যদি অমানুষই বলি আরাকে, তা আমরা এই পৃথিবীর হিসাবে বলতেই পারি, সে তখন শেওলাজমা টানেলটা ধরে আরও উত্তরের দিকে ছুটছে। উত্তর...একই সঙ্গে একটা দিক এবং একটা সিদ্ধান্ত।
সামনে তিনটা টানেল। সরু। দুইটায় তবু আলো আছে। তৃতীয়টি অন্ধকারাচ্ছন্ন। স্যাঁতসেঁতে হবে দেখেই মনে হচ্ছে।
ফলে এটিকেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে হলো আরার। ছুটল সেদিকে। রাস্তায় পড়ে একটা ডাইভ দিল বাতাসে যেন। একটা ডিগবাজি। অন্ধকারে শরীরটা ঢুকতেই বিপরীত মোড় থেকে বেরিয়ে এল যানটা। নিঃশব্দে। কিন্তু আলোর বন্যা তুলে। মুহূর্তেই জায়গাটা দিনের চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মসৃণ রাস্তার পিনও দেখা যাবে এখন; যদি তা থাকে।
কিন্তু ব্ল্যাক ফোর্স টু সেভেনের দলটা দেখল নেই, কিছুই নেই। রাস্তায় কিচ্ছুটি নেই। এমন হওয়ার কথা নয়। কমান্ডারের সামনে ত্রিমাত্রিক ভাসমান পর্দা। তাতে বেশ স্পষ্ট করেই বন্দী আরার স্থানাঙ্ক দেখানো হচ্ছে এবং তা কয়েক শ মিটারের মধ্যেই। অথচ কোনো মানুষেরই অবস্থান জানতে এত বেশি ঝক্কি পোহাতে হয় না তাদের। শুধু আরা, একটা অমানুষ বলেই ঠিক স্থানাঙ্ক দিতে পারছে না সুপ্রিম ডেটাবেইসও।
যদি অমানুষই বলি আরাকে, তা আমরা এই পৃথিবীর হিসাবে বলতেই পারি, সে তখন শেওলাজমা টানেলটা ধরে আরও উত্তরের দিকে ছুটছে। উত্তর...একই সঙ্গে একটা দিক এবং একটা সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত, যা উত্তরের অর্থ জবাব না করে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে। ছুটছে আরা...আমাদের গল্পের একমাত্র অমানুষ, আরা।
আমরা চাইলে এবার আরাকে উত্তরের দিকে ছুটতে দিয়ে তার বিপরীত দিকে, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে বা বলা ভালো, প্রশ্নের দিকে যেতে পারি। আর প্রশ্নটা এক বিরাট জিজ্ঞাসাচিহ্ন হিসেবে ঝুলে থাকতে দেখতে পারি বার্ষিক বিশ্ব বিজ্ঞান মহাসমাবেশে। যেখানে এসেছেন পৃথিবীর তাবৎ মহাবিজ্ঞানী। যারা মুক্তি দিচ্ছেন মানুষের বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে। আঁকছেন অতীতের ভুলত্রুটি। আর এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে রয়েছেন মহাবিজ্ঞানী জাবেল জালিল। মঞ্চে তার নাম আসতেই একটা হল্লা ছুটে যায় দর্শক দরবারে। সবার করতালি আর মুহুর্মুহু উল্লাসে ধ্বনিত হতে থাকে সমাবেশের পুরো হল।
ওদিকে জাবেল জালিল স্মিত হাসেন শুধু। সবার দিকে তাকিয়ে নেন নিমেষে। শান্ত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, আমরা...মানুষের ভবিষ্যৎ পাল্টে দেব!
হলময় একটা নীরবতা। মানুষেরা যেন শ্বাসটাও আটকে রেখেছে। এমন বদলে যাওয়ার কথা আগে যেন শোনেনি তারা; ভবিষ্যতেও যে শুনবে, তার নিশ্চয়তা কী? কী হবে তাহলে মানুষের ভবিষ্যৎ?
শেষের দিকে দর্শক মৃদু গুঞ্জনের ঢেউ তুললে জাবেল জালিলের হাসিটা আরেকটু চওড়া হয়। বলেন, নিশ্চয় ভাবছেন কেমন হবে মানুষের ভবিষ্যৎ? আমরা আসলে কেমন হব আগামীর দিনগুলোতে?
জাবেল একটু সময় নেন। তারপর বলেন, আমরা আগামী দিনে মানুষ হব।
মৃদু গুঞ্জনটা এবার আলোড়িত হয় যেন। দু–একটা শব্দও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেউ একজন চাপা স্বরে বলে, আমরা কি তাহলে মানুষ নই এখন?
জাবেলের তীব্র উত্তর ভেসে আসে তখনই, না! আমরা মানুষ নই। আমরা শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করি, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় আমরা যে শ্রেষ্ঠ, তা ঠিক করে বলেই উঠতে পারি না। আগামীর মানুষ হবে শ্রেষ্ঠ, উন্নত এবং অবশ্যই সত্যিকারের মানুষ!
হলঘরের ভেতর নিশ্চয়তার একটা বিমূর্ত শব্দ শোনা যায়। সত্যিই তো, আমরা যে শ্রেষ্ঠ, তা আমরা কীভাবে যেন শ্রেষ্ঠ? কী আছে আমাদের?
জাবেল এবার উঠে দাঁড়ান। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ত্রিমাত্রিক পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে মানুষের শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রের ছবি। জাবেল বলেন, শুরুটা হোক শরীর দিয়েই! পৃথিবী ভরে গেছে দূষণে…আমরা জানি…কিন্তু আমাদের শরীরে কি সেটা প্রতিরোধ করার সত্যি কোনো ব্যবস্থা আছে? মাত্র একটা ফুসফুস আমাদের? সত্যিই? এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কী হতে পারে, তা–ই না?
হলভর্তি মানুষ শুধু না, পাশে বসে থাকা বিজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞানীরাও এবার হেসে ওঠেন। সত্যিই, এটা সম্ভবত মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে বড় রসিকতা যে টিকে থাকার জন্য তার শরীরে রয়েছে মাত্র একটা ফুসফুস। অথচ পৃথিবীর বাতাসে এখন নাক পাতা দায়। এ অবস্থায় একটা ফুসফুস আমাদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয় কীভাবে?
মহাবিজ্ঞানী জাবেল তার আইডল। কিন্তু কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তার মনে। আইডল বলেই হয়তো সেগুলো করতে হয়!
জাবেল বলেন, শুধু ফুসফুসই না…একটু অন্যদিকেও তাকাই। আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্র আর বৃহদন্ত্র যেভাবে তৈরি, শরীরকে শক্তি দেওয়ার জন্য, প্রতিনিয়তই খেতে হয় আমাদের। সত্যিই? সকালে খাও, দুপুরে খাও, বিকেলে খাও, রাতে খাও…মানুষ কি শুধু খাদ্য গ্রহণ ও বর্জনের জন্য জন্মগ্রহণ করে নাকি? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না…আমাদের শরীরের সবচেয়ে ওপরে যে অঙ্গ রয়েছে, সেটি মস্তিষ্ক। আমাদের কাজ হবে মস্তিষ্ক নিয়ে। আমরা ভাবব, আমরা আমাদের চিন্তাকে রূপান্তর করব সৃষ্টিতে! কিন্তু সময় কোথায় আমাদের? আমাদের সব সময়, সব সম্ভাবনা পতিত হচ্ছে শুধু খাদ্য উৎপাদন আর তা গ্রহণে। এমন স্থূল ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছে বিপর্যয়! আমরা আসলে মানুষ নই, আমরা হয়ে আছি শুধুই অমানুষ!
ঠিক তখনই হলরুমের দর্শকসারির মধ্য থেকে উঠে দাঁড়ায় আরা।
বিজ্ঞানের ছাত্রী সে। মহাবিজ্ঞানী জাবেল তার আইডল। কিন্তু কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তার মনে। আইডল বলেই হয়তো সেগুলো করতে হয়!
‘স্যার, আমি কি কোনো প্রশ্ন করতে পারি?’
হলঘরটা যেন থমকে যায়। সবাই ঘুরে তাকায় আরার দিকে। জাবেল মঞ্চ থেকে আরার দিকে তাকিয়ে থাকেন একটু সময়। তারপর বলেন, অবশ্যই। প্রশ্নই তো বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রশ্নহীনতা কোনো সমাধান না প্রিয় আরা…
আরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। মহাবিজ্ঞানী জাবেল তার নাম জানেন? কীভাবে?
জাবেল আরেকবার হাসেন। বলেন, ভাবছ তোমার পরিচয় আমি কীভাবে জানি? তুমি মাত্র ১২ বছর বয়সে স্কলারশিপ পেয়ে সেন্ট্রাল একাডেমিতে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছ। তোমার কথা আলাদাভাবে জানা আমার জন্য কি খুব অন্যায়?
আরা হাসতে চায়, পারে না। তার বিমূঢ়তা আরও গাঢ় হয়।
জাবেল বলে যান, তা ছাড়া তুমি এখন ১৮ বছরের ঝকঝকে তরুণী…এবং আমিও ততটা বৃদ্ধ হয়ে যাইনি, তাই না? ফলে তোমার দিকে একটু আলাদা করে নজর দিলেও কি আমার অপরাধ হয়ে যাবে, প্রিয়?
আরা কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। হলঘরে মৃদু হাসির হুল্লোড় ওঠে। মহাবিজ্ঞানী জাবেল হাতটা বাতাসে নাড়ান চকিতে। তারপর আবারও ভুবন ভোলানো হাসিটা হাসেন। বলেন, রসিকতা করলাম। আমি তোমার পরিচয় জানি…কারণ, আমি আর অমানুষ নেই!
হঠাৎই আবার একটা নীরবতা সবার মধ্যে। সবাই উন্মুখ জাবেলের কথা শোনার জন্য।
জাবেল বলতে থাকেন, অস্ত্রোপচার হয়েছে আমার শরীরে এবং আমার শরীরে এখন তিনটা ফুসফুস। তারা একযোগে দারুণ কাজ করছে। ফলে বাইরের দূষণের জন্য আমি তৈরি। আমি এখন আরও অনেক বেশি অক্সিজেন ছেঁকে নিতে পারি। ওদিকে আমি আমার ক্ষুদ্রান্ত্র–বৃহদন্ত্রেও পরিবর্তন ঘটিয়েছি। আমার খাদ্যচাহিদা এখন কত, কেউ কি ধারণা করতে পারবেন? আরা, তুমি?
আর বন্ধুরা, কথা দিচ্ছি আপনাদের সবাইকেই আমি…আমরা…আমাদের মহাবিজ্ঞান সংস্থা মানুষে পরিণত করবে। কেউ অমানুষ থাকবে না।
আরা কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারে না। তার মনে হয় মহাবিজ্ঞানীর ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াটা শোভন নয়। কিন্তু ঠিক কী বললে যে উত্তরটা বোকা বোকা শোনাবে না, তা–ও সে বুঝতে পারে না। জাবেলই সমস্যার সমাধান করে দেন। বলেন, জানি…কেউই তা ধারণা করতে পারছেন না…খুদে বিজ্ঞানী আরাও না। আমার খাদ্যচাহিদা এখন...শূন্য! শক্তি পেতে বাজে বাজে জিনিস কিনে সারা দিন ধরে রান্না করে শরীরের ভেতর আর ঢোকাতে হয় না আমাকে। আমি শুধু সারা দিনে একবার বৈদ্যুতিক শক্তি নিই। দিনের শুরুতে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য এবং দেখো, আমি খুব ভালো আছি, তা–ই না? এদিকে আমার মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত করেছি সুপ্রিম কম্পিউটারকে। যেকোনো তথ্য যেকোনো সময় আমি চাইলেই সেকেন্ডেরও কম ভাগে আমার ভেতর চিহ্নিত হয়। বিষয়টা অভূতপূর্ব না?
আরা মাথা নাড়ায়। কিন্তু তার ভেতরের প্রশ্ন যেন হারিয়ে যায় না। বলে, কিন্তু মহামান্য…এভাবে কি আমরা মানুষ হচ্ছি…নাকি আসলে পরিণত হচ্ছি যন্ত্রে?
জাবেল তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎই অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। হেসে ওঠে অন্যরাও। বড় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতে হয় আরাকে। হাসি থামাতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয় যেন জাবেলকে। আরার মুখে অস্বস্তি এসে ভর করলেও উত্তরের আশা সে একেবারেই ছেড়ে দেয়নি। জাবেল সেটা দেখেই যেন বিস্মিত হন। বলেন, এই, তুমি সত্যিই এই প্রশ্নের উত্তর চাও? আচ্ছা, একটা কথা তুমি সত্যি করে বলো তো? তুমি কি কবিতাটবিতা পড়ো নাকি?
দর্শকসারিতে আবার গুঞ্জন। জাবেল সবার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলেন, কবিতা! বুঝতে পেরেছি অনেকের মধ্যেই ব্যাপারটা নিয়ে ধারণা নেই। কবিতা হলো লাইনের পর লাইন কিছু অর্থহীন কথা…সেখানে যা বলা হয় তা বোঝানো হয় না, আবার যা বোঝানো হয়, তা সব সময় নাকি অনুধাবিত হয় না। কোনো একসময় এই পৃথিবীতে এই অনর্থক জিনিসের চর্চা হতো। আমার ধারণা, প্রাচীন এই কুসংস্কারকে কোনোভাবে তুমি ধারণ করা শুরু করেছ আরা, তা–ই না?
আরার দিকে সবাই এবার কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করে। যেন ডাইনোসরের যুগ বলে যে একটা যুগ ছিল, সেখান থেকে উঠে এসেছে সে। জাবেল বলেন, তুমি বিজ্ঞানী হতে চলেছ আরা। তুমি কত কারও আইডল হবে। তোমার কিন্তু অনেক কিছু এড়িয়ে চলতে হবে…যেমন কুসংস্কার!
আরা শ্বাস নিয়ে বলে, আমি এই প্রশ্নের সত্যিই উত্তর চাই। মানুষ হওয়ার নামে কি আমরা যন্ত্র হতে চলেছি!
জাবেলের চোয়ালটা একটু শক্ত হয়। নাটকীয় ভঙ্গিতে এগিয়ে আসেন মঞ্চের দিকে। তারপর দুই হাত প্রসারিত করেন দুই দিকে। বলেন, কী মনে হয় আমাকে? যন্ত্র? বলো?
সবার দিকে তাকিয়ে একই প্রশ্ন ছুড়ে দেন জাবেল। বলেন, কী মনে হয় আপনাদের…দূষণ আর খাদ্যচাহিদা জয় করে আমি যন্ত্রে পরিণত হয়েছি?
সমবেত উত্তর আসে দর্শকদের কাছ থেকে, না না না!
জাবেল হাসেন। বলেন, আমি মানুষে পরিণত হয়েছি। আর বন্ধুরা, কথা দিচ্ছি আপনাদের সবাইকেই আমি…আমরা…আমাদের মহাবিজ্ঞান সংস্থা মানুষে পরিণত করবে। কেউ অমানুষ থাকবে না।
আশা, কৌতূহল আর কৃতজ্ঞতায় ভরা করতালিতে ফেটে পড়ে হলরুম। আরার পরের প্রশ্নটা সেই তালির ভেতরই হারিয়ে যেতে থাকে। জাবেল বলে যেতে থাকেন, কেউ অমানুষ থাকবে না! কেউ অমানুষ থাকবে না!
২
একটা জলার পাশে এসে হাঁপাচ্ছে আরা। এতটা দৌড় টানা কখনো দেয়নি সে। ক্ষুধা লেগেছে তার; পিপাসাও। কোথাও পালানোর থেকে এই দুটোকেই এখন মনে হচ্ছে প্রধান অসুবিধা। স্রেফ কুকুরের মতো ঝুঁকে জলার পানি চেটে খায় আরা। জানে না কী হবে! বাইরের এসব পানি পান করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বলা হয়ে থাকে, পানিজুড়ে বিষ। কী কী সব রাসায়নিক জহর যুক্ত হয়ে আছে পানিতে। ফলে মানবদেহে তৈরি করে ভীষণ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সেসব ভাবার সময় কোথায় আরার! পানি তাকে খেতে হবে এবং টিকে থাকতে গেলে খেতে হবে খাবারও! কিন্তু সে যদি অস্ত্রোপচার করাত, তাহলে এসবের কোনো প্রয়োজন হতো না। মহাবিজ্ঞানী জাবেল ও তার অনুসারীর মতো সকালে মাত্র পাঁচ মিনিটের বৈদ্যুতিক চার্জ নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারত ২৪ ঘণ্টা। এটাই কি তাহলে বেশি ভালো ছিল না? মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত দেখায় আরাকে।
চুক চুক করে পানি খায় আরা। শীতল পানি তাকে শান্ত করে। ভাবার অবকাশও দেয় যেন। এখনো হাঁপাচ্ছে; তবে ফিরে তাকানোর মতো স্বস্তিও পায় যেন। আর তাতে কান্নাই আসে আরার। এক অদ্ভুত সময়ের ভেতর প্রবেশ করেছে পৃথিবী। মানুষ হওয়ার পৃথিবী!
৩
বার্ষিক বিশ্ব বিজ্ঞান সমাবেশে মহাবিজ্ঞানী জাবেল জালিলের তত্ত্ব, যুক্তি ও প্রযুক্তি পারমাণবিক বোমার চেয়ে কম কিছু ছিল না। রাষ্ট্রগুলো তাদের অবকাঠামোয় পরিবর্তন আনল ব্যাপকভাবে। তাদের কাছে এটা ছিল এক অসামান্য বিষয় যে মানুষকে আর খাদ্যের দাস হয়ে থাকতে হবে না! রাষ্ট্রগুলোকেও আর ছুটতে হবে না খাদ্যের জোগাড় যন্ত্রণার পিছু। উন্নয়ন এবার চাক্ষুষই হবে না শুধু...পাবে আলোর গতি।
মহাবিজ্ঞানী জাবেল পরিণত হলেন মহাত্রাতায়। তার তত্ত্বাবধানে দিকে দিকে গড়ে উঠল অস্ত্রোপচার কেন্দ্র। কৃত্রিম ফুসফুস, বৃহদন্ত্রের সংকোচন আর শরীরের বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয়ের এক মাইক্রোচিপ…প্রত্যেক মানুষের এটিই যেন হয়ে উঠল আরাধ্য। শুধু অন্য কথা বলতে থাকল আরা।
আরা একটি বার্তা পাঠাল ওপেন প্ল্যাটফর্মে।
সেখানে বিজ্ঞানী জাবেলের কাছে রাখল নিজের কিছু প্রশ্ন… প্রশ্নগুলো এ রকম…
মহামান্য জাবেল, শরীরে অস্ত্রোপচার করিয়ে একাধিক ফুসফুস স্থাপন এবং বৃহদন্ত্রে পরিবর্তন ঘটানো প্রকৃতিবিরুদ্ধ কি না? ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই, মানবসভ্যতা যখনই প্রকৃতির বিপরীতে গেছে, তা বয়ে এনেছে মহাবিপর্যয়!
মহামান্য জাবেল, এই অস্ত্রোপচারসমূহের পর আপনার কথিত মানুষেরা যদি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে, যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার দায়ভার আপনি নেবেন কি না?
মহামান্য জাবেল, আপনি পৃথিবী বদলে দিতে চাচ্ছেন। বদলে দিতে চাচ্ছেন মানুষের সামগ্রিক অবস্থা…এত বড় পরিবর্তন ধারণ করার ক্ষমতা পৃথিবীর আছে কি না?
তিনটি প্রশ্নের কোনো উত্তর এল না। গভীর রাতে এল ফোর্স। তারা আরাকে তুলে নিয়ে গেল মানসিক পরিবর্তন কেন্দ্রে। আশ্চর্যজনকভাবে মহাবিজ্ঞানী জাবেল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আরাকে সামনে পেয়ে তিনি ভীষণ আফসোস করলেন। একটা সম্ভাবনাময় প্রতিভা নষ্ট হতে চলেছে। আরা বলল, আরেকটা প্রতিভাবান বিজ্ঞানী পুরো মানবজাতিকে ঠেলে দিচ্ছেন ভয়ংকর খাদে।
জাবেল জানালেন অদ্ভুত এক কথা…তার এই নিরীক্ষায় যারা টিকে থাকবে, তারাই আগামীর মানবজাতি…বাকিটা অমানুষ।
অমানুষ হিসেবেই মানসিক পরিবর্তন কেন্দ্রে বন্দী করা হলো আরাকে।
৪
ধাতব একটা শব্দ শুনছে আরা।
খুব কাছে কোথাও…কিন্তু উৎপত্তি বুঝতে পারছে না সে। কিছুক্ষণ পরপর মৃদু আওয়াজটা খুব কান খাড়া না করলে শোনাও যায় না অবশ্য। আরা আরেকটু এগিয়ে যায়। জলাটা বাঁ পাশে ফেলে ক্রমেই শব্দ খুঁজতে থাকে আরা। একটা গাছের গুঁড়ি শুকিয়ে কটোমটো চোখে যেন তাকিয়ে আছে এই রাতে। তারই পাশে ম্যানহোলের ঢাকনাটা যেন অল্প, খুবই অল্প নড়ছে। আরা থমকে যায়। ব্ল্যাক ফোর্সদের কোনো বিশ্বাস নেই। এরা জলে-স্থলে-আকাশে-পাতালে যেকোনো জায়গা থেকেই আক্রমণ করতে পারে। কে জানে, এরই মধ্যে আরার স্থানাঙ্ক নির্ভুলভাবে বের করে ফেলেছে। গাছের গুঁড়ির জমানো অন্ধকারে আরা নিজেকে সেঁটে ধরে। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে ম্যানহোলটার দিকে। একটু বেশিই নড়ে ওঠে সেটা। তারপর সরে যায়…ভেতর থেকে একটা কিছুর অবয়ব বেরিয়ে আসে মুহূর্তে। আরা আঁতকে পিছিয়ে নিজেকে আরও অন্ধকারে ঢুকিয়ে নেয়।
৫
বাইরে থেকে মানসিক পরিবর্তন কেন্দ্র ভীষণ জেল্লাদার হলেও ভেতরে চলছে অদ্ভুত সব কাণ্ড। টানা পাঁচ দিন আরাকে মানসিক উন্নয়নের নামে মহাবিজ্ঞানী জাবেলের গুণকীর্তন শোনানো হয়। কিন্তু আরা তার চিন্তা ও প্রশ্নে অনড় এবং বিস্ময় নিয়ে দেখে, আরা একা নয়। ঠিক একই প্রশ্ন নিয়ে এখানে বন্দী হয়েছে নীল চোখের এক তরুণ। তরুণের নাম জাফি। দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে কেন্দ্রের গবেষকেরা নতুন বিজ্ঞান, নতুন চিন্তা এবং জাবেলকে নিয়ে যত বক্তৃতাই দিক না কেন…ওদের ওপর কোনো পরিবর্তন আসে না।
অথচ বাইরে কী বিষম পরিবর্তন।
মানুষগুলো পালে পালে নিজেদের বদলে নিচ্ছে। তিনটা ফুসফুস আর বৃহদন্ত্রে বিস্তর পরিবর্তন নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফিরছে। খাদ্যের দরকার নেই আর…কী অদ্ভুত সুখের বেঁচে থাকা!
কেন্দ্রের বন্দিত্বের ভেতর দিন কাটতে থাকে আরা আর জাফির। পৃথক পৃথক। দেখা হয়, যখন তাদের চিকিৎসায় নেওয়া হয়। প্রথম একটা মাস সহ্য করতে পারে আরারা। কিন্তু আরা খেয়াল করে, দ্বিতীয় মাস থেকেই প্রলাপ বকতে শুরু করেছে জাফি। এলোমেলো কথা। কখনোবা ছন্দে ছন্দে! কেন্দ্রের চিকিৎসকদের মুখে হাসি ফোটে। আরার মনে হয় তাদের পরিকল্পনামতোই সব এগিয়ে যাচ্ছে। আরার কেমন ঘোর লাগে সব। তার মনে হয়, তাদের যে খাবার দেওয়া হচ্ছে, তাতেই কোনো ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। আরা খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। সুযোগ পেয়ে জাফিকেও নিষেধ করে।
কিন্তু জাফির পরিবর্তন জারি থাকে। সে ক্রমেই যেন নিজের অবস্থান থেকে সরে যায়। আর দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে মহাবিজ্ঞানী জাবেলের নাম শুনতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসকেরা তালি দিয়ে ওঠে। এই তো চেয়েছিল তারা!
পরদিনই জাফির কাছ থেকে তারা অস্ত্রোপচারের অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এই সাফল্য চিকিৎসকেরা ফলাও করে প্রচার করে। উদ্যাপনও করে। জাফিকে বদলি করা হয় অস্ত্রোপচার কেন্দ্রে।
যাওয়ার আগে বিশেষ অনুমতি নিয়ে আরার সঙ্গে দেখা করে জাফি। তাকে দেখেই কেমন খারাপ লাগে আরার। কী প্রবল সম্ভাবনাময় দুটো চোখ…অথচ সেখানে এখন কেবলই আত্মবিশ্বাসহীনতা। উষ্কখুষ্ক চুল…ফাটা ত্বক! জাফি তাকে একটা কাগজ উপহার দিল। জাফি চলে গেলে আরা দেখল, জাফি আসলে তাকে একটা ছবি উপহার দিয়েছে। যে ছবিতে লোহার খাঁচায় একটা তোতাপাখি উল্টে মরে পড়ে আছে।
জাফি কেন এমন ছবি তাকে উপহার দিল আরা বুঝল না প্রথমে, কিন্তু অষ্টম দিনে আরা যেন পুরো বিষয়টা ধরতে পারল এবং জাফির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল সে।
এক বিকেলে মহামান্য জাবেলের নাম শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘোলাটে চোখ তার আরও ঘোলাটে দেখাল। মুখের হাসিতে দেখা গেল কৃতজ্ঞতা। চিকিৎসকেরা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পরের দিনই নিয়ে এল অনুমতিপত্র। তাতে স্বাক্ষর করে নিজের চোখের ছাপ রেখে বেরিয়ে পড়ল আরা…তাকেও বদলি করা হলো অস্ত্রোপচার কেন্দ্রে।
পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটল আরার জীবনে।
একটা বৃত্তাকার যানে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অস্ত্রোপচার কেন্দ্রে। কিন্তু নিতে গিয়েই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল আরা। ঠিক জাফির আঁকা তোতাটির মতো যেন মরেই গেল যানের ভেতর। প্রহরীরা ছুটল। তাকে নিতে চাইল চিকিৎসাকেন্দ্রে। কিন্তু সেই নেওয়ার ফাঁকেই আরা উঠে দাঁড়াল দ্রুত। দিনের পর দিন না খেয়ে শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল আরা…কিন্তু এই উঠে দাঁড়ানো যেন মনের জোরেই। এমনকি পা ছুড়ে যে লাত্থিটা মারতে পারল সে প্রহরীদের দিকে, এটি সে কীভাবে পেরে উঠল জানে না। কিন্তু এরপর সে ছুটল…রাতের অন্ধকারে নিজের শরীর মিশিয়ে ছুটল অনিশ্চিত পৃথিবীর দিকে।
৬
ম্যানহোলের ঢাকনা তুলে যে অবয়বটা বেরিয়ে এল, চাঁদের আলোয় তার দুটো চোখ দেখতে পেল আরা।
নীল।
এলোমেলো চুল। আর শরীরে মাখানো কালো রং। ফাটা ঠোঁট। বোঁটকা গন্ধ আসছিল তার শরীর থেকে…তবু তাকেই এই মুহূর্তে সবচেয়ে আপন মনে হলো আরার। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল আরা। দাঁড়াল অবয়বটার মুখোমুখি।
তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল শুধু।
জাবেল পৃথিবী বদলে দিয়েছেন সত্য, কিন্তু পৃথিবীতে এখন শুধু অদ্ভুত মানুষের বাস।
৭
মহাবিজ্ঞানী জাবেল তার ‘মানুষ’ তত্ত্ব প্রয়োগের পর পাঁচ বছর অতিক্রম করেছে। পৃথিবীর মানুষ ক্ষুধা হারিয়ে ফেলেছে। তিন ফুসফুসে পেয়েছে দীর্ঘ জীবনের নিশ্চয়তা। জাবেল ভেবেছিলেন, তার এই নিশ্চয়তা কাজে লাগিয়ে মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে…ব্যবহার করবে মস্তিষ্কের; হয়ে উঠবে আরও সৃজনশীল।
কিন্তু জাবেলের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পতিত হয়েছে।
ক্ষুধা না থাকায় মানুষের শরীরের অন্য চাহিদাগুলো বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। যেকোনো আবেগে মানুষ এখন অনেক বেশি তাড়িত হয়ে পড়ে। সেই আবেগকে বহন করে নিয়ে চলে দিনের পর দিন; যা মানুষকে কখনো হতাশায় নিমজ্জিত করছে তো কখনো আবার করে তুলছে বিক্ষুব্ধ। মানুষের যৌনতাড়না চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সব ধরনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে গড়ে উঠেছে নতুন ধরনের উপকরণ…যা সৃজনশীলতা থেকে আসলে যোজন দূরের বিষয়।
জাবেল পৃথিবী বদলে দিয়েছেন সত্য, কিন্তু পৃথিবীতে এখন শুধু অদ্ভুত মানুষের বাস। যারা কেউই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেই। যারা সবাই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একেকটা ‘মানুষ’–এ রূপান্তরিত হয়েছে।
জাবেল বুঝতে পেরেছেন, এভাবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ খুব বেশি এগোবে না। তাই তিনি এখন দুজনকে ভীষণভাবে খুঁজছেন। দুজন ‘অমানুষ’। যারা কোথায় আছে জাবেল জানেন না…তবে জানেন, এই পৃথিবীর কোথাও হয়তো তারা আছে…প্রকৃতি নিজের স্বার্থেই নিশ্চয় তাদের টিকিয়ে রেখেছে। নিজের স্বার্থেই পৃথিবীর ভার তাদের ওপর ন্যস্ত করেছে।
মহাবিজ্ঞানী জাবেলকে ইদানীং কবিতা পড়তে শোনা যায়। কেউ কেউ বলে, তিনি নাকি নিরর্থক শব্দ দিয়ে কবিতা নির্মাণও করছেন!