মহাকাব্যিক মহাকর্ষ তরঙ্গ

২০১৭ সালের ১ জুন তৃতীয়বারের মতো মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার ঘোষণা দেয় লাইগো। লাইগো সেই মহাকর্ষ তরঙ্গটি শনাক্ত করে সে বছরেরই ৪ জানুয়ারি। প্রায় ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা এই মহাকর্ষ তরঙ্গটির উৎস ছিল ৩১ ও ১৯ সৌরভরের দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলন। এ দুটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের মিলনের ফলে উৎপন্ন ব্ল্যাকহোলটি ছিল ৪৯ সৌরভরের সমান। বাকি ১ সৌরভরের সমান শক্তি ছড়িয়ে পড়ে মহাকর্ষ তরঙ্গ আকারে। তৃতীয় মহাকর্ষ তরঙ্গের উৎস আগের দুটির উৎসের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি দূরত্বে। সেই শনাক্তকরণের মাধ্যমে জানা গেছে কিছু নতুন সব তথ্য। এ উপলক্ষে মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত বিজ্ঞানচিন্তার সেই সংখ্যায়ে একটি ফিচার লেখেন ইবরাহিম মুদ্দাসসের ইশতিয়াক আকিব । সেই ফিচারটিই নতুন করে প্রকাশ করা হলো:

মহাকর্ষ তরঙ্গের কথা

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুসারে, মহাকর্ষ হচ্ছে বস্তুর ভরের প্রভাবে স্থান-কালের বক্রতা। বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তা বক্রতা তৈরি করবে তত বেশি। যেমন অল্প ভরের মানুষ স্থান-কালকে খুবই সামান্য বাঁকাতে পারবে। আবার ভর অনেক বেশি হলে যেমন সূর্যের ভর, আশপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেবে অনেকটা বেশি। এই যে ভরের প্রভাবে স্থানকাল বেঁকে যাচ্ছে, এই বাঁকানো পথে অন্য কোনো বস্তু যাওয়ার সময় তার পথটাও যায় বেঁকে। তা আমাদের কাছে ধরা পড়ে মহাকর্ষের প্রভাব হিসেবে।

এখন যদি কোনো ভরযুক্ত বস্তু স্থির না থেকে চলতে থাকে তাহলে কী হবে? আশপাশের বক্রতাকেও সঙ্গে নিয়ে চলতে শুরু করবে। বস্তু সমবেগে চললে বক্রতাও চলবে সমবেগে। তবে বস্তু কোনো কারণে ত্বরণ থাকলে—অর্থাত্ বেগের পরিবর্তন হলে বক্রতা আর সুষমভাবে চলবে না। ঢেউ খেলানো হয়ে যাবে বক্রতার পথ। এখান থেকেই আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব সিদ্ধান্তে আসে ভারী বস্তু বেগ পরিবর্তন করে চলতে থাকলে শক্তি বিকিরণ করবে। এই শক্তি চারপাশে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে ছড়িয়ে পড়বে। ছড়িয়ে পড়ার সময় এর গতি হবে তরঙ্গাকার, মানে ঢেউ খেলানো। অর্থাত্ এটি একটি তরঙ্গ। অনেকটা চার্জ বা আধানের মতো। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুসারে, আধান ত্বরণে গতিশীল হলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ, তথা আলো বিকিরণ করে।

ত্বরণে চলা ভরযুক্ত বস্তুর বিকিরিত তরঙ্গের নাম দেওয়া হলো মহাকর্ষ তরঙ্গ। এ তরঙ্গ শব্দের মতো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। শব্দ যেমন বাতাস বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে প্রসারণ ও সংকোচনের মাধ্যমে চলে, মহাকর্ষ তরঙ্গও স্থান-কালের সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে চলে। শব্দের সঙ্গে অবশ্য মহাকর্ষ তরঙ্গের একটা পার্থক্য আছে। শব্দ তরঙ্গের সংকোচন-প্রসারণ হয় একদিক বরাবর। কিন্তু মহাকর্ষ তরঙ্গের ক্ষেত্রে সংকোচন-প্রসারণ হয় দৈর্ঘ্য-প্রস্থ উভয় দিকে। অর্থাত্ দৈর্ঘ্য বরাবর প্রসারিত হলে প্রস্থ বরাবর সংকুচিত হয়। আবার পর মুহূর্তেই প্রস্থ বরাবর সংকোচন ঘটলে প্রসারণ ঘটে দৈর্ঘ্য বরাবরও। এভাবেই স্থান-কালকে সংকোচন-প্রসারণ করে এগিয়ে যায় মহাকর্ষ তরঙ্গ।

মহাকর্ষ তরঙ্গ যেহেতু স্থান-কালকে দুমড়েমুচড়ে দেয়, তাই ওই স্থান ওই সময়ে থাকা সব বস্তুও দুমড়েমুচড়ে যায়। অর্থাত্ বস্তুরও সংকোচন ঘটে দৈর্ঘ্য বরাবরও, প্রসারণ ঘটে প্রস্থ বরাবর। পরমুহূর্তেই ঘটে উল্টো ঘটনা। যেমন ধরা যাক, একটা মহাকর্ষ তরঙ্গ আপনার বাসার ছাদ ভেদ করে পুরো বাসা ভেদ করে মাটির মধ্য দিয়ে চলে গেল। আপনার বাসার সামনের আর পেছনের দেয়ালের দূরত্বকে যদি দৈর্ঘ্য ধরা হয় তবে এই দূরত্বটা একটু কমে যাবে। একই সঙ্গে প্রস্থ বরাবর, অর্থাত্ পাশের দেয়ালের দূরত্ব যাবে একটু বেড়ে। আবার পরমুহূর্তেই ঘটবে উল্টো ঘটনা।

এখন কথা হচ্ছে যেকোনো ভরের বস্তুর জন্যই কি মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হবে? তাত্ত্বিক উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হবে। যেমন একটা গাড়ি হঠাত্ চলতে শুরু করলে তার একটা বেগ বাড়তে থাকবে। অর্থাত্ এ গতি ত্বরিত গতি। হিসাবমতো, সে তৈরি করবে মহাকর্ষ তরঙ্গ। কিন্তু এ মহাকর্ষ তরঙ্গ এত কম যে তা আমরা কখনোই শনাক্ত করতে পারব না। এমনকি পৃথিবীর মতো বিশাল ভারী বস্তুর উত্পন্ন মহাকর্ষ তরঙ্গও শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তবে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব।

ব্ল্যাকহোল অত্যন্ত ভারী বস্তু। এখন দুটি ব্ল্যাকহোল যদি পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে একে অপরের দিকে ছুটে যাবে মহাকর্ষের টানে। এরা কিন্তু যাওয়ার সময় সোজাসুজি একজন আরেকজনের দিকে ধাবিত হবে না; বরং একজন আরেকজনকে ঘিরে ঘুরতে থাকবে। কারণ, এরা তো দুজনই আশপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। একজনের বাঁকানো পথে অন্যজন চলবে। আমরা জানি, ত্বরণ হচ্ছে দ্রুতি অথবা দিকের পরিবর্তনের হার। যেহেতু দুটো ব্ল্যাকহোলই ঘুরছে, তাই প্রতিমুহূর্তে এদের দিকের পরিবর্তন হচ্ছে তথা ত্বরণ হচ্ছে। এ কারণে সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে উভয়ে মহাকর্ষ তরঙ্গ আকারে শক্তি বিকিরণ করবে। কিছু শক্তি ছেড়ে দেওয়ার জন্য এরা আর আগের মতো দূরত্বে ঘুরতে পারবে না। তাই দুটো ব্ল্যাকহোল কাছাকাছি চলে আসবে। কাছাকাছি আসায় এদের মধ্যে মহাকর্ষ বল আরও বাড়বে, তাই ত্বরণও আরও বাড়বে; এ কারণে আরও বেশি মহাকর্ষ তরঙ্গাকারে শক্তি ছেড়ে দেবে। এভাবে কাছে আসতে আসতে দুটো ব্ল্যাকহোল মিলে একটিতে পরিণত হবে। আর মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রাবল্যও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। মিলে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রাবল্য সব থেকে বেশি হবে। কিন্তু নতুন ব্ল্যাকহোল তৈরি হওয়ার পর যেহেতু আর ও রকম ত্বরণ নেই, তাই আর কোনো মহাকর্ষ তরঙ্গ পাওয়া যাবে না। একত্র হয়ে যাওয়ার পর থেকে ব্ল্যাকহোলের তো আর আগের সেই ত্বরিত গতিটা থাকছে না, তাই আর শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গও সৃষ্টি করবে না। অর্থাত্ আমরা যদি পৃথিবীতে বসে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করতে চাই, মিলনের ঠিক আগ মুহূর্তে উৎপন্ন মহাকর্ষ তরঙ্গকেই শনাক্ত করতে হবে।

মহাকর্ষ তরঙ্গের কথা যেভাবে জানা গেল

শতকোটি বছর আগে রওনা দেওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ এখন ধরতে চাইলেও এদের কথা আমরা কিন্তু বেশি দিন আগে জানতে পারিনি। মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রথম ধারণাটা কিন্তু আইনস্টাইনও দেননি। দিয়েছিলেন হেনরি পয়েনকার, ১৯০৫ সালে। তিনি বিদ্যুত্ ক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের জন্য একধরনের তরঙ্গের ধারণা দেন। বিদ্যুেক্ষত্র যেমন ত্বরিত হলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে, পয়েনকার ধারণা করেন, মহাকর্ষক্ষেত্রও নিশ্চয় তেমনি তরঙ্গ বিকিরণ করবে। কিন্তু পয়েনকারের এ ধারণা ধোপে টেকেনি, কারণ চুম্বক দ্বিমেরু বা চার্জের দ্বিমেরুর মতো মহাকর্ষ দ্বিমেরুর কোনো অস্তিত্ব নেই।

এরপরের ইতিহাস আসলে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব দেওয়ার পরে। সাধারণ তত্ত্ব দেওয়ার পর হিসাবমতো মহাকর্ষ তরঙ্গ অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল। আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে তিন ধরনের মহাকর্ষ তরঙ্গের কথা পাওয়া গেল। এই তিন তরঙ্গের নাম হারমান ভাইল দিলেন অনুদৈর্ঘ্য-অনুদৈর্ঘ্য, অনুদৈর্ঘ্য-অনুপ্রস্থ এবং অনুপ্রস্থ-অনুপ্রস্থ। কিন্তু এ তিন মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব বেশি দিন টিকল না। ১৯২২ সালে স্যার আর্থার এডিংটন প্রমাণ করলেন, অনুদৈর্ঘ্য-অনুপ্রস্থ এবং অনুপ্রস্থ-অনুপ্রস্থ মহাকর্ষ তরঙ্গ আসলে আলাদা করে কিছু থাকার কথা না। তিনি দেখালেন, এই দুই প্রকার তরঙ্গ কেবলই স্থানাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাত্ ইচ্ছামতো স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা ধরে নিলে এই দুই প্রকার (অনুদৈর্ঘ্য-অনুপ্রস্থ ও অনুপ্রস্থ-অনুপ্রস্থ) তরঙ্গের ইচ্ছামতো মান পাওয়া যায়। এ কারণে ওই দুই প্রকার তরঙ্গের আসলে কোনো গুরুত্ব নেই।

এরপর যা হওয়ার তা-ই হলো। দুই প্রকার মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব নেই হয়ে যাওয়ায় সন্দেহের সৃষ্টি হলো অনুদৈর্ঘ্য-অনুদৈর্ঘ্য মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়েও। ১৯৫৬ সালে ফেলিক্স পিরানি এই সমস্যার সমাধান করেন। তিনি রিমান কারভেচার টেনসর দিয়ে হিসাব করেন, এ ক্ষেত্রে মহাকর্ষ তরঙ্গ পাওয়া যায় মাত্র একটা। তিন মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যার সমাধানও হয়ে যায় একই সঙ্গে। এরপর মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে যে তা আসলেই শক্তি বহন করে কি না। এ প্রশ্নের সমাধান হয় ১৯৫৭ সালে, চ্যাপেল হিল কনফারেনেসে রিচার্ড ফাইনম্যানের প্রস্তাবিত স্টিকি বিড আর্গুমেন্টের (Sticky bead argument) মাধ্যমে। সবাই যখন এই সমস্যার সমাধানে হন্যে হয়ে বড় বড় সমীকরণ নিয়ে পড়ে ছিল, তখন ফাইনম্যান দিলেন এই নিতান্তই নিরীহদর্শন সমাধান। ধরা যাক, একটা লম্বা লাঠিতে ছোট ছোট দানা লাগানো আছে। এখন যদি মহাকর্ষ তরঙ্গ এই লাঠিকে অতিক্রম করে যায়, তবে দানাগুলো লাঠির ওপর দিয়ে চলতে থাকবে। তাহলে লাঠির ওপরের তলের সঙ্গে দানাগুলোর ঘর্ষণ হবে, ঘর্ষণে তাপ উত্পন্ন হবে। তাপ একপ্রকার শক্তি এবং এই তাপশক্তি এসেছে মহাকর্ষ তরঙ্গের দরুন। সুতরাং মহাকর্ষ তরঙ্গ অবশ্যই শক্তি বহন করে।

মহাকর্ষ তরঙ্গের সরাসরি প্রমাণ মাত্র ২০১৫ সালে পাওয়া গেলেও পরোক্ষ প্রমাণ কিন্তু পাওয়া গিয়েছিল ১৯৭৪ সালেই। বিজ্ঞানী হালস এবং টেইলর একটি পালসার তারাযুগল পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখেন, এদের পর্যায়কালের ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে মহাকর্ষচালিত কোনো সিস্টেমের শক্তি তথা, পর্যায়কাল হ্রাস পাওয়ার কথা নয়। এর একমাত্র ব্যাখ্যা ছিল, মহাকর্ষ তরঙ্গ আকারে শক্তির বিকিরণ হচ্ছে তাই পর্যায়কাল হ্রাস পাচ্ছে। এই পরীক্ষার ফলাফল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের করা ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মিলে যায়। এই আবিষ্কারের জন্য হালস ও টেইলর ১৯৯৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।

তবে নানা চেষ্টার পরও সরাসরি মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা যাচ্ছিল না। ২০১৪ সালে হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিকসের বাইসেপ-২ নামক দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত ডিটেক্টরে বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পরের মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরতে পারার দাবি করা হয়। তবে এই সিগন্যাল মহাকাশের ধুলার জন্যও হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, তাই এই দাবি স্বীকৃতি পায়নি। অবশেষে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের ৩৬ ও ৩৯ সৌরভরের দুটো ব্ল্যাকহোলের মিলনে নির্গত মহাকর্ষ তরঙ্গ লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি বা সংক্ষেপে লাইগোর দুটি ডিটেক্টরে ধরা পড়ে। এরপর ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে এমন আরেকটি মিলনের তরঙ্গ ধরা পড়ে। সবশেষ ১ জুন ২০১৭ সালে লাইগো থেকে ঘোষণা আসে, তারা এ বছরের ৪ জানুয়ারিতে ৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের ৩১ এবং ১৯ সৌরভরের দুটো ব্ল্যাকহোল মিলনের মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করেছে।

যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ মহাকর্ষ তরঙ্গ

শতবর্ষের এই অভিযানের বাইরেও মহাকর্ষ তরঙ্গের গুরুত্ব অনেক। মহাকর্ষ তরঙ্গ খুঁজে পাওয়ার পরই প্রথমবারের মতো সরাসরি ব্ল্যাকহোলের প্রমাণ পেলাম আমরা। এর আগে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব পেতে পার্শ্ববর্তী নক্ষত্রের গতি এবং Accretion disk থেকে নির্গত বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করতে হতো। তা ছাড়া আগের পদ্ধতিতে সঙ্গী নক্ষত্র ছাড়া ব্ল্যাকহোল খুঁজে পাওয়াও সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন থেকে আমরা সরাসরি ব্ল্যাকহোল পর্যবেক্ষণ করছি মহাকর্ষ তরঙ্গ দিয়ে। এখন আর সঙ্গী নক্ষত্রেরও দরকার নেই। তাই এখন মহাকর্ষ তরঙ্গ দিয়েই বের করা যাবে ব্ল্যাকহোল। ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো আগের ধারণার চেয়ে বেশিই আছে ব্ল্যাকহোল।

মহাকর্ষ তরঙ্গ থেকে আমরা গ্রাভিটনের বৈশিষ্ট্য জানতে পারছি। মহাকর্ষ তরঙ্গের বেগ থেকে গ্রাভিটনের ভরের সম্পর্কে আরও নিখুঁত ধারণা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরতে পারলে বলা যাবে আসলেই গ্রাভিটন ভরহীন কি না।

গ্রাভিটনের অস্তিত্ব আবিষ্কার হলে আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিকসকে একই সুতোয় গাঁথা যাবে, যা হবে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

বিজ্ঞানীদের আরেকটি বড় আশার জায়গা হচ্ছে, বিগ ব্যাংয়ের পরে তৈরি হওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরতে পারা। বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পরে মহাবিশ্বের স্ফীতি (inflation) হয়, ফলে স্থান-কাল খুব দ্রুত প্রসারিত হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই প্রসারণের ফলে তৈরি হওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ এখনো আমাদের আশপাশেই আছে। ২০১৪ সালে বাইসেপ-২ বিগ ব্যাংয়ের মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরতে পারার দাবি করেছিল, যা পরে নাকচ হয়ে যায়। তবে এখনো সেই আদি মহাকর্ষ তরঙ্গের খোঁজ চলছে। বিগ ব্যাংয়ের মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরতে পারলে সেটা নিঃসন্দেহে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারের একটা হবে।

মহাকর্ষ তরঙ্গ জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন শাখার শুরু করেছে, যার নাম মহাকর্ষ তরঙ্গ জ্যোতির্বিজ্ঞান (Graavitational wave astronomy)। এত দিন পর্যন্ত মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য আমাদের একমাত্র হাতিয়ার ছিল আলো। কিন্তু এখন থেকে আমরা তা দেখার পাশাপাশি শুনতেও পারব বলে ধারণা করছেন অনেক বিজ্ঞানী। তাই এই অর্থে যে মহাকর্ষ তরঙ্গ প্রকারের হিসাবে শব্দের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মজার ব্যাপার হলো, মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার পর তার কম্পিউটার সিম্যুলেশন যে মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি করে, তা একটি শব্দও উত্পন্ন করে।

এবার যা জানা গেল

বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ তরঙ্গের ক্ষেত্রে একটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে চান, যার নাম বিচ্ছুরণ। আলোর কথাই ধরা যাক। আলো যখন কোনো মাধ্যমে প্রবেশ করে, তখন আলাদা তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের জন্য বেগ আলাদা হয়। এ জন্য প্রিজমের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আলো বিভিন্ন রঙে ভেঙে যায়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বলে, মহাকর্ষ তরঙ্গের ক্ষেত্রে এমন বিচ্ছুরণ দেখা যাবে না। আসলেই যাবে কি না, তা-ই দেখতে চান বিজ্ঞানীরা।

যদি মহাকর্ষ তরঙ্গেরও বিচ্ছুরণ হয়, তবে মহাকর্ষ তরঙ্গ যত দূর থেকে আসবে, তার বিচ্ছুরণ হবে তত বেশি। এবারের মহাকর্ষ তরঙ্গের উত্স ছিল আগের দুই উেসর দ্বিগুণের বেশি। মহাকর্ষ তরঙ্গের ক্ষেত্রে এবারও কোনো বিচ্ছুরণ ধরা পড়েনি। তাই আইনস্টাইনকে এখনো এ ব্যাপারে ভুল প্রমাণ করা যায়নি।

ধরা হয়, মহাকর্ষ বল বহনকারী কণার নাম গ্রাভিটন। গ্রাভিটনের ভরের সঙ্গে বিচ্ছুরণের সরাসরি সম্পর্ক আছে। পদার্থবিজ্ঞানে এক বড় প্রশ্ন গ্রাভিটনের ভর। লাইগোর সহকারী মুখপাত্র লরা ক্যাডোনাটি জানান, তাঁরা এই শনাক্তকরণের মাধ্যমে গ্রাভিটনের ভরের সীমা আগের থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। যদি মহাকর্ষ তরঙ্গের জন্য বিচ্ছুরণের অস্তিত্ব নেই এটা প্রমাণ করা যায়, তবে গ্রাভিটনের ভর হবে শূন্য। গ্রাভিটনের ভর শূন্য হওয়ার অর্থ, গ্রাভিটন তথা মহাকর্ষ বলের বেগ আলোর বেগের সমান।

দ্বিতীয়ত, এবার যে দুটো ব্ল্যাকহোল মিলে নতুন ব্ল্যাকহোল তৈরি করেছে, তাদের নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণনের দিক একই ছিল না। ঘূর্ণন অক্ষ ছিল ভিন্ন। অর্থাত্ এদের উত্স ছিল ভিন্ন। সাধারণত জোড়া ব্ল্যাকহোল তৈরি হয় জোড়া তারা থেকে, যারা একই গ্যাসপুঞ্জ থেকে সৃষ্টি। এ কারণে তাদের নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণনের দিক একই হবে। যেমন সৌরজগতের সবকিছু একই গ্যাসপুঞ্জ থেকে তৈরি। তাই মোটামুটি সব গ্রহ, ধূমকেতুর ঘূর্ণনের দিক এবং সূর্যের ঘূর্ণনের দিক একই। যদি দুটো ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণনের দিক একই হয়, তবে মিলিত হওয়ার সর্বশেষ মুহূর্তে তাদের সামান্য বেশি সময় লাগবে, যেমনটা প্রথম দুই শণাক্তকরণে ছিল। তার মানে, দুটো যুগল তারার পরিবর্তিত অবস্থা থেকে ওই মহাকর্ষ তরঙ্গ দুটি উত্পন্ন হয়েছিল।

কিন্তু এবার আসা সিগন্যাল থেকে এমন কোনো সময় ব্যবধান লক্ষ করা যায়নি। তাই বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, ব্ল্যাকহোল দুটোর ঘূর্ণনের দিক ছিল আলাদা। যার অর্থ এরা আলাদাভাবে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়ে পরবর্তী সময়ে একে অপরের আকর্ষণে বাধা পড়ে। এ রকমটা হতে পারে, যদি অনেক ব্ল্যাকহোল খুব ঘন ক্লাস্টার আকারে অবস্থান করে। এ রকম ঘন ব্ল্যাকহোল ক্লাস্টার ডার্ক ম্যাটারের একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। কেননা ডার্ক ম্যাটার ও ব্ল্যাকহোল দুটোই কেবল মহাকর্ষ বল ছাড়া অন্য কোনো মিথস্ক্রিয়া করে না।

তৃতীয়ত, এটা নতুন এক প্রজাতির ব্ল্যাকহোলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত দুই রকমের ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে অবগত ছিলেন। প্রথম প্রকার হচ্ছে চন্দ্রশেখর সীমার ওপরের তারার শেষ অবস্থা এবং দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোল। তারা থেকে বিবর্তিত ব্ল্যাকহোলগুলোর ভর সাধারণত ৪-১৫ সৌর ভর এবং গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোলগুলোর ভর কয়েক অযুত থেকে কয়েক শতকোটি সৌর ভর। হিসাবমতো এর মাঝামাঝি কোনো ব্ল্যাকহোল থাকার কথা নয়।

কিন্তু প্রথমবার মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার পর আবার এই দুই সীমার মধ্যবর্তী ভরের ব্ল্যাকহোল পাওয়া গেল। অর্থাত্ শনাক্ত করা তিনটি মহাকর্ষ তরঙ্গের উত্সই এমন ব্ল্যাকহোল থেকে আসা, যে ভরের ব্ল্যাকহোলের কথা আগে জানা ছিল না। এ রকম ভরের ব্ল্যাকহোলের উত্স কী, তা এখন এক বড় প্রশ্ন। একটা সম্ভাব্য সমাধান হচ্ছে, এরা নিজেরাই দুটো ব্ল্যাকহোলের মিলিত হওয়ার ফল।

তবে আরও একটা সম্ভাবনা বিজ্ঞানীদের উচ্ছ্বসিত করছে। হয়তো এরা ঠিক বিগ ব্যাংয়ের পরের মুহূর্তে সৃষ্ট। এমন হতে হলে বিগ ব্যাংয়ের পরে ব্ল্যাকহোলের ক্লাস্টার তৈরি হওয়ার কথা। ফলে এই ক্লাস্টারের ব্ল্যাকহোলের ভর যেকোনো রকমই হতে পারে। এ রকম উত্পত্তি হয়ে থাকলে এবারের পাওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ উত্পন্নকারী ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণনের দিক না মেলার ব্যাখ্যাও দেওয়া যেতে পারে এখান থেকে। এমনকি এটা হতে পারে ডার্ক ম্যাটারেরও ব্যাখ্যা। তবে নিশ্চিতভাবে সঠিক ব্যাখ্যা বলতে হলে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন পড়বে।

লেখক:

ইবরাহিম মুদ্দাসসের, পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র

ইশতিয়াক আকিব, শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (কাইস্ট)

সূত্র: লাইগো নিউজ