‘সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়, বেগে ধায় নাহি রয় স্থির...’ সময়ের স্রোত সামনের দিকে চলছে, তা আমরা জানি। সময় মাপার জন্য অতি উন্নতমানের যন্ত্র বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। আমাদের আধুনিক মোবাইল অ্যাপস এখন প্রতি সেকেন্ড সময়কে এক হাজার ভাগে ভাগ করে নির্ভুল সময় জানিয়ে দিচ্ছে। আরও নিখুঁত বৈজ্ঞানিকভাবে সময় নিরূপণের জন্য আমরা অ্যাটমিক ক্লক বা পারমাণবিক ঘড়িও ব্যবহার করছি। আজ আমরা সময়ের অতি সূক্ষ্ম হিসাব রাখতে পারছি। কিন্তু আমরা এখনো যখন সময়ের সংজ্ঞা দিতে যাই, তখন খুব সমস্যায় পড়ে যাই। সময় কাকে বলে? ঘড়ি যা মাপে তাকে সময় বলে—এ রকম সংজ্ঞায় আমরা সন্তুষ্ট নই। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সূত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন সময় ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে। স্টিফেন হকিংয়ের বিশ্ববিখ্যাত বই দ্য ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বা কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সময়ের প্রবাহের সঙ্গে মহাবিশ্বের পরিবর্তনের ইতিহাস জানায় ঠিকই, কিন্তু সেখান থেকেও সময়ের সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু আমরা সবাই ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বুঝতে পারি যে সময় চলে যাচ্ছে। সকাল-দুপুর-রাত গড়িয়ে যাচ্ছে—এর মধ্যে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। এখন যা ঘটছে, কিছু সময় পরেই তা হয়ে যাচ্ছে অতীত।
সময় মাপার বৈজ্ঞানিক একক হচ্ছে সেকেন্ড। ৬০ সেকেন্ডে ১ মিনিট, ৩৬০০ সেকেন্ডে এক ঘণ্টা ইত্যাদি আমরা জানি। দৈনন্দিন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১ সেকেন্ড সময় হয়তো খুব একটা দীর্ঘ নয়। আমাদের বাংলা ভাষায় সেকেন্ডের চেয়েও সংক্ষিপ্ত একটা সময়ের একক আমরা ব্যবহার করি ‘নিমেষ’।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন আছে, ‘আমি দাঁড়াব যেথায় বাতায়ন কোণে/ সে চাবে না সেথা জানি তাহা মনে/ ফেলিতে নিমেষ দেখা হবে শেষ/ যাবে সে সুদূর পুরে।’ আমাদের চোখের পলক ফেলতে যেটুকু সময় লাগে, সেই সময়টুকু হলো নিমেষ। একজন স্বাভাবিক মানুষের চোখের পলক ফেলতে গড়ে এক সেকেন্ডের তিন ভাগের এক ভাগ সময় লাগে। এই সময়টুকু খুব সংক্ষিপ্ত হলেও এটুকু সময়ের মধ্যেই ঘটে যেতে পারে অনেক ঘটনা।
পারমাণবিক পর্যায়ে এক সেকেন্ড অনেক দীর্ঘ সময়। পারমাণবিক ঘড়িতে সিজিয়াম-১৩৩ আইসোটোপের পারমাণবিক শক্তিস্তরের মধ্যে ৯১৯,২৬,৩১,৭৭০টি (৯১৯ কোটি ২৬ লাখ ৩১ হাজার ৭৭০) শক্তিবিনিময় ঘটনা ঘটতে যে সময় লাগে, তার পরিমাণ হলো এক সেকেন্ড। এখন আমরা যদি সিজিয়াম-১৩৩-এর পারমাণবিক শক্তিস্তরের একটি শক্তিবিনিময় ঘটনার সময়কে আলাদা করে মাপতে পারি, তাহলে আমরা ১ সেকেন্ডের ৯১৯,২৬,৩১,৭৭০ ভাগের এক ভাগ সময় মাপতে পারব। বিজ্ঞানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাপের হিসাব করতে হয় বলে পরিমাপের একককে অনেক ছোট ছোট ভাগে ভাগ করার ব্যবস্থা আছে। ১ সেকেন্ডের এক মিলিয়ন বা ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ হলো এক মাইক্রো-সেকেন্ড (০.০০০০০১ বা ১০-৬ সেকেন্ড), এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ হলো এক ন্যানো-সেকেন্ড (০.০০০০০০০০১ বা ১০-৯ সেকেন্ড)। সে হিসাবে সিজিয়াম-১৩৩-এর শক্তিস্তরে একটি বিকিরণের ঘটনা ঘটে প্রায় নয় ন্যানো-সেকেন্ডে। আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই ন্যানো-সেকেন্ড সময়কেও সঠিকভাবে মেপে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এখন ন্যানো-সেকেন্ডেরও ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়, অর্থাত্ এক অটো-সেকেন্ড (০.০০০০০০০০০০০০০০০০০১ বা ১০-১৮ সেকেন্ড) সময় পর্যন্ত সঠিকভাবে মাপা সম্ভব হয়েছে।
২০১৬ সালে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা হিলিয়াম পরমাণু থেকে ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের ফলে একটি ইলেকট্রন বেরিয়ে আসার ঘটনা নিখুঁতভাবে রেকর্ড করেন এবং এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানের ইতিহাসের এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সময় মাপতে সমর্থ হলেন। এই সময়ের পরিমাণ ৮৫০ জেপ্টো-সেকেন্ড। এক জেপ্টো-সেকেন্ড হলো ০.০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১ বা ১০-২১সেকেন্ড।
ধাতব পাতের ওপর অতিবেগুনি রশ্মি পড়লে সেখান থেকে বিদ্যুত্প্রবাহ উত্পন্ন হয়। কিন্তু সাধারণ আলো থেকে এ রকম ঘটনা ঘটে না। এ ঘটনা বিজ্ঞানীরা অনেক দিন আগে থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু আইনস্টাইনের আগে কেউই এর সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের ব্যাখ্যা দিলেন। কোনো ধাতব পদার্থের ওপর আলো বা বিদ্যুত্-চুম্বক তরঙ্গ পড়লে ধাতব পদার্থটি সেই আলো থেকে কিছু শক্তি শোষণ করে। যত বেশি শক্তির আলো ধাতুর ওপর আপতিত হয়, তত বেশি শক্তি শোষিত হয়। পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। পরমাণুর কক্ষ থেকে বের হতে হলে ইলেকট্রনগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি অর্জন করতে হয়। বিভিন্ন পদার্থের পরমাণুর জন্য এই শক্তি বিভিন্ন। আপতিত আলোর শক্তি থেকে কোনো ইলেকট্রন এই প্রয়োজনীয় শক্তি শোষণ করে পরমাণুর কক্ষ থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেই বিদ্যুত্ প্রবাহ ঘটে। আর যদি আপতিত আলোর শক্তি কম হয়, তবে ইলেকট্রনগুলো প্রয়োজনীয় শক্তি পায় না। ফলে কোনো বিদ্যুত্ প্রবাহ ঘটে না।
ম্যাক্স-প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা হিলিয়াম গ্যাসের প্রবাহের ওপর অতিবেগুনি লেজার রশ্মি প্রয়োগ করেন মাত্র ১০০ অটো-সেকেন্ড বা ০.০০০০০০০০০০০০০০০১ বা ১০-১৬ সেকেন্ডের জন্য। অতিবেগুনি রশ্মির শক্তি শোষণ করে হিলিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো কক্ষপথ থেকে বের হয়ে আসে। কম শক্তির অবলোহিত লেজার রশ্মির সাহায্যে এই ইলেকট্রন নির্গমনের ঘটনাটি ধারণ করা হয়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করেছেন যে এ ঘটনার ব্যাপ্তি মাত্র ৮৫০ জেপ্টো-সেকেন্ড (৮৫০ x ১০-২১ সেকেন্ড)।
এর চেয়েও কম সময়ে কি কোনো ঘটনা ঘটা সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তবে কি সময়ের সর্বনিম্ন সীমা বলে কিছু আছে? হ্যাঁ আছে। অর্থবোধক সর্বনিম্ন সময়কে বলা হয় ‘প্ল্যাংক-সময়’। জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক এই সময়ের হিসাব করেছেন। কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রধান স্থপতি ম্যাক্স প্ল্যাংক পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৮ সালে।
ম্যাক্স প্ল্যাংকের বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক। ছোটবেলা থেকে সংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল ম্যাক্স প্ল্যাংকের। চমত্কার পিয়ানো বাজাতেন ম্যাক্স। ইচ্ছা ছিল সংগীত বিষয়ে পড়াশোনা করবেন। সে উদ্দেশ্যে একজন সংগীতগুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সংগীত শেখার জন্য কী কী বই পড়া দরকার? তাতে গুরু রেগে গিয়ে বলেছিলেন, এমন প্রশ্ন যদি মাথায় আসে, তাহলে সংগীত তোমার জন্য নয়। তুমি অন্য কিছু পড়ো।
পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশোনা করতে চান শুনে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফিলিপ জোলি ম্যাক্সকে বলেছিলেন, ফিজিকস পড়ে কী করবে? ফিজিকসের সবকিছুই তো আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। প্রফেসর জোলি তো সেদিন জানতেন না যে ম্যাক্স প্ল্যাংক পদার্থবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ নতুন একটা জগত্ কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তি স্থাপন করবেন। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাংক আবিষ্কার করলেন, বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকিরণের শক্তি বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গের কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। বিকিরণের শক্তিকে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক দিয়ে ভাগ করলে যে সমানুপাতিক ধ্রুবক পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় প্ল্যাংকের ধ্রুবক, লেখা হয় h। বিভিন্ন শক্তি ও কম্পাঙ্কবিশিষ্ট বিদ্যুত্চুম্বক বিকিরণ পরীক্ষা করে h-এর সর্বজনীন মান পাওয়া গেছে ৬.৬২৬০৭৬x১০-৩১ জুল-সেকেন্ড। h হলো কোয়ান্টাম ঘটনার একক।
নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (G=6.67259x10-11m3/kgs2), শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ (c=3x108 m/s), এবং প্ল্যাংক-ধ্রুবক (h)-এর মান কাজে লাগিয়ে প্ল্যাংক বিজ্ঞানে অর্থবোধক দৈর্ঘ্যের সর্বনিম্ন মান হিসাব করে বের করেছেন। এই দৈর্ঘ্যকে প্ল্যাংক-দৈর্ঘ্য বলা হয়। কোনো দৈর্ঘ্য যদি প্ল্যাংক দৈর্ঘ্যের চেয়ে কম হয়, তবে সেখানে পদার্থবিজ্ঞানের কোনো সূত্রই আর কাজ করে না।
গাণিতিকভাবে প্ল্যাংক-দৈর্ঘ্য = √(Gh/2πc5) = 5.39×1044
হিসাব করে প্ল্যাংক-দৈর্ঘ্যের মান পাওয়া যায় 1.61599x10-35 মিটার।
আলোকের বেগে চলমান একটি ফোটন প্ল্যাংক-দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে যে সময় নেয়, তাকে বলা হয় প্ল্যাংক-সময়। আর এটাই হলো অর্থবোধক সময়ের সর্বনিম্ন সীমা। এর চেয়ে কম কোনো সময় পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী হতে পারে না।
গাণিতিকভাবে প্ল্যাংক-সময় =√(Gh/2πc3) সেকেন্ড।
সময় যদি এর চেয়ে কম হয়, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব আর কাজ করে না। তার মানে, পদার্থবিজ্ঞানের কার্যকর সূত্র অনুযায়ী সময়ের শুরু শূন্য থেকে নয়। অন্যভাবে বলা যায়, মহাবিশ্বের শুরুতে যদি সময়ের মান শূন্য ধরা হয়, তাহলে ০ সেকেন্ড থেকে ৫.৩৯x১০-৪৪ সেকেন্ড পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের কোনো নিয়ম কাজ করবে না। এখানেই গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের পার্থক্য। গণিতে আমরা দৈর্ঘ্য ও সময়ের সর্বনিম্ন মান শূন্য ধরে নিতে পারি, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে তা সম্ভব নয়।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, স্কুল অব বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস, আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
সূত্র: নেচার ফিজিকস, কিউ ইজ ফর কোয়ান্টাম/জন গ্রিবিন
*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার মে ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়