রাডার থেকে মাইক্রোওয়েভ ওভেন

১৯৪৫ সালের কথা। রাডারের জন্য চৌম্বক তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছিলেন মার্কিন প্রকৌশলী পার্সি স্পেনসার। হঠাৎ অদ্ভুত এক অনুভূতি টের পেলেন পার্সি। অনুভূতিটা আসছে তাঁর পকেট থেকে। সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন অদ্ভূত অনিভূতিটার কারণ উত্স সেটাই। পকেটে একটা ক্যান্ডিবার ছিল, সেটা গলে গেছে। কিন্তু ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা না হলে তো ক্যান্ডিবার গলে যাওয়ার কথা নয়। তাহলে তিনি ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন!

পার্সি স্পেনসার কাজ করছিলেন রেথিয়ন কোম্পানির গবেষণাগারে। রেথিয়ন কোম্পানির পাওয়ার টিউব ডিভিশনের প্রধান তিনি। রাডার টিউব ডিজাইনে তখন তিনি অদ্বিতীয়। যুদ্ধে ব্যবহূত রাডারের উপকরণগুলো আরও কার্যকর করার গবেষণার লড়াইয়ে নেমেছিল বেশ কয়েকটা কোম্পানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। অস্ত্র ও রাডার ব্যবসা জমজমাট। স্পেনসারের সুখ্যাতির কারণে রেথিয়ন কোম্পানি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) রেডিয়েশন গবেষণাগারের জন্য রাডারের যন্ত্রপাতি ডিজাইন করা ও উত্পাদনের কাজটি সরকারের কাছ থেকে সহজেই পেয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ম্যানহাটন প্রজেক্টের পর মার্কিন সরকার কাজটাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল। এ কারণে কয়েক বছরের মধ্যে পার্সির কর্মী সংখ্যা ১৫ থেকে ৫ হাজার হয়েছিল।

যাহোক, ক্যান্ডিবার গলে যাওয়ায় বেশ অবাক হলেন স্পেনসার। খেয়াল করে দেখলেন, তিনি একটি চলমান রাডার সেটের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। রাডারের সামনে দাঁড়িয়ে যে কাণ্ডটা ঘটে গেল, এটা যে স্পেনসারের বেলায়ই প্রথম হয়েছে তা নয়। তবে স্পেনসারই প্রথম বিষয়টা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। এবার স্পেনসারের কৌতূহলের কারণে তাঁর কয়েকজন সহকর্মী কিছু খাবার নিয়ে এলেন। এবং তাঁরা দেখলেন খাবার গরম হচ্ছে। রাডার থেকে বেরোনো অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভের কারণে এই খাবার গরম হচ্ছে। এবার কিছু ভুট্টার দানা এনে রাখলেন ওই তরঙ্গ বরাবর। বাহ্! ভুট্টার দানাগুলো নিমেষেই পপকর্ন হয়ে গেল। স্পেনসারের কৌতূহল তবু মিটল না। এবার তিনি একটা ডিম নিয়ে এলেন। চায়ের কেটলিতে ডিমটা রেখে ঠিক তার ওপর ম্যাগনেট্রন রাখা হল। ডিমটার কী হলো বারবার দেখার জন্য মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর বিকট শব্দে ডিমটা বিস্ফোরিত হয়ে তাঁর সহকর্মীর মুখমণ্ডলে মেখে গেল।

এবার কী করতে হবে বুঝে ফেললেন স্পেনসার। একটি ঘের দেওয়া ধাতব বাক্সের ভেতর দিয়ে ঘন বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করলেন। এই ক্ষুদ্র তরঙ্গ এখন আর বাইরে বেরিয়ে তো যেতে পারবেই না, বরং অতিক্ষুদ্র তরঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর নিরাপদও হবে। এটাই হলো দুনিয়ার প্রথম মাইক্রোওয়েভ ওভেন। আবিষ্কারের পর নানা তাপমাত্রায় নানা খাবার দিয়ে পরীক্ষা চালালেন পার্সি।

১৯৪৫ সালের ৮ অক্টোবর মাইক্রোওয়েভ ওভেনের পেটেন্ট নেয় স্পেনসারের কোম্পানি রেথিয়ন। তখন যন্ত্রটার নাম ছিল রাডারেঞ্জ। বাণিজ্যিকভাবে তৈরি প্রথম মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ওজন ছিল ৩৪০ কেজির বেশি, উচ্চতায় ছিল ছয় ফুট। যন্ত্রটার দাম ছিল ৫ হাজার ডলার। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে ১৯৬৭ সালে। তখন এর আকার বেশ ছোট হয়ে যায়। আর দাম? মাত্র ৪৯৫ ডলার।

স্পেনসারের জীবন

স্পেনসারের জন্ম ১৮৯৪ সালের ৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মেইনের হাউল্যান্ডে। মাত্র ১৮ মাস বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। চাচা-চাচির কাছে স্পেনসারকে রেখে চলে যান মা। সাত বছর বয়সে তাঁর চাচাও মারা যান। ১২ বছর বয়সে গ্রামার স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়ে কাজ নেন সুতা প্যাঁচানোর নাটাই তৈরির কারখানায়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করতেন। টানা চার বছর কাজ করলেন সেখানে। তখন কাছাকাছি একটা কাগজকলের কথা শুনলেন, যেটা বিদ্যুতে চলে। বৈদ্যুতিক কারখানা তাঁকে আকৃষ্ট করল। মেইনের নির্জন এলাকার বেশির ভাগ মানুষ তখন বিদ্যুত্ সম্পর্কে জানতই না। বিদ্যুত্ সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করলেন স্পেনসার। ওই কাগজকলে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার কাজে তিনজনের একজন হিসেবে কাজ শুরু করলেন।

আঠারো বছর বয়সে মার্কিন নৌবাহিনীতে কাজ করার ইচ্ছে হলো স্পেনসারের। কারণ একটাই। তারবিহীন যোগাযোগব্যবস্থা তাঁকে ভীষণ রকম কৌতূহলী করে তুলেছিল। বিশেষ করে টাইটানিক জাহাজডুবির পর এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন নৌবাহিনীতে কাজ করার সময় রেডিও প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠলেন তিনি। এ নিয়ে বিস্তর পড়ালেখাও করলেন। গোগ্রাসে পড়লেন ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ধাতুবিদ্যাসহ আরও অনেক কিছু।

১৯৩৯ সালে রেথিয়ন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হলেন রাডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে। বাকিটা তো ইতিহাস।

১৯৭০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের নিউটনে ইহলোক ত্যাগ করেন স্পেনসার।

লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত