উষ্ণতা

রাত ১০টা ৩৫ মিনিট। আমার ঘুমাতে যাওয়ার সময়ের এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেছে। রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। ঘুমাতে আমার সমস্যা হয় না। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম চলে আসে। আজ ঘুমাতে যেতে পারিনি। অদ্ভুত অচেনা এক যন্ত্র নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। দিশা পাচ্ছি না।

পুরোনো অকেজো ইলেকট্রনিক যন্ত্র নিয়ে এসে চালু করার অভ্যাস আমার। বলা যায় নেশার মতো। তাতে মনে হয় মৃত কোনো কিছুতে পুনঃপ্রাণ প্রতিষ্ঠা করছি। রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে আনি। কখনো ভাঙারির দোকান থেকেও কিনি। পুরোনো জিনিস বেচাকেনার দোকান আছে আমার অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে। আজ এই যন্ত্র কিনেছি সেখান থেকে।

দোকানদার বলতে পারল না এটা কিসের অংশ। আমার দেখে মনে হলো রোবট। বললাম তাকে, দেখে তো মনে হচ্ছে ভাঙা রোবট।

লোকটা অমনি চমকে উঠল। তাকে ভীত দেখাচ্ছে। পুরোনো রোবট কিংবা রোবটের যন্ত্রাংশ বিক্রি আইনত নিষিদ্ধ। ধীরে ধীরে পৃথিবী রোবটের দখলে চলে যাচ্ছে। আবিষ্কারে উন্মত্ত হয়ে সেই পথ তৈরি করে দিচ্ছে মানুষ।

দোকানদার আমতা আমতা করে বলল, আমি ঠিক জানি না।

জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পেয়েছেন?

সে আতঙ্কিত গলায় বলল, বিশ্বাস করুন, আমি মনে করতে পারছি না। অনেক জিনিসের ভেতর পড়ে ছিল।

অতি কম দামে লোকটা আমাকে এটা দিয়ে দিয়েছে। বড় কাগজে মুড়ে ব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে এসেছি।

রাতের খাবার সন্ধ্যায় সেরে নিই। ডিনার খেয়ে যন্ত্রটা নিয়ে বসলাম। এক এক করে সব কটি সার্কিট পরীক্ষা করেছি। যেখানে অসুবিধা ছিল, তা মেরামত করা হয়েছে। চার্জ আছে যথেষ্ট। যন্ত্র চালু হওয়ার কথা, চালু হচ্ছে না। আমার ধৈর্য পর্বতের মতো। তবু বিচলিত বোধ করছি। না পারার অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসেছে।

আগামীকাল অফিসে যেতে হবে না। সাপ্তাহিক ছুটি। সিদ্ধান্ত নিলাম, কাল সকালে নাশতা খেয়ে আবার নতুনভাবে পরীক্ষা করে দেখব। শুয়ে পড়লাম। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে গেছি।

যন্ত্র চালু হলো রাত ৪টা বেজে ১০ মিনিটে। আমার বিছানার সোজাসুজি দেয়ালে ঘড়ি আছে। ঘুম ভেঙে আমি বরাবর ঘড়ির দিকে তাকাই। পিপপিপ শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। শুনলাম পাশের ঘর থেকে কেউ বলছে, হেমা কোথায়? আমি হেমাকে দেখতে চাইছি।

বেডরুমের পাশে আমার স্টাডিরুম। বাসায় ফিরে বাইরের দরজা ভালোভাবে আটকে দিয়েছি। এখানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই। আচমকা এ বাড়িতে অন্য কারও কথা শোনা যাবে, এমন আশা করিনি। অতিপ্রাকৃত কোনো কিছুতে আমার বিশ্বাস শূন্য।

বিছানা থেকে নেমে স্টাডিরুমে গেলাম। যন্ত্রের একটা সার্কিটে সার ধরে গোলাপি আলো জ্বলছে। যন্ত্র থেকে আওয়াজ শোনা গেল, হেমা, মা, তোমাকে দেখছি না কেন? তুমি কোথায়?

চট করে নিজেকে সামলে নিলাম। শান্ত গলায় বললাম, আমি ধ্রুব। আপনি কে?

যন্ত্র উত্তর দিল, আমি ১০২। অষ্টম পর্যায়ের রোবট। আমাকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে?

রোবট ১০২ তার কথা বলল। সেই কাহিনি এখানে সংক্ষেপে গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।

বিশাল জাইগোট ব্যাংক। তাকের ওপর সারি সারি সাজানো জাইগোট। তার সঙ্গে ভ্রূণের ডিএনএ ও আরএনএ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা। কেউ জাইগোট ব্যাংক থেকে সন্তান নিতে চাইলে ভ্রূণের বিস্তারিত জেনে অর্ডার দেয়। তখন তারা প্রসেসিং শুরু করে। সন্তান পূর্ণতা পেলে গ্রাহককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

জাইগোট ব্যাংকের দায়িত্বে থাকে অষ্টম পর্যায়ের রোবট। তারা আবেগপ্রবণ। মানবমস্তিষ্কের মতো করে তাদের লিম্বিক সিস্টেম বানানো হয়েছে। যা নিওকর্টেকস ফাংশনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাদের ভেতর মানবিকতা যেমন আছে, তেমনি ঈর্ষা, লজ্জা ও অনুতাপের পাশাপাশি একাকিত্বের মতো আবেগও আছে। তাতে তারা কারও সাহচর্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে।

এখানকার রোবটদের আলাদা কোনো নাম নেই। তাদের সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। রোবট ১০২ চাইল সে মা হবে। সেই ভাবনা থেকে গোপনে একটি ভ্রূণকে পূর্ণতা দিয়েছে। ভ্রূণ পূর্ণতা পাওয়ার পর রোবট ১০২ তাকে নিয়ে পালাল। মেয়ের নাম রাখল হেমা।

সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে রোবট ১০২ কেন্দ্রীয় শহর থেকে অনেক দূরে এক ছোট শহরে গিয়ে উঠল। অনেকে সন্তানকে লালন-পালনের জন্য রোবটের সহযোগিতা নেয়। কেউ বাড়িতে রোবট রাখে, আবার কেউ সন্তানকে রোবটের কাছে দিয়ে দেয়। সন্তানের বয়স পাঁচ বছর হওয়া পর্যন্ত সে রোবটের কাছে থাকে। তাই হেমাকে রোবট ১০২-এর কাছে দেখে কেউ কিছু ভাবল না।

তারা থাকে ফাঁকা মাঠের মধ্যে কাঠের বাড়িতে। বিচ্ছিন্ন জায়গায় বাড়ি বলে কম ভাড়ায় পাওয়া গেছে। ১০২ কাছাকাছি এক আপেলবাগানে কাজ জোগাড় করে নিয়েছে। সেখান থেকে যা রোজগার করে, তাই দিয়ে হেমার জন্য খাবার, জামাকাপড়, খেলনা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনে।

হেমা কাঁদে। ১০২ তাকে পরম মমতায় বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে। হেমার কান্না বন্ধ হয় না। ১০২ তার বুকের তাপ বাড়িয়ে দেয়। হেমা কান্না থামায়। খানিক পর আবার কান্না শুরু করে। এবার আগের চেয়ে জোরে কাঁদে। ১০২ বুঝতে পারে, তার বুকের তাপ হয়ে গেছে অতিরিক্ত। হেমা সহ্য করতে পারছে না।

হেমা বেড়ে ওঠে। তাকে নিয়ে ১০২ বেড়াতে যায়। হেমা মায়ের হাত ধরে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক দূর চলে যায়। আবার ফিরে আসে। ১০২ হেমাকে গাছ চেনায়, পাখি দেখায়, অন্য রোবটদের কাছে যেতে বলে। হেমা আনন্দ পায়, তবে তার আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অমনি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ১০২ তাকে কোলে নিয়ে আদর দেয়। হেমা আরাম বোধ করে না। দিন দিন ১০২-এর কাছে হেমা একটু একটু করে বড় হতে থাকে।

প্রথম ঘটনা যখন ঘটল, তখন হেমার বয়স সাড়ে চার বছর। আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা রোবট ১০২-এর বাড়ি ঘিরে ফেলল। ১০২ জানত, কোনো দিন এমন ঘটনা ঘটতে পারে। বিপদ থেকে বাঁচতে সে বাড়ির বেজমেন্টে ঘর বানিয়ে রেখেছে। কাঠের পাটাতন তুলে হেমাকে নিয়ে ১০২ বেজমেন্টে চলে গেল।

সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন সাজ সাজ রব তুলে দুড়দাড় করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল। তারা ১০২ আর হেমাকে খুঁজছে। হেমাকে বুকের ভেতর শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে ১০২। হেমার কষ্ট হচ্ছে। তবে সে বুঝতে পারছে, ভয়ংকর কিছু ঘটছে। হেমা কোনো আওয়াজ করেনি। সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা হেমা কিংবা ১০২-কে খুঁজে পায়নি। তারা পুরো বাড়ি তছনছ করে দিয়ে ফিরে গেল।

১০২ বুঝতে পেরেছে, এখানে থাকা তাদের জন্য নিরাপদ নয়। সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন তাদের খোঁজে আবার আসবে। হেমাকে নিয়ে ১০২ চলে গেল বহুদূরে কাজল নদীর পারে সুরাশ্রম গ্রামে। এখানে যাদের বসবাস, তারা খামারে কাজ করে। সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারা দিন। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। হেমা বা ১০২-এর ব্যাপারেও তাদের কোনো কৌতূহল দেখা গেল না।

হেমা গাছ থেকে নেমে এসেছে। ১০২ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে হকচকিত ভাব। সে অবাক গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝলে, তোমাকে গাছে উঠতে হবে?

সেদিন বিকেলে হেমাকে নিয়ে ১০২ হাঁটছিল। হেমার বয়স ১০ বছর। ইশকুলে যায়। বেশ মেধাবী হয়েছে। ইশকুলের পড়া যেমন নিজে থেকে করে নিতে পারে, তেমনি নিজে নিজে ভেবে কোনো কাজও করতে পারে।

বিকেল পড়ে আসছে। সন্ধ্যার আগমুহূর্ত। একজন রোবট দুটি গরু নিয়ে খামারে যাচ্ছে। আচমকা গরু তেড়ে এল হেমার দিকে। হতভম্ব হয়ে গেছে ১০২। বুঝতে পারছে না কী করবে। গরুটাকে থামানো দরকার। কিন্তু কীভাবে উন্মত্ত গরুকে বশ মানানো যাবে, ভাবতে পারছে না।

গরু ছুটে কাছাকাছি চলে এসেছে। হেমা সরসর করে গাছে উঠে পড়ল। গরু ছুটে এসে গাছের গোড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রোবট ছুটে এল। সে গরুকে নিজের আয়ত্তে নিয়েছে। করুণ মুখে বলল, গরুর এহেন ব্যবহারে আপনাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি। বুঝতে পারছি না, সে কেন মানুষ দেখলে খেপে যাচ্ছে। কোনো রোবট দেখলে এমন আচরণ করছে না। কিছুক্ষণ আগে আরেকজন মানুষের দিকে তেড়ে গিয়েছিল।

গাছের নিচের ডালে নেমে এসেছে হেমা। সে বলল, কাপড় দিয়ে গরুর চোখ বেঁধে নিয়ে যান।

রোবট জিজ্ঞেস করল, তাহলে সে দেখবে কেমন করে?

হেমা বলল, তাকে দেখতে হবে না। তার পাশে আরেকটি গরু আছে, আপনি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, এতে গরু বিশ্বাস করবে তার কোনো বিপদ হবে না। সে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাবে। চোখ বাঁধা বলে পথে কোনো মানুষ দেখতে পাবে না। তাই সে খেপে গিয়ে কারও দিকে ছুটে যাবে না।

রোবট গরুর চোখে কাপড় বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। গরু কোনো যন্ত্রণা না করে হেলেদুলে হেঁটে যেতে থাকল।

হেমা গাছ থেকে নেমে এসেছে। ১০২ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে হকচকিত ভাব। সে অবাক গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝলে, তোমাকে গাছে উঠতে হবে? আগে কখনো তুমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওনি। তোমার অভিজ্ঞতা নেই। এমন সমাধান আমার ভাবনায় আসেনি।

হেমা ধীরেসুস্থে বলল, মা, মানুষের ব্রেন তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সিগন্যাল দেয়। রোবট শুধু ততটুকু জানে, যেটুকু তার ভেতর প্রোগ্রামিং করে দেওয়া হয়।

১০২-এর মন খারাপ হয়ে গেল। সে বিষণ্ন মনে তাকিয়ে থাকল। হেমা বলল, মন খারাপ কোরো না, মা। তুমি চেষ্টা করলে এই সমাধান বের করে ফেলতে পারতে।

১০২ চুপ করে আছে, কিছু বলছে না। হেমা বলল, বিড়াল যখন কাঠবিড়ালিকে তাড়া করে, তখন কাঠবিড়ালি দৌড়ে গাছে উঠে যায়, তুমি দেখেছ। এই অভিজ্ঞতা থেকে তুমি বুঝতে পারতে।

১০২ হাহাকারের সুরে বলল, কিন্তু আমি তোমাকে বাঁচানোর জন্য সব উপায় ভাবছিলাম। গরুকে থামিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। কিন্তু তেড়ে আসা গরুকে কীভাবে থামাতে হয়, আমার জানা নেই।

হেমা বলল, তোমার ভেতর যতটুকু তথ্য ইনস্টল করা আছে, তুমি কেবল সেটুকু দিয়ে ঘটনা বিশ্লেষণ করতে পারো। তার অতিরিক্ত করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাড়ির বারান্দায় বসে আছে ১০২। তার দৃষ্টি দূর মাঠের দিকে। তাকে উদাস দেখাচ্ছে। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।

১০২-এর মন আরও খারাপ হয়ে গেল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বুঝতে পারছে, সে সন্তানকে অচেনা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে অক্ষম।

হেমা দেখল মায়ের চোখ কাতর হয়ে আছে। মা কাঁদছে। মায়ের মন ভালো করার জন্য হেমা হেসে বলল, মানুষেরও সীমাবদ্ধতা আছে, মা। পাখি উড়তে পারে, মানুষ পারে না।

অমনি মায়ের মন ভালো হয়ে গেল। সে হেমার যুক্তি মেনে নিল। হেমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে আদর করল। মায়ের শক্ত বুকের ভেতর হেমা ব্যথা পাচ্ছিল, তবু সে কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে মায়ের আদর নিল।

হেমা বড় হলো। তার বিয়ে হলো। সন্তান হলো। হেমার সন্তানের নাম তাতাই। মুগ্ধ চোখে ১০২ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাতাই হাত-পা নেড়ে বিছানায় শুয়ে খেলা করে। আচমকা কেঁদে ওঠে। ১০২ তাকে কোলে নেয়। তাতাইয়ের কান্না থামে না। হেমা কোলে নিতেই তাতাই কান্না বন্ধ করে চুপ হয়ে যায়। ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদলে, কান্না থামিয়ে আবার পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে যায়। অন্য সময় হাসে, খেলা করে।

১০২-কে ব্যাপারটা দারুণভাবে ভাবাচ্ছে। তার কী নেই, যা হেমার আছে! তার কোলে এসেও তাতাই কেন কাঁদে, হেমা কোলে নিলে কান্না থেমে যায়। জটিল ভাবনায় আটকে গেছে ১০২। একসময় বুঝতে পারল, হেমা তার মা। তাই তাতাই তার কোলে প্রশান্তি বোধ করে। কিন্তু এই ভাবনা ১০২-কে আরাম দিল না। সে হেমার মা। হেমা যখন ছোট ছিল, সে কাঁদলে তাকে কোলে তুলে নিত। তাতাইয়ের মতো হেমার কান্না বন্ধ হতো না। কেঁদে যেত।

বাড়ির বারান্দায় বসে আছে ১০২। তার দৃষ্টি দূর মাঠের দিকে। তাকে উদাস দেখাচ্ছে। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।

হেমা এসেছে। কোলে তাতাই খেলা করছে। হেমা বলল, মা, তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?

মুখ তুলে তাকিয়েছে ১০২। তার চোখে গভীর বিষণ্নতা। খাদে পড়ে যাওয়া গলায় বিড়বিড় করে বলল, বল তো মা, তোর কাছে এমন কী আছে, যা আমার কাছে নেই! তুই যখন তাতাইকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরিস, তখন সে আরাম পায়। আমি যখন তোকে অমনভাবে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরতাম, তুই আরাম পাসনি।

তাতাইয়ের মাথা কাঁধে রেখে হেমা বলল, মন খারাপ করে না, মা আমার। তুমি অনেক ভালো। শোনো মা, মানুষের বুকে ওম থাকে। যে ওম রোবটের বুকে থাকে না। এই উষ্ণতা কৃত্রিমভাবে বানানো সম্ভব নয়। মায়ের বুকের উষ্ণতা হচ্ছে প্রাকৃতিক। প্রকৃতি মাকে এমন উষ্ণতা উপহার দিয়েছে। কমও না, আবার বেশিও না, একদম ঠিকঠাক।

১০২ বুঝতে পারছে। সে দেখেছে যখন বরফ পড়ে, তুষারকুচিতে ঢেকে যায় মা পাখি। সে তার ছানাদের তখনো বুকের ভেতর রেখে ওম দেয়। শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণীর বুকে উষ্ণতা থাকে, যা রোবটের নেই।

দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল তখন। ১০২ দেখল সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোক আসছে। হেমার সামনে সে ধরা দিতে চাইল না। ১০২ পালাল। পালিয়ে নদীর দিকে চলে গেল। সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন তাকে দেখে ফেলেছে। তারা পেছনে তেড়ে আসছে। ১০২ সিদ্ধান্ত নিল, সে দৌড়ে গাছে উঠে পড়বে। আশপাশে কোনো গাছ দেখতে পেল না। সামনে নদী। ১০২ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আমার হাসি পেল। হাসলাম না। আমি জানি, দশম পর্যায়ের রোবট সিনট্যাকস আর সিম্যানটিকসের মাঝখানের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলেছে।

নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে গেল ১০২। সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকদের আর দেখা গেল না। ১০২ হঠাৎ বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেল। তারপর সে আর কিছু জানে না।

ভোর হয়ে গেছে। চারপাশ অদ্ভুত শুভ্র স্নিগ্ধতায় ভরে আছে। পাখি ডাকছে। আজ আমার অফিস নেই। ১০২-কে সারা দিন সময় দিতে পারব। বললাম, আমাকে কিছুক্ষণ সময় দাও। সকালে এক মগ ব্ল্যাক কফি খাই।

১০২ কিছু বলল না। উঠে গিয়ে মগভর্তি গরম কফি নিয়ে এলাম।

১০২ বলল, আমার কী হয়েছিল জানি না। আমাদের চার্জ শেষ হয়ে যেতে থাকলে আমরা বুঝতে পারি। সংকেত দিয়ে অন্যকে বোঝাতে পারি। অন্যের কাছ থেকে প্লাগ চেয়ে নিয়ে নিজেকে চার্জ করতে পারার মতো করে আমাদের বানানো হয়েছে। কিন্তু আমার চার্জ শেষ হয়ে যায়নি। আমি পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে যেতে পারছি না। হেমাকে দেখতে পাচ্ছি না।

আমার হাসি পেল। হাসলাম না। আমি জানি, দশম পর্যায়ের রোবট সিনট্যাকস আর সিম্যানটিকসের মাঝখানের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলেছে। তারা সচেতনভাবে সাড়া দিতে পারে। কিন্তু এখনো মানুষের মতো তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মানুষ কোনো ঘরে ঢুকলে চেয়ার দেখে, টেবিল দেখে, ঘরের মেঝে, আসবাবসহ অন্যান্য জিনিস দেখে চিনতে পারে। রোবট পুরো ঘর স্ক্যান করে দেখে অনেকগুলো সরল ও বক্ররেখা। বক্ররেখাগুলোকে পিক্সেলে কনভার্ট করে। জটপাকানো এসব রেখা থেকে কিছু বুঝে উঠতে তাদের অনেক সময় লেগে যায়। অষ্টম পর্যায়ের রোবট সেটাও পারে না।

১০২ বলল, তুমি আমাকে হেমার কাছে নিয়ে যাবে?

বললাম, যাব। শোনো, তোমার ব্রেনসার্কিট আর অপটিক্যাল মডিউল ঠিক আছে, যা দিয়ে তুমি তথ্য বিশ্লেষণ করতে ও দেখতে পারছ। তুমি কি তোমার আগের শরীর ফিরে পেতে চাইছ? তাহলে সময় লাগবে।

১০২ বলল, তোমার ব্যাকপ্যাকে করে আমাকে নিয়ে চলো। হেমার কাছে আমাকে রেখে দেবে। তাকে দেখব।

সার্কিটের আলোর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার হাত নেই। তুমি হেমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

আবেগজড়ানো কণ্ঠে ১০২ বলল, আমার শরীরের দরকার নেই। রোবটের শরীরে ওম থাকে না। তার ব্রেনের সার্কিটে আবেগ থাকে। আমার স্পর্শ হেমাকে কোনোভাবে উষ্ণতা দেবে না।

সকাল ১০টায় রোবট ১০২-কে নিয়ে রওনা হলাম। আমরা যাচ্ছি কাজল নদের পারে সুরাশ্রম গ্রামে, হেমার কাছে।

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত