সত্যেন্দ্রনাথ বসু: বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের জনক

ইদানীং বিজ্ঞানের জগতে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান এবং হিগস বোসন বা ঈশ্বর কণা বহুল আলোচিত বিষয়। বোসন নামটা এসেছে বাঙালি বিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সত্যেন বোসের নাম থেকে। যদিও হিগস বোসন আবিষ্কারের সঙ্গে সত্যেন বোসের কোনো সম্পর্ক নেই। সত্যেন বসুর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান। তবে তার একটি গবেষণা থেকেই জন্ম বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের। সেই কাজের সূত্র ধরেই আইনস্টাইন বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট নামে পদার্থের এক বিশেষ অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করেন আইনস্টাইন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু পূর্বভারতীয় রেলওয়েতে একজন হিসাবরক্ষক ছিলেন। আর মা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলীপুরের বিখ্যাত মতিলাল চৌধুরীর কন্যা। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে। এরপর তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে পঞ্চম স্থান পেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯০৯ সালে। এরপর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে ১৯১১ সালে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯১৩ সালে একই কলেজ থেকে গণিতসহ স্নাতক ও ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। উভয় পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন তিনি।

শিক্ষাজীবনে তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মাঝামাঝি সময়ে ডাক্তার যোগেন্দ্রনাথ ঘোষের কন্যা উষাবতী দেবীকে বিয়ে করেন তিনি। ছাত্রজীবনে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পরও তাঁর চাকরি জোটেনি না। সে সময় বহু সরকারি অফিস এবং কলেজে চেষ্টা করেও সুযোগ পাননি তিনি। কৃতী ছাত্রের উপযুক্ত চাকরি নেই বলে তাঁকে জানানো হয়। তাই তিনি টিউশনি শুরু করেন। এ সময় তাঁকে ডেকে পাঠান স্যার আশুতোষ মুখার্জি। তাঁর পরামর্শে তিনি প্রভাষক হিসেবে বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করেন। সেখানে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বন্ধু মেঘনাদ সাহার সাথে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। এর আগে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে তিনি যৌথভাবে জার্মান ভাষা থেকে আইনস্টাইনের 'জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি'র পেপারগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

ইতিমধ্যে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর কাজ শুরু করেন তিনি। পরে কাজ করেন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আলোকে কণা হিসেবে বিবেচনা করে। প্ল্যাঙ্ক সমীকরণের দুটি অংশ। প্রথম অংশটি আলোকে কণা ধরে নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। গোল বাধে সমীকরণের দ্বিতীয় অংশটা নিয়ে। দ্বিতীয় অংশটা তড়িৎগতিবিদ্যার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে ছিল। এটা চিরায়ত বিজ্ঞানের অংশ। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক তার সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করতে চিরায়ত বলবিদ্যা থেকে বেরিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও নতুন শাখার জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের মূল সমীকরণের একটা অংশ তড়িৎগতিবিদ্যা মেনে চলবে, এটা অস্বস্তিকর। কিন্তু এটা এড়ানোর কোনো পথ ছিল না। আইনস্টাইন চেষ্টা করেছেন, আরও অনেকেই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ত্রুটিটা দূর করা যায়নি। বিষয়টা সত্যেন বোসকে ভাবিয়েছিল। রীতিমতো গবেষণা করেন এটা নিয়ে। এক সময় সমাধানটা করে ফেলেন তিনি।

‘প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও আলোর কোয়ান্টা তত্ত্ব’ নামে লিখে ফেলেন এবং সেটি পাঠান সে সময়ের বিখ্যাত জার্নাল ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন-এ। কিন্তু অমনোনীত হয়ে ফিরে আসে সেটা। হতাশ সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবার আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হন। পেপারটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠান, সঙ্গে একটা অনুরোধ পত্র—পেপারটা যেন আইনস্টাইন অনুবাদ করে শাইটশ্রিফ্ট ফুর ফিজিক জার্নালে ছাপার ব্যবস্থা করেন। পেপারটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেটি ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে শাইটশ্রিফ্ট ফুর ফিজিক জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠান আইনস্টাইন। বসুর আলোচিত বিষয়ের সঙ্গে তাঁর নিজের লেখা একটি নোটও জুড়ে দেন। সেখানে বলেন, ‘প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ধারণের এই পদ্ধতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

ওই পেপারের সূত্রে জন্ম নেয় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। আইনস্টাইন এই ধারণাটি গ্রহণ করে তা প্রয়োগ করেন বস্তু কণাদের ওপর। এ থেকে পাওয়া যায় বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট। এই কন্ডেন্টসেট মেনে চলে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান।

বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান এমন একটি সংখ্যায়ন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে পদার্থের পূর্ণসংখ্যার স্পিনবিশিষ্ট মৌলিক কণাদের বন্টন ব্যাখ্যা করা হয়। অর্থাৎ বিশ্বজগতের যে কণাগুলোর ঘূর্ণন পূর্ণসংখ্যা, বসুর নামানুসারে পল ডিরাক সেগুলো নামকরণ করেন বোসন কণা। বোসন কণারা মেনে চলে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আলবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কৃত ওই পরিসংখ্যান। আলোর কণা ফোটন, গ্লুয়ন, হিগস বোসন, ডব্লিউ ও জেড বোসন কণা এই শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। একদল কণা আছে, সেগুলো এনরিকো ফার্মি ও পল ডিরাক প্রতিষ্ঠা করা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান। এদের সাধারণ নাম ফার্মিয়ন। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, নিউট্রিনো ইত্যাদি হলো ফার্মিয়ন কণা।

আইনস্টাইনের সুপারিশে প্রবন্ধ প্রকাশের পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান সত্যেন বোস। আরও বেশি গবেষণার জন্য ১৯২৪ সালে ইউরোপ ভ্রমণ করেনি তিনি। ফ্রান্সে গিয়ে মাদাম কুরির সাথে দেখা করেন এবং তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সুযোগ পান। কিছুদিন তিনি দ্য ব্রগলির ল্যাবেও কাজ করেন। ১৯২৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক এবং সায়েন্স ফ্যাকালটির ডিন নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং সেখানে তিনি ‘খয়রা অধ্যাপক’ হিসেবে শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন। ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদ থেকে অবসর নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে মনোনীত করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেশিকোত্তম এবং ভারত সরকার পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর গবেষণার জন্য বোস চেয়ার প্রবর্তিত হয়। ১৯৮৬ সালে কলকাতা শহরের সল্ট লেকে তার নামে এস.এন. বোস ন্যাশানাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত এবং সাহিত্যেও তাঁর আকর্ষণ ছিল। তিনি দক্ষতার সাথে এস্রাজ বাজাতেন। বাংলা ভাষায় যে বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব এটা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ গঠিত হয়। এখান থেকে নিয়মিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান নামের ম্যাগাজিন প্রকাশিত হত। মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারে তাঁর একটি উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি বলতেন, ‘যাঁরা বলেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।’

অদূর ভবিষ্যতে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান, বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন আদি মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে। নোবেল তার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সেটা তিনি পাননি। তবে মহাবিশ্বের অর্ধেক কণার নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে, এটাও কম বড় ব্যাপার নয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিজ্ঞান-সাধনা করে গেছেন। আইনস্টাইনের মতো তাঁরও অন্তিম বাসনা ছিল সবকিছুর একটা তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া। তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা শহরে মারা যান সত্যেন বোস।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত গবেষক, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ