গাছের ভাষা গাছের শিস

তারা শোধ নেবে।

তারা ঠিক করল।

বোকা মানবজাতি। ভাবে কী বোকার দল! প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে তারা! আরে, মাত্র অঙ্কুরোদগম হলো যে গাছের সেও তো এ রকম কখনো ভাবে না, যদিও মহিরুহই সে হবে একদিন। মহিরুহ কি মানুষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে নাকি? না বোঝে লড়াই, না বোঝে অংশ হয়ে থাকা; ঢিট করতে হবে এই বোকাদের।

তারা আরও আগেই এটা পারত। কিন্তু দেখেছে। লাখ লাখ বছর ধরে দেখেছে। হেলদোল যদি কিছু ঘটে বোকাদের। কিস্যু ঘটেনি। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের বোকা বিশ্বাস তাদের কূপমণ্ডূক করে রেখে দিয়েছে। এবং নির্বিকার। তারা মেরে ফেলেছে অগুনতি নদীকে। মেরে ফেলেছে অগুনতি গাছকে। কখনো ভাবেনি এবং ভাবেও না কুকর্মের হিসাব দিতে হবে একদিন। আজব! তারা আবার নদী রক্ষা নিয়ে গবেষণা করে! গাছ রক্ষা নিয়ে গবেষণা করে।

‘তারা বোকা, তারা হাস্যকর!’

‘তারা বোকা, তারা অর্বাচীন!’

‘তারা বোকা, তারা নির্বোধ।’

‘হা! হা! হা!’

‘হা! হা! হা!’

বোকার দল এসব কথা কি শোনে না? কী করে শুনবে? সব শব্দ কি তারা শুনতে পায়? সব রং কি তারা দেখতে পায়? সীমাবদ্ধ প্রাণী। বোকারা মনে করে তারা আলাদা। দ্য থিংকারের দল।

সব পাখি গাছ নদী টিলা পাহাড়ের নাম দিয়ে বসে আছে তারা। কেন? কেউ কবে তাদের এই উড়ো মাতবরির অধিকার দিয়েছে? বোকার দল মনে করে তারা জন্মগতভাবে এটা পেয়েছে। আচ্ছা পেয়েছে। তবে কৃতজ্ঞ থাক একটু। বিনয়ী থাক। তা না। উঠেপড়ে লেগে তারা বরং নিত্য সর্বনাশ ঘটাচ্ছে নিজেদের গ্রহটার। এত নির্বোধ। নানা প্রান্তের উনত্রিশ শ চব্বিশটা শহরে এখন বাস করে মানব সম্প্রদায়। প্রতিটা শহরে ঘণ্টায় গড়ে এক দশমিক শূন্য আটটা খুন হয়। সহজ হিসাব? জটিল এরা। অতিশয় জটিল। টিকে আছে যে খাদ্যচক্রের বদৌলতে, পারে তো অস্বীকার করে সেটাও। সব প্রাণীর হত্যাকারীরা এখন ‘প্রাণী হত্যা করিও না’ বলে তড়পাচ্ছে। প্রাণী তারা আর হত্যা করবে না, লতাপাতা খেয়ে বাঁচবে। লতাপাতা কিছু প্রাণী নয় আর–কী!

‘তারা মনে করে তারা সৃষ্টিশীল।’

‘সৃষ্টিশীল। হা! হা! হা! সর্বোচ্চ সৃষ্টিশীলতা কী তাদের? বাইসনকে খাদ্য বিবেচনা করা নয়? কবে সৃষ্টিশীল দুপেয়ে প্রথম ভাবল, বাইসন খাদ্য হতে পারে তাদের? হা! হা! হা! সৃষ্টিশীল আর কিছু তারা করেছে?’

‘যারা করতে চায় তাদের তারা নিজেদের মনে করে না আর। লুনিবিনের বাসিন্দা করে দেয়। রিভিসের টোরোকে দিয়েছে।’

‘ডর্কির তুরাকে দিয়েছে।’

‘টিউনের পেকোকে দিয়েছে।’

‘সব লুনিবিন পূর্ণ হয়ে গেছে।’

‘না। য়্যামজেআই লুনিবিনে দুটো কেবিন খালি আছে এখনো।’

‘পূর্ণ হয়ে যাবে। ম্যাপলের ট্রিনি এবং রেকুনের হিউকে তারা পাঠাবে।’

‘পাঠাবে?’

‘তারা চেষ্টা করবে।’

‘তারা বোকা।’

ম্যাপল শহরের ট্রিনি পেইন্টার। রেকুন শহরের হিউ নৃ-তাত্ত্বিক, গবেষক। তারা পরস্পর পরিচিত। হিউয়ের সর্বশেষ সেমিনারে ছিল ট্রিনি। টোগা শহরে। পরে হিউকে জানানো হয়েছে তার পেপারের বিষয় এবং ধরন নিরাপত্তা পরিষদকে যথেষ্ট পরিমাণ উদ্বিগ্ন করেছে। একই কথা ট্রিনিকেও জানানো হয়েছে সেমিনারে তার উপস্থিতির জন্য। এর মানে একটাই। নিরাপত্তা পরিষদ যেকোনো দিন ডাকবে ট্রিনি এবং হিউকে। কিছু রুটিন প্রশ্ন করবে এবং লুনাটিক ঘোষণা করবে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য দুটি কেবিন বরাদ্দ হয়ে যাবে যেকোনো লুনিবিনের।

উদ্বিগ্ন না হলেও তারা সতর্ক। হিউ ও ট্রিনি। হিউ তার পেপারে বলেছে, চরম সংকটের এই মুহূর্তে প্রকৃতি রক্ষা করবে বিপন্ন মানবজাতিকে। প্রকৃতিকে রক্ষা করার সক্ষমতা মানবজাতি রাখে না কখনোই। নিরাপত্তা পরিষদের জনসংযোগ কর্মকর্তা কেরুয়াক এটাকে বলেছেন, আজগুবি ধারণা। পৃথিবীর ওজোন স্তর বিপর্যয়ের উল্লেখ ছিল হিউয়ের পেপারে। আড়াই লাখ বছর আগে একবার ওজোন স্তর ফুটো হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর। মানবজাতি সেই ফুটো মেরামতের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছিল এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ইউনিট খরচ করেছিল প্রজেক্টে। ওজোন স্তরের ফুটো মেরামত করে তারা রক্ষা করবে পৃথিবীকে। পৃথিবী তাদের সহায়তা নেয়নি। বিপর্যয়কর সেই ফুটো নিজেই মেরামত করে নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কেরুয়াক বলেছেন, আড়াই লাখ বছর আগের আরেক মানবসভ্যতার সময়ের ঘটনা। বর্তমান মানবজাতির বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিশীলতা এতে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে না।

কেরুয়াক কুটিল। দেখতেও কুটিল। তার এসব কথাবার্তা নিশ্চয় আতঙ্ক ও শঙ্কাজনক। তবে সতর্ক থাকলেও হিউ এখনো তার প্রিয় রেকুন শহর ছাড়েনি। ট্রিনিও ম্যাপল শহর ছাড়েনি। ছেড়ে কিছু হবে না। পরিত্যক্ত কোনো শহরে আত্মগোপন করলেও নিরাপত্তা পরিষদের রোবট এজেন্টরা তাদের ধরে নিয়ে যেতে পারবে।

রাত এখন। ম্যাপল ঘুমিয়ে গেছে। ট্রিনি ঘুমায়নি। লে-আউট করছে পেইন্টিয়ের। কিছু গাছ ড্রয়িং করেছে। তারা মানুষের মতো দেখতে। কিংবা মানুষ, তারা গাছের মতো দেখতে।

ঘুমিয়ে গেছে পাহাড়ি রেকুন শহরও। ঘুমিয়ে গেছে হিউ। চৌত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে, একা থাকে সে এখনো। জিন বিজ্ঞানী ত্রানার সঙ্গে একটা সম্পর্কের কথা শোনা যায় তার। এই নীল গ্রহের সবচেয়ে রূপবতী বিজ্ঞানী ত্রানা। একসঙ্গে তারা কিছুদিন থেকেছে। মিডিয়া টাইকুন পিসারো এখন ত্রানার পার্টনার। পিসারোর ভাইপো ক্রন হিউয়ের বন্ধু।

ইনসমনিয়া আছে ট্রিনির। ঘুম ধরে না। ধোঁয়া ওড়া এক মগ যোকো নিয়ে বসে আছে সে। মনিটরে পৃথিবীর গহিনতম জঙ্গল দেখছে। কদিন আগে এই জঙ্গলের বারো হাজার একর এলাকা ভস্মীভূত হয়ে গেছে দাবানলে। রহস্য দাবানল। তথ্যকেন্দ্রের ‘ফাইন্ডার’ ক্যামেরায় ধরা পড়েনি কী করে এমন দাবানল ঘটল। এটা বিস্ময়কর। বারো হাজার একর মানে কত লাখ গাছ? শতাব্দীপ্রাচীন, সহস্রাব্দপ্রাচীন গাছ, বৃক্ষ সম্প্রদায়। পুড়ে গেছে তারা। কেরুয়াক বলেছেন সব বানোয়াট কাহিনি। সিনেমার ক্লিপ দাবানলের দৃশ্যটা।

কোন সিনেমার?

সেটা জানাতে বাধ্য নয় কেরুয়াক।

যতবার দেখে বিষাদগ্রস্ত হয় তবু ট্রিনি বারবার দেখে ক্লিপটা। দাবানল দেখে, কেরুয়াককে দেখে। কেরুয়াক কি মানুষ আদৌ? আজব! হঠাৎ ট্রিনির মনে পড়ল হিউকে। কেন? হিউ এখন কী করছে? মানুষটা নিশ্চয় কিছু পড়ছে বা লিখছে। তাকে কি এখন একটা কল দেবে ট্রিনি? মাথা খারাপ। মানুষটার মতবাদ সমর্থন করে এবং মানুষটাকে শ্রদ্ধা করে সে। যোকোর মগে চুমুক দিল এবং মানুষটার একটা পোর্ট্রেট ড্রয়িং করল ট্রিনি। মুখস্থ ড্রয়িং। মানুষটা কি এই ড্রয়িং কখনো দেখবে? না। দেখাবে না ট্রিনি। কেন? বলতে পারবে না। আচ্ছা মাঝেমধ্যে এই মানুষটাকে নিয়ে এ রকম চিন্তা করে কেন সে? ধড় নেই মুণ্ডু নেই চিন্তা! মানুষটা কি তার আঁকা একটা গাছ?

হিউ একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠল।

ভার্না দ্বীপের গ্রেকো সহপাঠী হিউয়ের। আদিবাসী গ্রেকো। তাদের গোত্র হলো কার্পাশ গোত্র। তারা বিশ্বাস করে গাছ শিস দিয়ে কথা বলে। গাছের শিস, তুই শুনিস (তারা বলে তাদের বাচ্চাদের)

গাছের ভাষা, গাছের শিস

তুই শুনিস তুই শুনিস!

স্বপ্নে কিছু গাছ শিস দিয়ে কিছু কথা বলল ‘মসিয়ো’ হিউকে।

‘মসিয়ো হিউ। মসিয়ো হিউ।’

‘তুমি আর একজন। তুমি আর একজন।’

‘গাছ হতে পারবে। গাছ হতে পারবে।’

‘তুমি আর একজন। তুমি আর একজন।’

‘কে ঠিক করো! কে ঠিক করো।’

স্বপ্নে কিছু ঠিক করতে পারল না, ঘুম থেকে উঠে হিউ ঠিক করল, সত্যি তেমন কিছু যদি ঘটত ট্রিনিকে তার সঙ্গে গাছ হতে বলত সে। ম্যাপল শহরের পেইন্টার ট্রিনি। বয়স তার অর্ধেক, সবে উনিশ।

যুক্তিহীন একটা কাজ করল হিউ। সময় দেখল না বা আমলে নিল না, কল দিল ট্রিনিকে। ধরবে ভাবেনি, ট্রিনি ধরল, ‘হিউ!’

ভূমিকা করল না, হিউ বলল, ‘তুমি কি গাছ হতে চাও, ট্রিনি?’

‘অবশ্যই চাই, হিউ। সব সময় চাই। অতি প্রাচীন টাইকো ভাষায় ট্রিনি শব্দের অর্থ হলো গাছ। আমি যখন পেটে, শুটিং স্টার দেখলে সব সময় আমার মা উইশ করত, আমি যেন গাছ হয়ে জন্মাই।’

আবার ঘুমিয়ে আবার স্বপ্ন দেখল হিউ। সে একটা গাছ হয়ে গেছে। গাছ সে দেখল ট্রিনিকে। কিছু দূরে। ট্রিনিও একটা গাছ হয়ে গেল। এত সহজ!

যোকো শেষ করেনি, বসে আছে ট্রিনি। হিউ তাকে কল করেছিল সত্যি! আর কিছু ভাবতে যাচ্ছে না সে। আরে, তার কি ঘুম পাচ্ছে নাকি? ঘুম না তন্দ্রা। তাও আশ্চর্য। তন্দ্রার ভেতর বিচিত্র এক অনুভূতি হলো ট্রিনির। হিউয়ের একটা স্বপ্নে ঢুকে পড়ছে সে। তারা গাছ হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো তার।

স্বপ্ন, বাস্তব না অধিবাস্তব? সেই স্বপ্ন সেই বাস্তব সেই অধিবাস্তব থেকে আর বের হতে পারল না হিউ, ট্রিনি। পৃথিবীতে দুটি গাছ বাড়ল। গাছেরা জানল, মানবজাতি জানল না।

পরের উনত্রিশ হাজার আটাশ বছরে গাছ হয়ে গেল পৃথিবীর সব মানুষ। শিস দিয়ে এখন কথা বলে তারা।

গাছের ভাষা গাছের শিস

তুই শুনিস তুই শুনিস...।

দুই লাখ বছর পরের ঘণ্টা। পাতাঝরা এবং ওড়া এক দুপুরে হলুদ পাতাঅলা একটা গাছের মনে হলো, আচ্ছা, মানুষ হয়ে দেখি তো আর একবার।

আরও একটা গাছের মনে হলো এমন।

আরও একটা গাছের মনে হলো...

শিস দিল তারা।

গাছের ভাষা গাছের শিস

তুই শুনিস তুই শুনিস...