ডা. আশফাক আমার কাছে জানতে চাইছেন, সূর্যমুখী ফুলের রং কী?
এ কেমন কথা! জন্মান্ধকে সূর্যমুখী ফুলের রং জিজ্ঞাসা করা কি রসিকতা নয়? অনেক বড় রসিকতা। সত্যি বলতে কি, এর চেয়ে বড় রসিকতা আর হতেই পারে না। ডা. আশফাক সবচেয়ে বড় এই রসিকতা করলেন আমার সঙ্গে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার কাছে না বুঝেই জানতে চাইছেন বুঝি। কিন্তু একই প্রশ্ন পাঁচবার করলেন। আমি টের পেলাম, ডা. আশফাক আমার মতো একজন জন্মান্ধের সঙ্গে নির্মম রসিকতা করতে চাইছেন। কেন চাইছেন, তা বুঝিনি। আর তাই প্রশ্ন করলাম পাল্টা। বললাম, কী বলছেন?
ডা. আশফাক চমত্কার করে হাসেন। হাসলে সুন্দর ছন্দময় ধ্বনি তৈরি হয়। সেই হাসি দেখতে কতটা চমত্কার, তা আমি জানি না। আমার মতো জন্মান্ধের তা জানার কথাও নয়। হাসতে হাসতেই ডা. আশফাক বিস্ময়ের ভান্ডার উপুড় করে দিয়ে বললেন, আশ্চর্য! আপনি কি কানে শুনতে পারছেন না নাকি? নাকি কানে শোনার যে কাজটা আগে করতেন, তা ছেড়ে দিয়েছেন?
তা কেন? এই তো শুনছি। দিব্যি শুনছি। আপনি আমার কাছে জানতে চাইছেন, সূর্যমুখী ফুলের রং কী!
আশ্চর্য! দিব্যি তো শুনেছেন।
শুনেছি। কিন্তু এ রকম প্রশ্ন করলেন, বুঝতে পারছি না। সূর্যমুখী ফুলের রং...
ডা. আশফাক হাসি মুছে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, দেখতে পাচ্ছেন? সূর্যমুখী ফুল দেখতে পাচ্ছেন? দেখতে পাচ্ছেন সূর্যমুখী ফুলের রং কেমন?
আমার গালে আলতো ছোঁয়া পেয়ে টের পেলাম, একখানা জলজ্যান্ত সূর্যমুখী ফুল আমার চোখের সামনে ধরা হয়েছে। বুঝলাম, এই সূর্যমুখী ফুল আমার চোখের সামনে রেখে ডা. আশফাক টের পেতে চাইছেন, আমি এটাকে দেখতে পারছি কি না! জানতে চাইছেন, দেখতে পাচ্ছেন?
দেখতে পাওয়া কাকে বলে?
আশ্চর্য!
আমি খেয়াল করেছি, কথায় কথায় ‘আশ্চর্য’ শব্দটাকে টেনে আনা ডা. আশফাকের অভ্যাস। এবারের ‘আশ্চর্য’তে তুমুল বিরক্তি মিশে আছে, টের পেলাম। এই বিরক্তি কী রকম যেন, খারাপ ব্যবহারের সঙ্গে মিশে গেল। আজ কী হলো ডাক্তারের? আজ কি তার মেজাজ খুব খারাপ? মেজাজ খারাপের ব্যাপারটা কি সবার সঙ্গেই ঘটছে, নাকি কেবল আমার বেলায়? ব্যবহার খারাপ হচ্ছে কি কেবল আমার সঙ্গেই? হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার যৌক্তিক কারণ আছে। আমি দেখতে পারি না। পারি না ব্যাপারটা ক্ষমা করা যায় না। ডাক্তার কেন, আমি নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। আশ্চর্য নয়? তিন–তিনবার অপারেশন করা হলো আমার দুই চোখে, তবু আমি দেখতে পাচ্ছি না। ডাক্তারের মতো করে নিজেকেই নিজে ধমকালাম—আশ্চর্য!
আশ্চর্য হওয়ার মতো আরও অনেক কাণ্ড আছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলের নাম যেমন পদ্মলোচন হয় না, তেমনি কোনো কেরানি পিতা তার পাঁচ-পাঁচটি কন্যার দায় অস্বীকার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলের চোখ ফোটানোর আশায় বিষয়-আশয় পানিতে ভাসিয়ে দেন না। আমার পিতা মো. রুহুল আমিন শিকদার একজন পারফেক্ট সরকারি কেরানি, আশা ছাড়া নিশ্বাসও ফেলেন না, তিনি কেন আমার পেছনে অহেতুক পয়সা খরচ করলেন?
পাঁচ কন্যার পর আমি তার একমাত্র পুত্র। বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমার আশাতেই পাঁচ কন্যাকে পৃথিবীতে এনেছেন তিনি। সেই আমি জন্মানোর পর থেকে তার হাসি মুছে গেছে। একমাত্র পুত্রের চোখের আলো না ফুটলে পিতার মুখের হাসি ফোটার আশা করা ঠিক নয়। সে আমি মানি। তিনিও মানেন। আর তাই পুত্রের হাসি কেড়ে নেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা এই ভদ্রলোকের। কথায় কথায় ‘ব্যাটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী’ বলতে পছন্দ করেন খুব। আর আমিও শুনতে শুনতে ভাবতাম, এটাই বুঝি আমার নাম। দিব্যি সাড়া দিতাম। শুধু বোনেরা আর মা যখন দৃষ্টিহীন চোখে ঠান্ডা হাত বুলিয়ে আমাকে আদর করত, তখন জানলাম, আমাকে মানিক বলেও ডাকা হয়।
মানিক আমারই নাম। একটি পুত্রের আশায় থাকা পিতা প্রতিবার কন্যা জন্মানোর আগে বলতেন, পুত্র হলে নাম রাখবেন মানিক। অবশেষে যখন পুত্র জন্মাল, তখন তিনি আর তাকে মানিক নামে ডাকতে পারলেন না। কিন্তু নাম তো নামই। রাখা যখন হয়েছিলই, যেকোনোভাবেই হোক ছিল ওটা। অন্ধ হয়ে জন্মানোর পর এই একটি চমত্কার জিনিস আমার ভাগ্যে জুটেছিল। সুন্দর একটি নাম। মানিক। হোক না দ্বিতীয় নাম। ‘ব্যাটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী’ নামের সঙ্গে সঙ্গে মানিক নামটাও বেঁচে ছিল এই পঁচিশ বছর ধরে।
ঠিক ধরেছেন। আমি আমার জীবনের পঁচিশ বছর পার করে দিতে পেরেছি। দুই চোখ দিয়ে দেখতে পারার কাজটি না করেই পার করে দিতে পেরেছি জীবনের পঁচিশটি বছর। আশ্চর্য নয়!
খুব বেশি আশ্চর্য তাঁরা হন না, যাঁরা আমাকে কাছ থেকে দেখেছেন। একেবারে ফুটো কলসি নই আমি। মাথাটা মোটামুটি পরিষ্কার। বোনেরা শব্দ করে পড়ত আর আমি শুনে শুনে শিখে ফেলতাম। এভাবে শিখতে শিখতে একসময় ওদেরই শেখাতে শুরু করলাম। শিখতে আসত বাড়ির পাশের কতজন। তবু অফিসফেরত বাবা আমাকে দেখে শব্দের বমি উগরাতে উগরাতে বলতেন, ব্যাটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী! লেহাপড়া শিহে করবিটা কী? চাহারি করবি? চাহারি? ব্যাটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তোরে চাহারি দেবে খিডা শুনি?
এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। কত কিছুই না আমি জানি না। এই যে পড়তে ভালোবাসি, তবু জানি না, কোন বই দেখতে কেমন। আমি বই চিনি গন্ধে। সব বইয়ের শরীরে গন্ধ থাকে। পুরোনো বইয়ের গন্ধ পুরোনো পুরোনো। নতুন বইয়ের গন্ধ নতুন নতুন। সব গন্ধই মন মাতিয়ে দেয়। পাগলের মতো শুঁকতে ইচ্ছা হয়। বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে খুব ইচ্ছা হয় বইটাকে দেখি। জানতে ইচ্ছা হয়, কী রকম দেখতে এই গন্ধে ভরপুর সুন্দরী? হলদে? নাকি বড় আপা যেমন বলে ডিমের কুসুমভাঙা কটকটে হলুদ, সে রকম?
মেজ আপা গুনগুন করে গান গায়, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে/ অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে’।
তখন বুকের কষ্ট চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। বইয়ের গন্ধ অন্তরে ঢুকে যায় আর আমি টের পাই, আলো নেই কোথাও। আমি দেখব কী করে? না দেখার কষ্ট ভুলতে আমি গন্ধকেই আপন করে নিতে চাই। আসলেই তা–ই। এই পৃথিবীর সবকিছু চিনি গন্ধ থেকে। আর যেটুকু জানি, তা আমার কানে শুনে পাওয়া বিদ্যা থেকে। বোনদের কাছ থেকে তো শুনিই, সারা দিন রেডিও অন করে বসে থাকি। যা শুনি, তা-ই গেঁথে যায় মাথার ভেতর। তৃষ্ণা মেটে না আমার। মনের ভেতরকার হাজারো প্রশ্ন খামচে রক্তাক্ত করে ফেলে আমাকে। শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালে নিঃসীম অন্ধকারের ভেতর ভাবনাগুলো সাঁতার কাটে। কোত্থেকে এসেছি আমি? আমার চারপাশের এই জগতের অর্থ কী?
হাতের ওপর রোদের তাপ খেলা করে। অসহ্য উত্তাপে হাত সরিয়ে নিতে নিতে ভাবি, সূর্যের আলো দেখতে কেমন? আমার শরীরের ভেতর আলো ঢোকে কী করে?
নারকেলপাতায় বাতাস সরে যাওয়ার শব্দ শুনি। দূরে কোথাও রাস্তার হট্টগোল। সব শুনে আমার চারপাশের এক আশ্চর্য কোলাহলময় ত্রিমাত্রিক জগৎ নিয়ে ভাবনায় বসি আমি।
ঠিক বলেছি। ত্রিমাত্রা। এক মাত্রার পৃথিবীতে বাস করি আমি নিজে, অন্তত আমার অনুভূতির মাত্রাকে এক বলাই যায়। কিন্তু আমি বেঁচে আছি ত্রিমাত্রিক এক জগতে, রেডিওতে একবার এক অনুষ্ঠানে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছিল বিষয়টা। সেই থেকে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতেই শিউরে উঠি। ত্রিমাত্রিক এক জগতের বাসিন্দা আমি! এই ত্রিমাত্রিক জগৎকে একবার, সারা জীবনে অন্ততপক্ষে একবার প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছা করে।
কী ভাবছেন?
এই প্রশ্ন যে কণ্ঠ থেকে ভেসে এল, সেই মিষ্টি কণ্ঠটি আমার চেনা। সারা দিনের মধ্যে এই প্রথম ভালো লাগল আমার। নার্স শম্পা। এত মায়া করে কথা বলে মেয়েটি! এই মেয়েকে দেখতে খুব ইচ্ছা হয়।
শম্পার কথাগুলো আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, নেচে নেচে যাচ্ছে। ও বলছে, সারাক্ষণ শুধু ভাবেন। এত কী ভাবেন আপনি? নাকি মন খারাপ লাগছে? আহা! এবারও ব্যর্থ হলেন।
নাহ! মন খারাপ নয়। ভাবছিলাম আপনাদের পৃথিবীর কথা।
আমার এই কথা শুনে শম্পা হাসে। বলে, এই পৃথিবী কি শুধু আমাদেরই? আপনি এই পৃথিবীর কেউ নন? বেড়াতে এসেছেন বুঝি?
শম্পার হাসিতে কাচের চুড়ি ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সুন্দর। সুন্দর।
সেভাবে বলিনি। দৃশ্যমান যে পৃথিবী, সে তো শুধু আপনাদেরই। যাক গে। একটা প্রশ্ন করব। এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ।
শম্পাকে এবার এড়িয়ে যেতে দেব না, মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম। কৌতূহলটা কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে। বিমুখ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা কেন এমন মরিয়া হয়ে আমার চোখ ভালো করতে চাইছেন? নিজের জন্মদাতা পিতাকে না দেখেই খুব ভালো চিনেছি আমি। এ কাজ তার জন্য একদম অসম্ভব। নিতান্ত নিম্নমধ্যবিত্ত অর্থনীতিতে এ রকম কার্যকলাপ বেখাপ্পা। বেমানান। অন্য কোথাও চললে চলতে পারে। বিশ্বাস করুন, আমাদের সংসারে সম্ভব নয়। হাসপাতালে আমার খোঁজ নিতে আসার মতোই তো কেউ নেই। মা এবং বোনেরা একবারও আসেনি। বাবা আসেন প্রতি সন্ধ্যায়। টের পাই, দরজা থেকে দেখে চলে যান। ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তাও শুনেছি। ডা. আশফাকের ধৈর্যের প্রশংসা করে বলছিলেন, ও ব্যাটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নিহে এত নাচার কী হলো? যা দুই তা তো দুই দিন পরেও দুই, আইজকেও দুই। শুধু শুধু খাইটে কী লাভ? বুঝি না আপনাগের কাজবাজ!
এসব শুনেই আমি বুঝে গেছি, আমার চোখে আলো ফোটানোর চেষ্টা তার নয়। তবে কার? জানতে চাই আমি।
শম্পা বলতে পারে না। অথবা বলতে চায় না। মুখ নামিয়ে বলে, আমি কী করে বলব?
আমি মরিয়া হয়ে গেছি। শম্পার হাত না ধরে পারলাম না। অনুনয় করে বললাম, এড়িয়ে যাবেন না দয়া করে। নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। আমাকে জানতেই হবে সেই রহস্য। কার এমন দায় পড়েছে আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার? কার? আমাকে জানতেই হবে।
শম্পা হাত ছাড়িয়ে নেয় না। বলে, আমি অত জানি না। সত্যি বলছি, জানি না। তবে...
তবে?
আচ্ছা, আপনি কি শওকত আলীকে চেনেন?
শওকত আলী?
মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে হাতড়ালাম আমি। এই নামের কাউকে পেলাম না। কে এই শওকত আলী?
আমিও চিনি না। আপনার বাবা একদিন ডা. আশফাককে বলছিলেন এই শওকত আলীর কথা। লোকটা নাকি পাগল। তার পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হয়েছে। খুব বিরক্ত আপনার বাবা এই লোকের ওপর।
শওকত আলী সেই পাগলের নাম, তাই তো?
ঠিক তাই। চেনেন তাকে? নাম শুনেছেন তার? হয়তো তিনি আপনার কোনোরকমের ডালপালা মেলানো আত্মীয়। হয়তো কেন, সত্যিই তিনি আপনার আত্মীয় নিশ্চয়ই। হাসপাতালের সব খরচ তো তিনিই দিচ্ছেন।
শম্পার ধারণা কি সত্যি? আমি তো জানি না এ নামের কোনো আত্মীয় আছে আমার।
শম্পা চলে যেতে যেতে বলল, আপনি বরং আপনার বাবাকে জিজ্ঞাসা করুন। ডা. আশফাকও হয়তো কিছু বলতে পারবেন।
দারুণ এক রহস্য জমে উঠেছে মনে হচ্ছে। সেই রহস্যের নাম শওকত আলী। গাঁটের পয়সা খসিয়ে আমার উপকার করতে চাইছে। হাসপাতালে ভর্তি করতে, চোখের অপারেশন একবার নয় তিন–তিনবার করতে পাগলামি করেছে। তার পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা ভদ্রলোকটি বাধ্য হয়েছেন আমাকে হাসপাতালে আনতে। সাধারণ বেড থেকে এই যে এখন নিজে একটি কেবিন দখল করে আছি, বোঝা যাচ্ছে, সেটাও তারই কারণে। কিন্তু কেন তার এই পাগলামি আমার জন্য?
শম্পা দরজার কাছে গিয়ে ফিরে এলেন। আমি বললাম, শম্পা! আমার বাবা এলে বলবেন, আমি কথা বলতে চাই। দরজা থেকে ফিরে যেন না যান তিনি।
বলব। আজব মানুষ আপনার বাবা। নিজের ছেলে, কিন্তু এমন ভাব দেখান যেন শত্রুর সঙ্গে বাধ্য হয়ে দেখা করতে এসেছেন। আচ্ছা, ঠিক করে বলুন তো, মাথায় গন্ডগোল নেই তো ভদ্রলোকের?
শম্পা চলে গেলে হাতড়ে হাতড়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আমার জানালার পাশেই মনে হয় সুন্দর এক টুকরা বাগান আছে। ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক মিলিয়ে আমার জন্য অপূর্ব সুন্দর বিনোদনের ব্যবস্থা। জানালার গ্রিলে মুখ চেপে বাইরে তাকালাম আমি। নিত্যদিনের মতো ভাবনা এসে ভর করল। কী যে সব ভাবনা! ত্রিমাত্রিক জগৎ নিয়ে ভাবনা। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা নিয়ে বিশাল বিশাল অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে। বোনদের কাছ থেকে শুনেছি, মাটিতে পড়ে অট্টালিকার ছায়া। এই পৃথিবীর সবকিছুরই নাকি ছায়া আছে। এমনকি এই যে আমি, আমারও নাকি ছায়া লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। যখন আমি রোদে যাই কিংবা ঘরের ভেতর বাতি জ্বলে, আমারও ছায়া দেখা যায়।
কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে হয়, আমার ভেতরে কেউ নড়েচড়ে বসে। আমার ভাবনার সঙ্গে তাল মেলায়। আজকাল এ রকম প্রায়ই হয়। এখন যেমন হচ্ছে। আমি সেই তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি।
দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা হচ্ছে তিন মাত্রা। চার নম্বর মাত্রা হচ্ছে সময়। মানুষ তিন মাত্রার হিসাব বোঝে, যদিও সময়ের মধ্যে বাস করতে হয় তাকে।
মানুষ যে চতুর্মাত্রিক জগৎ নিয়ে ভাবছে, সেটা তো জানো? এই প্রশ্ন সে করে আমাকে। এরপর বলে, সময়কে বাকি তিন মাত্রার সঙ্গে কবজা করতে পারলেই মানুষ সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ভেবে দেখেছ ব্যাপারটা?
সে আমাকে বলছে, আমি ভেবে দেখেছি কি না ব্যাপারটা! আশ্চর্য! একবার ভাবুন তো! অত ভেবে লাভ কী আমার? আমি যদি সময়ের ভেতর দিয়ে ঘুরেও বেড়াই, লাভ কী? দেখতে তো পারব না।
সে কেমন রাগ মিশিয়ে বলল, তুমি বড় স্বার্থপর! শুধু নিজের কথা ভাবো।
এরপর অনেকক্ষণ কথা হয় না আমাদের। এরপর যখন কথা হয়, তখন শুরুটা করে সে-ই। বলে, দ্বিমাত্রিক জগৎ নিয়ে ভেবেছ কখনো?
দ্বিমাত্রিক জগৎ, ছায়াদের জগৎ। যাদের কেবল দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ আছে। উচ্চতা নেই।
কী ভাবব ছায়াদের নিয়ে?
একবার ভাবো তো, পৃথিবীজুড়ে কেবল ছায়াদের বাস।
দূর! এ রকম হয় কখনো?
কেন হবে না?
চমকে উঠলাম আমি। সে আমার ওপর ধমকে উঠেছে! স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার মাথার ভেতর কেউ আমাকে ধমক দিল! মনে হলো গলাটা একটু মোটা, কেমন যেন ভারী ভারী ভাব।
আবার ধমক! এবার কি আমি একটু শিউরে উঠলাম! গলার স্বর নেমে গেল আমার। জানতে চাইলাম, কোথায় তুমি?
আরেকটা ব্যাপার ঘটছে বলে মনে হচ্ছে। আমার চোখের অন্ধকারে কিছু পরিবর্তন ঘটছে যেন। এ রকমটা টের পেয়েই আমার মনের ভেতরের উচ্ছ্বাস বুদ্বুদের মতো বেরিয়ে আসতে চাইল মুখ থেকে। আমি কি তবে দেখতে পাওয়া শুরু করেছি? আমি কি তবে দেখতে পাব?
পাবে। তুমি দেখতে পাবে।
আবার! আবার সেই কণ্ঠস্বর! একটু মোটা, ভারী ভারী। জিজ্ঞাসা করি, কে তুমি?
হাসে সে। ভারী হাসি। মোটা হাসি। তারপর বলে, আমি তুমি।
বুঝিনি।
আমি তুমি। ব্যস! এতে বোঝা না বোঝার কিছু নেই।
আবার ধমক! এবার কি আমি একটু শিউরে উঠলাম! গলার স্বর নেমে গেল আমার। জানতে চাইলাম, কোথায় তুমি?
তোমার সঙ্গে।
জানালা থেকে সরে আসি আমি। নিজেকে আচ্ছামতো বকা দিই। নিজের সঙ্গে বকবক করতে করতে নিজেকে দুই মানুষ ভাবতে শুরু করেছি! এর কোনো মানে হয়? লোকে শুনলে হাসবে।
দরজায় শম্পা। ওর কাপড়ের খসখস আওয়াজ আমি চিনি। কিন্তু এবার হলো কী শুনবেন? দিব্যি দেখলাম, শম্পার অবয়ব নিতে নিতে কিংবা না নিতে নিতে অস্পষ্ট কিছু আলোর রেখা নেচে গেল হঠাৎ। এরপরও বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলাম। মনে মনেই ধমকে দিলাম নিজেকে। দেখতে পাচ্ছি না আমি। একে দেখতে পাওয়া বলে না। মনে মনে ভাবছি কেবল। ভেবে ভেবেই যদি দেখার কাজটা হয়, তবে আর চোখের দৃষ্টি কে চাইত!
শম্পার পেছনে এসে দাঁড়ানো আরেকটা অবয়বেও দেখি আলোর রেখার অস্পষ্টতা। শম্পা বলল, আপনার বাবা এসেছেন।
শম্পার গলার স্বরটা গম্ভীর। ঠিক তক্ষুনি কানের ভেতর মধু বর্ষিত হলো পরিচিত সেই কণ্ঠে। কী রে ব্যাটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী!
ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই ধমকে উঠেছিল শম্পা। বলেছিল, চুপ করুন! এভাবে কোনো ভদ্রলোক কথা বলেন?
আমি ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেলাম। বাবা ভদ্রলোক এখন শম্পার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে কোথায় যাব আমি? শম্পার সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করবে, এটা ভাবতেই যে কষ্ট হচ্ছে খুব। নিচু গলায় শম্পাকে থামতে বললাম। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম ওর মসৃণ হাতের কবজি।
বাহ, ব্যাটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর দেহি উকিল লাগতেছে আইজকাল! ভালো ভালো!
শম্পা গলা উঁচু করল আরও। বলল, এখানে অভদ্রতা করবেন না। সাবধান করে দিচ্ছি।
মো. রুহুল আমিন শিকদার, ছা-পোষা কেরানি। কোনো নারীর কাছ থেকে মুদারা তো দূরের কথা, উদারা মাত্রাতেও কোনো দিন ধমক শোনেননি। এই প্রথম অভিজ্ঞতা তাকে চুপসে দিল বেশ। মিনমিন করে বললেন, আমারে ডাকিছে ক্যান, সেইডে কি জানতি পারি?
শম্পা আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। পিঠের নিচে গুঁজে দিল বালিশ। আমার চোখের অন্ধকার আরও হালকা হয়েছে মনে হচ্ছে। আমি সেই হালকাতে চোখ রেখে জানতে চাইলাম, শওকত আলী কে?
চিনি না। কোনো দিন দেহিনি।
তাহলে! সে আমাকে চিনল কীভাবে? আপনাকেই–বা অতিষ্ঠ করে তুলল কীভাবে? কেন সে আমার দায়িত্ব নিচ্ছে? আমি সব জানতে চাই।
সব জানানো আমার কইর্তব্য না।
এই বাক্য শেষ করে বাবা ভদ্রলোক উদাস হয়ে গেলেন। শম্পা আরেকবার ধমকে উঠতেই বলতে শুরু করলেন, যতটুকু জানি, কচ্ছি।
বলুন।
চিঠি লেহে শওকত আলী। তা–ও বেশ কয়েক মাস আগে। ঠিকানা-ফিকানা কিছু নাই। চিঠির ভাষা বিচ্ছিরি। শুধু আদেশ দেওয়া। তুমার চিকিত্সার ব্যবস্থা করতি হবে। মানি অর্ডারে টাহা পালাম। এ্যাত টাহা চোহে দেহিনি কোনো দিন।
আমাকে তো কিছু বলেননি। আমি কিছুই জানি না। কেন?
ক্যাঁচ করে উঠল চেয়ারটা। আমার সামনের আকারটা পাল্টাচ্ছে। কী রকম লম্বা হয়ে উঠল, তারপর সরে গেল বাঁ দিকে। কিছুক্ষণ গড়িয়ে সরে গেল। একটু থামল।
জিজ্ঞেস না করলি জানানোর দরকার কি আমার? যা–ই হোক, তুমার অপারেশন অল, বড় দুই মাইয়ের বিয়ে দিলাম উপরি টাহায়। কিন্তু আসল কাজ মাইনে তুমার কানাগিরি তো সাঙ্গ অল না। আর অবে বলেও মনে অয় না।
দেখতে পাওয়া কাকে বলে? আমার সামনে ফিকে আলোর এ রকম এক জগৎ, লুটিয়ে পড়েছে কিছু আকার, নড়ছে আকারগুলো। বুঝতে পারছি না কিছু। এসব কী হচ্ছে?
তুমি শওকত আলীর কথা জানতে চাও?
এই প্রশ্ন বাবা করেননি। মনের ভেতরে আবারও কথা বলে উঠেছে সে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, সত্যিই কেউ প্রশ্নটা করল আমাকে। কী হচ্ছে এসব!
আমার চেহারায় নিশ্চয়ই বিভ্রান্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল। বাবা ভদ্রলোক উঠে পড়ার তোড়জোড় করলেন। বললেন, যা জানতাম, তা কলাম।
শওকত আলী কটা চিঠি দিয়েছে?
পরতেক সপ্তায় একখান কইরে পাই। তয় নতুন কিছু লেহা থাহে না। একই কথার ঘ্যানর ঘ্যান, তোর যত্ন নেওয়ার হুকুম, কথার উল্টোপাল্টা অলি থোবে না আমারে, ইরাম ভয় দেহায়।
ক্যাঁচ করে উঠল চেয়ারটা। আমার সামনের আকারটা পাল্টাচ্ছে। কী রকম লম্বা হয়ে উঠল, তারপর সরে গেল বাঁ দিকে। কিছুক্ষণ গড়িয়ে সরে গেল। একটু থামল।
আপনার কী মনে হয় এ ব্যাপারে? আমি জানতে চেয়েছিলাম। তখন আকারটা থামল। একটু সরে এল ডান দিকে। লম্বা আরেকটা আকারের সঙ্গে মিলে গেল খানিকটা।
আমার অত কিছু মনে অয় না। টাহা পাচ্ছি। অত ভাবাভাবির দরকার কী? তুমার অপারেশন তিনখান ক্যান, হাজারডা অলিও আমার কোনো অসুবিধে নেই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অলিও ছাওয়াল বাপের টাহাপয়সার সুবিধে অইরে দেচ্ছে। ব্যাপারডা মন্দ না!
আকারটা মিশে গেল আরেকটা আকারের সঙ্গে। আমার কাছের আকারটা এবার লম্বা হলো। চাপা গলায় ধমকে উঠল শম্পা। বলল, আপনার বাপটা মানুষ না। জ্যান্ত ছোটলোক।
মুচকি হাসলাম আমি। আমার সঙ্গে হেসে উঠল আমার ভেতরের সে। মনে মনে প্রশ্ন করি তাকে। কে তুমি?
শওকত আলী।
কী বলছ! কী আবোল–তাবোল বলছ! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার ভেতরের সে ভারিক্কি ভাব নিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে আমাকে বোঝাতে শুরু করল। তুমি বুদ্ধিমান, মানিক। তুমি অবশ্যই বুঝতে পারবে। অনেক খুঁজে তোমাকে বের করেছি আমরা। আমাদের এ রকম নির্বাচনে কখনোই ভুল হয় না। এর আগে কখনোই হয়নি।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কেবল শুনে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে কী কী বলছিল, আপনাকে বলছি, যদি আপনি অন্তত বুঝতে পারেন। সে বলছিল, সে নাকি আমার ছায়া। আসলে ঠিক ছায়া নয়। আসলে সে আর তারা দ্বিমাত্রিক জগতের বাসিন্দা, ত্রিমাত্রিক পৃথিবীর ভেতরেই তাদের বাস বলে বাধ্য হয়ে সে আমার ছায়া হয়ে থাকে আর অন্যরা থাকে আর সব মানুষের ছায়া হয়ে। কেন থাকে? বাঁচার তাগিদে থাকে। আমাদের মতো ত্রিমাত্রিক জগতের মানুষদের দরকার আছে ওদের। বুঝলাম, এই দরকার বেঁচে থাকার তাগিদে। সেই বেঁচে থাকাটা কী রকম বুঝতে পারিনি তখনো। সে আর বলতে চায়নি। বলেছিল, আমি নিজেই নাকি সব জেনে ফেলতে পারব। তাড়াহুড়ো না করে আমার নাকি উচিত আমার দেখতে পাওয়াতে আনন্দিত হওয়া। সে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল।
হায় রে অভিনন্দন! হায় আমার দেখতে পাওয়া! আমি দেখতে পাচ্ছি বটে। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমি শুধু দ্বিমাত্রিক জগত্টাকে দেখতে পাচ্ছি। সবার ছায়া দেখছি। কিন্তু কেন? কোনো জবাব নেই। শওকত আলী? ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি চেয়ারের ছায়া পড়েছে, কিন্তু আমার কোনো ছায়া নেই। শম্পা কি খেয়াল করেছে ব্যাপারটা?
শম্পা! শম্পার ছায়া নড়ছে দ্রুত। আমার বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে। ত্রিমাত্রিক শম্পা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর দেখতে। আমি তো ওর দ্বিমাত্রিক রূপ দেখেই মুগ্ধ। লম্বাটে ছায়াটা ঝুঁকে যাচ্ছে, লম্বা হচ্ছে। কী রকম ছন্দময় ছায়াটা!
চারদিকে তাকাই। নাহ, কোথাও কোনো উচ্চতা নেই। আচ্ছা, শম্পার ছায়াও কি শওকত আলীর মতো কিছু?
কথা বলে উঠল শওকত আলী। বলল, ঠিক ধরেছ।
কী নাম শম্পার ছায়ার?
এতক্ষণে বুঝতে পারি পুরোটা। মুচকি হাসল শওকত আলী। বলল, কেন তোমাকে বেছে নিয়েছি বুঝতে পেরেছ তো! আমার উচ্চতার জন্য। আমাদের উচ্চতা চাই।
শব্দের ছায়া বুঝতে হলে দ্বিমাত্রিক জগতে নামতে হবে হে! এই যে বলছি, আমার নাম শওকত আলী। মোটেও সেটা ঠিক নয়। মানিক শব্দের ছায়া হচ্ছে আমার নাম। দ্বিমাত্রিক নামটা ত্রিমাত্রিকভাবে বলতে গেলেই মানিক হয়ে যাবে। এই যেমন আমি উচ্চতা পেয়ে গেলেই তুমি হয়ে যাব!
সর্বনাশ!
এতক্ষণে বুঝতে পারি পুরোটা। মুচকি হাসল শওকত আলী। বলল, কেন তোমাকে বেছে নিয়েছি বুঝতে পেরেছ তো! আমার উচ্চতার জন্য। আমাদের উচ্চতা চাই। তুমি আমাকে উচ্চতা দেবে। একসময় আমরা সবাই উচ্চতা পাব।
আমি অস্থির হয়ে উঠি। এসব কী শুনছি আমি! শওকত আলী আমাকে আশ্বস্ত করে বলে, মাথা খারাপ করার কিছু নেই। তোমরাও তো চাচ্ছ চতুর্মাত্রা পেতে। চতুর্মাত্রার জীবরা এ খবর শুনলে তোমার মতোই ভাববে। আসলে শ্রেণিবিভেদটাই বড় করে দেখে সবাই। কেউ কি নিজের অবস্থানে আর কাউকে দেখতে চায়?
আমি ধমকে উঠি। বলি, আমাদের মাত্রা পরিবর্তনের কারণ আছে।
শওকত আলীও ধমকে ওঠে। বলে, আমাদেরও মাত্রা পরিবর্তনের কারণ আছে।
কোনো কারণ নেই। আরামসে গড়িয়ে বেড়াও।
শওকত আলীও বলে, কোনো কারণ নেই। আরামসে হেঁটে বেড়াও।
জানো উচ্চতা পেলে কত সমস্যা হবে?
শওকত আলীও বলে, জানো সময়ের ভেতর কত সমস্যা হবে?
আমি আর কথা বলি না। হাঁপিয়ে উঠেছি। একটু পর শওকত আলী কেমন মন খারাপ করা স্বরে বলে, আমাদের গঠনটা খুব সিম্পল। খুব বেশি ক্ষণস্থায়ী জীবন আমাদের। সূর্যের আলো মাটিতে পড়লে এক বিশেষ ধরনের যৌগের জন্ম হয়, তা-ই আমাদের খাদ্য। তোমাদের শরীরের সঙ্গে মিশে থাকি। যখন সূর্যের আলো মাটিতে পড়ে, আমরাও লুটিয়ে পড়ি মাটিতে। খাবারের প্রয়োজনে, বাঁচার প্রয়োজনে। এরপরও কি বাঁচতে পারি? পারি না। ক্রমে ফিকে হতে থাকি। ফিকে হতে হতে একসময় মিলিয়ে যাই। মৃত্যু হয় আমাদের।
মৃত্যু হয় তোমাদের! তোমারও! তাহলে তুমি কি? কীভাবে আছ আমার সঙ্গে!
বিস্ময়ে গাল হাঁ হয়ে গেছে আমার। শম্পা মিষ্টি করে বলে, আবার কী ভাবছেন এত মনোযোগ দিয়ে! নিন, ওষুধটা খান।
ওষুধ খেতে খেতে লক্ষ করি, শম্পার কোনো ছায়া নেই। আমারও নেই। দুটো ছায়া জড়াজড়ি করে ওই দরজার পাশে লম্বা হয়ে পড়ে আছে।
একটু ঘড়ঘড়ে শোনাল শওকত আলীর কথা। কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু এটা করছি তোমার জন্য। আমরা যে তোমাদের থেকে আলাদা, সেটা বোঝানোর জন্য। পারতপক্ষে তোমাদের ছেড়ে নড়ি না আমরা। এতে ফিকে হতে হয় আরও বেশি। তাই তোমরা যেখানে যাও, সেখানেই যাই। উচ্চতা পেয়ে গেলে এসব সমস্যা থাকত না। তোমাদের সমান আয়ু পেয়ে যেতাম আমরা।
আয়ু! শওকত আলীর কথায়, আমাদের হিসাবে চার দিন ওদের আয়ু। এই দুই মাসে ১৫ জন শওকত আলী আমার সঙ্গে আছে। বলা যায়, শওকত আলী টিম! দরকার পড়লে আরও আসবে।
জানতে চাইলাম, আমি শুধু তোমাদের দেখতে পাচ্ছি। এটা কীভাবে হলো?
ডা. আশফাকের সঙ্গে থাকা টিমটা এই কাজ করেছে। প্রথমবার অপারেশনেই তুমি ত্রিমাত্রিক জগৎ দেখতে পেতে, কিন্তু ডা. আশফাকের টিমের কাজ তো তা ছিল না। তাদের কাজ ছিল নির্দিষ্ট। পরের দুবার অপারেশনের ফলে সেই কাজ সফলভাবে শেষ হয়েছে। তোমার চোখ দ্বিমাত্রিক জগতের উপযোগী হয়েছে আর শওকত আলী দেখতে পাচ্ছে ত্রিমাত্রিক জগৎ।
কীভাবে!
আমি হাহাকার করে উঠি। কেন এসব করছ! ছেড়ে দাও আমাকে, ব্রেন-শরীরসমেত ছেড়ে দাও। আমি জীবনে কোনো অক্ষর দেখিনি, বইয়ের গন্ধ শুঁকে বুক ভরেছি। সেই বই নিজের চোখে দেখার আশা নিয়ে বেঁচে আছি অসহায় এই আমি।
তোমার চোখের রেটিনা বসাতে হয়েছে উল্টো করে। এমনিতে তোমাদের চোখে প্রতিবিম্ব পড়ে খাড়া, কিন্তু উল্টোভাবে পড়ে ব্রেনে গিয়ে সেটা সোজা হয়।
জানি জানি। আমার বেলায় সেটা হচ্ছে না, তাই তো!
ঠিক তাই। তোমার বেলায় প্রতিবিম্ব ত্রিমাত্রিকভাবে খাড়া নয়, দ্বিমাত্রিকভাবে অনুভূমিক। কীভাবে দ্বিমাত্রিক জগৎ দেখা যাবে, বুঝেছ?
বুঝেছি। দ্বিমাত্রিক প্রতিবিম্ব ব্রেনে যে সংকেত নিয়ে যাচ্ছে, তা আর কিছুতেই ত্রিমাত্রিক নয়। পুরোপুরি দ্বিমাত্রিক। ব্রেন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে দ্বিমাত্রিক সংকেতে। দ্বিমাত্রিকভাবে ভাবতে শুরু করেছে।
ঠিক তাই।
কিন্তু আমার শরীর! আমার শরীর তো ত্রিমাত্রিক নয়!
শওকত আলী খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলে, তোমার আর শরীর! আমার ব্রেন ত্রিমাত্রিক সংকেত নিতে নিতে ত্রিমাত্রিক ভাবনা ভাবছে বলেই তোমার ত্রিমাত্রিক শরীরটা ত্রিমাত্রিক ব্রেনের আওতায় চলে যাচ্ছে। আর আমার দ্বিমাত্রিক শরীরটা তোমার দ্বিমাত্রিক ব্রেনের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে নিচ্ছে। সে রকমই তো হওয়া উচিত। মাত্রাজ্ঞান বলে একটা কথা আছে তোমাদের, জানি আমি।
আমি হাহাকার করে উঠি। কেন এসব করছ! ছেড়ে দাও আমাকে, ব্রেন-শরীরসমেত ছেড়ে দাও। আমি জীবনে কোনো অক্ষর দেখিনি, বইয়ের গন্ধ শুঁকে বুক ভরেছি। সেই বই নিজের চোখে দেখার আশা নিয়ে বেঁচে আছি অসহায় এই আমি।
শওকত আলী মানতে চায় না আমি অসহায়। আমি নাকি ক্ষমতাধর। কেননা, আমি বুদ্ধিমান। আমি নাকি এত বুদ্ধিমান, যাকে কাজে লাগিয়ে ত্রিমাত্রিক মানুষদের মাত্রার দখল নিতে পারবে ওরা। আর তাই ওরা আমার দখল নিয়েছে বুদ্ধিমান ত্রিমাত্রিক মানুষ ডা. আশফাকের সাহায্য নিয়ে।
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে সে। বলে, ডা. আশফাক ত্রিমাত্রিক মানুষ! হাসি পাচ্ছে শুনে। কবেই ছায়া হয়ে গেছে ডা. আশফাকের কায়া। এখন যাকে দেখছ, সে তো তার কায়া দখলকারী ছায়া। দ্বিমাত্রিক ছায়াই এখন ত্রিমাত্রিক কায়া। আর আসল ত্রিমাত্রিক কায়া দ্বিমাত্রিক ছায়ার জীবন পেয়ে কবেই আসল ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেছে মাটিতে! কী আর করা! ছায়াদের জীবন তো তোমাদের হিসাবে মাত্র চার দিন! হা হা হা!
এত সব কুটিল চিন্তা করছ কী করে?
আমি তো করছি না। করছ তুমি। হা হা হা!
ক্রমে আমার ত্রিমাত্রিক ব্রেনের দখল নিয়ে নিচ্ছে শওকত আলী। এতকাল ধরে যত জ্ঞান আমি আমার ব্রেনে জমা করে রেখেছিলাম, তার দখল এখন শওকত আলীর। এই বুদ্ধিমান ব্রেন দিয়ে ও দ্বিমাত্রিক ছায়াদের ত্রিমাত্রিক জগতে নিয়ে আসার কাজ করবে। আমি ওকে ঠেকাতে পারছি না। বুঝতে পারছি, ত্রিমাত্রিক জগৎ ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। ঠিক যেমন করে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় ছায়ারা।
জানতে চাইলাম, তুমি আমার মতো অন্ধ?
আমার গলার স্বরে ঘ্যাড়ঘেড়ে ভাব। শওকত আলী স্পষ্ট উচ্চারণে জবাব দেয়, অপারেশনের সময় দুই রকমের চোখের বন্দোবস্ত হয়েছে। ত্রিমাত্রিক জগৎ দেখতে পাবে এক চোখ, আরেক চোখ পারবে শুধু ছায়াদের দেখতে।
শওকত আলী এক চোখে অল্পস্বল্প দেখতে পাচ্ছে। জানাল, আজকে নাকি শম্পা চমত্কার টিয়া রঙের চুড়ি পরেছে। কপালে টিয়া রঙের টিপ। খুব নাকি অপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে।
আমি তো জানি না টিয়া রং কাকে বলে? আমি শুধু গড়িয়ে গড়িয়ে শওকত আলীর সঙ্গে, না না ভুল বললাম, মানিকের সঙ্গে পথ চলি। একটু আগে মানিক শম্পার হাতের কাচের চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল। শম্পাকে আরও ভালো করে দেখাতে আমি তখন মানিকের থেকে একটু সরে গিয়ে দেখলাম সব। এক ফাঁকে মানিক আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। কী ভাবছিল ও তখন? ওর ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটু হাসি ঝুলছিল কেন? জানি না।
কিছুতেই মানিকের শরীরে আর ঢুকতে পারছি না। গড়িয়ে গড়িয়ে চলছি আর চলছি। আমার পাশে কত রকমের ছায়া। কেউবা আমার মতো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। দ্বিমাত্রিক জগতেও মরে যাওয়া এত কষ্টের, আমি জানতাম না।