সময় কেন পেছনে চলে না

ধরুন, আপনার সামনে হঠাৎ একটি ডিম ভেঙে গেল। ডিমটার জন্য আপনার খুব মায়া হলো। ইচ্ছা হলো একে আবার জোড়া লাগিয়ে ফেলতে। কিন্তু চাইলেই কি কাজটি সহজে করা সম্ভব? আসলে ভাঙা ডিম জোড়া লাগানোর সমস্যা নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাবিশ্বের জন্মকৌশলও। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কত সহজে এবং সেকেন্ডের মধ্যেই একটি ডিম ভেঙে ফেলা যায়! অথচ উল্টো কাজটি কেন এত সহজে করা যায় না? কাজটি কি আসলে খুব বেশি কঠিন? ডিমের খোলস, কুসুম আর সাদা অংশটুকুই তো জোড়া লাগাতে হবে, ব্যস! কিন্তু বলা যত সহজ, কাজটা মোটেই ততটা সহজ নয়। কিন্তু কেন? প্রকৃতির কোনো সূত্র কি ডিমকে জোড়া লাগতে বাধা দেয়? কাজটা কি আসলেই অসম্ভব?

না। পদার্থবিদ্যা বরং বলছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা ঘটতে পারে উল্টো দিকেও। কিন্তু তবু কেন আমরা ভাঙা ডিম বা চায়ের কাপ জোড়া লাগাতে ব্যর্থ? ঘটনাগুলো কেন পেছন দিকে চলে না, সব সময় চলতে থাকে ভবিষ্যতের পানে? প্রশ্নটিকে খুবই সাদামাটা মনে হয়। কিন্তু এর উত্তর অতটা সহজে দেওয়া যায় না।

১৬৬৬ সালে প্লেগের কবলে পড়ে নিউটনকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসতে হয় লিংকনশায়ারে তাঁর মায়ের কাছে। সেখানকার নির্জনতা তাঁকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গভীর ভাবনার সুযোগ করে দেয়। ফল—গতির তিনটি সূত্র এবং মহাকর্ষ সূত্র। দৈনন্দিন পৃথিবীর পরিচিত বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যায় অবিশ্বাস্য রকম সফল তাঁর সূত্রগুলো। আপেল কেন মাটিতে পড়ে, পৃথিবী কেন সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তা জানা হয়ে গেল। তবে সূত্রগুলোর একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। আপনি যদি সময়কে উল্টো দিকেও চিন্তা করেন, যেমন ধরুন পৃথিবী এখন সূর্যের চারদিকে যেভাবে ঘুরছে, তার উল্টো দিকে ঘুরতে লাগল, মানে পেছনে চলতে থাকল। অথবা পশ্চিম থেকে পুবের বদলে পৃথিবী ঘুরতে থাকল পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। তাহলে ফলাফল হতো সূর্য উঠবে পশ্চিমে আর ডুববে পুবে। তবু নিউটনের সূত্রগুলো কাজ করে আগের মতোই। ফলে নিউটনের সূত্র অনুসারে, ভাঙা ডিমও জোড়া লাগতে পারে। নিউটনের পরেও বিভিন্ন পদার্থবিজ্ঞানী যে সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছেন, তাদের প্রায় সবগুলোর একই ব্যাপার। সময় বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে, নাকি অতীতের দিকে তার কোনো গুরুত্বই নেই সূত্রগুলোর কাছে। এরা বরং গুরুত্বের সঙ্গে দেখে যে আপনি বাঁহাতি নাকি ডানহাতি। কিন্তু আমরা তো সূত্রগুলোর মতো নই। আমাদের কাছে সময়ের অতীতের বা ভবিষ্যতের দিকের প্রবাহের ফল তো এক নয়।

এই সমস্যাকে সবার আগে গুরুত্বের সঙ্গে নেন অস্ট্রিয় পদার্থবিদ লাডভিগ বোলজম্যান। তিনি ঊনবিংশ শতকের মানুষ। সে সময় পরমাণুর ধারণা কাজে লাগত রসায়নে। কিন্তু পরমাণুর অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ ছিল না তাঁদের হাতে। বোলজম্যানের বিশ্বাস ছিল, পরমাণুর অস্তিত্ব আছে। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করলেন। যেমন আগুন কেন জ্বলে, আমাদের ফুসফুস কীভাবে কাজ করে বা বাতাস পেলে চা কেন ঠান্ডা হয়ে যায়। তাঁর কথায় আস্থা রাখলেন অল্প কিছু বিজ্ঞানী। বাকিরা তাঁকে একঘরে করে ফেললেন। কিন্তু তিনি থেমে থাকলেন না। প্রথমে ভাবলেন উত্তপ্ত পানি নিয়ে। প্রথমে মনে হতে পারে, এমন চিন্তার সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক কী! কিন্তু বোলজম্যানের গবেষণা থেকে জানা যাবে, একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক আছে।

ওই সময়েই পদার্থবিদ্যার জগতে প্রবেশ করল তাপগতিবিদ্যার ধারণা। এটি ব্যাখ্যা করে তাপের গতিপ্রকৃতি। সে সময় বোলজম্যানের বিরোধীরা ভেবেছিলেন, তাপকে অন্য কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাপ শুধুই তাপ, অন্য কিছু নয়। এ ধারণা দূর করতে কাজে লেগে পড়লেন তিনি। তিনি ভাবলেন, তাপ উত্পন্ন হয় বস্তুর ভেতরে থাকা পরমাণুর এলোমেলো গতির কারণে। আর তাপগতিবিদ্যাকেও এসব পরমাণুর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সঠিক হলেও বাকি জীবনটা কেটে যায় এ ধারণা অন্যদের বোঝাতে। তিনি শুরুতে এনট্রপির ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলেন। তাপগতিবিদ্যা অনুসারে জগতের সব বস্তুর মধ্যেই কিছু না কিছু এনট্রপি জড়িয়ে আছে। যখনই এতে কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে, এর এনট্রপি বেড়ে যায়। যেমন আপনি যদি একটি গ্লাসের মধ্যে একটি আইস কিউব ডুবিয়ে একে গলতে দেন, তবে গ্লাসের এনট্রপি বেড়ে যাবে। মূলত এনট্রপি হলো এলোমেলো অবস্থার একটি পরিমাপ। যে সিস্টেম যত এলোমেলো, তার এনট্রপি তত বেশি। একটি সাজানো-গোছানো রুমের মধ্যে একটি বাচ্চা খেলাধুলা করতে থাকলে একটু পরই রুমের এনট্রপি বেড়ে যাবে।

এনট্রপির বৃদ্ধিকে পদার্থবিদ্যার অন্য কিছুর সঙ্গে মেলানো যায় না। এনট্রপি কখনো কমে না, সব সময় বেড়ে চলে অবাধ্য গতিতে। কিন্তু কেউ জানে না কেন। বোলজম্যানের সহকর্মীরা আবারও ভাবলেন, এনট্রপির স্বাভাবিক এই বৃদ্ধিকে অন্য কোনো কিছুর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কিন্তু বোলজম্যান তা মানলেন না। নেমে পড়লেন কারণ অনুসন্ধানে। ফলাফল হিসেবে আমরা পেলাম এনট্রপির সম্পূর্ণ নতুন এক জ্ঞান। এটা এমনই যুগান্তকারী ছিল যে তাঁর সমাধিতেও লিখে রাখা হয় তাঁর আবিষ্কৃত সূত্রখানা।

লুডভিগ বোলজম্যান

তিনি আবিষ্কার করলেন, একটি বস্তুতে যে শক্তি এবং পরমাণুগুলো আছে, তাদের যত উপায়ে বিন্যস্ত করা যায়, তারই একটি পরিমাপ হলো এনট্রপি। এনট্রপি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, বস্তুর ভেতরে পরমাণুগুলো আরও বেশি এলোমেলো বা অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাঁর মতে, এ কারণেই পানিতে রাখলে বরফ গলে যায়। পানি যখন তরলে পরিণত হয়, তখন কঠিন অবস্থার তুলনায় এর অণুগুলোর বিন্যস্ত হওয়ার উপায় অনেক বেড়ে যায়। আর অণুগুলোর মধ্যে বিনিময়কৃত তাপশক্তি আরও বেশি উপায়ে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ পায়। বরফ কঠিন অবস্থায় থাকার চেয়ে তরল অবস্থায় চলে যাওয়ার জন্য অনেক বেশি উপায় খুঁজে পায়।

একইভাবে আপনি যদি কফির কাপে একটু ক্রিম ঢেলে দেন, এটি পুরো কাপে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, সেটাই হলো অধিক এনট্রপির অবস্থা। এই ক্রিম একটি জায়গায় থাকার বদলে ছড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বেশিসংখ্যক উপায়ে বিন্যস্ত হতে পারে। বোলজম্যানের মতে, এনট্রপি হলো একটি সম্ভাবনা। অল্প এনট্রপির বস্তু সুবিন্যস্ত অবস্থায় থাকে বলে সে রকম থাকার সম্ভাবনা কম। বেশি এনট্রপির বস্তু তুলনামূলকভাবে অপরিচ্ছন্ন বা অবিন্যস্ত থাকে বলে তার সম্ভাবনা বেশি। এনট্রপি সব সময় বাড়ে, কারণ বস্তুর জন্য অবিন্যস্ত অবস্থায় থাকা সহজ। মজার বিষয় হলো, এই এনট্রপির মাধ্যমে অ্যারো অব টাইম বা সময়ের সামনে চলাকে ব্যাখ্যা করা যায়। যেহেতু পুরো মহাবিশ্বের এনট্রপি সব সময় বেড়ে চলেছে, তাই কোনো ঘটনাকে পেছন দিকে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

এনট্রপির ব্যাখ্যা থেকে আমরা এটাও ব্যাখ্যা করতে পারি যে কেন আমরা অতীতকে মনে রাখতে পারি, কিন্তু ভবিষ্যেক নয়। ভাবুন তো কেমন হতো যদি আপনার স্মৃতিতে এমন একটি ঘটনা গাঁথা আছে, কিন্তু ঘটনাটি ঘটল পরে। এরপর আপনি স্মৃতি হারিয়ে ফেললেন। আপনার মস্তিষ্কে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা বেশ কম। বোলজম্যানের মতে, অতীত থেকে ভবিষ্যেক আলাদা মনে হয়, কারণ জগতের এনট্রপি বাড়ছে। তার নাছোড়বান্দা শত্রুরা কিন্তু এতে একটি খুঁত পেয়ে গেলেন।

বোলজম্যান বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যেতে থাকলে এনট্রপি বাড়ার কারণ হলো বস্তুর মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণুর আচরণের সম্ভাবনা। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু তো পদার্থবিদ্যার নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না। আর সেই নিয়মমতে তো অতীত আর ভবিষ্যতে কোনো বিভেদ নেই। তাহলে তো ভবিষ্যতে গেলে যেমন এনট্রপি বাড়বে, তেমনি বাড়বে অতীতে গেলেও। এর সমাধান করতে বোলজম্যান কয়েকটি উপায়ের কথা বলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে সেরাটি হলো পাস্ট হাইপোথিসিস। এটি অনুসারে, কোনো এক দূর অতীতে মহাবিশ্বের এনট্রপি ছিল খুবই কম। এটি সঠিক হলে তার যুক্তির খুঁতটি আর থাকে না। অতীত ও ভবিষ্যেক ভিন্ন দেখায়, কারণ ভবিষ্যতের চেয়ে অতীতের এনট্রপি অনেক কম। ফলে ডিম ভাঙে, জোড়া লাগে না। কিন্তু এই ব্যাখ্যা তৈরি করে আরেকটি নতুন সমস্যা। স্বল্প এনট্রপি থাকা যদি কঠিনই হয়, তাহলে দূর অতীতেই এত কম এনট্রপি ছিল কেন?

এ সমস্যার সমাধান তিনি করতে পারলেন না। ভাবলেন, ভবিষ্যতের পদার্থবিজ্ঞান তাঁকে অচিরেই ভুলে যাবে। হতাশ হয়ে ১৯০৬ সালে তিনি নিজেকে রশিতে ঝুলিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন। তিনি যদি আর মাত্র এক দশক বেঁচে থাকতেন, তবেই নিজের ধারণার সাফল্য দেখে যেতে পারতেন। কারণ, পদার্থবিদেরা তাঁর দেওয়া পরমাণুর ধারণা মেনে নিলেন। নতুন আবিষ্কার থেকে এ-ও দেখা গেল যে পাস্ট হাইপোথিসিসের পক্ষেও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।

বিশ শতকে এসে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা গেল পাল্টে। জানা গেল, মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে। কিন্তু বোলজম্যানের যুগে অধিকাংশ বিজ্ঞানীর বিশ্বাস ছিল, আমাদের মহাবিশ্ব চিরন্তন ও স্থির, যার কোনো শুরু বা শেষ নেই। ১৯২০-এর দশকে এসে দেখা গেল, অধিকাংশ গ্যালাক্সি আমাদের থেকে দূরে সরছে। আস্তে আস্তে প্রমাণ দাঁড়িয়ে গেল, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং একসময় সবকিছু খুব কাছাকাছি ছিল। পরের দশকগুলোতে জানা গেল, একটি অতি উত্তপ্ত ও ঘনীভূত অবস্থা থেকে জন্ম হয়েছে মহাবিশ্বের। একসময় এটি প্রসারণের ফলে শীতল হতে হতে আজকের এ অবস্থায় এসেছে।

একে পাস্ট হাইপোথিসিসের পক্ষে একটি প্রমাণ বলেই মনে হলো। বলা হলো, আচ্ছা, ঠিক আছে। আদি মহাবিশ্বের এনট্রপি তাহলে অনেক কম ছিল। তবে প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগের সেই সময়টিতে কেন এনট্রপি কম ছিল, তা জানা গেল না। মনে হওয়া অতি স্বাভাবিক যে মহাবিশ্বের আদি বিস্ফোরণ ও প্রসারণের সঙ্গে নিম্ন এনট্রপির সম্পর্ক কী? বিস্ফোরণ তো বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি করে। তা ছাড়া সেই আদি ও উত্তপ্ত অবস্থায় পদার্থ ও শক্তির বিন্যস্ত হওয়ার বহু ভিন্ন উপায় থাকার কথা। একটি বিশাল শূন্যস্থানের কথা কল্পনা করুন, যার কেন্দ্রে আছে সূর্যের ভরের সমান একটি গ্যাসীয় মেঘ। মহাকর্ষের আকর্ষণে গ্যাসগুলো ক্রমশ জড়ো হয়ে পরিণত হবে নক্ষত্রে। এনট্রপি যদি সব সময় বেড়েই চলে, তাহলে এটি কী করে সম্ভব? গ্যাসগুলো যখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তখনই বরং এরা বেশিসংখ্যক উপায়ে বিন্যস্ত হতে পারত।

গুচ্ছবদ্ধ থাকার গুরুত্ব

আসলে মহাকর্ষ এনট্রপিকে এমন একটি উপায়ে প্রভাবিত করে, যা বিজ্ঞানীরা এখনো ভালোভাবে জানতে পারেননি। বেশি ভারী বস্তুদের ক্ষেত্রে ঘন ও সুষম থাকার চেয়ে গুচ্ছবদ্ধ থাকলেই এনট্রপি বেশি হয়। ফলে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ও গ্রহদের মহাবিশ্বের এনট্রপি উত্তপ্ত ও ঘনীভূত মহাবিশ্বের চেয়ে বেশি। সমস্যা কি তাহলে শেষ হলো? ব্রিটিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ একবার বলেছিলেন, বিজ্ঞান একটি সমস্যার সমাধান করে আরও দশটি নতুন সমস্যা তৈরি করে। এখানেও তা-ই। বিগ ব্যাংয়ের সময় সেই উত্তপ্ত ও ঘন মহাবিশ্বের এনট্রপি কম থাকায় এমন অবস্থায় মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা খুব কম। তাহলে এমন একটি অনিশ্চিত অবস্থা নিয়ে মহাবিশ্বের জন্ম হলো কীভাবে? একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে বিগ ব্যাংয়ের আগেও কিছু একটা ছিল, যা আদি মহাবিশ্বের এনট্রপির স্বল্পতার জন্য দায়ী।

কসমোলজিস্ট শন ক্যারোল ও তাঁর এক সাবেক ছাত্রের মতে, প্রতিনিয়ত মূল একটি মহাবিশ্ব থেকে শিশু মহাবিশ্বদের জন্ম হচ্ছে। তারাই প্রসারিত হয়ে আমাদের মহাবিশ্বের রূপ নিচ্ছে। এই শিশু মহাবিশ্ব কম এনট্রপি নিয়েও থাকতে পারে। কিন্তু মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্বের সামগ্রিক এনট্রপি সব সময় বেশিই থাকবে। এটা সত্য হলে এর অর্থ হবে মহাবিশ্বের এনট্রপি কম মনে হওয়ার কারণ হলো আমরা বড় চিত্রটি দেখছি না। এটা সত্য অ্যারো অব টাইমের জন্যও। ক্যারোলের মতে, অনেক দূরের অতীত অনেক দূরের ভবিষ্যতের মতোই দেখাবে। তবে ক্যারোলের এই মতটি সর্বজনীন নয়। এর একটি সমস্যা হলো, আমাদের জ্ঞাত পদার্থবিদ্যার সেরা সূত্রগুলোও বিগ ব্যাং পর্যন্ত গিয়ে অচল। মহাবিশ্বের আদি সূচনা কী করে হয়েছিল, তা বুঝতে না পারলে এর নিম্ন এনট্রপির ব্যাখ্যাও পাওয়া সম্ভব নয়।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুই প্রধান স্তম্ভ কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব। প্রথমটির কাজ পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র জিনিসকে নিয়ে, আর পরেরটির কাজ হলো গ্রহ, নক্ষত্র বা তার চেয়ে বড় বস্তুদের নিয়ে। কিন্তু দুটোকে ঐকতানে আনা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ আদি মহাবিশ্বকে বুঝতে হলে দুটোকে মিলিয়ে একটি সার্বিক তত্ত্ব বা থিওরি অব এভরিথিং তৈরি করতেই হবে। অ্যারো অব টাইমের ব্যাখ্যা পেতে তাই সেই চূড়ান্ত সূত্রটি বড় দরকার। কিন্তু সেই সূত্র বহুদিন ধরেই সোনার হরিণ। চূড়ান্ত সেই সূত্রের কিছু প্রস্তাবের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হলো স্ট্রিং থিওরি। এই তত্ত্ব অনুসারে, অতিপারমাণবিক কণিকারা আসলে স্ট্রিংয়ের কম্পনমাত্র। এই তত্ত্বের আরও বক্তব্য হলো আমাদের চেনা চার মাত্রার চেয়ে বাস্তবে মাত্রা আছে আরও বেশি, যেগুলো খুব ক্ষুদ্র জায়গায় পেঁচিয়ে আছে। আরেকটি বক্তব্য হলো, মহাবিশ্ব আছে বহু সংখ্যক, যার প্রতিটিতে হয়তো কাজ করে আলাদা আলাদা সূত্র। কিন্তু সময় সামনে চলার ব্যাখ্যা নেই এখানেও। পদার্থবিদ্যার অন্য মৌলিক সূত্রের মতো এটিও অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। ফলে অ্যারো অব টাইমের ব্যাখ্যা পাওয়ার ব্যাপারে স্ট্রিং থিওরির ওপরও নির্ভর করা যাচ্ছে না।

এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ মেরিনা কোর্টেস তাই আরও ভালো কিছুর সন্ধানে আছেন। কানাডার পেরিমিটার ইনস্টিটিউটের লি স্মোলিনের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি স্ট্রিং তত্ত্বের বিকল্প উপায়ে আরও মৌলিক জায়গা থেকে সময়ের সামনে চলার ব্যাখ্যা খুঁজছেন।

তাঁদের মতে, মহাবিশ্ব একগুচ্ছ অনন্য ঘটনার সমাবেশ নিয়ে গঠিত। কোনো ঘটনাই দুবার ঘটে না। প্রতিটি ঘটনাই কেবল তার পরেরটিকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ধারণা বোলজম্যানের ধারণার বিপরীত, যেখানে অ্যারো অব টাইম ছিল সম্ভাবনার সূত্র থেকে আসা একটি দুর্ঘটনা। তবে সত্য ব্যাপার যা-ই হোক, সময়ের সম্মুখ গতির ব্যাখ্যা পেতে হলে মহাবিশ্বের শুরুর দিকের নিম্ন এনট্রপির ব্যাখ্যা পেতেই হবে। দরকার হবে থিওরি এভরিথিংয়ের, সেটা স্ট্রিং থিওরিই হোক আর কোর্টেসদের প্রস্তাবই হোক। এক কথায় ক্যারোল সারমর্ম দিচ্ছেন, ‘নিম্ন এনট্রপির বিগ ব্যাংয়ের ব্যাখ্যা পেলেই কাজ শেষ। অতীত ও ভবিষ্যতের বড় পার্থক্যই তখন আমাদের জানা হয়ে যাবে।’

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: বিবিসি ডট কম