ভিনগ্রহী

‘অনি...অনি...দাঁড়াও...কোথায় যাচ্ছ তুমি?’

ভার্সিটির এরিয়া ক্রস করছিল অনি। তখনই রবিনের ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় ও। রবিন কাছাকাছি আসতেই অনি বলল, ‘কী হলো, ডাকছ কেন? কিছু বলবে?’

অনির চেহারা গম্ভীর, চোখে-মুখে যেন সকাল থেকেই লাল আভা বেরোচ্ছে। অন্তত রবিনের এটাই মনে হয়েছে।

‘না, আসলে আজ সন্ধ্যায় একটু ঘুরতে যেতে চাইছিলাম, যাবে?’ অনি রবিনের কথায় বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। রবিনের কেন যেন হঠাৎ মনে হতে থাকে, অনির চোখে-মুখে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে। কিন্তু তা কী, ও বুঝতে পারছে না।

অনি নতুন এসেছে এই ভার্সিটিতে। রবিন এখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তবে জুনিয়রদের মাধ্যমেই অনির সঙ্গে রবিনের পরিচয় হয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই রবিন বুঝতে পেরেছে, অনি সবার চেয়ে আলাদা। এ জন্যই মনে হয় অনিকে এতটা ভালো লাগে রবিনের। তবে অনির একাকী কথাবার্তা বলা আর হঠাৎ চিন্তায় ডুবে যাওয়াটা রবিনের দৃষ্টি এড়ায়নি।

‘আজ...হ্যাঁ যেতে পারি। কখন?’

‘এই তো সন্ধ্যা...সাতটায়।’

‘আচ্ছা, আমি রেডি হয়ে অপেক্ষা করব।’ বলেই সোজা চলে গেল। রবিনও নিজের বাসায় ফেরার পথ ধরে।

রবিন ছেলেটা মন্দ নয়। মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে। তবে বেশির ভাগ সময়ই টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখে। ভিনগ্রহ সম্পর্কে অনেক আগ্রহ ওর। ও প্রায় সব তারাই চেনে। শখের বশে প্রায় দশ কি বারোটা বিভিন্ন ধরনের টেলিস্কোপ কিনেছিল সে। মাঝেমধ্যে ও ভিনগ্রহী প্রাণীদের কথা ভাবে। ওর ধারণা, এলিয়েন আছে, ইচ্ছা করেই মানুষের কাছ থেকে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে। এসব কথা বন্ধুদের বলে রবিন। ওরা হেসেই ফেলে। রবিন ভাবে...ভাবতেই থাকে।

ঠিক সন্ধ্যায় ওরা একসঙ্গে বের হয় ঘুরতে। নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে সিনেমা হলেও যায় ওরা। এমনকি রেস্তোরাঁয় বসে ডিনারও করে ফেলে।

রাত প্রায় বারোটা। দুজনই খুব ক্লান্ত। রবিন বাসায় ফেরার কথা বলে। কিন্তু ও বলে, ‘আরেকটু পর যাব, এই ব্রিজটার ওপর বসে থাকতে ভালোই লাগছে। জনশূন্য, এমনকি আজকে আকাশটাও মেঘমুক্ত। কত তারা আকাশে!’

রবিন আর কথা বাড়ায় না। অপেক্ষা করতে থাকে। নিচে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। ওরা প্রায়ই আসে এই ব্রিজটার ওপর। তবে এত রাত অবধি থাকেনি কখনো। এ সময়টাতে ব্রিজটা একদম জনমানবহীন থাকে। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে অনি বলে, ‘তোমায় একটা কথা বলব, মাইন্ড করবে না তো?’

‘না...বলো।’

‘তুমি মহাকাশ সম্পর্কে কতটা জানো?’

‘এই তো...যা নিয়ে পড়াশোনা করছি, তা–ই জানি। কেন?’

‘ভিনগ্রহীদের সম্পর্কে কতটা জানো?’

‘তেমন কিছুই জানি না।’

‘হুঁ...তার মানে তুমি কিছুই জানো না?’

‘আরে অনি, আমি কেন, এই বিশ্বই জানে না।’

এতক্ষণ অনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার সে রবিনের দিকে ফিরল। অনির চোখ যেন কথা বলছে, গভীর কিছু।

‘আজ সময় এসেছে। তোমাকে সবকিছুই বলব আমি, রবিন।’

‘কী বলবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘আসলে রবিন...আমি খুবই দুঃখিত। আমি আসলে এই পৃথিবীর প্রাণী না। আমাকে পাঠানো হয়েছে বহু বছর আগে। শুধু আমি নই। আমরা এই পৃথিবীতে বাস করছি গত শতক থেকে। তোমরা তো কিছুই জানো না আমাদের সম্পর্কে। জানবে কীভাবে? তোমরা সেটাই জানো, যা তোমাদের জানানো হয়, তোমরা সেটাই দেখো, যা দেখানো হয়। তোমরা আজও খুঁজে বেড়াচ্ছ আমাদের। অথচ আমরা এই পৃথিবীতে বসতি গড়েছি এক শ বছর আগে। আজ শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আমাদের রিসার্চ সেন্টারে বায়োম্যান প্রজেক্ট চালু করা হবে। এ জন্য দশজন মানুষ প্রয়োজন। তার মধ্যে তুমি তৃতীয়জন।’ অনির কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত রবিন অপেক্ষা করছিল। ওর কাছে সবকিছুই পরিষ্কার। তবে কোনো কথা মুখ ফুটে বলে না।

‘রবিন, তোমাকে আর সময় দিতে পারব না। চলো আমার সঙ্গে।’

রবিন কিছু বলার আগেই অনি ওকে ধরে যেন শূন্যে লাফ দিল। সামনেই একটা আলোকিত গহ্বর তৈরি হলো। চোখের পলকেই রবিনকে নিয়ে অনি হারিয়ে গেল সেই গহ্বরে।

কিন্তু রবিনের পকেট থেকে পড়ে গেল অনির জন্য আনা ছোট একটা উপহার আর একটি কার্ড, সে কার্ডে লেখা ছিল এত দিন ধরে না বলা কিছু কথা।

নাসিমবাগ, মিরপুর, ঢাকা