লেজার রশ্মি ও আধুনিক চিকিৎসা

লেজার রশ্মিফাইল ছবি

রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় আলোর ব্যবহার হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে। বৈদ্যুতিক আলো উদ্ভাবনের আগপর্যন্ত প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করেছে মানুষ। প্রাচীন কালের মানুষ সূর্যের আলোর সাহায্যে অনেক রোগের চিকিৎসা করতো– বিশেষ করে ত্বক, চোখ ইত্যাদির। বৈদ্যুতিক বাতি উদ্ভাবনের পর ক্রমে ক্রমে সূর্যের আলোর চেয়েও অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং শক্তিশালী আলোর উৎস মানুষের হাতের মুঠোয় এসে যায়। তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের যে অংশটা আমরা দেখতে পাই, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০ ন্যানোমিটার থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। দৃশ্যমান আলোর একটি পরিবর্তিত শক্তিশালী রূপ হলো লেজার (Laser)। ১৯৬০ সালে লেজার উদ্ভাবনের পর থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব শাখায় লেজার ব্যবহার করা হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানও তার ব্যতিক্রম নয়। এই অধ্যায়ে আমরা দেখবো রোগের চিকিৎসায় লেজার কীভাবে ভূমিকা রাখছে।

লেজার শব্দটি 'লাইট অ্যামপ্লিফিকেশান বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন'-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। বিশেষ উদ্দীপনায় আলোর বিকিরণ ঘটিয়ে সাধারণ আলোর ক্ষমতা ও শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলে লেজার তৈরি করা হয়। লেজার তৈরির প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৭ সালে। তিনি ‘অন দি কোয়ান্টাম থিওরি অব রেডিয়েশন’ গবেষণাপত্রে ফোটনের ধর্ম কাজের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন । সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, যদি কোনো ফোটন কোনো পরমাণুর ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তবে ইলেকট্রনটি ফোটনের শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হবে। উত্তেজিত হয়ে ইলেকট্রনটি তাঁর মূল শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যাবে। কিন্তু যদি ফোটন কোন উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তখন উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন তার অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের মূল শক্তিস্তরে ফিরে আসবে। এই শক্তিস্তর পরিবর্তনের সময় যে শক্তি ত্যাগ করবে, সেই শক্তি যে ফোটনটি ধাক্কা দিয়েছিল সেই ফোটনের শক্তির সমান। এক্ষেত্রে একই শক্তির দুটি ফোটন একই দিকে একইভাবে ছুটে যাবে। এই দুটি ফোটন যদি আবার দুটি উত্তেজিত ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, আরো দুটি সমান শক্তির ফোটন পাওয়া যাবে। মোট ফোটন হবে চারটি। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এই চারটি থেকে আটটি, আটটি থেকে ষোলটি, ষোলটি থেকে বত্রিশটি– এভাবে কোটি কোটি একই শক্তির ফোটনের স্রোত তৈরি হবে। এই ফোটনগুলির প্রত্যেকটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সমান। ফলে এদের সম্মিলিত প্রাবল্য হবে সাধারণ আলোর চেয়ে অনেক বেশি।

আইনস্টাইনের এই তত্ত্বকে প্রথম কাজে লাগিয়েছিলেন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী চার্লস হার্ড টাউনস। তিনি অ্যামোনিয়া বাষ্পের ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে সেখান থেকে শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ তৈরি করেছিলেন, যেটার নাম দেয়া হয়েছিল মেজার (Maser – মাইক্রোওয়েভ অ্যাম্প্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অ্যান্ড রেডিয়েশন) ১৯৫৩ সালে। এই পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৬৪ সালে। মেজার পদ্ধতিতে যে শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ পাওয়া যায়– সেই মাইক্রোওয়েভ খালি চোখে দেখা যায় না। মেজার পদ্ধতির মতো করে মাইক্রোওয়েভের পরিবর্তে শক্তিশালী দৃশ্যমান আলো তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী থিওডর হ্যারোল্ড ম্যাইম্যান ১৯৬০ সালে।

বিশ্বের প্রথম লেজারের সাথে থিওডর ম্যাইম্যান
ফাইল ছবি

শুরুতে এর নাম ছিল অপটিক্যাল মেজার। পরে নাম দেয়া হয় লেজার। থিওডর ম্যাইম্যান একটি রুবি রড (রুবি পাথরের রড) ব্যবহার করেন লেজারের উৎস হিসেবে। রুবি রডে উচ্চশক্তির আলো ফেলে রুবির পরমাণুর ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে সেই ইলেকট্রন থেকে ফোটনের স্রোত তৈরি করেন। সেই ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৬৯৪ ন্যানোমিটার যা দৃশ্যমান আলোর লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি। ম্যাইম্যানের দেখানো পথে এখন বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লেজার রশ্মি তৈরি করা সম্ভব। যে উৎস থেকে লেজার তৈরি হয়– সেই উৎসের নামেই লেজার রশ্মির নাম দেয়া হয়। যেমন রুবি থেকে উৎপন্ন লেজার– রুবি লেজার, আর্গন গ্যাস থেকে উৎপন্ন লেজার – আর্গন লেজার, ইত্যাদি।

লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়মে এগুলি কক্ষপথে বিন্যস্ত থাকে– প্রথম কক্ষপথে ২টি, দ্বিতীয় কক্ষপথে ৮টি, তৃতীয় কক্ষপথে ১৮টি ইত্যাদি। ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলি হলো তাদের শক্তিস্তর। একটি কক্ষপথে যতগুলি ইলেকট্রন থাকে সবগুলি ইলেকট্রনের শক্তি সমান। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের যে কক্ষপথ (১ম কক্ষপথ), সেই কক্ষপথে যে সব ইলেকট্রন থাকে তাদের শক্তি সবচেয়ে কম। এই শক্তিস্তরকে গ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়। ইলেকট্রনগুলি যদি কোনভাবে শক্তি শোষণ করে তখন তারা উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু একটু পরেই সেই অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। স্বতস্ফূর্তভাবে শক্তি নির্গমনের এই প্রক্রিয়াকে স্পনটেনিয়াস এমিশন বলা হয়। পরমাণুর ইলেকট্রনগুলিকে যদি নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনগুলি উত্তেজিত হয়ে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে তখন যে শক্তি শোষণ করেছিল তা ফোটনের মাধ্যমে বের করে দেয়। এই নির্গত ফোটনের শক্তি শোষিত ফোটনের শক্তির সমান। ফোটনের প্রবাহ যদি অনবরত চলতে থাকে– তাহলে একটি ফোটন থেকে একই শক্তির ২টি ফোটন, ২টি থেকে ৪টি, ৪টি থেকে ৮টি ফোটন– এভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোটি কোটি ফোটনের প্রবাহ পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ফোটনের শক্তি সমান এবং প্রত্যেকেই একই সাথে একই দিকে যায়। তীব্র প্রাবল্যের এই ফোটনপ্রবাহই লেজার। সাধারণ দৃশ্যমান আলোতে ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে কোন তরঙ্গ থাকতে পারে। তাই আলোকরশ্মি সমশক্তির হয় না এবং বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মিশ্রণের কারণে সবগুলি ফোটন একদিকে না গিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু লেজারে সবগুলি ফোটনের শক্তি সমান, ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যও সমান। ফলে তারা সব একবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে। লেজার রশ্মি তাই একটুও না ছড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। পৃথিবী থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে লেজার রশ্মি পাঠানো হয়, সেই রশ্মি একটুও ছড়িয়ে না পড়ে চাঁদের পিঠে রাখা আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে।

একটি ফোটন থেকে দুইটি একই শক্তির ফোটন সৃষ্টির প্রক্রিয়া
ছবি: লেখক

লেজার এখন ব্যবহৃত হচ্ছে যে কোন আধুনিক প্রযুক্তিতে। স্লাইড পয়েন্টারের লেজার রশ্মি তৈরি করা হচ্ছে কলমের চেয়ে ছোট ডিভাইসে। সিডি, ডিভিডি প্লেয়ার, প্রিন্টার ইত্যাদিতে লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়। যে কোন বারকোডের ডিজিটাল স্ক্যানিং-এ লেজার স্ক্যানার ব্যবহৃত হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেজার দিয়ে বড় বড় স্টিলের পাত কেটে ফেলা যায় নিমিষে। চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের লেজার। সব ধরনের লেজারেরই মূল প্রস্তুত প্রণালী কমবেশি একই রকম।

প্রথমে দরকার একটি উপযুক্ত পদার্থের অ্যামপ্লিফাইয়িং মিডিয়াম বা গেইন মিডিয়াম বা অ্যাকটিভ মিডিয়াম। এই মিডিয়ামের ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে ফোটন বের করা হয়। এই মিডিয়াম কঠিন, গ্যাস, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি হতে পারে। এই পদার্থের ওপর বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রয়োগ করলে পদার্থের ইলেকট্রন উত্তেজিত হয় এবং ফোটন নির্গত হয়। অ্যাকটিভ মিডিয়ামের আলোর ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মিডিয়ামের চারপাশে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করা হয়, অথবা অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় পাম্পিং। ফ্ল্যাশ লাইট বা অন্য লেজার দিয়েও এই পাম্পিং করা যায়। পাম্পিংসহ অ্যাকটিভ মিডিয়ামকে একটি সিলিন্ডার আকৃতির নলের মধ্যে স্থাপন করা হয়। এই নলটিকে বলা হয় লেজার ক্যাভিটি। এই নলের দুই প্রান্তে দুটি আয়না বসানো থাকে। নলের ভেতর যে আলো উৎপন্ন হয় সেই আলো এই আয়না দুটোতে অনবরত প্রতিফলিত হতে থাকে। একটি আয়না নলের ভেতরের সব আলোর প্রতিফলন ঘটায়। অন্যদিকের আয়নাটি পুরোপুরি প্রতিফলক নয়। সেই আয়না কিছুটা স্বচ্ছ– যার ভেতর দিয়ে লেজার রশ্মি বের হয়ে আসে।

লেজার তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান
ছবি: লেখক

সাধারণত অ্যাকটিভ মিডিয়ামের নাম অনুসারে লেজারের নাম হয়ে থাকে। যেমন অ্যাকটিভ মিডিয়াম রুবি হলে– রুবি লেজার, গেইন মিডিয়াম আর্গন গ্যাস হলে আর্গন লেজার ইত্যাদি। বিভিন্ন মিডিয়াম থেকে উৎপন্ন লেজারের শক্তি এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেক রকমের ও শক্তির লেজার ব্যবহার করা হয়। কসমেটিক সার্জারি, ত্বকের চিকিৎসায়, ক্ষতস্থান নিরাময়ে, অসাড় স্নায়ুর উদ্দীপনা জোগাতে, দাঁতের চিকিৎসায়, চোখের চিকিৎসায়– ভিন্ন ভিন্ন রকমের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। কী ধরনের লেজার প্রয়োগ করা হবে তা নির্ভর করে শরীরের সাথে লেজারের কী ধরনের ইন্টার‍্যাকশান বা মিথস্ক্রিয়া ঘটানো দরকার তার ওপর।

চিকিৎসার জন্য মানুষের শরীরে যে লেজার প্রয়োগ করা হয়, শরীরের কোষের সাথে তার চার ধরনের মিথস্ক্রিয়া হতে পারে– ফটোমেকানিক্যাল, ফটোথার্মাল, ফটোকেমিক্যাল, এবং ফটোবায়োস্টিমুলেশান। ফটোমেকানিক্যাল ইন্টারঅ্যাকশানে প্রচণ্ড শক্তির লেজার প্রয়োগের ফলে কোষ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। চোখের কর্নিয়ার পরিবর্তন ঘটিয়ে চোখের দৃষ্টির সমস্যার স্থায়ী সমাধানে এধরনের লেজার ব্যবহার করা হয়। মুত্রথলির পাথর অপসারণেও এধরনের লেজার ব্যবহার করা হয়। লেজার দিয়ে পাথরগুলি ভেঙে ফেলা হয়। ফটোথার্মাল ইন্টারঅ্যাকশানে লেজারের শক্তি শোষণ করে কোষ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড তাপে কোষের ভেতরের জলীয় অংশ বাষ্প হয়ে যায়, ফলে কোষ মরে যায়। ফটোকেমিক্যাল ইন্টারঅ্যাকশানে শরীরের উপর রাসায়নিক প্রয়োগ করে তার ওপর লেজার প্রয়োগ করা হয়। লেজার রশ্মি রাসায়নিকের সাথে বিক্রিয়া ঘটায়। ফটোবায়োস্টিমুলেশান কোষের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটায়।

লেজার সার্জারি

লেজার সার্জারিতে যখন শরীরে লেজার প্রয়োগ করা হয় তখন রক্ত, কোষ, পেশী ইত্যাদি লেজারের শক্তি শোষণ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তখন সেই জায়গার কোষের স্বাভাবিক রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে যায়। প্রচণ্ড তাপে অনেকটা সিদ্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয় তাদের। তাপের ফলে কোষের প্রোটিনসহ অন্যান্য জৈব উপাদান পুড়ে যায়। লেজার যেহেতু খুব সূক্ষ্মভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রয়োগ করা হয়, এই তাপ শরীরের অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে না। ত্বকের ক্ষতিকর টিউমার বা অন্যান্য অনাকাঙ্খিত কোষ ধ্বংস করার জন্য সেই নির্দিষ্ট জায়গায় লেজার প্রয়োগ করা হলে খুবই কম সময়ের মধ্যে সেই কোষগুলি পুড়ে যায় এবং তাদেরকে সহজে সরিয়ে নেয়া যায়। চোখের কিছু কিছু সমস্যার সমাধানও এভাবে করা হয়, বিশেষ করে ডায়াবেটিসের কারণে চোখের রেটিনায় সমস্যা হলে সেখানে লেজারের সাহায্যে মাইক্রোসার্জারি করা যায়। লেজার সার্জারির সবচেয়ে ভালো দিক হলো এতে রক্ত বের হয় না। সার্জারির সময় রক্তনালী কেটে গেলে তাপের ফলে রক্তনালীর দেয়ালে প্রোটিন সংকুচিত হয়ে রক্তপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। রক্তক্ষরণ খুব কম হয় বলে সার্জারি সহজতর হয়।

আরো উচ্চক্ষমতার লেজার প্রয়োগ করে শরীরের যে জায়গায় চিকিৎসা করা দরকার, সেই জায়গায় কোষকে একেবারে বাষ্প করে ফেলা যায়। উচ্চক্ষমতার লেজার ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় কোষের ভেতরের সমস্ত জলীয় অংশ বাষ্পে পরিণত করে ফেলে প্রয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে। অনেক সময় সার্জারির সুবিধার্থে অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমেও নির্দিষ্ট স্থানে লেজার প্রয়োগ করা হয়।

ত্বকের চিকিৎসায় লেজার

লেজার সার্জারির মাধ্যমে ত্বকের উপরিস্তরের অনেক ধরনের চিকিৎসা করা হয়। লেজারের সাহায্যে ত্বকের কসমেটিক সার্জারি করে ত্বকের অনাকাঙ্খিত দাগ, লোম, বলিরেখা ইত্যাদি দূর করা হয়। ত্বকের একেবারে বাইরের স্তর (০.১ মিলিমিটার পুরু) ফেলে দিয়ে ত্বকের দাগ দূর করা যায়। ত্বকের ক্যান্সার টিউমার দূর করতে লেজার সার্জারি খুবই কার্যকর।

চোখের চিকিৎসায় লেজার

খুব নির্দিষ্টভাবে খুবই ছোট জায়গায় প্রয়োগ করা যায় বলে চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানে লেজার প্রয়োগ করা হচ্ছে। চোখের মধ্যে লেজার সরাসরিও প্রয়োগ করা যায়, আবার এন্ডোস্কোপির সাহায্যে অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমেও প্রয়োগ করা যায়। স্বাভাবিক দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গের লেজার রশ্মি চোখে প্রবেশ করলে চোখের মারাত্মক কোন ক্ষতি হয় না। কারণ আমাদের চোখ দৃশ্যমান আলোয় অভ্যস্ত। এই আলো চোখের কর্নিয়া ও লেন্স ভেদ করে রেটিনায় গিয়ে পৌঁছায়। লেজারও সাধারণ আলোর মতো কর্নিয়া ও লেন্সের ভেতর দিয়ে চোখের ভেতর প্রবেশ করে। রেটিনায় পৌঁছার পর সেই লেজারের শক্তি রেটিনা শোষণ করে নেয়। তাই রেটিনার সমস্যার সমাধানে লেজার প্রয়োগ করতে হলে সরাসরি চোখের ভেতর দিয়ে লেজার রশ্মি পাঠানো যায়। অতিবেগুনি লেজার রশ্মি দিয়ে চোখের কর্নিয়া ও লেন্সের চিকিৎসা করা যায় – কারণ লেন্স ও কর্নিয়া অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে।

চোখের গঠন দেখলে আমরা বুঝতে পারব, যে এটা গোলাকার ছোট্ট বলের মতো– যাকে আমরা অক্ষিগোলক বলে থাকি। এর ভেতর তরল পদার্থ থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট চাপ বজায় রাখতে হয় সুস্থ চোখের জন্য। অনেক কারণে চোখের ভেতরের প্রেসার বা চাপ বেড়ে যেতে পারে। চাপ বেড়ে গেলে চোখে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত চাপে চোখের স্নায়ু ছিঁড়ে গিয়ে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই সমস্যাকে ডাক্তারি ভাষায় গ্লুকোমা (glaucoma) বলে। লেজারের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। চোখে আর্গন লেজার প্রয়োগ করে চোখের ড্রেনেজ সিস্টেমে অথবা চোখের মণিতে (iris) সূক্ষ্ম ছিদ্র করে কিছু তরল বের করে অক্ষিগোলকের চাপ কমিয়ে দেয়া হয়। চোখের ভেতর টিউমার হলে লেজার সার্জারির মাধ্যমে সেই টিউমার দূর করা যায়। অনেক সময় মাথায় আঘাত পেলে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রেটিনায় ক্ষত তৈরি হতে পারে। লেজারের সাহায্যে এই ক্ষত জুড়ে দেয়া যায়।

ডায়াবেটিক রোগীদের চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অত্যধিক ব্লাড সুগারের কারণে রোগীর রেটিনার রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। রক্তনালীর সমস্যায় রেটিনার কোষে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। আমাদের শরীর নিজে নিজে অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলে। রেটিনার কোষে রক্তচলাচল ঠিক রাখার জন্য সেখানে নতুন রক্তনালী তৈরি হয়। কিন্তু কম জায়গায় বেশি রক্তনালী হয়ে গিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি করে। আস্তে আস্তে রোগী অন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে রোগীর এই সমস্যা তত মারাত্মক হয় না, কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে রোগীর চোখের সমস্যা বাড়তে থাকে। তখন লেজার সার্জারি করে এই সমস্যার সমাধান করা হয়।

ল্যাসিকের বিভিন্ন ধাপ
ছবি: লেখক

চোখের ছানি পড়া (cataract) বয়স্ক মানুষের চোখের একটি স্বাভাবিক সমস্যা। চোখের লেন্স স্বচ্ছতা হারিয়ে ক্রমশ ঘোলা হতে থাকলে দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যায়। প্রচলিত চিকিৎসা হলো চোখের ছানি কাটা– বা সার্জারি করে চোখের ঘোলাটে লেন্স ফেলে দিয়ে একটা প্লাস্টিকের স্বচ্ছ কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দেয়া। এতে রোগী নতুন দৃষ্টি পায়। কিন্তু অনেক রোগীর ক্ষেত্রে কিছু কিছু সমস্যা দেখা দেয়। নতুন লেন্সের চারপাশে ময়লা আবরণ জমে নতুন লেন্সও ঘোলা হতে থাকে। সেক্ষেত্রে লেজার দিয়ে সেই ময়লা আবরণ বাষ্পীভূত করে ফেলা যায়।

চোখের হ্রস্বদৃষ্টি (myopia) হলে আমরা সাধারণত মাইনাস পাওয়ারের চশমা পরে কাজ চালিয়ে নিতে পারি। কিন্তু এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায় লেজারের মাধ্যমে। এই সমস্যা হয় মূলত কর্নিয়া যদি সঠিক কোণে আলোর প্রতিসরণ ঘটাতে না পারে। তখন চোখের লেন্সে আলো সঠিক কোণে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে রেটিনায় প্রতিবিম্ব তৈরি হয় না। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য লেজারের সাহায্যে কর্নিয়ার আকৃতির পরিবর্তন ঘটানো হয়, যাতে কর্নিয়ার ভেতর দিয়ে আলো যাবার সময় সঠিকভাবে প্রতিসৃত হয়ে চোখের লেন্সে ঢোকে। এই পদ্ধতির নাম ফটোরিফ্রাকটিভ কেরাটেকটোমি (photorefractive keratectomy)। এই পদ্ধতির আরো আধুনিকায়ন ঘটেছে নতুন একটি পদ্ধতিতে যার নাম ল্যাসিক (LASIK – laser assisted in-situ keratomileusis)। এই পদ্ধতিতে প্রথমে কর্নিয়ার ওপরের অংশ কেটে আলাদা করে রাখা হয়। তারপর সেখানে আলট্রাভায়োলেট লেজার প্রয়োগ করে প্রয়োজন মতো কর্নিয়ার আকৃতির পরিবর্তন করা হয়। তারপর কর্নিয়ার ওপরের অংশ যেটা আলাদা করে রাখা হয়েছিল সেটা আবার বসিয়ে দেয়া হয়। রোগী কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে আর চশমা পরতে হয় না। তবে কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ল্যাসিক অপারেশানের কয়েক বছর পর আবার চশমা পরতে হতে পারে।

দাঁতের চিকিৎসায় লেজার

মুখের ও চোয়ালের নরম ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষতিকর কোষ অপসারণ করার জন্য লেজার ব্যবহৃত হচ্ছে। দাঁতের চিকিৎসার জন্য দাঁতের আকৃতির পরিবর্তন, কিংবা দাঁতের মাঝখানে গর্ত করার জন্যও লেজার ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সময়ও কম লাগে, আবার রোগীর অস্বস্তি এবং কষ্টও কম হয়। দাঁতের ফিলিং এবং রুট ক্যানেল করার জন্যও লেজার ব্যবহার করা হচ্ছে।

ক্যান্সার চিকিৎসায় লেজার

ত্বকের ক্যান্সার টিউমার অপারেশানে লেজার রশ্মি এখন খুবই কার্যকরী। ত্বকের ওপরের স্তর থেকে দুই মিলিমিটার গভীর পর্যন্ত টিউমারের ওপর লেজার প্রয়োগ করে টিউমারের সব কোষ মেরে ফেলা যায়। ক্যান্সার চিকিৎসায় আরেকটি কার্যকর পদ্ধতি ফটোডায়নামিক থেরাপিতেও লেজার ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে রোগীর শরীরে আলোক-সংবেদী রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। শরীরের ক্যান্সার কোষ এই রাসায়নিক শোষণ করে। তারপর সেখানে লেজার প্রয়োগ করলে এই কোষগুলির শোষিত রাসায়নিক কার্যকর হয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে ফেলে। যেসব ক্যান্সার কোষ রেডিওথেরাপি কিংবা কেমোথেরাপি দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব হয় না, তাদের কোন কোনটার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর।

লেজার রশ্মি একদিকে যেমন চিকিৎসার মাধ্যম হিসেবে জীবন বাঁচাতে পারে, তেমনি আবার অদক্ষ হাতে পড়লে প্রচন্ড ক্ষতির কারণও হতে পারে। যাদের লেজার ব্যবহারের উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ লাইসেন্স নেই, তাদের হাতে লেজার মোটেও নিরাপদ নয়। লেজার চিকিৎসা নেয়ার আগে সবকিছু ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া