এলিয়েন

‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ’ (অবশ্য রাজনৈতিক বানান ভুল। লেখা আছে রাজনতিক) ছাপরা চা–শিঙাড়ার দোকানটার ভেতরে চুন দিয়ে বড় বড় করে লেখা টিনের ওপর। আজ অবশ্য কোনো রাজনৈতিক আলাপ হচ্ছে না। চারজন তরুণ বসে কঠিন বিজ্ঞানের আলোচনা করছে। তাদের আলোচনার বিষয় এলিয়েন। ঠিক চারজনই আলোচনা করছে, কথাটা ঠিক না। তিনজন আলোচনা করছে আর চতুর্থজন চুপচাপ ঝিম মেরে শুনছে। সে এই আড্ডায় নতুন।

মহাবিশ্বে এলিয়েন বলে কিছু নেই।

তুই কী করে শিওর হলি?

আমি শিওর, এলিয়েন থাকলে এত দিনে ঠিকই যোগাযোগ করত।

ঘোড়ার ডিম।

নাসার এক রিটায়ার্ড জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটা বই লিখেছে রিসেন্টলি। ওখানে স্পষ্ট লেখা আছে এলিয়েনের কথা...

কী রকম?

১৯৯০ বা ৯২ সালের দিকে একটা সসার শুক্র গ্রহ পর্যন্ত এসে ঘুরে গেছে। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিল, কোনো ধূমকেতু বের হয়ে হয়েছে। ওটা আসলে ইউএফও ছিল। আমার কাছে পিডিএফ কপি আছে, পড়লে দিতে পারি।

আরে ধুর ধুর...ফালতু। এলিয়েন নেই।

আছে। চতুর্থজন এবার মুখ খুলল।

ইনি এলিয়েন। ফিসফিস করে রঞ্জন। মাথায় রক্ত উঠে গেল সজলের। ফাজলামোর একটা সীমা আছে। এক পাগলকে কোত্থেকে ধরে এনে বলছে এলিয়েন। মুনীরের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। চোখের ভাষায় তারা একজন আরেকজনকে বলল, ‘চল যাই, এখানে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, তবে এখানে কোনো ঝামেলা করিস না।’

তিনজনই চতুর্থজনের দিকে তাকাল। এ অতিসম্প্রতি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখনো সিগারেট ভাগাভাগি করার মতো খাতির হয়নি। তবে লোকটা একটু ইন্টারেস্টিং, পাগলাটে!

এলিয়েন আছে এবং তারা পৃথিবীতে এসেছিল। বেশ শক্তভাবে কথাটা বলে চতুর্থজন। তার নাম রঞ্জন।

তাই নাকি? কবে এসেছিল? ব্যঙ্গর সুরে বলে একজন।

শুরু থেকেই তারা আসছে। এ পর্যন্ত ৫৩৩ বার এলিয়েন এসেছে পৃথিবীতে। বাংলাদেশেই এসেছে ১৩২ বার। তিনজনের মুখ হাঁ হয়ে যায়। ছাগল বলে কী?

ওহ্! এসে নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে দেখা করেছে?

তা করেছে। ৬৩ জন আমার সঙ্গে দেখা করেছে।

বাহ্‌ বাহ্‌ চমত্কার। মুনীর উঠে দাঁড়ায়, এখানে এই পাগলের সঙ্গে বসে আড্ডা মারা অসম্ভব। ছগীরের ওপর অসম্ভব মেজাজ খারাপ হচ্ছে, ও এই ছাগলটাকে নিয়ে এসেছিল। ‘আমি চললাম রে’ বলে উঠে পড়ে। সজলও উঠে পড়ে।

হ্যাঁ, আমারও একটা জরুরি কাজ আছে, উঠি। এই যে ভাই, এরপর এলিয়েন এলে খবর দিয়েন, একটা সেলফি তুলে রাখব। চোখ টিপে বলে সজল।

আসবে, এই তো আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আসার কথা, এবার আসবে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি থেকে। আপনারা আসতে পারেন আমার বাসায় সন্ধ্যা সাতটায়...পরিচয় করিয়ে দেব।

এ ঘটনার পর তারা ওই পাগলকে এড়িয়ে চলে, ওই ছাপরা দোকানেই আর যায় না চা খেতে। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল। সজল আর মুনীর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। দেখে হন্তদন্ত হয়ে সেই এলিয়েন বিশেষজ্ঞ হনহন করে যাচ্ছে।

এই যে এলিয়েন ভাই। রঞ্জন থমকে দাঁড়াল।

আরে, আপনারা? যাবেন নাকি আমার বাসায়?

কেন, এলিয়েন এসেছে নাকি আপনার বাসায়?

হ্যাঁ, গেলে চলুন। অপেক্ষা করছে। ফিসফিস করে সজল, ‘চল যাই। আজ শালারে দেখিস ঠিক সাইজ করে দেব...’

রঞ্জনের বাসাটা ছিমছাম। বসার ঘরে খালি পায়ে একটা লোক বসে আছে—রোগা লম্বা ফরসা। চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। সামনের টেবিলে কাগজে উবু হয়ে কী সব লিখছে, ঠিক লিখছে না...দাগাদাগি করছে। টেবিলের পাশে নিচে পড়ে আছে একটা ভাঙা মগ। ঘরের পরিবেশটা একটু যেন অন্য রকম, কেমন একটা সূক্ষ্ম আওয়াজ হচ্ছে কোথাও; অস্বস্তিকর আওয়াজ। সজল, মুনীর খেয়াল করল, লোকটা তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না, যেন তারা দুজন লোকটার কাছে অদৃশ্য। লোকটা তখনো গভীর মনোযোগে কাগজে হিজিবিজি কী সব লিখছে, লিখেই চলেছে।

ইনি এলিয়েন। ফিসফিস করে রঞ্জন। মাথায় রক্ত উঠে গেল সজলের। ফাজলামোর একটা সীমা আছে। এক পাগলকে কোত্থেকে ধরে এনে বলছে এলিয়েন। মুনীরের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। চোখের ভাষায় তারা একজন আরেকজনকে বলল, ‘চল যাই, এখানে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, তবে এখানে কোনো ঝামেলা করিস না।’

ওয়াশরুমে যাওয়া যাবে? মুনীর বলে।

হ্যাঁ, এই তো।

একটু বেগ হচ্ছিল। কাজটা এখানে সেরে গেলেই ভালো, তা ছাড়া সাইকিয়াট্রিস্ট কৌশিক মিত্র একবার বলেছিল, ওয়াশরুমে ঢুকলে বাড়ির মালিকের মেন্টালিটি ৪০ শতাংশ বোঝা যায়। মুনীর ওয়াশরুমে গেল। দ্রুতই বের হয়ে এল। ফিরে এসে টেবিলের সামনে একটু যেন থমকে দাঁড়াল। তারপর ‘যাই তাহলে’ বলে দুজনেই বের হয়ে গেল।

বাইরে এসে হড় হড় করে বমি করল মুনীর।

কী হলো তোর?

আমার ভয় লাগছে, ভয় লাগলে আমার বমি হয়...ওয়াক!

মানে কী? কিসের ভয়?

মানে, বসে থাকা লোকটা সত্যি এলিয়েন!

কী বলছিস গাধার মতো?

আমি ঠিকই বলছি। আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি, লোকটার পাশের টেবিলের নিচে পড়ে থাকা ভাঙা মগটা জোড়া লেগে গেছে। আর সাদা কাগজে দাগগুলো সে কলম দিয়ে মুছছিল, আঁকছিল না।

মানে?

মানে পরিষ্কার। রঞ্জনের ঘরের ভেতর থারমোডাইনামিকসের সূত্র কাজ করছে না। সময় উল্টো দিকে ছুটছে। এনট্রপি কমছে। যা আসলে অসম্ভব!

এর মানে কী?

মানে বুঝলি না? এনট্রপি কমা মানে সময় উল্টো দিকে বইছে। এ রকম রিভার্স টাইম ফ্লোতে ওদের আসতে সুবিধা। ওরা ঘন ঘন আসে...। মুনীর ড্রেনের পাশে বসে আবার হড় হড় করে বমি করে। কিছু কিছু মানুষ টেনশন–বিস্ময়–ভয় এসব নিতে পারে না। তাদের শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ হয় না।