স্ট্যান্ডার্ড মডেলে নতুন কণা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা

জি-২ এক্সপেরিমেন্টের জন্য ব্যবহৃত বৃত্তাকার চুম্বকফার্মিল্যাব

৭ এপ্রিল ফিজিকাল রিভিউ লেটার্সে প্রকাশিত এক গবেষণা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে পদার্থবিদদের মহলে। গত ৫০ বছর ধরে সকল পরীক্ষণে পাশ করে আসা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে নতুন কণা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও এই ফলাফল একদম নতুন নয়, ব্রুকহ্যাভেন ল্যাবরেটরির পুরানো এক পরীক্ষণের আরও নিখুঁত ফলাফল, এমনকি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের কাঙ্ক্ষিত নিশ্চয়তার চাইতে একটু কম নিখুঁত, তবুও স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ব্যাখ্যায় নতুন কিছু যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে অবস্থিত ফার্মিল্যাবে সদ্য সমাপ্ত এক পরীক্ষায় মিউয়ন কণার চৌম্বক ভ্রামকের মান তাত্ত্বিক হিসাবের থেকে সামান্য বেশি এসেছে। এতে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষত যারা নতুন কণা খোঁজেন তাদের জন্য এই ফলাফল বেশ আশাপ্রদ। গত ৭ এপ্রিল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় এবং একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ফিজিকাল রিভিউ লেটারস জার্নালে।

মোটামুটি সব কণারই চৌম্বক ভ্রামক নামে একটা জিনিস থাকে। সহজ কথায় চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতিতে কণারা দন্ড চুম্বকের মত আচরণ করে। এই বিষয়টি প্রথম লক্ষ্য করেন স্টার্ন ও গারলাখ, ১৯২২ সালে। তারা চৌম্বকক্ষেত্রে ইলেক্ট্রন চালিয়ে দেখেন ইলেক্ট্রনরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এরই মাধ্যমে ইলেক্ট্রনের স্পিন আবিষ্কার হয়।

মিউয়ন হলো ইলেক্ট্রনের মতোই আরেকটি লেপটন কণা। এদেরও এমন চৌম্বক ধর্ম আছে। কোনো কণার চৌম্বকত্ব কতটা শক্তিশালী তা মাপার জন্য বিজ্ঞানীরা g-factor (জি ফ্যাক্টর) নামে একটা সংখ্যা ব্যবহার করেন। এমনিতে সরাসরি কেবল কোয়ান্টাম মেকানিকসের হিসাব করলে জি ফ্যাক্টরের মান হবে ঠিক ২। কিন্তু কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিকস ব্যবহার করে হিসাব করলে এই মান ২ থেকে সামান্য বেশি হবে। এর কারণ হলো স্টান্ডার্ড মডেলের অনান্য কণার সাথে মিউয়নের মিথস্ক্রিয়ার কারণে পরীক্ষায় চৌম্বকত্ব সামান্য বেশি হওয়ার কথা। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সব কণা এবং অন্যান্য হ্যাড্রনের জন্য মিউওনের জি ফ্যাক্টর হবার কথা ২.০০২৩৩১৮৩৬(২০) - স্টান্ডার্ড মডেল যে কতটা কার্যকর তার প্রমাণ হলো আমরা দশমিকের পর এতো ঘর পর্যন্ত ঠিক-ঠাক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। শেষ দুইঘর ব্রাকেটে রাখার কারণ হলো এই দুই ঘরের মানে অনিশ্চয়তা আছে।

২০০১ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকহ্যাভেন ল্যাবরেটরিতে জি ফ্যাক্টর মাপা হলে সেই মান পাওয়া যায় সামান্য বেশি এবং পরে আরো পরীক্ষার পরে শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালের শেষ রিপোর্টে মান ছিল ২.০০২৩৩১৮৪১৬(১৩)। এই মান তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণী থেকে পাওয়া মানের সঙ্গে দশমিকের পরে অষ্টম ঘর থেকে আলাদা। প্রশ্ন হতে পারে দশমিকের পরে আট ঘর পর্যন্ত একই ফল পাওয়া গেলে এতো মাথা ঘামানোর কারণ কী?

স্টান্ডার্ড মডেলের থেকে করা হিসাব এবং ব্রুকহ্যাভেন ল্যাবের পরীক্ষা এতোই নিখুঁত যে এই পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। ব্রুকহ্যাভেন ল্যাবের মান কোন কাকতালীয় কারণে স্টান্ডার্ড মডেলের মান থেকে আলাদা হবার সম্ভাবনা ছিল মোটামুটি দশহাজার বারে একবার। যেটাকে পরিসংখ্যানের ভাষায় ৩.৭-সিগমা নিশ্চয়তা বলা হয়। কিন্তু পার্টিকেল ফিজিকসের বড় কোনো আবিষ্কার হতে হলে বিজ্ঞানীরা সাধারণত ৫ সিগমা নিশ্চয়তা চান- সম্ভাবনার ভাষায় যা ৩৫ লাখ বারে একবার।

জি-২ (জি মাইনাস দুই অর্থাৎ জি ফ্যাক্টরের মান দুই থেকে কত বড়) আরও ভালোভাবে বের করতে বিখ্যাত ফার্মিল্যাবে নিয়ে আসা হয় ব্রুকহ্যাভেন ল্যাবের বড় বৃত্তাকার চুম্বকটি। মিউয়ন কণাগুলোকে পনের মিটার ব্যাসের সুপারকন্ডাকটর চুম্বক ব্যবহার করে বৃত্তাকারে ঘুরানো হয়। একই সময়ে কণাদের (যারা মোটামুটি দন্ডচুম্বকের মতো আচরণ করে) উত্তর-দক্ষিণ মেরুর অক্ষ ঘোরানো হয়। আরেকটু সঠিক করে বললে, স্পিনের দিক পরিবর্তন করা হয়। মিউওনের জি ফ্যাক্টর যত বড় হবে, এর চৌম্বক ধর্ম তত বেশি হবে। ফলে এই অক্ষ ঘোরার সময়ও তত কম হবে। খুবই নিখুঁত একটি ঘড়িতে এই সময় মাপা হয়। মজার ব্যাপার হলো, পরীক্ষার ফলাফলে অনাকাঙ্ক্ষিত পক্ষপাত এড়াতে গবেষকদের এই ঘড়ির কম্পাঙ্ক জানানো হয়নি। অর্থাৎ, ঘড়িতে কত সময় লেগেছিলো গবেষক দল তা জানতেন না।

এক্সপেরিমেন্টের ফল
ফার্মিল্যাব

ঘড়ির কম্পাঙ্ক অজানা রেখেই তাদের আলাদা আলাদা টিমে বাকি সব হিসাব করতে দেয়া হয়। এই গবেষণা দলে সব মিলিয়ে বিজ্ঞানী ছিলেন ২০০-এরও বেশি। ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরা সবাই যুক্ত হন এক টেলিকনফারেন্সে। ওই টেলিকনফারেন্সে সবার কাছে ঘড়ির কম্পাঙ্কের মান দেয়া হলে তারা তখন সেই মান তাদের হিসাবে বসিয়ে দেখেন ব্রুকহ্যাভেন ল্যাবের মতোই তাদের পরীক্ষাতেও জি ফ্যাক্টর সামান্য বেশি এসেছে। তাদের জি-২ (জি মাইনাস দুই) এর মান আসে ০.০০২৩১৮৪০৮(১১) আর ব্রুকহ্যাভেন ল্যাবের ফলাফলের সাথে মিলিয়ে শেষমেষ জি-২ এর মান হয়ে যায় ০.০০২৩১৮৪১২২(৮২)। এই ফলাফলের জন্য নিশ্চয়তা ৪.২ সিগমা পরিমান- অর্থাৎ প্রায় এক লাখ বারে একবার সম্ভাবনা আছে এই ফলাফল কাকতালীয় হওয়ার।

এক্সপেরিমেন্টের অ্যানাটমি
ফার্মিল্যাব

তবে এই ফলাফলের নিশ্চয়তা এখনো কণা পদার্থবিদদের আকাঙ্ক্ষিত ৫ সিগমা থেকে কম। এজন্য এখনই নিশ্চিতভাবে নতুন কণার কথা বলা যাচ্ছে না, স্ট্যান্ডার্ড মডেলেও এখনই পরিবর্তন এসে গেছে বলা যাচ্ছে না। ইউরোপের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারও ২০১২ সালের হিগস বোসনের পরে এত দিনেও আর কোনো নতুন কণা খুজে পায়নি। তাছাড়া গত বছর বুদাপেস্ট- মার্শেই-ভুপের্টাল কোলাবোরেশানের এক দল বিজ্ঞানী জি-২ এর একটি নতুন তাত্ত্বিক মান প্রস্তাব করেন যা পরীক্ষালব্ধ মানের আরও কাছে। তারা স্টান্ডার্ড মডেলের অন্তর্ভুক্ত গ্লুয়ন কণার সাথে মিউয়নের মিথস্ক্রিয়ার জন্য নতুন হিসাব করে এই মানে পৌছান। তবে তাদের এই হিসাব এখনো বিজ্ঞানী মহলে পর্যালোচনা হচ্ছে। ফার্মিল্যাবের এই এক্সপেরিমেন্ট ২০২২ সাল পর্যন্ত চলবে। তাতে করে শেষমেষ ৫ সিগমা নিশ্চয়তায় পৌছানোর সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া সম্পূর্ণ আলাদা পরীক্ষা পদ্ধতিতে যদি এই মান বের করা যায় তবে তা নিশ্চিতভাবেই আরো জোরালো প্রমাণ হবে। তেমন একটি এক্সপেরিমেন্ট সেটাপের কাজ চলছে জাপানের প্রোটন এক্সিলেরেটর রিসার্চ কমপ্লেক্সে (J-PARC) যা ২০২৪ সাল থেকে কাজ শুরু করতে পারবে। তবে নতুন কণা পাওয়া যাক বা না যাক, মিউওনের জি-২ এর মান সামনের কয়েক বছর থিওরেটিকাল ও এক্সপেরিমেন্টাল, দুই ধরনের কণা পদার্থবিদদের জন্যই বেশ রোমাঞ্চকর হবে।

সূত্র: নেচার, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ফিজিকাল রিভিউ লেটার্স, ফার্মিল্যাব

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (কাইস্ট)