প্রতিসাম্য ও সৌন্দর্যের যোগসূত্র

শুধু রবিঠাকুর কেন-আমরা বরারবই সুন্দরের পূজারি, হোক না সেটা কারও মুখমণ্ডল বা কোনো নান্দনিক শিল্পকর্ম। প্রকৃতিও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কোনটা সুন্দর সেটা আমরা বা প্রকৃতি কীভাবে বিচার করে?এটা আপাতদৃষ্টিতে একটি আত্মনিষ্ঠ (subjective) ব্যাপার মনে হলেও এর পেছনে কিন্তু গাণিতিক সম্পৃক্ততা আছে। এর সঙ্গে আরও যুক্ত আছে একটি চমত্কার উপপাদ্য। সেটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে গণিতবিদ এমি ন্যুথেরের নাম। ব্যাপারটা তাহলে কী?

একটা সরল উদাহরণ দিই। ধরা যাক, কোনো ব্যক্তির দুটি কান অত্যন্ত বৈসাদৃশ্যিক। তাহলে তাকে সুন্দর ব্যক্তি বলে স্বীকার করতে অনেকেই চাইবেন না। এ থেকে বোঝা যায় যে সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রতিসাম্যের একটা যোগসূত্র আছে। এ রকম চিন্তাভাবনা একদম নতুন নয়। প্লেটো (Plato) ও তাঁর ভাবশিষ্যরা পাঁচটি সুষম ঘনবস্তু-ঘনক, টেট্রাহেড্রন, অক্টাহেড্রন, আইকোসাহেড্রন ও ডোডেকাহেড্রন (এদের আমরা বর্তমানে একত্রে প্লেটোনিক সলিড বলি। এদের সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বিশদ আছে) দিয়ে বিশ্বজগৎ তৈরির স্বপ্ন দেখতেন। এটার পেছনে তাঁদের যে ধারণাটা কাজ করেছিল, সেটা হলো এই প্লেটোনিক সলিডের সংখ্যা পাঁচ। কিন্তু প্রাচীন ধারণায় পৃথিবীর সবকিছু পানি, বাতাস, মাটি আর আগুন এই চারটি ‘মৌল’ দিয়ে তৈরি। প্লেটো তাই চিন্তা করেছিলেন, পাঁচটি সুষম ঘন বস্তু চার মৌলকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং ডোডেকাহেড্রনের মৌল দিয়ে স্বর্গ তৈরি। এখন আমরা জানি, তাদের এ ধারণা কতখানি অমূলক ছিল। তবু প্রতিসাম্য তাদের ধ্যানধারণায় কতখানি গুরুত্ব পেয়েছিল তা এখান থেকেই বোঝা যায়।

আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক এ রকম না হলেও যে তত্ত্বে যত বেশি প্রতিসাম্য থাকবে, সাধারণ নিয়মেই আমরা পদার্থবিজ্ঞানীরা সেই তত্ত্বের দিকে তত পক্ষপাতিত্ব দেখাব। কিন্তু কেন এই দুর্বলতা? এর কারণ প্রতিসাম্য থাকলে আমাদের পক্ষে সমস্যা সমাধান করা সহজ হয়। এটা যেকোনো গণিত জানা ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন। কিন্তু এর সঙ্গে প্রতিসাম্য বেশি হওয়ার সম্পর্কটা কী? ধরা যাক, কোনো সিস্টেমে কোনো একটা রাশির মান প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করা হচ্ছে। তারপরও যদি সিস্টেমটিকে অপরিবর্তিত দেখায়, তাহলে সেই সিস্টেমে অপর একটি সংরক্ষিত রাশি থাকবে। এই ব্যাপারটিই এমি ন্যুথের তাঁর উপপাদ্যের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রমাণ দিয়েছিলেন। আমরা স্কুলপর্যায়ের পদার্থবিজ্ঞানে যে ভরবেগের নিত্যতার সূত্র পড়ি, তার ব্যাখ্যা ন্যুথেরের উপপাদ্যের মাধ্যমে মেলে। যদি সিস্টেমকে যথেচ্ছ সরণ করলেও তার কোনো পরিবর্তন না হয়, এই উপপাদ্য অনুসারে তবে সে সিস্টেমের ক্ষেত্রে ভরবেগ একটি সংরক্ষিত রাশি হবে। একই ধারায় আমরা শক্তির নিত্যতার সূত্রকেও ব্যাখ্যা করতে পারি। আর শেষমেশ যে কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের নীতির কারণে আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলোর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার নির্দিষ্ট সময় পাই, তারও মূলে রয়েছে প্রতিসাম্য। সেখানে ত্রিমাত্রিক জগতের উত্তর-দক্ষিণ বা এ রকম (অসংখ্য) সব দিকই সমান। আমরা যে কোনো দিককেই আমাদের স্থানাঙ্কের অক্ষের শুরু হিসেবে বেছে নিতে পারব।

এসব প্রতিসাম্য সবগুলোই কিন্তু আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মাধ্যমে একই সুতোয় গাঁথা। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শুরুতেই ধরে নেওয়া হয় আমরা যেসব ঘটনা দেখি (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ সব মিলিয়ে) সেগুলোকে আমরা চারটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করি। সময় বা কখন ঘটেছে তা জানার জন্য একটি আর কোথায় ঘটেছে সেটার জন্য তিনটি, যাকে আমরা x, y, z স্থানাঙ্ক বলে জানি। কিন্তু যে বিষয়টা জরুরি যে এই সংখ্যাগুলো নির্ণয় করে একজন পর্যবেক্ষক (observer)। এগুলোর জন্য তাঁকে ব্যবহার করতে হয় একটি ঘড়ি আর একটি মিটার রড। আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এই ঘড়ি আর রড শ্বাশত বা অপরিবর্তনীয়। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুত্-চুম্বকীয় তরঙ্গের সমীকরণের চেহারা আর ফলাফল যে পর্যবেক্ষকের অবস্থান আর গতির ওপর নির্ভর করে না। শুধু এই সন্দেহের ওপর ভর করেই আইনস্টাইন কাজ করতে শুরু করলেন। চলন্ত ঘড়িকে স্থির ব্যক্তি ধীরে চলতে দেখবে এসব আশ্চর্যজনক ঘটনার সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ সুযোগে আমরা বর্তমানে যে জিপিএস ব্যবহার করি তা যে এই ঘটনার ওপর নির্ভরশীল, তা মনে করিয়ে দিচ্ছি। চলমান মিটার রডকে দ্যৈর্ঘ্যে ছোট হতে দেখা যায়। এর মানে এই নয় যে ঘড়িটার ভেতরের কলকবজাগুলো ধীরে চলছে বা মিটার রডটা সুতি কাপড়ের মতো চুপসে ছোট হয়ে গেছে। ঘড়ি বা রডের সঙ্গে চলমান যে কেউ এই ঘটনার বিন্দুমাত্র দেখবে না। কিন্তু এই ঘটনাগুলো থেকে আমরা, যারা বিশেষ করে ৩০-৪০ বছর আগের লেখা পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষা দিই, একটা ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হই।

আর সেটা হচ্ছে সবকিছুই আপেক্ষিক। কিন্তু বিজ্ঞানে, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানে, সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতা (objectivity)। যেমন ধরা যাক, আমরা কোনো যৌগকে অ্যাসিড বলি কিন্তু সেটা কে পরিমাপ করল, সেটা উল্লেখ করি না। কারণ, পরিমাপ পদ্ধতি ঠিক হয়ে থাকলে বিশুদ্ধ অ্যাসিডটির pH লেভেল ৭.০ এর কম হতে হবে এবং সবার পরিমাপ সঠিক হলে একই মান দেবে। এখানে সম্রাট আকবরের দিল্লির কাকের সংখ্যার প্রশ্নের মতো হেরফের করা উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি প্রশ্নের উত্তর একেকবার একেক রকম হয়, তার মানে হলো আমরা সঠিক প্রশ্ন করছি না। এ রকম প্রশ্ন তখনই আমরা করি যখন আমাদের পরিমাপ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকে। একসময় আমরা পরমাণুতে ইলেকট্রনের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ নিয়ে চিন্তিত থাকতাম। কারণ, কোয়ান্টাম জগত্ ও তার নিয়মকানুন আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু সম্ভাবনার ভিত্তিতে কোয়ান্টাম জগতের নীতির ব্যাখ্যা পাওয়ার পর কেউ নিউটনীয় ধারণার ধরা-বাঁধা ইলেকট্রনের কক্ষপথ নিয়ে আর মাথা ঘামায় না।

আপেক্ষিকতা বোঝার জন্য যে চতুর্মাত্রিক কাঠামো ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় তা কিন্তু আইনস্টাইন উদ্ভাবন করেননি। বরং করেছিলেন তাঁর প্রাক্তন শিক্ষক হারম্যান মিনকৌস্কি। আইনস্টাইনের নাম বিযুক্ত না থাকায় বোধ হয় মিনকৌস্কির এই কাঠামো নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের উত্সাহ কিছুটা কম। কিন্তু এই কাঠামো ব্যবহারের ফলে যে জিনিসটা খোলাসা হয় তা হলো লরেঞ্জের রূপান্তর আর আমাদের পরিচিত লাটিমের ঘূর্ণন দুটো প্রায় একই রকম গণিতের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। এই তুলনামূলক চিত্রটা বুঝতে পারলে আপেক্ষিক তত্ত্বের ভান্ডারে কী কী মূল্যবান রত্ন রয়েছে তা আমরা জানতে পারব। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিসাম্যকে কীভাবে শ্রেণিবিন্যস্ত করা যায় সেটা আপেক্ষিক তত্ত্বের উদাহরণ থেকেও আমরা বুঝতে পারব। বিজ্ঞানচিন্তার পরের কোন সংখ্যায় এটা নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখি।

লেখক: অধ্যাপক ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ

  • লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত