সৌরজগতে বিপ্লব

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের সৌরজগতের বাইরে একটার পর একটা গ্রহ আবিষ্কার করে চলেছেন। বিপুল উৎসাহ নিয়ে মানুষ এখন ভাবছে, পৃথিবীর মতো আরেকটা গ্রহ পাওয়া যাবে কি, যেখানে বায়ুমণ্ডল থাকবে, যেখানে মানুষ নতুন বসতি গড়তে পারে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা জ্যোতির্জীববিদ্যা নামে একটা নতুন গবেষণার বিষয় ইতিমধ্যে সৃষ্টি করেছেন। এই গবেষণা দার্শনিকভাবে মহাবিশ্বে মানুষের একাকিত্বকে কিছুটা লাঘব করতে পারে। আড়াই দশক ধরে এই যে বহিঃগ্রহ আবিষ্কারের ধারা, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবটি পড়েছে আমাদের প্রাচীন ধারণার ওপর। সৌরজগৎ সৃষ্টির ইতিহাস ও এর বর্তমান গঠন নিয়ে আমাদের আগের এবং বর্তমান ধারণার ফারাক আকাশ-পাতাল।

ট্রাপিস্ট-১

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মতো সাতটি গ্রহ আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। সেগুলো আমাদের কাছ থেকে ৪০ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। সেগুলো ঘুরছে ট্রাপিস্ট-১ (Trappist-1) নামে একটি লাল বামন নক্ষত্রের (Red dwarf) কক্ষপথে। পৃথিবীর মতো মানে এই নয়, সেখানে পৃথিবীর মতো ফানি ও বায়ুমণ্ডল রয়েছে। এর মানে হলো, ওই গ্রহগুলোর ভর ও ব্যাস অনেকটা পৃথিবীর মতো। বিজ্ঞানীরা নতুন আবিষ্কৃত গ্রহগুলোর নাম দিয়েছেন Trappist b, c, d, e, f, g, ও h। প্রথম গ্রহটা, যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন Trappist-b, সেটা তার সূর্য (ট্রাপিস্ট-১) থেকে মাত্র ০.০১ জ্যোতির্বিদ্যা একক (AU) দূরত্বে অবস্থান করছে। অর্থাৎ মাত্র দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার বা ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে। তাই মাত্র দেড় দিনে সেটি তার ট্রাপিস্ট-১-কে একবার ঘুরে আসতে পারে। তার সূর্যের এত কাছে তবু কিন্তু খুব বেশি বিকিরণ ট্রাপিস্ট-বি পায় না। বিকিরণ পায় পৃথিবী সূর্য থেকে যে বিকিরণ পায় তার থেকে মাত্র সাড়ে চার গুণ বেশি। এর কারণ হলো ট্রাপিস্ট-১-এর ঔজ্জ্বল্য আমাদের সূর্যের মাত্র শতকরা ০.০৫ ভাগ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, e, f ও g গ্রহে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে। মুশকিল হলো, এ গ্রহগুলোর কেন্দ্রীয় বামন তারা থেকে প্রচুর এক্সরে বিকিরিত হতে পারে। এ ছাড়া আছে উচ্চশক্তির নাক্ষত্রিক কণা বিকিরণও। এই কণা বিকিরণ ওই গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডলকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সেখানে থাকতে পারে আরও অনেক প্রতিকূল অবস্থাও। এর মধ্যে একটা হলো ওই গ্রহগুলো তাদের সূর্যের সঙ্গে জোয়ার-ভাটার কারণে আবদ্ধ। অর্থাৎ তাদের একটা দিক সব সময় কেন্দ্রীয় সূর্যের দিকে থাকে (যেমন আমরা শুধু চাঁদের একটা দিক দেখতে পাই)। এটি সেখানে প্রাণের বিপরীতে কাজ করবে।

আমাদের গ্যালাক্সিতে ট্রাপিস্ট-১ ধরনের লাল বামন তারার সংখ্যাই বেশি। আমাদের নিকটবর্তী তারা প্রক্সিমা সেন্টরি একটি M-6 বর্ণালির বামন তারা। গত বছর প্রক্সিমা সেন্টরি কক্ষপথে পৃথিবীর ভরের সমান একটি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটিও খুব কাছে থেকে তার তারাটিকে প্রদক্ষিণ করে। এর আগে ২০ আলোকবর্ষ দূরে গ্লিজ-৫৮১ নামে আরেকটি M-6 বর্ণালির লাল বামনের কক্ষপথে চারটি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে।

বামন তারা

লাল বামন নক্ষত্র আমাদের সূর্যের মতোই। এর কেন্দ্রে হাইড্রোজেন পুড়ে ও সংযোজিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি হয়। এটা মূলত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যে শক্তি সৃষ্টি হয়, সেটাই নক্ষত্রকে বাঁচিয়ে রাখে। বামন তারার কেন্দ্রে যে হিলিয়ামটা তৈরি হয়, সেটা কেন্দ্রেই থেকে যায় না। বরং পরিচলনের (Convection) মাধ্যমে গোটা তারাটিতেই ছড়িয়ে যায় (সূর্যের ক্ষেত্রে হিলিয়ামটা কেন্দ্রে রয়ে যায়)। ফলে বামন তারাটি ফিউশনের জন্য কেন্দ্রের বাইরে থেকে নতুন হাইড্রোজেন পায় এবং এর জীবন দীর্ঘায়িত হয়। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, একটি লাল বামন তারা প্রায় ১ ট্রিলিয়ন বছর বা ১০০০ বিলিয়ন বছর বাঁচতে পারে। সূর্যের আয়ু যেখানে ১০ বিলিয়ন বা ১০০০ কোটি বছর। আলো কম বিকিরণ করে বলেই লাল বামন তারার আয়ু বেশি। যে নক্ষত্র যত বেশি আলো বিকিরণ করে, সেটির আয়ু অনেক কম হয়। এবার ভাবুন, আমাদের গ্যালাক্সিতে যত তারা আছে, এর চার ভাগের তিন ভাগই লাল বামন। অর্থাৎ ১০০টা তারার মধ্যে ৭৫টাই লাল বামন। কিন্তু কম উজ্জ্বলতার জন্য এদের সহজে দেখা যায় না। নিঃসন্দেহে লাল বামনের চারদিকে গ্রহজগৎ পাওয়ার সম্ভাবনা সূর্যের মতো তারার চেয়ে বেশি।

বহির্গ্রহ আবিষ্কারের পদ্ধতি

NASA-এর এক্সোপ্লানেট আর্কাইভ থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেখা যায়। পৃথিবীর তাবৎ দুরবিনের তথ্য একসঙ্গে করে বলা যায়, ৬০০-এর কাছাকাছি একধিক গ্রহওয়ালা নক্ষত্র এবং ৩ হাজার ৫০০-এর মতো গ্রহকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা গেছে। গ্রহগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে বেশ কয়েকটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে মূলত দুটি পদ্ধতি—Transit (অতিক্রমণ) ও Radial velocity (রেডিয়াল গতিবেগ) খুবই কার্যকর। ট্রানজিট পদ্ধতিতে গ্রহ যখন তারার চাকতির সামনে দিয়ে যায়, অর্থাৎ অতিক্রমণ করে তখন তারার উজ্জ্বলতার হেরফের হয়। রেডিয়াল গতিবেগ ডপলার ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। একটি গ্রহ যখন তার সূর্যের চারদিকে ঘোরে, এর কক্ষপথটি উপবৃত্তাকার হয়। ফলে হেরফের হয় তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ বলের। এতে মূল তারাটি বেশ নড়াচড়া করে। অর্থাত্ সেই তারাটি কখনো আমাদের দিকে আসে, কখনো আমাদের বিপরীত দিকে যায়। এই বাড়তি গতি বোঝা যায় এর বিকিরণ দেখে। যখন তারাটি আমাদের দিকে আসে তখন সেই বিকিরণের কম্পাঙ্ক (Frequency) বেড়ে যায়। আর যখন তারাটি দূরে চলে যায়, তখন কমে যায় কম্পাঙ্ক। আলোর কম্পাঙ্ক বাড়া-কমা মানে সেটির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কমা-বাড়া। সেই পরিবর্তন আমাদের দুরবিনে ধরা পড়ে। গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা গ্রহটির ভর ও মূল নক্ষত্র থেকে সেটি কত দূরে আছে, জানতে পারি। ট্রানজিট পদ্ধতিতে প্রায় ২ হাজার ৭০০টি ও ডপলার গতিবেগ পদ্ধতিতে ৬০০-এর ওপর গ্রহ আবিষ্কার করা গেছে। নিশ্চিতভাবে আবিষ্কৃত গ্রহগুলোর ভর ও সূর্য থেকে এগুলোর দূরত্বের একটা গ্রাফ দেওয়া হয়েছে।

সৌরজগতে নতুন বস্তুর আবিষ্কার

১৯৯২ সালে দুজন বিজ্ঞানী নতুন পৃথিবীর মতো দুটি গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন মহাকাশে। একটি পালসারের কক্ষপথে ঘুরছিল গ্রহ দুটি। পালসার খুব শক্তিশালী চুম্বকক্ষেত্র-সংবলিত নিউট্রন নক্ষত্র। তাই সাধারণ মানুষ এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি। ১৯৯৫ সালে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদেরা অনেকটা সূর্যের মতো তারা খুঁজে পান। ৫১ পেগাসাই নামে সেই তারার কক্ষপথে পাওয়া যায় একটি গ্রহও। তখনই মূলত বহির্গ্রহ জ্যোতির্বিদ্যা সত্যিকারের উত্সাহ খুঁজে পায়।

১৯৯২ সালেই আরেকটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছিল। আমাদেরই সৌরমণ্ডলে। নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে, প্লুটো ছাড়া আরেকটি L-গোল বস্তুর শনাক্ত করেন জ্যোতির্বিদেরা। এ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে নেপচুন-অতিক্রান্ত (Trans-Neptunian) বস্তুদের আবিষ্কারের হিড়িক পড়ে যায়। সেই কবে ১৯৩০ সালে ক্লাইড টমবো প্লুটো আবিষ্কার করেছিলেন। ৬২ বছর পর প্লুটো ছাড়িয়ে নতুন কিছু পাওয়া গেল। ১৯৯২-এর পর প্রায় ২ হাজার ৩০০টি নেপচুন-অতিক্রান্ত সৌরীয় L-গোল বস্তু খুঁজে পাওয়া গেছে। অবশ্য এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্লুটোই। এতগুলো ট্রান্স-নেপচুন বস্তুর আবিষ্কার সৌরমণ্ডলের উত্পত্তি ও বিবর্তন সম্পর্কে আমরা এত দিন যা ভাবতাম, সেটা কিছুটা বদলে দিল। দেখা গেল, এ বস্তুগুলোকে আবার বড় দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হলো কুইপার বেষ্টনীর বস্তুসমূহ, আরেকটি বিক্ষিপ্ত চাকতির বস্তুসমূহ (Scattered disc objects)। কুইপার বেষ্টনীর বস্তুসমূহ ৩০ থেকে ৫০ জ্যোতির্বিদ্যা একক ও বিক্ষিপ্ত চাকতির বস্তুসমূহ মূলত ৫০ জ্যোতির্বিদ্যা এককের বাইরে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়ন দ্বারা বামন গ্রহ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে কুইপার বেষ্টনীর প্লুটো, হাউমিয়া ও মাকিমাকি এবং বিক্ষিপ্ত চাকতির এরিস। বহু বিজ্ঞানীর ধারণা, শেষ পর্যন্ত বামন গ্রহের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

গ্রহের স্থানান্তর

বিক্ষিপ্ত চাকতির বস্তুরা এমনিতে সূর্য থেকে দূরে। এসব বস্তুর কক্ষপথ এমন, অনুসূরের সময় বস্তুগুলো নেপচুনের কাছাকাছি আসে এবং নেপচুনের মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে বিক্ষিপ্ত চাকতির বস্তুরা স্থিতিশীল কক্ষপথে ভ্রমণ করতে পারে না, বরং নেপচুন দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়। অনেকে মনে করেন, অনেক ধূমকেতুর উত্পত্তিস্থল বিক্ষিপ্ত চাকতি। অন্যদিকে কাইপার বেষ্টনীর বস্তুরা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। এই বস্তুরা, যে নীহারিকা-চাকতি থেকে সৌরমণ্ডলের উত্পত্তি, তা ধারে মহাকর্ষের ফলে ছোট ছোট গ্রহাণু হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলো মূলত কাইপার বেষ্টনীর বস্তু। এরা ছোট গ্রহাণু হিসেবে সৃষ্টি হলো কেন? কারণ, সেখানে বড় গ্রহ সৃষ্টি হওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ উপাদান ছিল না। কম্পিউটার সিমুলেশন বলছে, এমনকি এখন যেখানে ইউরেনাস ও নেপচুন, সেখানেও যথেষ্ট গ্রহ তৈরির উপাদান ছিল না। বিজ্ঞানীরা আদি সৌরজগতের বিবর্তন বিষয়ে যেসব মডেল নিয়ে গবেষণা করছেন, তার মধ্যে একটি হলো শনি গ্রহ। ইউরেনাস ও নেপচুন আদিতে সৌরমণ্ডলের অনেক ভেতরে ছিল, বৃহস্পতির কাছাকাছি। কিন্তু বিভিন্ন গ্রহাণুর সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণজনিত বিক্ষিপ্ত প্রক্রিয়ায় তারা দূরে সরে যায় (Migrate করে)। শনি ও বৃহস্পতি অবশেষে অরবিটাল রেজোনান্স প্রক্রিয়ায় ২:১ কক্ষপথে স্থিত হয়। অর্থাৎ সূর্যের চারদিকে শনি যে সময়ে একবার ঘুরবে, বৃহস্পতি সেই সময়ের মধ্যেই দুবার ঘুরে আসবে।

বহির্গ্রহ বা সৌরমণ্ডলের বাইরের গ্রহ নিয়ে আলোচনা করতে কেন আমাদের সৌরমণ্ডলকে নিয়ে এত বড় ভূমিকা লিখলাম? জ্যোতির্বিদেরা বহির্গ্রহ খুঁজতে গিয়ে অনেক গ্রহজগৎ আবিষ্কার করেছেন। সেখানে বৃহস্পতি বা তার থেকে অতিকায় গ্রহরা তাদের নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবী থেকে কয়েক গুণ বেশি ভারি অতিকায় পৃথিবীও তাদের নক্ষত্রের কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছেন। এখন একটা প্রশ্ন, আমাদের সৌরমণ্ডলেও কি উষ্ণ বৃহস্পতি বা অতিকায় পৃথিবী ছিল? বিজ্ঞানীরা বহিঃসৌরমণ্ডলগুলোর আবিষ্কৃত গ্রহগুলোর গঠন ও কক্ষপথ থেকে এটা বুঝতে পারছেন, যেকোনো নক্ষত্রমণ্ডলের বিবর্তনে গ্রহগুলোর Migration বা স্থানান্তর একটা বিরাট ভূমিকা পালন করছে।

উষ্ণ বৃহস্পতি

প্রথমে উষ্ণ বৃহস্পতি নিয়ে কিছু বলি। সেই ১৯৯৫ সালে ৫১ পেগাসাই তারার কক্ষপথে যে গ্রহটি আবিষ্কৃত হয়েছিল, সেটাই ছিল প্রথম উষ্ণ বৃহস্পতি। এরপর ০.০১৫ থেকে ০.১৫ জ্যোতির্বিদ্যা একক দূরত্বে ০.১ থেকে ১০ জুপিটার ভরের অনেক গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। ঘঅঝঅ-এর এক্সোপ্লানেট আর্কাইভের তথ্য থেকে, যেসব গ্রহকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা গেছে, তাদের ভরকে তাদের নক্ষত্রের থেকে দূরত্বের অপেক্ষক (Function) হিসেবে দেখানো যায়। তবে একটা বিরাটসংখ্যক নক্ষত্রমণ্ডলে যে বৃহস্পতির বা তার থেকে বড় গ্রহেরা তাদের নক্ষত্রের কাছাকাছি আছে, সেটা বোঝা যায়। নক্ষত্রের এত কাছে বলেই তাদের উষ্ণ বৃহস্পতি বলা হয়। ঠিক কতসংখ্যক গ্রহজগতের উষ্ণ বৃহস্পতি আছে, সেটা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। জ্যোতির্বিদেরা ধারণা করেন, সূর্য বা সূর্যের মতো মূল সারণি (Main sequence) তারাদের ১% এর উষ্ণ বৃহস্পতি আছে।

অতিকায় পৃথিবী

এবার দেখা যাক আরেক ধরনের গ্রহের তথ্য, যাকে আমরা অতিকায় পৃথিবী বা Super Earth বলছি। এই অতিকায় পৃথিবীদের ভর পৃথিবী থেকে কয়েক গুণ বেশি। সেই ১৯৯২ সালে একটি পালসারের চারদিকে প্রথম বহির্গ্রহ পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো হলো অতিকায় পৃথিবী, পৃথিবী থেকে চার গুণ বেশি ভরের। অনেক অতিকায় পৃথিবীর সন্ধান পাওয়া গেছে (পৃথিবীর ভর হলো ০.০০৩ বৃহস্পতির ভর)। ওই চিত্র দেখে মনে হতে পারে অন্য সব গ্রহজগতই উষ্ণ বা নাতিশীতোষ্ণ বৃহস্পতি বা অতিকায় পৃথিবী দিয়ে পূর্ণ। এর কারণটা কিছুটা পর্যবেক্ষণগত; নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি বড় গ্রহেরা থাকলে সেগুলো নক্ষত্রের আলো বা গতির ওপর বেশি প্রভাব ফেলবে, আমাদেরও সেগুলো আবিষ্কার করা সহজ হবে।

বৃহস্পতির স্থানান্তর

কিন্তু বিশাল ভরের গ্রহগুলো তার সূর্যের এত কাছে কী করে থাকবে? কারণ প্রাক্-সৌরীয় নীহারিকায়—যখন সূর্য ও অন্য গ্রহেরা সবে সৃষ্টি হচ্ছে—তখন বৃহস্পতি ও শনির মতো অতিকায় গ্যাসীয় গ্রহদের জন্ম হওয়ার কথা সূর্য থেকে অনেক দূরে frost line বা হিম রেখার কাছে, যেখানে এমন ঠান্ডা থাকবে যে শুধু যে জলই বরফ হবে তা নয়, অ্যামোনিয়া, মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডও বরফে পরিণত হবে। আমরা মনে করি, আমাদের সৌরজগতে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস বা নেপচুন এভাবেই হিম রেখার বাইরে, সূর্য থেকে দূরে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অন্য গ্রহজগতে সেই অতিকায় গ্যাসীয় দানবেরা সূর্যের এত কাছে কেন? অনেক বিজ্ঞানীই বলছেন, সেই গ্রহগুলো migration করে সৌরজগতের ভেতরে এসেছে। অর্থাৎ প্রথমে তারা হিম রেখার বাইরে সৃষ্টি হলেও কয়েক কোটি বছর ধরে ধীরে ধীরে তারা তাদের সূর্যের কাছাকাছি এসেছে।

আমাদের সৌরজগতের কম্পিউটার সিমুলেশনের একটি মডেল বলছে, অন্যান্য গ্রহজগতের মতো বৃহস্পতিও সৌরজগতের ভেতরে migrate করতে করতে প্রায় ১.৫ জ্যোতির্বিদ্যা একক (AU) দূরত্বে এসে পৌঁছায় (এখনকার মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের কাছে)। বৃহস্পতির এই আগমনের ফলে পৃথিবীর মতো বা অতিকায় পৃথিবীর মতো অনেক গ্রহের একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং তারা সূর্যে পতিত হয়। এর মধ্যেই আবার শনি গ্রহ সৃষ্টি হয় এবং বৃহস্পতির সঙ্গে শনির একধরনের মহাকর্ষণীয় রেজোন্যান্স বা অনুনাদ সৃষ্টি হয়, যা বৃহস্পতিকে আবার বাইরের দিকে নিয়ে যায়। ওই সময়েই ধ্বংসপ্রাপ্ত ছোট ছোট গ্রহাণু থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতি এখন প্রায় পাঁচ জ্যোতির্বিদ্যা একক দূরত্বে আছে। এই মডেল যদি ঠিক প্রমাণিত হয়, তাহলে বলা যায়, পৃথিবী তার অস্তিত্বের জন্য বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের কাছে ঋণী।

এই মডেলটার উল্লেখ করলাম কারণ সৌরজগৎ বলতে আমরা যা বুঝি যে পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহেরা থাকবে ভেতরে আর বৃহস্পতির মতো গ্যাসীয় দানবেরা থাকবে বাইরে—সেই ধারণাটা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আবার কিছু কিছু গ্রহজগতে আবার এ রকম উষ্ণ বৃহস্পতি পাওয়া গেছে, যার কক্ষপথ কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের আবর্তনের বিপরীতে। এসব কিছু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমাদের নতুন নতুন মডেল সৃষ্টি করতে হচ্ছে। এর মানে হলো, বিজ্ঞান কখনো থেমে থাকে না, আমরা পুরোনো জ্ঞানকে সম্বল করে বসে থাকতে পারি না। নতুন নতুন তথ্যের আলোকে আমাদের পুরোনো ধারণা ক্রমাগতই বদলে যায়। এই যে বদলানো, এটাই বিজ্ঞানের অভিনবত্ব।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও অধ্যাপক, রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র