বিষাক্ত-সুন্দর মৃত্যুর ৩৩ বছর

চেরনোবিল বিস্ফোরণ, ইতাহাসের অন্যতম বৃহৎ মানবিক বিপর্যয়। বিজ্ঞান ইতিহাসেরও বড় বিপর্যয় এটি। তৎকালীন বিশ্ববিজ্ঞানের অন্যতম ঝাণ্ডাবাহীদের হাতে বিজ্ঞানের এত বড় বিপর্যয় কীভাবে হলো? ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জন্য কী হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছিল এই বিপর্যয়?

২৬ এপ্রিল, ১৯৮৬। ৩৩ বছর আগের এক রাত।

সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো সদর্পে টিকে আছে। ইউক্রেনের প্রিপয়েত শহরের ইয়ানিভ রেলস্টেশন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের ব্রিজটির ওপর জড়ো হয়েছে হাজারো মানুষ। চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন লেগেছে। ৫ কিলোমিটার দূর থেকে সেই আগুনের নীল শিখা আকাশের বুকে যে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছে, অবাক বিস্ময়ে সেটাই দেখছে ওরা। কিন্তু দুই দিন পর সেখানে উপস্থিত সবাই জানতে পারবে তেজস্ক্রিয়তায় ভর করে মৃত্যু সেদিন বিষাক্ত-সুন্দর রূপে হাজির হয়েছিল। মারা যাবে উপস্থিত সবাই। অথচ ইতিহাসের পাতায়, আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জানাবে, মৃতের সংখ্যা মাত্র ৩১!

ঘটনার শুরু কিছুক্ষণ আগে। রাতের শেষ প্রহর। এই শিফটের সুপারভাইজার আলেক্সান্ডার আকিমভকে ৪ নম্বর রিঅ্যাক্টর নিয়ে একটা পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উত্তপ্ত পারমাণবিক জ্বালানির কিছুটা ওপরে পানি পাম্প করার ব্যবস্থা আছে। এর ফলে বাষ্প তৈরি হয় এবং দুটি টারবাইন ঘোরে। এতে পারমাণবিক বিক্রিয়াটা ঘটে। সেদিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দেখতে চাচ্ছিলেন, মূল পাওয়ার সাপ্লাই হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলে কী হয়। সেটা দেখার জন্য তাঁরা কিছু স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তাব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে বলেন আকিমভকে। প্রথমে রাজি না হলেও অনেক বলার পর তিনি ২০ সেকেন্ডের জন্য সিস্টেমটা বন্ধ করে দিতে রাজি হন। কিন্তু যে নিয়ন্ত্রক রডগুলোর ধীরে ধীরে বিক্রিয়ার গতি কমিয়ে দেওয়ার কথা, তারাই প্রচণ্ড বেগে বিদ্যুৎ টেনে নিতে শুরু করে। ফলে প্রবল বিদ্যুতের ঢেউ আছড়ে পড়ে সিস্টেমের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়। রিঅ্যাক্টরের ভেতরের পানি ফুটতে শুরু করে, চাপের পরিমাণ মুহূর্তে অনেক বেড়ে যায় এবং ১০০০ টনের রিঅ্যাক্টরের মাথার অংশটুকু ভেঙে পড়ে। রডগুলো জ্যাম হয়ে যায় এবং যে টিউবগুলোতে পারমাণবিক জ্বালানি ছিল, সেগুলো ফাটতে শুরু করে। তারপরেই বুম! বিস্ফোরিত হয় চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রের ৪ নম্বর রিঅ্যাক্টর। আর এর ২০০ টন তেজস্ক্রিয় কোরের প্রায় ৫ শতাংশ বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। সবকিছুর মতোই তেজস্ক্রিয়তার মাত্রারও একক আছে—সিয়েভার্ট। পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের আশপাশে ২ মিলিসিয়েভার্টের (এমএসভি) মতো তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা থাকলে সেটাকে নিরাপদ হিসেবে ধরা হয়। সেদিন একলাফে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার এমএসভিতে। ব্যাপারটা অনুভব করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফেলা পারমাণবিক বোমার কথা ভাবা যেতে পারে। হিরোশিমা-নাগাসাকির তুলনায় প্রায় ৫০০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবি করেছিল, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ‘এক্স–রের চেয়ে কিছুটা বেশি’!

আমাদের পরম সৌভাগ্য, অমানুষের তুলনায় পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। সেদিন নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের শত শত কর্মীর সঙ্গে দমকলকর্মীরা নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলেন। রিঅ্যাক্টরটির ওপরে ঘণ্টায় প্রায় ৩০০ টন পানি ঢালা হয়েছে। রোবট পাঠিয়ে তেজস্ক্রিয় কোরের ভাঙা অংশ উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এলাকাজুড়ে বৈমানিকেরা বিমান নিয়ে ১ হাজার ৮০০ বার চক্কর দিয়েছেন এবং তেজস্ক্রিয়তা শুষে নিতে পারে, এমন ৫ হাজার টন পদার্থ ফেলেছেন ওপর থেকে।

তেজস্ক্রিয় এই বিক্রিয়াগুলো আসলে চেইন বিক্রিয়া। তেজস্ক্রিয় কোর, মানে পরমাণুর তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসটাকে নিউট্রন ধাক্কা মারলে সেটা ভেঙে যায়। প্রতিবার কোনো নিউক্লিয়াস ভেঙে গেলে সেখান থেকে আরও নিউট্রন বের হয়, সেটা আবার আরও অনেকগুলো নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মারে। এভাবে বিক্রিয়াটা চলতে-ই থাকে। এই বিক্রিয়া বন্ধ করতে হলে নিউট্রনগুলোকে সরিয়ে নিতে হবে। নিউট্রন শুষে নেওয়ার জন্য ফেলা হয়েছিল বোরন। সেই সঙ্গে তেজস্ক্রিয়তা যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তাই লেড বা সিসা ফেলা হয়েছিল। তাপ শুষে নেওয়ার জন্য ডোলোমাইট ফেলা হয়েছিল। আর সবার পরে বালু বা সিলিকন ডাই-অক্সাইড ফেলা হয়েছিল, যেটা সবকিছুর ওপর একটা পর্দা হিসেবে কাজ করেছে।

কিন্তু এসব করতে করতেই বিস্ফোরণের ফলে তৈরি ভাঙাচোরা টুকরো আর ধুলোবালু বাতাসের সঙ্গে মিশে ১ মিলোমিটারের মতো ওপরে উঠে গিয়েছিল। বায়ুপ্রবাহের ফলে এই সবকিছুই উত্তর দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আক্ষরিক অর্থেই আকাশ থেকে নেমে আসে মৃত্যুবাণ। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হচ্ছে সিজিয়াম আর আয়োডিন। কারণ এই দুটি জিনিস খাবারের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, নষ্ট করে দিতে পারে মানুষ বা পশুপাখির ডিএনএ। সিজিয়াম-১৩৭ অবশ্য আকারে কিছুটা বড় হয়, তাই এরা সরাসরি বেশি দূর ছড়াতে পারেনি। আশপাশের গাছপালা, বাড়িঘর ইত্যাদির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মোটামুটি চারপাশের এলাকার মধ্যেই আছড়ে পড়েছে। তারপর মানুষের জামাকাপড়, বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া, নদী-নালা কিংবা মাটির গভীরে পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় ২ লাখ বর্গকিলোমিটার।

এটাকেই যদি আপনার অনেক বেশি মনে হয়, তাহলে আয়োডিন-১৩১–এর কথা ভাবতে পারেন। আকারে বেশ ক্ষুদ্র হওয়ায় এই কণাগুলো আকাশের অনেকটা ওপরে উঠে গিয়েছিল। ফলে ইউরোপজুড়ে তো ছড়িয়ে পড়েছিলই, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে!

সবচেয়ে ক্ষতিকর অবস্থায় ছিল আশপাশের এলাকার মানুষ। ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটার এলাকার সবার ওপরে হামলে পড়েছিল প্রায় ৩৫০ এমএসভি তেজস্ক্রিয়তা। প্রিপয়েতের ৪৫ হাজার মানুষও ৫০ এমএসভি তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছিল। দেড় লাখের বেশি মানুষকে সেদিন মুহূর্তের মধ্যে ঘরবাড়ি সব ছেড়ে পথে নামতে হয়েছে। আজতক রিঅ্যাক্টর ৪-এর চারপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকাকে এক্সক্লুশন জোন বলে গণ্য করা হয়। মানুষের জন্য ওই অঞ্চলটা পুরোপুরি নিরাপদ হওয়ার জন্য লাগবে আরও ২০ হাজার বছর!

স্থানীয় লোকজন চলে গেলে আরও হাজার হাজার কর্মী কাজে নেমে পড়েন। মোলাসেস নামের একধরনের ঘন তরল দিয়ে পরিষ্কার করেন তেজস্ক্রিয় সমস্ত ময়লা-ধুলোবালু। মৃত গাছ আর ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে মিশিয়ে দেন মাটিতে, পুঁতে ফেলেন ভাঙাচোরা সব যন্ত্রপাতি। এসব করতে গিয়ে ১০০ থেকে ৫০০ এমএসভি তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ২৩৭ জন কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে মারা যান। শেষ পর্যন্ত ১০ মে–তে এসে রিঅ্যাক্টর-৪–এর আগুন নেভাতে সমর্থ হন দমকলকর্মীরা।

আয়োডিন-১৩১–এর অর্ধায়ু মাত্র ৮ দিন। আর সিজিয়াম-১৩৭–এর অর্ধায়ু ৩০ বছর। সময়ের সঙ্গে এদের ক্ষতিকর প্রভাব কমে যাবে, ধীরে ধীরে পুরো এলাকাটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকবে। এর পেছনে অবশ্যই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে স্বয়ং প্রকৃতি। সেদিন বিস্ফোরণের পরও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ওই অঞ্চলের গাছপালা। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার ৬০-৯০ শতাংশ এরাই শুষে নিয়েছিল। ৪০০ হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত পাইনের বন লাল হয়ে গিয়েছিল। মারা গিয়েছিল বুকের সমস্ত অধিবাসী মৌমাছি, প্রজাপতি এবং অন্য পোকামাকড়দের নিয়ে। বুলডোজার দিয়ে ওসব গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর বৃষ্টি এসে ধুয়ে দেয় বাকি রয়ে যাওয়া তেজস্ক্রিয় কণা। তারপরও অনেকটা রয়ে গিয়েছিল। এর মাঝেই সময়ের হাত ধরে জন্ম নেবে নতুন গাছপালা। ধীরে ধীরে বাকি কণাগুলো মিশে যাবে গাছে-মাটিতে, মাশরুম এবং হরিণের মতো প্রকৃতির বুকে। ধীরে ধীরে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ অনেকটা কমে গেলে জন্ম নেবে আরও নতুন সব গাছ। বার্চ, পাইন, অ্যাসপিরিনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো অঞ্চলে ভিড় জমাবে বন্য প্রাণীরা। তেজস্ক্রিয়তা যতই ক্ষতিকর হোক, মানুষের চেয়ে তো আর ক্ষতিকর নয়!

এদিকে সেই বিস্ফোরণের ৫ বছর পর প্রবল প্রতাপশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হবে। শেষ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ সারা জীবন বুকের মধ্যে লালন করবেন এক নির্মম সত্য। রাজনীতি আর ক্ষমতার দাবা খেলা যতই ভূমিকা রাখুক, সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের শুরুটা আসলে হয়েছিল সেই বিষাক্ত রাতে। চেরনোবিলকে কবর দেওয়ার জন্য তাঁরা নিতান্ত কম করেনি। যথাসাধ্য সবই করেছিলেন। কিন্তু সেই ঘটনার ১১ বছর পর সভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচের হাত ধরে সত্যটুকু উঠে এসেছিল বইয়ের পাতায়। পৃথিবীর আঙিনায়।

আলেক্সিয়েভিচ বেলারুশের নাগরিক। পেশায় সাংবাদিক মানুষটি সাধারণ মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। তাঁদের কাছে গেছেন, সুখ-দুঃখের কথা শুনেছেন, তাঁদের বুঝতে চেষ্টা করেছেন। এভাবে পাঁচ শ মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। তাঁদের মুখ থেকে শুনেছেন চেরনোবিল বিপর্যয় তাঁদের জীবন কীভাবে এলোমেলো করে দিয়েছিল। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যখন নিজেদের পিঠ বাঁচাতে সত্যকে কবর দিয়ে নিজেদের মতো করে ইতিহাস লেখার চেষ্টায় ব্যস্ত, এই মানুষগুলো তখন নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বাকিদের সাহায্য করেছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়েও ভয়ানক এক পারমাণবিক বিস্ফোরণের মূল্য তারা চুকিয়েছে নিজেদের রক্ত, ঘাম আর জীবন দিয়ে। এই সাক্ষাৎকারগুলো থেকে তিনি ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল: দ্য ওরাল হিস্ট্রি অব আ নিউক্লিয়ার ডিজাস্টার নামে একটি বই লেখেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এই বই প্রথমবারের মতো বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে চেরনোবিলের বিভীষিকা এবং একদল মানুষের আত্মত্যাগের কথা পৌঁছে দেয়। সোভিয়েত রাশিয়ার এত দিনের তৈরি নির্লজ্জ মিথ্যা ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যায়। আলেক্সিয়েভিচ তাঁর পোলিফোনিক ধাঁচের লেখা, মানে দুই মলাটের মাঝে একসঙ্গে বহু মানুষের কণ্ঠ তুলে ধরার জন্য ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

চেরনোবিল বিপর্যয়ের ফলে আসলেই কত মানুষের ক্ষতি হয়েছে, এর সঠিক হিসাব পাওয়া দুষ্কর। কারণ ঘটনার পরে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও মানুষের ক্ষয়ক্ষতির কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব করা হয়নি। তবে ন্যাশনাল কমিটি ফর রেডিয়েশন প্রোটেকশন অব দ্য ইউক্রেনিয়ান পপুলেশনের ২০০০ সালের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষ তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্যানসারে ভুগে মারা গেছে প্রায় চার হাজার মানুষ। বেলারুশের যেসব কর্মী জরুরিভাবে দূষণ পরিষ্কারে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় ৫ হাজার ৭০০ জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

আলেক্সিয়েভিচের লেখা বইটি থেকে ক্রেইগ মাজিনের চিত্রনাট্য এবং জোহান রেঙ্কের পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে পাঁচ পর্বের মিনি সিরিজ চেরনোবিল। সম্প্রতি এইচবিওতে প্রচারিত এই সিরিজে চেরনোবিলের সেই বিষাক্ত রাত এবং এর পেছনে সোভিয়েত রাশিয়ার উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারদের কীর্তিকলাপের কথা উঠে এসেছে। সিরিজটি দেখতে দেখতে দর্শক ফিরে যাবেন সেই ভয়ংকর সময়ে, যখন আক্ষরিক অর্থেই আকাশ থেকে মৃত্যু নেমে এসেছিল মানুষের দরজায়।

চেরনোবিল এক্সক্লুশন জোনের অনেকটুকু এখন বন্য প্রাণীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। হরিণ, ভালুক, বাঘ ও বাইসনের মতো প্রাণীতে ভরে উঠেছে চারপাশ। তবে কিছু অঞ্চলে এখনো প্রচুর তেজস্ক্রিয়তা রয়ে গেছে। সেসব জায়গায় কোনো প্রাণ নেই। গাছের পাতা, ময়লা, ধুলোবালু জমে জমে মাটির স্তর বেশ পুরু হয়ে গেছে। এ রকম জায়গায় দাবানল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আগুন লেগে পুড়ে যায় একরের পর একর বনাঞ্চল। সেই সম্ভাবনা এড়াতে একদল দুর্লভ বুনো ঘোড়া এনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ওই অংশটুকুতে। তেজস্ক্রিয়তার থোড়াই কেয়ার করে ঘোড়াগুলো সেই অঞ্চলে দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে।

গবেষকেরা এখনো পরিত্যক্ত ওই অঞ্চলটুকুকে আবারও ব্যবহারোপযোগী করে তোলার যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন। যেমন দেখা গেছে, পটাশিয়ামের সার দিলে উদ্ভিদ তেজস্ক্রিয় সিজিয়ামকণা আর শোষণ করে না। আর শোষণ না করলে শিকড়ের মাধ্যমে মাটিতে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দিতেও পারবে না এসব উদ্ভিদ। এ রকম ছোটখাটো আরও বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব মিলে ধীরে ধীরে তেজস্ক্রিয়তা আরও কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

কিন্তু একটা বড় সমস্যা রয়ে গিয়েছিল। রিঅ্যাক্টর-৪–এর তেজস্ক্রিয় কোরের বাকি ৯৫ শতাংশ আজও সেখানে-ই রয়ে গেছে। আশির দশকে এর চারপাশ ঘিরে সিমেন্ট দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কালের আঁচড়ে সেটা অনেকটা-ই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই বাধা ভেঙে গেলে নতুন করে তেজস্ক্রিয় কণামেঘ ছড়িয়ে পড়তে পারে বাতাসে।

এমনটা যাতে না হয়, সে জন্য ২০১৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক দল সেখানে গিয়েছিল। রিঅ্যাক্টর-৪–এর চারপাশ ঘিরে নতুন আরেকটি শেল্টার তৈরি করেছে তারা। ওই শেল্টারের ভেতরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ৫০০ এমএসভি হলেও বাইরের অংশ বর্তমানে অনেকটাই নিরাপদ।

মানুষ ও প্রকৃতির যুগ্ম চেষ্টায় চেরনোবিল বিস্ফোরণে বিপর্যস্ত এলাকা যেভাবে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে, এমন নজির ইতিহাসে বিরল। অথচ এই পুরো বিপর্যয়ের পেছনে ছিল হাতেগোনা কিছু মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতা। কথা হলো, ইতিহাস থেকে আমরা আসলেই শিক্ষা নিতে পারব তো? এটি বাংলাদেশের জন্যও এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

উত্তরটা বরং পাঠকের হাতেই তোলা থাকুক।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, দ্য গার্ডিয়ান