ব্ল্যাকহোলের নোবেল বিজয়

আগামীকাল ৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার বিকেল ৩.৪৫ মিনিটে চলতি বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। এ বছরের পুরষ্কার কে পাবেন সেটা জানার আগে জেনে নিন গতবছর কারা এবং কেন পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।

নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত আমাদের মহাবিশ্ব। আমরা জানি আলোর গতি সর্বত্র। কত লাখ কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে সুদূর অতীতের আলো এসে ঝিকমিক করে আমাদের রাতের আকাশে। কিন্তু আমরা এটাও এখন জানি, এই মহাবিশ্বের এমন কিছু জায়গা আছে যেখান থেকে আলোও ফিরে আসতে পারে না। গভীর নিকষ অন্ধকার সেখানে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং যেটাকে তুলনা করেছেন ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরির ডিভাইন কমেডিতে বর্ণিত দোজখের সঙ্গে। সেখানে প্রবেশ করার সময় সব আশা চিরতরে পরিত্যাগ করতে হয়। সেখানে মাধ্যাকর্ষণের টান এতটাই তীব্র যে সেই টানে আয়তন এত কমে যায় যে সেটা স্থান-কাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখান থেকে আলো কিংবা বিদ্যুৎ–চুম্বক তরঙ্গ কিংবা কোনো কিছুই আর বের হয়ে আসতে পারে না। এই অদৃশ্য বস্তু আসলে মৃত নক্ষত্র। আগে এর নাম ছিল ডার্ক স্টার। ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দিয়েছেন ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। জন হুইলারের ছাত্র ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান, কিপ থর্নের মতো খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানী কিপ থর্ন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৭ সালে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য। তাঁদের শনাক্ত করা মহাকর্ষ তরঙ্গের ঢেউ এসেছিল শত কোটি বছর আগে ঘটে যাওয়া দুটো ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ থেকে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের সাহায্যে গ্যালাক্সি এম-৮৭-এর কেন্দ্রে থাকা কৃষ্ণগহ্বরের ছায়া থেকে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের ছবি তৈরি করতে সমর্থ হন। বিশ্বজুড়ে ব্যাপক উৎসাহের জন্ম দিয়েছিল সেই ছবি। এরই হাত ধরে ২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের মূল বিষয়—ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর।

২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়র অধ্যাপক রজার পেনরোজ, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিকস ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির অধ্যাপক রাইনহার্ড গেনজেল এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের অধ্যাপক আন্দ্রিয়া গেজ।

কৃষ্ণগহ্বরের আধুনিক গাণিতিক তত্ত্বের মূল উৎস আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। যদিও আইনস্টাইন নিজে কৃষ্ণগহ্বরের ফ্যান ছিলেন না, কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর ১০ বছর পর ১৯৬৫ সালে ব্ল্যাকহোলসংক্রান্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সবচেয়ে ক্ল্যাসিক গাণিতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী রজার পেনরোজ। ১৯৩১ সালের ৮ আগস্ট ইংল্যান্ডের কোলচেস্টারে জন্ম রজার পেনরোজের। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসক লিওনেল পেনরোজ। ১৯৫৮ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জনস কলেজ থেকে গণিতে পিএইচডি করেন। পরে তিনি গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে আকৃষ্ট হন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেনিস শিয়ামার উৎসাহে। ডেনিস শিয়ামা ছিলেন স্টিফেন হকিংয়ের পিএইচডি সুপারভাইজার। রজার পেনরোজের সঙ্গে যৌথভাবে অনেক গবেষণা করেছেন স্টিফেন হকিং। কৃষ্ণগহ্বরের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজের অসংখ্য গবেষণা রয়েছে। পেনরোজ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরকে শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর পাশাপাশি পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন এবং জনপ্রিয়তা দিয়েছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। বেঁচে থাকলে এ বছরের পুরস্কারের অন্যতম একজন হতেন স্টিফেন হকিং। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি পাওয়ার আগেই তিনি মারা যান ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ। রজার পেনরোজসহ অনেকেই ব্ল্যাকহোলসংক্রান্ত গবেষণায় স্টিফেন হকিংয়ের অবদানের কথা স্মরণ করছেন। নোবেল কমিটিও এ কথা বলেছেন। নোবেল পুরস্কারের প্রধান শর্ত হলো—বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ থাকতে হবে এবং পুরস্কার ঘোষণার সময় বিজ্ঞানীকে বেঁচে থাকতে হবে। সেই কারণেই ১৯৬৫ সালে উদ্ভাবিত তত্ত্বের জন্য রজার পেনরোজ নোবেল পুরস্কার পেলেন ৫৫ বছর পর।

বিস্ময়কর রহস্যে ভরা আমাদের মহাবিশ্ব। সেই প্রাচীনকাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে কাজ করে চলেছেন। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিজ্ঞান হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান। মানুষের হাতে যখন কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না, ছিল না কোনো পূর্বধারণা, তখন থেকেই শুধু কৌতূহল আর নিরন্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষ আবিষ্কার করেছে মহাবিশ্বের অনেক রহস্য। গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ, সৌরজগতের গ্রহ ও উপগ্রহগুলোর অনেক বৈশিষ্ট্য মানুষের জানা হয়ে গেছে দুরবিন আবিষ্কারের আগেই। দুরবিন আবিষ্কারের পর মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের গতি বেড়ে যায় বহুগুণ। কাছের নক্ষত্র পেরিয়ে মানুষের দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয় গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সিতে। শতকোটি বছর আগের নক্ষত্র থেকে উৎসারিত আলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, মহাবিশ্বের উৎপত্তির নাক্ষত্রিক ইতিহাস। সপ্তদশ শতাব্দীতে নিউটনের হাত ধরে আমরা জানলাম মহাবিশ্বের সর্বত্র নিরবচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে মহাকর্ষ বল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পেলাম বিদ্যুৎ–চুম্বক বল। এবং বিংশ শতাব্দীতে পেলাম সবল নিউক্লিয়ার বল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল।

এ চার ধরনের মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বল হলো সবচেয়ে দুর্বল। বাকি তিনটি বলই মহাকর্ষ বলের চেয়ে কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি (১০৩৮) গুণ শক্তিশালী হলেও শুধু মহাকর্ষ বলই সব জায়গায় সব ধরনের পদার্থের ওপর কাজ করে। নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র থেকে আমরা দেখি, দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ বস্তুর ভর বাড়লে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বাড়বে, দূরত্ব বাড়লে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ কমে যাবে। এই সহজ গাণিতিক হিসাব থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার আগপর্যন্ত ধারণা ছিল, যদি বস্তুর ভর শূন্য হয়, তাহলে তার ওপর মহাকর্ষ বল কাজ করবে না। আলোর ভর নেই এবং তার ওপর মহাকর্ষ বল কাজ করে না, সেটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের সেই ধারণা বদলে দিয়েছেন তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন ভরের যে ধারণা আমাদের এত দিন ধরে ছিল, সেই ধারণা ভুল। মহাবিশ্বের সবকিছুর ওপরই কাজ করে মহাকর্ষ বল। এই বলের প্রভাবেই স্পেস-টাইম বা স্থান-কালের পরিবর্তন হয়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব গত শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ধারণা আমূল বদলে দেয়। শুরু হয় মহাবিশ্বকে নিউটনীয় বলবিদ্যার বদলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগ দেখার যুগ।

বিংশ শতাব্দী থেকে আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়—আইনস্টাইনের যুগ থেকে মহাজাগতিক পদার্থগুলোর গতিপ্রকৃতির সূক্ষ্ম হিসাবে আপেক্ষিকতার প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এতটাই যুগান্তকারী যে আইনস্টাইন নিজেও ভাবতে পারেননি তাঁর তত্ত্ব থেকে পাওয়া যেতে পারে মহাবিশ্বের গভীর গোপন রহস্য—কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টির তত্ত্ব।

ব্ল্যাকহোল কী? বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম ব্ল্যাকহোলকে বলেছেন কৃষ্ণবিবর। অনেকে কৃষ্ণগহ্বরও বলেন। কিন্তু বিবর বা গহ্বর বললে যে রকম গর্তের ধারণা আমরা পাই, ব্ল্যাকহোল কিন্তু তেমন কোনো গর্ত নয়। কিন্তু বোঝার সুবিধার্থে আমরা ব্ল্যাকহোলকে একটা অসীম গভীরতার গর্ত ধরে নিতে পারি। সেই গর্তে মহাকর্ষ বলের টান এত বেশি যে সেখান থেকে কোনো কিছুই আর বের হয়ে আসতে পারে না, এমনকি আলোও নয়।

কেন এমন হয়? মহাবিশ্বের কোথায় আছে কিংবা কোথায় সৃষ্টি হয় এই ব্ল্যাকহোল?

প্রায় চৌদ্দ শ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের উদ্ভবের পর থেকেই নানা রকম মহাজাগতিক ঘটনা ঘটে চলেছে মহাবিশ্বে। মানুষ সেগুলো ভালোভাবে জানতে শুরু করেছে কয়েক শ বছর আগে থেকে। নিউটনের মহাকর্ষ বলের সূত্র থেকে হিসাব করা যায় বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের ভর, তাদের মুক্তিবেগ। পৃথিবীর মুক্তিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ১১.২৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে কোনো বস্তু যদি এই বেগে ছুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে চলে যাবে আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন মিশেল এবং ১৭৯৬ থেকে ১৭৯৯ সালের মধ্যে ফরাসি গণিতবিদ পিয়েরে সাইমন ল্যাপলাস নিউটনের সূত্র কাজে লাগিয়ে বড় আকারের নক্ষত্রের মুক্তিবেগ হিসাব করেন। তাঁরা দেখান, নক্ষত্রের মুক্তিবেগ যদি আলোর বেগের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আলোও সেই নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করে বেরিয়ে যেতে পারবে না। তার মানে, সেই নক্ষত্রটিকে কখনোই দেখা যাবে না। তাঁরা সে ধরনের কল্পিত নক্ষত্রের নাম দিয়েছিলেন ডার্ক স্টার বা কৃষ্ণ নক্ষত্র বা কালো তারা। জন মিশেল যে নক্ষত্রটিকে কল্পনা করেছিলেন, সেই নক্ষত্রটির ব্যাসার্ধ ছিল আমাদের সূর্যের ব্যাসার্ধের ৫০০ গুণ। আর ল্যাপলাসের নক্ষত্রটি ছিল আমাদের সূর্যের ২৫০ গুণ, আর ঘনত্ব ছিল পৃথিবীর সমান অর্থাৎ আমাদের সূর্যের চার গুণ।

এখন প্রশ্ন হলো কোন নক্ষত্র ডার্কস্টারের বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে, তার হিসাব করার কোনো উপায় কি আছে?

প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই নক্ষত্র থেকে কোনো কিছুই বের হতে পারবে না। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এবং গতি শক্তির সূত্র কাজে লাগিয়ে সহজেই একটা বৈশিষ্ট্য বের করা গেল। দেখা গেল নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ যদি একটা নির্দিষ্ট পরিমাপের চেয়ে কম হয়, তাহলে সেখান থেকে কোনো কিছু বের হতে পারবে না। এই ব্যাসার্ধ হলো 2GM/c2, যেখানে G হলো মহাকর্ষ ধ্রুবক, M হচ্ছে নক্ষত্রের ভর, আর c হচ্ছে আলোর বেগ। (বক্স – ১)

১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে আইনস্টাইন পরপর তিনটি পেপারে তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড বা অভিকর্ষজ ক্ষেত্রতত্ত্বের সমীকরণ। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে স্থান-কাল জ্যামিতিকভাবে সমতল। কিন্তু সার্বিক তত্ত্বে স্থান-কাল অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে বেঁকে যায়। এদিকে ইউরোপে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মান বিজ্ঞানীদের অনেকেই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জশিল্ড তখন আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু রণক্ষেত্রের বাংকারে বসে সময় পেলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছেন। আইনস্টাইনের পেপারগুলো তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি সেখানে বসেই আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশন বা ক্ষেত্র সমীকরণের একটি সমাধান বের করে ফেললেন। স্ফেরিক্যালি সিমেট্রিক ঘূর্ণমান নয়, এমন কোনো বস্তুর চারপাশের স্থান-কালের বক্রতার মেট্রিকস সমীকরণ তিনি প্রকাশ করলেন আইনস্টাইনের পেপার প্রকাশিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই, ১৯১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। এর দুই মাস পরই যুদ্ধাবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান সোয়ার্জশিল্ড। তাঁর সমীকরণ থেকে পাওয়া যায় ব্ল্যাকহোলের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধ বা ইভেন্ট হরাইজন।

সোয়ার্জশিল্ড সমীকরণ থেকেও ব্ল্যাকহোলের যে ব্যাসার্ধ পাওয়া যায়, তা ১৭৮৩ সালের জন মিশেলের দেওয়া সমীকরণের সঙ্গে মিলে যায়। এ ব্যাসার্ধের কম হলেই তা হয়ে পড়ে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। যাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। এই সূত্র থেকে আমরা যেকোনো গ্রহ-নক্ষত্রের জন্য ঘটনা দিগন্তের দূরত্ব হিসাব করতে পারি। যেমন আমাদের সূর্যের ভর যদি হয় 2 x 1030 কিলোগ্রাম, তাহলে তার সোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ হবে 2.95 কিলোমিটার। অর্থাৎ আমাদের সূর্য যদি নিজের মহাকর্ষের টানে সংকুচিত হতে হতে তার ব্যাসার্ধ মাত্র তিন কিলোমিটারে চলে আসে, তাহলে এই সূর্য ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। আমাদের পৃথিবীর ক্ষেত্রেও এই হিসাব করা যায়। পৃথিবীর ভর 6 x 1024 কিলোগ্রাম। পৃথিবীর সংকুচিত হতে হতে যদি মাত্র ১ সেন্টিমিটারে চলে আসে, তাহলে আমাদের পৃথিবী ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এই বিরাট ভরকে যদি এত ছোট আকারের ভেতর রেখে দেওয়া হয়, তাহলে তার ঘনত্ব হবে সাংঘাতিকভাবে বেশি। পৃথিবী ও আমাদের সূর্যের ব্ল্যাকহোল হওয়ার যে শর্ত হিসাব করলাম, বাস্তবে তা হওয়া অসম্ভব। সব নক্ষত্রের শেষ পরিণতি কিন্তু ব্ল্যাকহোল নয়।

পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। হকিং দেখিয়েছেন বিশেষ অবস্থায় ব্ল্যাকহোল থেকে বিকিরণ নির্গত হতে পারে। যাকে আমরা হকিং রেডিয়েশন হিসেবে জানি। আর পেনরোজ তাঁর গাণিতিক মডেলে ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজন ব্যাখ্যা করেছেন কার্যকরভাবে। নক্ষত্র নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে চুপসে যায়। তারপর সেটা ঘটনা দিগন্তে প্রবেশ করে ব্ল্যাকহোলে বিলীন হয়ে যায়। সেখান থেকে কিছুই আর ফিরে আসতে পারে না। চুপসে যাওয়া নক্ষত্রের আয়তন কমতে কমতে এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে আয়তন হয়ে পড়ে শূন্য, ঘনত্ব হয় অসীম। সে ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের কোনো নীতিই আর কাজ করে না। এই বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি।

বিজ্ঞানীরা মহাকাশে ব্ল্যাকহোলের সন্ধান করতে শুরু করেছেন বহু বছর থেকে। জন মিশেল সেই ১৭৮৩ সালে ধারণা দিয়েছিলেন যে কালো তারা বা কৃষ্ণ নক্ষত্র থেকে কোনো আলো বের হবে না। আমরা তাদের দেখতে পাব না। কিন্তু অন্যান্য নক্ষত্র সেই কালো নক্ষত্রের অভিকর্ষণ বলের টানে তার চারপাশে ঘুরতে থাকবে। দুই শতাধিক বছর পর আমাদের গ্যালাক্সিতে এ রকম একটি ব্যাপার আবিষ্কার করেছেন মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী আন্দ্রিয়া গেজ এবং জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাইনহার্ড গেনজেল। সব তথ্যপ্রমাণ থেকে এটাই ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে একটি ব্ল্যাকহোল। এই আবিষ্কারের জন্য এ বছর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা পেনরোজের সঙ্গে।

রাইনহার্ড গেনজেলের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ জার্মানিতে। তাঁর বাবা লুডভিগ গেনজেল ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। রাইনহার্ড রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমিতে পিএইচডি করেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি থেকে ১৯৭৮ সালে। তারপর তিনি কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলিতে। সেখানে তিনি অধ্যাপক। একই সঙ্গে তিনি জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিকসের ডিরেক্টর। কর্মজীবনের শুরু থেকেই তিনি মহাকাশ গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর দল চিলির ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির টেলিস্কোপের মাধ্যমে ৩০ বছর ধরে চোখ রেখেছেন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে।

এদিকে ১৯৯০–এর শুরুতে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কেক পর্বতের ওপর তৈরি হয়েছে অবজারভেটরি। সেখানে স্থাপিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যাসের টেলিস্কোপ। সেখান থেকে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে চোখ রাখলেন ২৫ বছর বয়সী মার্কিন তরুণী আন্দ্রিয়া গেজ। তারপর ৩০ বছর ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণের পর আবিষ্কার করতে পেরেছেন মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে প্রচণ্ড ঘনত্বের সুপারম্যাসিভ পদার্থ। সেটা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত। এই আবিষ্কারের জন্য এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আন্দ্রিয়া গেজ। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে এ পর্যন্ত তিনিই চতুর্থ নারী। ২১৬ জন নোবেল বিজয়ীর মধ্যে মাত্র চারজন নারী—মেরি কুরি (১৯০৩), মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার (১৯৬৩), ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড (২০১৮) এবং এ বছর আন্দ্রিয়া গেজ।

গেজের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৬ জুন নিউইয়র্ক সিটিতে। ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের দিকে তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। বড় হয়েছেন শিকাগোতে। শিকাগো ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এমআইটি থেকে ফিজিকসে স্নাতক এবং ক্যালটেক থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৯২ সালে। তারপর গবেষণা ও অধ্যাপনা করেছেন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটিতে, কেমব্রিজে। ১৯৯৪ থেকে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে। পদার্থবিজ্ঞানে মেয়েদের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম। তার মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরও কম। এমন একটি ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে আন্দ্রিয়াকে হতে হয়েছে অনেক বেশি শক্ত প্রকৃতির মানুষ। কৈশোরে স্বপ্ন ছিল চাঁদে যাওয়ার। প্রথম নারী হিসেবে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর মাকে। চাঁদে যাওয়ার কোনো মিশন ছিল না সেই সময়। তাই ওই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু তিনি হয়েছেন বিশ্বের প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী। মেয়েদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ১৯৯৫ সালে তিনি একটি বইও লিখেছেন—ইউ ক্যান বি আ ওম্যান অ্যাস্ট্রোনমার।

আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে আছে অনেকগুলো নক্ষত্র আর প্রচুর উত্তপ্ত গ্যাস। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের পরিমাপ হিসাব করার জন্য এই নক্ষত্রপুঞ্জ ও গ্যাসের চলাচলের দিকে অনবরত দৃষ্টি রেখেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। চিলির অবজারভেটরি থেকে রাইনাহার্ড গেনজেলের দল আর হাওয়াইয়ের কেক অবজারভেটরি থেকে আন্দ্রিয়া গেজের দল স্বতন্ত্রভাবে নজর রাখছিল আর ডেটা সংগ্রহ করছিল মিল্কিওয়ে থেকে। প্রচণ্ড মহাজাগতিক ধূলির ভেতর দিয়ে পৃথিবী থেকে কিছু দেখা প্রায় অসম্ভব। প্রতি ১০০ কোটি আলোর কণা থেকে মাত্র একটি আলোর কণা ফোটন এসে পৌঁছাতে পারে টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। দুই দলই আলোর অবলোহিত তরঙ্গে দেখার চেষ্টা করেছে। তাতে খুব সামান্য বেশি ফোটন ধরা পড়েছে লেন্সে। কিন্তু অনেক বেশি সময় লাগে ডেটা সংগ্রহ করতে। তা ছাড়া পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পরিবেশ বদলে যায় অনেক দ্রুত। তাতে সমস্যা হয় আরও বেশি। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাঁদের নতুন বৈজ্ঞানিক কৌশল আবিষ্কার করতে হয়েছে। অনেক বেশি মাত্রার সংবেদী ডিজিটাল লাইট সেন্সর ব্যবহার করে তাঁরা কিছুটা ভালো ইমেজ পেলেন। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের প্রায় ৩০টি উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের দিকে নজর রেখেছেন তাঁরা। ৩০ বছর ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করে এবং সংগৃহীত ডেটা থেকে উভয় দলই প্রমাণ পেয়েছেন, সেখানে একটি নক্ষত্র S-02 গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরে আসছে মাত্র ১৬ বছরে। নক্ষত্রের ক্ষেত্রে এটা খুবই কম সময়। আমাদের সূর্যের প্রায় ২০ কোটি বছর লাগে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে। ভিন্ন ভিন্ন দুটি জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ করে দুটি স্বতন্ত্র দল একই ফলাফল পেল। তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা ব্ল্যাকহোল আছে, যার প্রচণ্ড টানে S-02 নক্ষত্র এত প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এই ব্ল্যাকহোলের ভর আমাদের সূর্যের ভরের ৪০ লাখ গুণ আর এই ৪০ লাখ সূর্যকে টেনে আনা হয়েছে আমাদের সৌরজগতের যতটুকু জায়গা ততটুকুতে। এর নাম দেওয়া হয়েছে স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার (SgrA*)। যদিও এটাকে এখনো পুরোপুরিভাবে ব্ল্যাকহোল বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, কিন্তু বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে অচিরেই গ্যালাক্সি এম-৮৭-এর কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোলের মতোই আমাদের SgrA* ব্ল্যাকহোলেরও ছবি পাওয়া যাবে।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট ওআরজি; সায়েন্টিফিক আমেরিকান; জার্নাল অব ফিজিকস; দ্য নেচার অব স্পেস অ্যান্ড টাইম/স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ ও কৃষ্ণবিবর, জামাল নজরুল ইসলাম