিয়মকে অনুসরণ করে মহাবিশ্বের অতীত এবং ভবিষ্যত্ নির্ভুলভাবে বলে দেওয়া সম্ভব। আমি এই মহাবিশ্বের একটি অংশ, তাই আমার জন্ম, মৃত্যু সবই অঙ্ক কষে বলে দেওয়া যাবে। মহাবিশ্ব ও সেই সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যত্ পূর্বনির্ধারিত। এমন অঙ্ক দ্রুত করার জন্য চাই একটি অতিমানবীয় বুদ্ধিমান (Super Mind) সত্তা। ওকে ল্যাপলাসের দৈত্য (Laplace’s Demon) বলে ডাকা হয়। ল্যাপলাসের দৈত্যকে ইদানীংকালে একটি সুপারকম্পিউটার হিসেবে ভাবা যেতে পারে! এমন একটি কম্পিউটার যার ইনপুট হবে এই মুহূর্তে মহাবিশ্বের প্রতিটি পরমাণুর অবস্থান, গতি, কোয়ান্টাম দশা এবং পদার্থবিদ্যার আইনসমূহ। এই ইনপুট থেকে অঙ্ক কষে কম্পিউটারটি মুহূর্তে জানিয়ে দেবে এই মহাবিশ্বের এবং আমাদের জন্ম, মৃত্যু, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ল্যাপলাসের এই পরিপূর্ণ নিখাদ জ্ঞানের তত্ত্ব বেশি দিন টেকেনি। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র, হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা তত্ত্ব এবং এত সব খবর মনে রাখার মতো এবং দ্রুত গণনা করার মতো কম্পিউটারের অবাস্তবতা, ল্যাপলাসের দৈত্যের মৃত্যু ঘটিয়েছে।

ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য তাপগতিবিদ্যা বিষয়ে। তাপ একধরনের শক্তি, গতি আরেক ধরনের শক্তি, এই দুই মিলিয়ে হলো তাপগতিবিদ্যা। বিজ্ঞানীরা তাপ বদলিয়ে বানাতে চান গতি, আলো, কাজ, আরও কত কী! তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো এই রূপান্তরের খেলার আইনকানুন। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রকে শক্তির নিত্যতার সূত্র বলা যেতে পারে। এই সূত্রমতে, শক্তির কোনো বিনাশ নেই, ওকে শুধুই এক রূপ থেকে আরেক রূপে পরিবর্তন করা যায়। আমরা প্রতিদিন হাটেবাজারে কেনাকাটা করি, টাকা বদলিয়ে কিনি চাল, ডাল, মাছ, শাড়ি, লুঙ্গি। বাজার না করেও কয়েক দিন বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু শক্তি লেনদেন না করে কয়েক সেকেন্ডের বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের প্রতিটি নিশ্বাস, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, ফুসফুসের ওঠানামা, পাকস্থলীর সংকোচন, এই শক্তি বদলের খেলা। পদার্থবিদ্যায় এই শক্তি রূপান্তরের খেলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়: ফিরে যাওয়া যাবে (Reversible) এবং ফিরে যাওয়া যাবে না (Irreversible) প্রক্রিয়া। প্রথমটি একটি আদর্শ প্রক্রিয়া, যা শুধুই পাঠ্যপুস্তকে খুঁজে পাওয়া যায়, প্রকৃতিতে নয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে সময়ের তির ছোটে শৃঙ্খলতা থেকে বিশৃঙ্খলতার দিকে। একটি কাচের পাত্র ভেঙে গেলে নিজ থেকে আর জোড়া লাগে না, এক গ্লাস পানিতে এক ফোঁটা কালো রং মেশালেও আর কোনো দিন কালো ফোঁটা হয়ে ফিরে আসবে না। ১৫ বছর আগে আমার কোনো এক বিকেলের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, হৃৎপিণ্ডের গতি, রক্তের চাপ ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য অঙ্ক কষে বলে দিতে পারবে কি? পারবে না, কারণ আমাদের জীবন একটি অপরিবর্তনীয় না-ফেরা প্রক্রিয়া।

ধরা যাক, মাঘ মাসের এক বিকেলে ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য ঘরের জানালার পাশে বসে আছে। ঘর গরম করার কোনো আয়োজন নেই, জানালার এপারে-ওপারে একই তাপমাত্রা। ঘরের ভেতরে এবং বাইরে বায়ুর অণুগুলো ছোটাছুটি করছে। তবে সবাই সমান বেগে নয়। কেউ ছুটছে মোটরগাড়ির বেগে, কেউ চলেছে গরুর গাড়ির বেগে, কেউ বা ছুটছে জেট প্লেনের চেয়েও জোরে। এই অণুগুলোর গড় গতিশক্তির রূপকেই তাপমাত্রা বলা হয়, অণুগুলো যত বেশি বেগে ছুটবে, তাপমাত্রা ততই বাড়বে।

“ঠান্ডা ঘরটিকে বিনে পয়সায় গরম করে দেওয়া যাক, ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য ভাবল, আমি যদি বাইরের জেট প্লেনের বেগে ছুটে চলা অণুগুলোকে জানালা খুলে ভেতরে আসতে দিই, আর ঘরের ভেতরের গরুর গাড়ির বেগে চলা অণুগুলোকে বাইরে যেতে দিই, তাহলেই তো ঘরটি গরম হয়ে যাবে!”

এখানে দৈত্য তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অমান্য করে সময়ের তিরকে উল্টো দিকে ছুড়তে চাচ্ছে, বিশৃঙ্খলতা থেকে শৃঙ্খলতার দিকে! ও পারবে কি? দৈত্যের বদলে একটি ছাঁকনি (Filter) বা কম্পিউটার ব্যবহার করলে কেমন হয়? অনেক গুণী এসব নিয়ে অনেক ভেবেছেন। সবাই একমত যে দৈত্য, ছাঁকনি, কম্পিউটার যাকেই অণু বাছাই করার কাজে লাগানো হবে, তার পেছনে শক্তি খরচ করতে হবে, ফোকটে কিছুই মিলবে না। এত সব অণুর খবর রাখতে গিয়ে কম্পিউটার বা দৈত্যের শরীরে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হবে, তাকেও হিসাবের মধ্যে ধরতে হবে। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অমান্য করার মতো কোনো দৈত্যের খোঁজ এখনো মেলেনি।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত