চোখের জাদু - ২

(গত সংখ্যায় পর)

ঘণ্টাখানেক ঘুমালেন ইউসুফ মাস্টার। চোখ মেলে দেখেন ঘর অন্ধকার। মাথায় হাত বোলাচ্ছেন রুনা। গালে গরম নিশ্বাস পড়ছে তার। তিনি মনে মনে বললেন, বিকেলে কড়ইগাছতলে কিছু দেখেননি। তার চোখেও কিছু ঘটেনি। আর কয়েক বছর পর অবসরে যাবেন তিনি। অবাস্তব কোনো চমক নিয়ে কাটাতে চান না এ সময়।

রুনা বললেন, ‘যাও, বাজার থিকা ঘুইরা আসো। মনটা ভালো হইব। কিছু জিনিসও আনা দরকার।’

খানিক পর রুনার দেওয়া লিস্ট আর চটের থলে নিয়ে বাজারে গেলেন ইউসুফ মাস্টার। কাছেই বাজার। হেঁটে যেতে মিনিট দশেক লাগে। সান্ধ্য বাজারে তাজা কিছু মাছ জোটে। নদীতে জাল ফেলে ধরে আনা মাছ। এক জেলে বড় কিছু তাজা ট্যাংরা নিয়ে বসেছে। লাফাচ্ছে মাছগুলো। দেখলেই শান্তি। বাড়ির পেছনের আঙিনায় গজানো নতুন ডাঁটার সঙ্গে জমবে বেশ। ট্যাংরার পাশে আরেক জেলের চেটাল থালায় পেট চিতিয়ে পড়ে আছে ইয়া বড় এক পাঙাশ। হাপরের মতো কানকো নাড়ছে। জীবনভর এসব মাছ শুধু দেখেই গেলেন, খাওয়া আর হলো না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্যাংরার দরদাম শুরু করলেন ইউসুফ মাস্টার। এমন সময় পাঙাশের সামনে এসে দাঁড়াল একজন। গায়ে লম্বা ঝুলের সিল্কের পাঞ্জাবি। মাস্টারকে দেখেই কাঁধে একটা থাবড়া মারলেন তিনি।

‘কী মাস্টার, খবর কী তোমার?’

ইউসুফ ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন সদু মেম্বার। ক্লাস টেন পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছেন তারা। আগে তুই-তোকারির সম্পর্ক দিল। গলাগলি ধরে হাঁটতেন। এখন তুমি-তুমি, সামাজিক দূরত্বও বেড়েছে।

পলকা হাসি দিয়ে ইউসুফ মাস্টার বলেন, ‘আমার আবার খবর কী? আগেও যা, এখনো তা–ই। নতুন নতুন খবর তো সব তোমাদেরই।’

‘অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয় না, কথা হয় না। চলো, কোথাও বইসা চা খাই।’

সদু মেম্বার যে ধাঁচের মানুষ, তার সঙ্গে চা খাওয়াটা ইউসুফের জন্য মোটেও রুচিকর নয়। এরপরও এমন আহ্বানে না করা যায় না। তার সঙ্গে ছোটবেলার সেই সব দিন মনে পড়ে যাচ্ছে। নদীতে নাইতে নেমে অনেক ঝাঁপাঝাঁপি করতেন তারা। দূর থেকে দৌড়ে এসে নদীর পাড় থেকে ডিগবাজি দিয়ে পানিতে পড়তেন। এ কাজে খুব পাকা ছিলেন ইউসুফ। সদু আর অন্য বন্ধুরা তাকে ঈর্ষা করতেন। ইউসুফের ডিগবাজি দেওয়ার দিন শেষ সেই কবেই। কিন্তু সদু মেম্বার এই শুকনো ডাঙাতেই কত ডিগবাজি দিচ্ছেন!

একটা চায়ের দোকানের দিকে এগোলেন দুজন। ইউসুফ খেয়াল করলেন, সদু মেম্বার একটু কেমন করে যেন হাঁটছেন। চোষ পাজামাটা কি খুব টাইট হয়েছে? এমন আঁটো জিনিস পরার দরকারটা কী?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সদু মেম্বারের আপাদমস্তক জরিপ করলেন ইউসুফ। স্যাঁত করে স্বচ্ছ হয়ে গেল তার কায়া। সদুর অন্তর্বাসে এক হাজার টাকার নোটের আস্ত একটা বান্ডিল। এত জায়গা থাকতে আন্ডারওয়্যারে টাকা কেন?

ইউসুফ মাস্টারকে বাইরে দাঁড় করিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন সদু মেম্বার। নিজেই দুকাপ চা এনে একটা ধরিয়ে দিলেন মাস্টারের হাতে।

‘মাস্টার, তুমি খালি আমারে অ্যাভয়েড কইরাই গেলা। একটা দিনও বন্ধুর প্রচারে পাইলাম না।’

ইউসুফ এতক্ষণে খুঁজে পেলেন তাকে হঠাৎ এত খাতির করার কারণ। ইলেকশন সন্নিকটে। তাকে প্রচারে লাগানোর মতলব।

‘কী মাস্টার, চুপ ক্যান? কিছু একটা বলো?’

‘আমি শিক্ষক মানুষ। ছাত্র পড়ানো ছাড়া আর কিছু জানি না। আমারে প্রচারে নামাইলে তোমার ভরাডুবি হইব।’

‘আরে, প্রচারে তো তোমার মতো ভালো মানুষই দরকার। তুমি যা বলবা, সবাই তা বিশ্বাস করব।’

‘কী বলব?’

‘বলবা যে সবাই যা ভাবে, আমি তা না। আমি রিলিফের গম চোর না।’

মুখের ওপর ফস করে কথা বলে বেকুব বনে যাওয়ার বাতিক আছে ইউসুফ মাস্টারের। তিনি বুলেটের মতো বলে ফেললেন, ‘গম চোর না হইলে তোমার আন্ডারওয়্যারের মধ্যে টাকার বান্ডিল ক্যান?’

সদু মেম্বারের কাপ ধরা হাতটা এমনভাবে কেঁপে উঠল, খানিকটা চা ছলকে পড়ল মাটিতে। তবে চট করে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ায় সুপটু তিনি। মুখে কপট হাসি টেনে বললেন, ‘এই বয়সে তো ভালোই রঙ্গ করতে পারো, বন্ধু! তবে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় আনা উচিত না? এইটা কোনো কথা!’

ইউসুফ মাস্টার দাঁত বের করে বললেন, ‘আমি পরিষ্কার দেখতে পাইতেছি, বন্ধু। কোনো ভুল নাই। সব এক হাজার টাকার নোট!’

মেম্বারের হাত থেকে চায়ের কাপটা এবার পড়ে গেল। বন্ধুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। মাস্টার এটা জানল কী করে?

ইউসুফ মাস্টার বড় কয়েকটা চুমুকে চা শেষ করলেন। দোকানে কাপ রেখে এসে বললেন, ‘যাই, বন্ধু। আমার একটু তাড়া আছে। চা খাওয়ানোর জন্য ধন্যবাদ।’

এই বলে ট্যাংরা কিনতে পা বাড়ালেন ইউসুফ। মনে মনে মাস্টারকে খুব কঠিন একটা গাল দিলেন মেম্বার। তার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাওয়া নিয়ে শোরগোল উঠেছে। কাপটা তুলতে ছুটে এসেছে দোকানের ছোকরা। তার গালে চড় দিলেন মেম্বার।

‘এই বেটা, কী দিয়া চা বানাইছস! আমার পেটে বড় একটা ঘোঁটা মারছে। এখন বাড়ি পর্যন্ত যাইতে পারি কি না!’

বাজার সেরে বাড়ি ফিরে একদম চুপ মেরে গেলেন ইউসুফ মাস্টার। কী যে একটা ল্যাঠা বাগিয়েছেন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তিনি। মানুষের সবকিছু দেখা ঠিক নয়।

পরদিন স্কুলে যেতেই হেডমাস্টার আকবর হোসেন তাকে ডেকে পাঠালেন। ইউসুফ একটু অবাক হলেন। হেড স্যার তাকে তেমন পছন্দ করেন না। দপ্তরি ফজল মিয়ার কাছে শুনছেন, হেডমাস্টার কখনো তাকে তলব করার সময় আদেশ করেন, ‘বেকুবটাকে ডাকো তো।’ আজও নিশ্চয়ই বলেছেন।

প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকে কিছুটা রুষ্ট হলেন ইউসুফ। জাভেদ বসে আছে একটা চেয়ারে। ওকে আবার আনা হয়েছে কেন? তার মুখে ফিচলে হাসি।

ইউসুফকে মুখোমুখি চেয়ারটায় বসতে বললেন হেড স্যার। বললেন, ‘কাল রাতে মেম্বার সাহেবের সঙ্গে কী একটা ঝামেলা নাকি করেছেন?’

‘ঝামেলা!’

‘হ্যাঁ, মেম্বার সাহেব তো ফোনে আমারে তা–ই বললেন। এরা হইল সমাজের মাথা। এদের সাথে কোনো গোলমাল করবেন না।’

ইউসুফ মাস্টার ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন, ‘গোলমাল কিছু করি নাই, স্যার। মেম্বারের আন্ডারওয়্যারে এক হাজার টাকার নোটের একটা বান্ডিল ছিল, সেটা আমি দেখে ফেলেছি। আর সে কথা মেম্বারকে বলতেই...’

কথা শেষ করার আগেই হাসি এসে গেল তার। চেহারাটা কঠিন হয়ে গেল আকবর হোসেনের। বললেন, ‘ঝামেলা তো ভালোই পাকাইছেন, দেখছি! একটা মানুষের ওই স্থানে টাকা থাকলে আপনার সমস্যা কী? আর ওটা আপনি দেখলেনই–বা কী করে? এই বয়সে ফাইজলামি ভালো না।’

এবার ইউসুফের চোয়ালও শক্ত হয়ে গেল। বললেন, ‘ফাইজলামি আমি করি নাই, স্যার। কাল থেকে আমি অনেক কিছু দেখতে পাই। এই যেমন আপনার এই পাঞ্জাবির ভেতর গলায় ঝোলানো তামার তাবিজটা দেখতে পাচ্ছি।’

অজান্তেই আকবর হোসেনের হাত চলে গেল বুকের ওপর, যেখানে তাবিজটা ঝুলছে। স্কুলে সবাই তাকে বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক শিক্ষক বলে জানে। এই বেকুবটা দেখা যাচ্ছে আসল গোমর জেনে ফেলেছে।

টেবিলের এক পাশে রাখা ব্যাগটা দেখিয়ে আকবর হোসেন বললেন, ‘এই ব্যাগের ভেতর কী আছে, বলেন তো?’

জাভেদের দিকে একবার তাকালেন ইউসুফ। তার চোখে পরিষ্কার চ্যালেঞ্জ, পারলে খেল দেখাও চাঁদু!

ইউসুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ব্যাগটার দিকে। চোখ দুটো সরু হয়ে এল।

হেড স্যার জানেন, এই বেকুবের বুজরুকি এবার বের হয়ে যাবে। তিনি তাড়া দিলেন, ‘কী, কিছু দেখতে পাচ্ছেন, ইউসুফ?’

‘জি, স্যার। ভেতর আপনার জন্য প্লাস্টিকের তিনটা বাটিতে দুপুরের খাবার দিয়েছেন ভাবি। শোল মাছের ঝোল আর ডাল আছে। বেগুন ভাজা আছে ভাতের ওপর।’

‘কী সাংঘাতিক!’

প্রবল উত্তেজনা চেপে রাখতে পারলেন না হেড স্যার। বললেন, ‘কোনো নজ্জুমি কিতাব পেয়েছেন নাকি, যা আপনার দিব্য চোখ খুলে দিয়েছে?’

‘জানি না, স্যার।’

‘এটা কীভাবে সম্ভব?’

কাল বিকেলে কড়ইগাছতলে ঘটা সেই ঘটনাটা অবলীলায় বলে গেলেন ইউসুফ। হেড স্যার চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?’

জাভেদ ঘাড় চুলকে বলল, ‘কী জানি, স্যার। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।’

জাভেদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন ইউসুফ। তার শার্টের বুকপকেটে একটা চিরকুট। যা লেখা আছে, গড় গড় করে পড়ে গেলেন তিনি, ‘আজ যেন গুড় আনতে ভুল না হয়। নারকেল কুড়িয়ে রেখেছি।’

এটুকু বলে থামলেন ইউসুফ। ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘কী জাভেদ, তোমার বউ তো মনে হয় পায়েস করব। গুড় নিতে আইজ ভুইলো না কিন্তু।’

লজ্জায় লাল হয়ে গেল জাভেদ। এই লোক নিচের দিকে তাকালে তো সর্বনাশ! হেড স্যার হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘যা অর্জন করেছেন, তা আপনার মধ্যেই থাকুক, ইউসুফ। এ নিয়ে আর কারও সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। স্কুলের ছেলেরা একটা হইচই বাধাইয়া দিব। মানুষ ছুইটা আসব। বিরাট সিন ক্রিয়েট হবে।’

‘জি, স্যার। আর কাউকে বলব না।’

এবার জাভেদের দিকে ফিরলেন হেড স্যার।

‘আর জাভেদ, আপনিও মুখ বন্ধ রাখবেন। এবার আপনারা যান।’

ইউসুফ আর জাভেদ একসঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, পেছন থেকে আকবর হোসেন ডাকলেন, ‘ইউসুফ, একটু শোনেন।’

থেমে গেলেন ইউসুফ। জাভেদও দাঁড়াল। হাত নেড়ে তাকে যেতে বললেন হেড স্যার। বেরিয়ে গেল সে। এবার ইউসুফকে ইশারায় কাছে ডাকলেন তিনি। ইউসুফ গেলেন এগিয়ে।

‘আচ্ছা, আপনি সত্যিই কোনো কিছু পেয়েছেন, ইউসুফ? নাকি স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞান? সত্যি কথা বলবেন।’

‘যা ঘটেছে, বলেছি। বিশ্বাস করা না–করা আপনার ব্যাপার, স্যার। ইচ্ছা করলে কড়ইগাছতলে গিয়া দেইখা আসতে পারেন।’

‘না, এর কোনো দরকার নাই।’

এই বলে ইতস্তত করতে লাগলেন আকবর হোসেন।

‘আর কিছু বলবেন, স্যার?’

‘না, বলছিলাম যে আপনার এই গুণটা হস্তান্তরযোগ্য কি না। মানে ট্রান্সফার করা যায়?’

হেড স্যার আসলে কী বলতে চান? কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলেন ইউসুফ।

আকবর হোসেন বললেন, ‘ট্রান্সফার করা গেলে আমাকে দেন। নগদ পাঁচ লাখ টাকা দেব। আমার অনেক কষ্টের সঞ্চয়।’

‘এটা দিয়ে আপনি কী করবেন, স্যার?’

‘আর কিছু দিন পরই তো রিটায়ারে যাব। তখন এই বিদ্যা কাজে লাগাব। সময় কাটবে, কিছু পয়সাও আসবে।’

‘কিন্তু আমার মনে হয় না এটা ট্রান্সফার করা যায়।’

আকবর হোসেন বেজার হয়ে বসে রইলেন। এর মধ্যে ঘণ্টা পড়ে গেছে। অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে ইউসুফও গিয়ে দাঁড়ালেন অ্যাসেম্বলিতে। ছাত্রদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’

জাভেদের মনটা আজ বড়ই উড়ু উড়ু। ক্লাসে মোটেও মন বসাতে পারছে না। বয়োজ্যেষ্ঠ ইউসুফকে কাল ভর্ৎসনা করলেও এলিয়েনকে নিয়ে ওই টিভি রিপোর্টিং সে দেখেছে। এলিয়েন নিয়ে তার আগ্রহও কম নয়, তা বাইরে যতই নির্বিকার ভাব দেখাক না কেন। এ জন্য ইউসুফের ওই কড়ইগাছটা তাকে চুম্বকের মতো টানছে। সেখানে একবার ঢুঁ না মারলেই নয়। যেহেতু ইউসুফের বাড়িতে কয়েকবার যাওয়া হয়েছে, জায়গাটা সে খুব ভালো করেই চেনে।

টিফিন পিরিয়ডে আর থাকতে পারল না জাভেদ। সবার নজর এড়িয়ে সেই কড়ইগাছতলে গিয়ে হাজির। মোটেও মিথ্যা বলেননি ইউসুফ। সত্যিই কিছু ঝোপ কুঁকড়ে নেতিয়ে আছে। পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন। তেলপোড়া একটা ঝাঁজ আছে জায়গাটায়। জাফনার সেই জঙ্গুলে স্থানের সঙ্গে অনেকটা মিল।

স্মার্টফোনের ক্যামেরায় পটাপট কিছু ছবি তুলল জাভেদ। দুকথা লিখে ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট দিল। নাসার ই-মেইল ঠিকানা আছে তার কাছে। এবার কাজে লাগল সেটা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কয়েকটা লাইন লিখে পাঠিয়ে দিল একগাদা ছবি। বিজ্ঞান জাদুঘরও বাদ রইল না।

স্কুল শেষে ইউসুফ বাড়ি ফিরে দেখেন, এলাহি কাণ্ড। উঠানের এক কোণে বাজার-সওদার বিশাল স্তূপ। রুনা এসে নাচন দিয়ে জানালেন, সদু মেম্বার একটা রিকশা–ভ্যানে করে এসব পাঠিয়েছেন। সঙ্গে পাঁচ কেজি ওজনের রুইও আছে। স্বামীকে দেখাবেন বলে এখনো কাটা হয়নি।

জারার মধ্যে সে রকম আনন্দ নেই। বাবাকে ভালো করেই চেনে ও। কাজেই মেম্বারের প্রতি মনে মনে রুষ্ট। তিনি ঘরের মধ্যে একটা ঝামেলা তৈরি করতেই এসব পাঠিয়েছেন।

ঝামেলা কিন্তু সত্যিই বেধে গেল। ভ্যানটা অমনি ফেরত পাঠানো হলো না কেন, এ নিয়ে রাগারাগি করতে লাগলেন ইউসুফ।

রুনাও পাল্টা খেপে গেলেন। বললেন, ‘কেউ খুশিমনে উপহার পাঠালে ফেরত দেওয়া যায়! আর উনি তোমার বাল্যবন্ধু না?’

এভাবে লেগে গেল দুজনের। মা–বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে একসময় হাল ছেড়ে দিল জারা। কথায় কথায় অনেক রাত হলো। ইউসুফ মাস্টার না খেয়েই ঘুমাতে গেলেন। রুনাও খেলেন না।

ইউসুফের মন স্বচ্ছ সাদা সরোবর। রাগ যত কঠিন হোক, এখানে জমাট থাকতে পারে না। বরফের মতো গলে যায়।

পরদিন ভোরে নরম মেজাজ নিয়ে জেগে উঠলেন তিনি। আজ শুক্রবার। ছুটি। সারা সপ্তাহে নিজের মতো করে কাটানোর জন্য একটা মাত্র দিন। তাই কোনো গোলমাল নয়।

রুনা যেই গুড়–মুড়ি আর চায়ের কাপ নিয়ে এলেন, সুবোধ বালকের মতো নিলেন তিনি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে পুরোনো দিনের গানের একটা সুর ভাঁজতে লাগলেন, ‘পোড়া চোখ, কেন তুই অন্ধ থাকিস না...’

বাড়ির সামনে একটা শোরগোল ইউসুফের গুনগুন থামিয়ে দিল। চা-গুড়–মুড়ি রেখে বেরোলেন তিনি। বেশ কয়েকজনের জটলা। ইউসুফকে দেখে ঘিরে ধরল তারা। সবাই নিম্নশ্রেণির মানুষ।

একজন বলল, ‘এইটা কি ইউসুফ উদ্দিন হুজুরের বাড়ি?’

‘কেন?’

আরেকজন বলল, ‘দয়া কইরা হুজুররে একটু ডাকেন।’

তার কথা বলার ঢঙে একটু খেপে গেলেন ইউসুফ। ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, ‘এত হুজুর হুজুর করছেন কেন? আমিই ইউসুফ উদ্দিন। কী বলবেন, বলেন?’

কানাঘুষা শুরু হলো তাদের। এই লোককে মোটেও ইউসুফ উদ্দিন হুজুর মনে হচ্ছে না। তার টুপি আর দাড়ি কই?

ইউসুফ ধমকের সুরে বললেন, ‘ইউসুফ উদ্দিনকে দিয়ে আপনারা আসলে কী করবেন, বলেন? কী দরকার তাকে?’

একজন বড় কাতর কণ্ঠে বলল, ‘শুনলাম তাইনে স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞান অর্জন করছেন। আমরা হুজুরের দোয়া পড়া পানি নিতে আইছি।’

ইউসুফ এতক্ষণে খেয়াল করলেন, সবার হাতেই ছোট-বড় বোতল আর কন্টেইনার। কোনোটা কাচের, কোনোটা প্লাস্টিকের। কী সর্বনাশ ঘটেছে, ভালো করেই টের পেলেন তিনি। আক্রোশবশে বিড়ম্বনায় ফেলতে তার নামে কেউ এসব রটিয়েছে। মেম্বার হতে পারে, আবার হেড স্যারও হতে পারেন। জাভেদকেও বিশ্বাস নেই।

ইউসুফ গলার রগ ফুলিয়ে একটা হুংকার দিলেন, ‘আমি কোনো হুজুর-টুজুর না। একজন স্কুলটিচার। দোয়া আমি জানি না।’

এই বলে দড়াম করে বাড়ির টিনের গেটটা বন্ধ করে দিলেন। এতে কোনো কাজ হলো না। বরং সময় যত গড়াতে লাগল, বাড়ির সামনে লোকজনের চাপ আরও বাড়তে লাগল। স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞান বলে কথা। কত কষ্ট করে কত সমস্যা নিয়ে এসেছে তারা। হুজুরের দোয়া পড়া পানি না নিয়ে আজ কেউ ফিরবেই না!

ইউসুফ তো বটেই, রুনা আর জারা পর্যন্ত চরম বিরক্ত। একসময় মনে হলো, লোকজনের চাপে টিনের গেট ভেঙে যাবে। রীতিমতো ঘামতে লাগলেন ইউসুফ। এখানকার থানার ওসির ছেলে তার স্কুলে পড়ে। সেই সূত্রে ওসির সঙ্গে পরিচয়। তাকে ফোন দিয়ে নিজের দুরবস্থার কথা জানালেন তিনি।

মিনিট পনেরো পর একজন এএসআই দুজন কনস্টেবল নিয়ে হাজির। তারা লোকজনকে সরাতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। ডাণ্ডা মারলেও কাজ হবে না। হুজুরের পানিপড়া চাই। পুলিশ তিনজন গুঁতোগুঁতি করে লোকজনকে লাইনে দাঁড় করাতে সক্ষম হলো।

এএসআই আজিম ভেতরে এসে বললেন, ‘আপনি এক কাজ করেন, স্যার। এরা যখন এত আশা নিয়া আসছে, আজকের মতো ফুঁ দিয়া দেন। কালকে ব্যাপারটা আমরা দেখব। কাল এক বেটাও আপনার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারবে না।’

মানুষ বুজরুকি করে দুপয়সার ধান্ধায়, আর ইউসুফকে করতে হচ্ছে নিজেকে রক্ষায়। কপালে এ–ও ছিল!

উঠানে একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন তিনি। এক কনস্টেবল তার মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরল। বাইরে দাঁড়ানো লোক সব একে একে হৃষ্ট চিত্তে পানিপড়া নিয়ে যেতে লাগল। কারও সন্তান হয় না, কারও বউ টেকে না, কারও মেয়ের বিয়ে হয় না, কারও ছেলের চাকরি হয় না—এই সব। এ ছাড়া শারীরিক আর মানসিক নানা সমস্যা তো আছেই।

পানি পড়া দিতে দিতে হয়রান ইউসুফ। একপর্যায়ে খয়রাতি জীবন কাটানো মাজারের ফকিরের মতো মনে হলো নিজেকে। ‘ধুত্তোরি’ বলে উঠে পড়লেন তিনি।

এএসআই আজিম একতাড়া নোট নিয়ে রুনার কাছে হাজির। বললেন, ‘চাচিআম্মা, এইখানে ১১ হাজার ৫০০ আছে। প্রথম দিন হিসেবে মন্দ না। স্যারে একটু ধৈর্য ধইরা চালাইয়া যাইতে পারলে এই বছরই ইনশাল্লাহ আলিশান দালান তুলতে পারবেন।’

রুনার দাঁত বেরিয়ে পড়ল। মাথায় আঁচল টেনে নোটগুলো নিয়ে গুনতে শুরু করলেন।

আজিম বাইরে এসে ঘোষণা দিলেন, হুজুর এখন বিশ্রাম নেবেন। আজ আর দোয়া পড়া হবে না। ফেরার সময় একজন কনস্টেবল উসখুস করতে করতে বলেই ফেলল, ‘এত্তগুল্যা টেকা, স্যার। আমরা তো...’

আজিম তার মুখের ওপর হাতচাপা দিলেন। বললেন, ‘সব জায়গায় এই সব চলে না। স্বপ্নে জ্ঞান পাওয়া মানুষ। এক্কেরে ছারখার হইয়া যাইবি!’

এদিকে ইউসুফের মাথা ভোঁ ভোঁ। কাল রাতে খাওয়া হয়নি। সকালে যাও–বা গুড়–মুড়ি ও চা খাচ্ছিলেন, বাগড়া দিয়েছে পানিপড়া নিতে আসা হতভাগারা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে নির্ঘাত তাকে পালাতে হবে।

বাবার বেগতিক অবস্থা দেখে জারা চট করে কয়েকটা সেদ্ধ আলু পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে চটকে ভাত নিয়ে এল। সঙ্গে একটা ডিমও ভেজে দিল। ক্ষুধার্ত ইউসুফ গাপুস-গুপুস করে নিমেষে সব সাবাড় করে দিলেন।

রুনা বারবার টাকা গুনছেন। এএসআই আজিম যে অঙ্ক বলেছেন, এর চেয়ে কিঞ্চিৎ কম দেখা যাচ্ছে। দু-একটা নোট কোথাও পড়ে গেছে নাকি? তিনি যে খুঁজে দেখবেন, সে সুযোগ দিল না তার ছোট ভাই মোকাদ্দেস। ফোন করে বলে, ‘তোদের ওদিকে নাকি এলিয়েন পাওয়া গেছে, ছোটপা?’

‘এলিয়েন! সেটা আবার কী রে?’

‘আরে, জাভেদ নামে কোন এক মাস্টরের পোস্টে আছে। খবরটা দুনিয়াজুড়ে ভাইরাল হইয়ে গেল, তুমি এখনো এলিয়েনই চিনো না! কোন দুনিয়ায় আছ?’

‘আমার এত চিননের কাম নাই। তুই জলদি আইসা পড়। তোর দুলাভাইয়ের মধ্যে কী য্যান নাজিল হইছে। সবাই কয় স্বপ্নে পাওয়া জ্ঞান। পানিপড়ার লাইগা আইজ লাইন পইড়া গেছিল। তুই জলদি আইসা পড়। এই সব সামলাইতে হইব।’

ভ্যাগাবন্ড মোকাদ্দেস নম্বর ছাড়া বেকুব। বাবার ধরিয়ে দেওয়া ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বেলে বেকার জীবন কাটাচ্ছিল। কাঁচা টাকার গন্ধ পেয়ে তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কিছু না ভেবেই ব্যাগে কয়েকটা জামাকাপড় ভরে ট্রেনে করে রওনা হয়ে গেল।

ভোররাতে টিনের গেটে ঠং ঠং আঘাতে ঘুম ভেঙে গেল সবার। ইউসুফ ভাবলেন, অপোগণ্ডের দল আবার জ্বালাতে এসেছে। রুনা দ্রুতপায়ে গেলেন গেট খুলতে। কে আর? মোকাদ্দেস!

রাতভর নির্ঘুম থেকে মোকাদ্দেস ক্লান্ত। কিন্তু কে করে কেয়ার? ছোট আপার কাছে পুরো ঘটনাটা আগে জেনে নিল সে। নিমেষে তার ভোলাভালা দুলাভাই ‘পানিপড়া হুজুরে’ পরিণত হলো। আর এ হুজুর মানে টাকার খনি, কাঁচা টাকার বিরাট ব্যবসা।

কিন্তু এ হুজুর তো যেখানে-সেখানে বসে পানিপড়া দিতে পারেন না। উঠানের কোথায় তার ‘তখত-তাউস’ হবে, এ নিয়ে ভাইবোনের সলাপরামর্শ চলতে লাগল। বাইরে বিশাল একটা শামিয়ানা লাগবে। অপেক্ষমাণ লোকদের বসাতে হবে না? সাজসজ্জায় একটা ভালো ডেকোরেটর লাগবে। হুজুরের আচকান-পাগড়িও তো লাগবে। মুখে মুখে খরচার বহর হাজার বিশেক ছাড়িয়ে গেল।

রুনা এ পর্যায়ে রুষ্ট হয়ে ছোট ভাইকে একটা ধমক দিলেন। বললেন, ‘বাবা মিছা বলে না, তুই আসলেই একটা ভাদাইম্যা! ইনকাম না হইতে হইতে খরচার ফর্দ! দূর অ!’

মোকাদ্দেসও দমবার ছেলে নয়। এক কিপটে বন্ধুর কাছ থেকে শ চারেক টাকা ধার করে এত দূর কি আর এমনি এমনি এসেছে? এদের গাঁট না খসালে পকেট ভরবে কী করে?

মোকাদ্দেস বলল, ‘দুনিয়ার কোনো ব্যবসাই ইনভেস্ট ছাড়া হয় না। টেকা ঢালবা না, তো ইনকামও গরিবি থাকব। মালদার আদমি পাইবা না।’

বোনকে অনেক বুঝিয়ে গেটের বাইরে একটা শামিয়ানা টাঙাতে রাজি করাতে পারল মোকাদ্দেস। দিনের আলো ফুটতে না–ফুটতে কিছু টাকা নিয়ে ডেকোরেটরের খোঁজে রওনা দিল সে।

শিগগিরই মোকাদ্দেস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। গোটা এলাকা রেইড করেছে পুলিশ। এলিয়েনের খোঁজে এসেছে সরকারের একটি বিশেষ দল। এই এলাকা থেকে কেউ বেরোতে পারবে না। ঢুকতেও পারবে না। লকডাউন।

ওদিকে জাভেদ মাস্টার পড়ে গেছে বড্ড বেকায়দায়। ইউএনওর নেতৃত্বে পুলিশসহ পুরো একটা দল সাতসকালে তার বাসায় গিয়ে হাজির। ঢাকা থেকে বিশেষ ফরেনসিক দল এসে অনুসন্ধান চালাচ্ছে সেই কড়ইগাছতলে। ডিসি সাহেব সশরীরে থেকে সব তত্ত্বাবধান করছেন। সেখানে জরুরি তলব পড়েছে জাভেদের।

মুখ না ধুয়েই ইউএনওর গাড়িতে চেপে কড়ইতলে গেল জাভেদ। ডিসি সাহেব বললেন, ‘আপনার পাঠানো ছবির সঙ্গে প্রাথমিক মিল পাওয়া গেছে জাফনার সেই জঙ্গলের ছবির। এখানকার ঝোপঝাড় বলে দিচ্ছে, অচেনা কেউ এসেছিল। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে তা–ই মনে করছেন।’

এটুকু বলে ডিসি সাহেব এলিয়েনের বিষয়ে খোঁজখবর নিলেন। ওটা দেখতে কেমন, কথা কীভাবে হলো, কী বলে গেল। বিভিন্ন বই ঘেঁটে এলিয়েন সম্পর্কে ভালোই জানে জাভেদ। তাই আন্দাজে মেরে দিতে অসুবিধা হলো না। কিন্তু ডিসি সাহেব যেই নাসার বিষয়টা তুললেন, জাভেদের পেটের ভেতর গুড়গুড় করতে লাগল।

এখান থেকে সে রকম রিপোর্ট গেলে শিগগিরই নাসা থেকে একটা টিম আসবে। এখানে তাঁবু ফেলবে তারা। তাদেরকে সর্বোতভাবে সহায়তা করতে হবে জাভেদকে। ডিসি সাহেব জাভেদের সঙ্গে বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন। ঠিক হলো, বেলা ১১টায় ডিসির অফিসে সংবাদ সম্মেলন হবে, সেখানে জাভদকে সামনে রেখে পুরো বিষয়টা তুলে ধরবেন ডিসি সাহেব।

চতুর জাভেদ টের পেল, তার থলের বিড়ালের এবার আর রক্ষা নেই। ডিসি সাহেবের কাছ থেকে কোনোমতে উতরে এসে পালাল সে। একেবারে পগারপার।

জাভেদের কেলেঙ্কারি রটতে সময় লাগল না। কিসের নাসার টিম আসবে, প্রতারণার অভিযোগে জাভেদের বিরুদ্ধে বরং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো। কিন্তু সে এখন দূর গাঁয়ে আত্মগোপন করেছে। মুসাফির সেজে আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধ এক কৃষকের ঘরে। কৃষকের এক মেয়ে বিধবা। তিন সন্তানের জননী। জাভেদের সঙ্গে তার বিয়ের আয়োজন করল কৃষক। নিরুপায় জাভেদ দেখল, আপৎকালীন সময়ে এ ছাড়া তার উপায়ও নেই। কোথায় যাবে?

সপ্তাহ দুয়েক পুলিশ আর গোয়েন্দাদের আনাগোনায় একরকম লকডাউন হয়ে রইল ওই এলাকা। বিপদে পড়ার ভয়ে এলিয়েন নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না। মাঝখান থেকে ইউসুফ বেঁচে গেলেন। হুজুরের দোয়া পড়ার জন্য আর কেউ এদিকে পা দিল না।

বেকার মোকাদ্দেস বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠল। একদিন সে রসিকতা করতে ইউসুফকে বলল, ‘আপনে তো সব দেখতে পান, দুলাভাই। আমার পেটের ভেতর কী আছে, দেখেন তো।’

ইউসুফ না তাকিয়েই বললেন, ‘তোর পেটের ভেতর ১০০টা শয়তান ঘুচুর ঘুচুর করতেছে। এইগুলা তোরে ধ্বংস করব।’

সেদিনই ভাগল মোকাদ্দেস।

দিন বসে থাকে না। বহতা নদীর মতো বয়ে যায়। কিছুদিন পর সব থিতু হয়ে গেল। ইউসুফ মাস্টার তার চোখের কেরামতি নিয়ে আর কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। নীরবে দেখেন, নীরবেই রেখে দেন সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। কিন্তু তাকে ঘাঁটানোর মতো লোকের কী অভাব?

সেদিন সাপ্তাহিক ছুটি। সকালের দিকে বাজারে গেছেন ইউসুফ মাস্টার। এক জায়গায় প্রচণ্ড হল্লা। কঠিন জটলা। ভাবলেন, গোল্লায় যাক, কী দরকার। পরে ভিড় ঠেলে ঠিকই আবার মাথা গলালেন। একেবারে সদু মেম্বারের চোখে চোখ।

মেম্বার ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘কী চান্দু, তুমি তো আন্ডারওয়্যারের ভেতরও টেকা দেখো। এইবার বলো, নুরা চোরা চেইনটা কোথায় লুকাইছে?’

এ তল্লাটের কুখ্যাত চোর নুরাকে ধরে আনা হয়েছে। অভিযোগ, সদ্য ইতালিফেরত যুবক মোস্তফার গলা থেকে সোনার চেইনটা ছিনতাই করেছে সে। বিদেশ থেকে এসে ফুরফুরে মেজাজে বাজার করছিল মোস্তফা, ভিড়ের মধ্যে আচমকা গলায় হ্যাঁচকা টান। নিমেষে চেইনটা গায়েব। কে নিয়েছে, কোনো চিহ্নই নেই।

ঘটনাচক্রে মেম্বারও এখন বাজারে। কিন্তু নুরা চেইনটা দিচ্ছে না। এই বেটার ওপর ইউসুফেরও রাগ রয়েছে। তার বাড়িতে হানা দিতে গিয়ে ধরা পড়েছিল বটে, তবে শাস্তিটা সেভাবে হয়নি। পুলিশের কবজা থেকে অল্পেই ছাড়া পেয়েছে। আজ বেটাকে একহাত নেওয়া যাবে।

মেম্বার সদু বললেন, ‘কী মাস্টার, চুপ কইরা আছ ক্যান? দেখো, চেইন কোথায় রাখছে?’

স্বর্ণের দামি চেইন খুইয়ে বেকুব বনে গেছে মোস্তফা। ফরসা চেহারাটা লালচে দেখাচ্ছে। মেম্বারের সমর্থনে তার গলায়ও বেশ জোর, ‘জলদি চেইন ফালা, বেটা। নইলে একটা কিলও মাটিতে পড়ব না।’

নুরা কাতর সুরে বলল, ‘চেইন আমি নিই নাই, ভাইজান। বিশ্বাস করেন, চুরিদারি ছাইড়া দিছি। মাইয়াডা বড় অইছে। অর বিয়া দিতে অইব না?’

একটা হাসির ঝড় উঠল। এর সঙ্গে একগাদা কটুকাটব্য যোগ হলো।

এ সময় ইউসুফ মাস্টার সরব হলেন। বললেন, ‘নুরাকে ছাইড়া দেও, মেম্বার। চেইন আসলে সে নেয় নাই।’

‘কে নিছে?’

‘আমার সাথে একটু দূরে আসো, কানে কানে বলছি।’

সদু মেম্বার ইউসুফের পিছু পিছু এগোলেন। খানিকটা দূরে গিয়ে বললেন, ‘আর রঙ্গ কইরো না, মাস্টার। বলো, কী বলতে চাও।’

‘চেইন তো দেখলাম তোমার পেটের ভিতর জ্বলজ্বল করতেছে। এই রকম আস্ত চেইন গিললা ক্যামনে? ধিক তোমারে, জনপ্রতিনিধি হইয়া সামান্য একটা স্বর্ণের চেইনের লোভও সামলাইতে পারো না! যাও, বাইর কইরা দিয়া আসো।’

চার্জ ফুরানো রোবটের মতো স্থির হয়ে গেলেন সদু মেম্বার। তার দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ইউসুফ মাস্টার। লোকটার গায়ে এত সুন্দর পোশাক, তবু যেনো কিছু নেই। মেম্বারের সবই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তিনি। এমন মানুষের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ সরিয়ে ঘুরে রওনা হয়ে গেলেন ইউসুফ মাস্টার।(গত সংখ্যায় পর)

ঘণ্টাখানেক ঘুমালেন ইউসুফ মাস্টার। চোখ মেলে দেখেন ঘর অন্ধকার। মাথায় হাত বোলাচ্ছেন রুনা। গালে গরম নিশ্বাস পড়ছে তার। তিনি মনে মনে বললেন, বিকেলে কড়ইগাছতলে কিছু দেখেননি। তার চোখেও কিছু ঘটেনি। আর কয়েক বছর পর অবসরে যাবেন তিনি। অবাস্তব কোনো চমক নিয়ে কাটাতে চান না এ সময়।

রুনা বললেন, ‘যাও, বাজার থিকা ঘুইরা আসো। মনটা ভালো হইব। কিছু জিনিসও আনা দরকার।’

খানিক পর রুনার দেওয়া লিস্ট আর চটের থলে নিয়ে বাজারে গেলেন ইউসুফ মাস্টার। কাছেই বাজার। হেঁটে যেতে মিনিট দশেক লাগে। সান্ধ্য বাজারে তাজা কিছু মাছ জোটে। নদীতে জাল ফেলে ধরে আনা মাছ। এক জেলে বড় কিছু তাজা ট্যাংরা নিয়ে বসেছে। লাফাচ্ছে মাছগুলো। দেখলেই শান্তি। বাড়ির পেছনের আঙিনায় গজানো নতুন ডাঁটার সঙ্গে জমবে বেশ। ট্যাংরার পাশে আরেক জেলের চেটাল থালায় পেট চিতিয়ে পড়ে আছে ইয়া বড় এক পাঙাশ। হাপরের মতো কানকো নাড়ছে। জীবনভর এসব মাছ শুধু দেখেই গেলেন, খাওয়া আর হলো না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্যাংরার দরদাম শুরু করলেন ইউসুফ মাস্টার। এমন সময় পাঙাশের সামনে এসে দাঁড়াল একজন। গায়ে লম্বা ঝুলের সিল্কের পাঞ্জাবি। মাস্টারকে দেখেই কাঁধে একটা থাবড়া মারলেন তিনি।

‘কী মাস্টার, খবর কী তোমার?’

ইউসুফ ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন সদু মেম্বার। ক্লাস টেন পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছেন তারা। আগে তুই-তোকারির সম্পর্ক দিল। গলাগলি ধরে হাঁটতেন। এখন তুমি-তুমি, সামাজিক দূরত্বও বেড়েছে।

পলকা হাসি দিয়ে ইউসুফ মাস্টার বলেন, ‘আমার আবার খবর কী? আগেও যা, এখনো তা–ই। নতুন নতুন খবর তো সব তোমাদেরই।’

‘অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয় না, কথা হয় না। চলো, কোথাও বইসা চা খাই।’

সদু মেম্বার যে ধাঁচের মানুষ, তার সঙ্গে চা খাওয়াটা ইউসুফের জন্য মোটেও রুচিকর নয়। এরপরও এমন আহ্বানে না করা যায় না। তার সঙ্গে ছোটবেলার সেই সব দিন মনে পড়ে যাচ্ছে। নদীতে নাইতে নেমে অনেক ঝাঁপাঝাঁপি করতেন তারা। দূর থেকে দৌড়ে এসে নদীর পাড় থেকে ডিগবাজি দিয়ে পানিতে পড়তেন। এ কাজে খুব পাকা ছিলেন ইউসুফ। সদু আর অন্য বন্ধুরা তাকে ঈর্ষা করতেন। ইউসুফের ডিগবাজি দেওয়ার দিন শেষ সেই কবেই। কিন্তু সদু মেম্বার এই শুকনো ডাঙাতেই কত ডিগবাজি দিচ্ছেন!

একটা চায়ের দোকানের দিকে এগোলেন দুজন। ইউসুফ খেয়াল করলেন, সদু মেম্বার একটু কেমন করে যেন হাঁটছেন। চোষ পাজামাটা কি খুব টাইট হয়েছে? এমন আঁটো জিনিস পরার দরকারটা কী?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সদু মেম্বারের আপাদমস্তক জরিপ করলেন ইউসুফ। স্যাঁত করে স্বচ্ছ হয়ে গেল তার কায়া। সদুর অন্তর্বাসে এক হাজার টাকার নোটের আস্ত একটা বান্ডিল। এত জায়গা থাকতে আন্ডারওয়্যারে টাকা কেন?

ইউসুফ মাস্টারকে বাইরে দাঁড় করিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন সদু মেম্বার। নিজেই দুকাপ চা এনে একটা ধরিয়ে দিলেন মাস্টারের হাতে।

‘মাস্টার, তুমি খালি আমারে অ্যাভয়েড কইরাই গেলা। একটা দিনও বন্ধুর প্রচারে পাইলাম না।’

ইউসুফ এতক্ষণে খুঁজে পেলেন তাকে হঠাৎ এত খাতির করার কারণ। ইলেকশন সন্নিকটে। তাকে প্রচারে লাগানোর মতলব।

‘কী মাস্টার, চুপ ক্যান? কিছু একটা বলো?’

‘আমি শিক্ষক মানুষ। ছাত্র পড়ানো ছাড়া আর কিছু জানি না। আমারে প্রচারে নামাইলে তোমার ভরাডুবি হইব।’

‘আরে, প্রচারে তো তোমার মতো ভালো মানুষই দরকার। তুমি যা বলবা, সবাই তা বিশ্বাস করব।’

‘কী বলব?’

‘বলবা যে সবাই যা ভাবে, আমি তা না। আমি রিলিফের গম চোর না।’

মুখের ওপর ফস করে কথা বলে বেকুব বনে যাওয়ার বাতিক আছে ইউসুফ মাস্টারের। তিনি বুলেটের মতো বলে ফেললেন, ‘গম চোর না হইলে তোমার আন্ডারওয়্যারের মধ্যে টাকার বান্ডিল ক্যান?’

সদু মেম্বারের কাপ ধরা হাতটা এমনভাবে কেঁপে উঠল, খানিকটা চা ছলকে পড়ল মাটিতে। তবে চট করে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ায় সুপটু তিনি। মুখে কপট হাসি টেনে বললেন, ‘এই বয়সে তো ভালোই রঙ্গ করতে পারো, বন্ধু! তবে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় আনা উচিত না? এইটা কোনো কথা!’

ইউসুফ মাস্টার দাঁত বের করে বললেন, ‘আমি পরিষ্কার দেখতে পাইতেছি, বন্ধু। কোনো ভুল নাই। সব এক হাজার টাকার নোট!’

মেম্বারের হাত থেকে চায়ের কাপটা এবার পড়ে গেল। বন্ধুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। মাস্টার এটা জানল কী করে?

ইউসুফ মাস্টার বড় কয়েকটা চুমুকে চা শেষ করলেন। দোকানে কাপ রেখে এসে বললেন, ‘যাই, বন্ধু। আমার একটু তাড়া আছে। চা খাওয়ানোর জন্য ধন্যবাদ।’

এই বলে ট্যাংরা কিনতে পা বাড়ালেন ইউসুফ। মনে মনে মাস্টারকে খুব কঠিন একটা গাল দিলেন মেম্বার। তার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাওয়া নিয়ে শোরগোল উঠেছে। কাপটা তুলতে ছুটে এসেছে দোকানের ছোকরা। তার গালে চড় দিলেন মেম্বার।

‘এই বেটা, কী দিয়া চা বানাইছস! আমার পেটে বড় একটা ঘোঁটা মারছে। এখন বাড়ি পর্যন্ত যাইতে পারি কি না!’

বাজার সেরে বাড়ি ফিরে একদম চুপ মেরে গেলেন ইউসুফ মাস্টার। কী যে একটা ল্যাঠা বাগিয়েছেন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তিনি। মানুষের সবকিছু দেখা ঠিক নয়।

পরদিন স্কুলে যেতেই হেডমাস্টার আকবর হোসেন তাকে ডেকে পাঠালেন। ইউসুফ একটু অবাক হলেন। হেড স্যার তাকে তেমন পছন্দ করেন না। দপ্তরি ফজল মিয়ার কাছে শুনছেন, হেডমাস্টার কখনো তাকে তলব করার সময় আদেশ করেন, ‘বেকুবটাকে ডাকো তো।’ আজও নিশ্চয়ই বলেছেন।

প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকে কিছুটা রুষ্ট হলেন ইউসুফ। জাভেদ বসে আছে একটা চেয়ারে। ওকে আবার আনা হয়েছে কেন? তার মুখে ফিচলে হাসি।

ইউসুফকে মুখোমুখি চেয়ারটায় বসতে বললেন হেড স্যার। বললেন, ‘কাল রাতে মেম্বার সাহেবের সঙ্গে কী একটা ঝামেলা নাকি করেছেন?’

‘ঝামেলা!’

‘হ্যাঁ, মেম্বার সাহেব তো ফোনে আমারে তা–ই বললেন। এরা হইল সমাজের মাথা। এদের সাথে কোনো গোলমাল করবেন না।’

ইউসুফ মাস্টার ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন, ‘গোলমাল কিছু করি নাই, স্যার। মেম্বারের আন্ডারওয়্যারে এক হাজার টাকার নোটের একটা বান্ডিল ছিল, সেটা আমি দেখে ফেলেছি। আর সে কথা মেম্বারকে বলতেই...’

কথা শেষ করার আগেই হাসি এসে গেল তার। চেহারাটা কঠিন হয়ে গেল আকবর হোসেনের। বললেন, ‘ঝামেলা তো ভালোই পাকাইছেন, দেখছি! একটা মানুষের ওই স্থানে টাকা থাকলে আপনার সমস্যা কী? আর ওটা আপনি দেখলেনই–বা কী করে? এই বয়সে ফাইজলামি ভালো না।’

এবার ইউসুফের চোয়ালও শক্ত হয়ে গেল। বললেন, ‘ফাইজলামি আমি করি নাই, স্যার। কাল থেকে আমি অনেক কিছু দেখতে পাই। এই যেমন আপনার এই পাঞ্জাবির ভেতর গলায় ঝোলানো তামার তাবিজটা দেখতে পাচ্ছি।’

অজান্তেই আকবর হোসেনের হাত চলে গেল বুকের ওপর, যেখানে তাবিজটা ঝুলছে। স্কুলে সবাই তাকে বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক শিক্ষক বলে জানে। এই বেকুবটা দেখা যাচ্ছে আসল গোমর জেনে ফেলেছে।

টেবিলের এক পাশে রাখা ব্যাগটা দেখিয়ে আকবর হোসেন বললেন, ‘এই ব্যাগের ভেতর কী আছে, বলেন তো?’

জাভেদের দিকে একবার তাকালেন ইউসুফ। তার চোখে পরিষ্কার চ্যালেঞ্জ, পারলে খেল দেখাও চাঁদু!

ইউসুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ব্যাগটার দিকে। চোখ দুটো সরু হয়ে এল।

হেড স্যার জানেন, এই বেকুবের বুজরুকি এবার বের হয়ে যাবে। তিনি তাড়া দিলেন, ‘কী, কিছু দেখতে পাচ্ছেন, ইউসুফ?’

‘জি, স্যার। ভেতর আপনার জন্য প্লাস্টিকের তিনটা বাটিতে দুপুরের খাবার দিয়েছেন ভাবি। শোল মাছের ঝোল আর ডাল আছে। বেগুন ভাজা আছে ভাতের ওপর।’

‘কী সাংঘাতিক!’

প্রবল উত্তেজনা চেপে রাখতে পারলেন না হেড স্যার। বললেন, ‘কোনো নজ্জুমি কিতাব পেয়েছেন নাকি, যা আপনার দিব্য চোখ খুলে দিয়েছে?’

‘জানি না, স্যার।’

‘এটা কীভাবে সম্ভব?’

কাল বিকেলে কড়ইগাছতলে ঘটা সেই ঘটনাটা অবলীলায় বলে গেলেন ইউসুফ। হেড স্যার চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?’

জাভেদ ঘাড় চুলকে বলল, ‘কী জানি, স্যার। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।’

জাভেদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন ইউসুফ। তার শার্টের বুকপকেটে একটা চিরকুট। যা লেখা আছে, গড় গড় করে পড়ে গেলেন তিনি, ‘আজ যেন গুড় আনতে ভুল না হয়। নারকেল কুড়িয়ে রেখেছি।’

এটুকু বলে থামলেন ইউসুফ। ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘কী জাভেদ, তোমার বউ তো মনে হয় পায়েস করব। গুড় নিতে আইজ ভুইলো না কিন্তু।’

লজ্জায় লাল হয়ে গেল জাভেদ। এই লোক নিচের দিকে তাকালে তো সর্বনাশ! হেড স্যার হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘যা অর্জন করেছেন, তা আপনার মধ্যেই থাকুক, ইউসুফ। এ নিয়ে আর কারও সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। স্কুলের ছেলেরা একটা হইচই বাধাইয়া দিব। মানুষ ছুইটা আসব। বিরাট সিন ক্রিয়েট হবে।’

‘জি, স্যার। আর কাউকে বলব না।’

এবার জাভেদের দিকে ফিরলেন হেড স্যার।

‘আর জাভেদ, আপনিও মুখ বন্ধ রাখবেন। এবার আপনারা যান।’

ইউসুফ আর জাভেদ একসঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, পেছন থেকে আকবর হোসেন ডাকলেন, ‘ইউসুফ, একটু শোনেন।’

থেমে গেলেন ইউসুফ। জাভেদও দাঁড়াল। হাত নেড়ে তাকে যেতে বললেন হেড স্যার। বেরিয়ে গেল সে। এবার ইউসুফকে ইশারায় কাছে ডাকলেন তিনি। ইউসুফ গেলেন এগিয়ে।

‘আচ্ছা, আপনি সত্যিই কোনো কিছু পেয়েছেন, ইউসুফ? নাকি স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞান? সত্যি কথা বলবেন।’

‘যা ঘটেছে, বলেছি। বিশ্বাস করা না–করা আপনার ব্যাপার, স্যার। ইচ্ছা করলে কড়ইগাছতলে গিয়া দেইখা আসতে পারেন।’

‘না, এর কোনো দরকার নাই।’

এই বলে ইতস্তত করতে লাগলেন আকবর হোসেন।

‘আর কিছু বলবেন, স্যার?’

‘না, বলছিলাম যে আপনার এই গুণটা হস্তান্তরযোগ্য কি না। মানে ট্রান্সফার করা যায়?’

হেড স্যার আসলে কী বলতে চান? কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলেন ইউসুফ।

আকবর হোসেন বললেন, ‘ট্রান্সফার করা গেলে আমাকে দেন। নগদ পাঁচ লাখ টাকা দেব। আমার অনেক কষ্টের সঞ্চয়।’

‘এটা দিয়ে আপনি কী করবেন, স্যার?’

‘আর কিছু দিন পরই তো রিটায়ারে যাব। তখন এই বিদ্যা কাজে লাগাব। সময় কাটবে, কিছু পয়সাও আসবে।’

‘কিন্তু আমার মনে হয় না এটা ট্রান্সফার করা যায়।’

আকবর হোসেন বেজার হয়ে বসে রইলেন। এর মধ্যে ঘণ্টা পড়ে গেছে। অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে ইউসুফও গিয়ে দাঁড়ালেন অ্যাসেম্বলিতে। ছাত্রদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’

জাভেদের মনটা আজ বড়ই উড়ু উড়ু। ক্লাসে মোটেও মন বসাতে পারছে না। বয়োজ্যেষ্ঠ ইউসুফকে কাল ভর্ৎসনা করলেও এলিয়েনকে নিয়ে ওই টিভি রিপোর্টিং সে দেখেছে। এলিয়েন নিয়ে তার আগ্রহও কম নয়, তা বাইরে যতই নির্বিকার ভাব দেখাক না কেন। এ জন্য ইউসুফের ওই কড়ইগাছটা তাকে চুম্বকের মতো টানছে। সেখানে একবার ঢুঁ না মারলেই নয়। যেহেতু ইউসুফের বাড়িতে কয়েকবার যাওয়া হয়েছে, জায়গাটা সে খুব ভালো করেই চেনে।

টিফিন পিরিয়ডে আর থাকতে পারল না জাভেদ। সবার নজর এড়িয়ে সেই কড়ইগাছতলে গিয়ে হাজির। মোটেও মিথ্যা বলেননি ইউসুফ। সত্যিই কিছু ঝোপ কুঁকড়ে নেতিয়ে আছে। পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন। তেলপোড়া একটা ঝাঁজ আছে জায়গাটায়। জাফনার সেই জঙ্গুলে স্থানের সঙ্গে অনেকটা মিল।

স্মার্টফোনের ক্যামেরায় পটাপট কিছু ছবি তুলল জাভেদ। দুকথা লিখে ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট দিল। নাসার ই-মেইল ঠিকানা আছে তার কাছে। এবার কাজে লাগল সেটা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কয়েকটা লাইন লিখে পাঠিয়ে দিল একগাদা ছবি। বিজ্ঞান জাদুঘরও বাদ রইল না।

স্কুল শেষে ইউসুফ বাড়ি ফিরে দেখেন, এলাহি কাণ্ড। উঠানের এক কোণে বাজার-সওদার বিশাল স্তূপ। রুনা এসে নাচন দিয়ে জানালেন, সদু মেম্বার একটা রিকশা–ভ্যানে করে এসব পাঠিয়েছেন। সঙ্গে পাঁচ কেজি ওজনের রুইও আছে। স্বামীকে দেখাবেন বলে এখনো কাটা হয়নি।

জারার মধ্যে সে রকম আনন্দ নেই। বাবাকে ভালো করেই চেনে ও। কাজেই মেম্বারের প্রতি মনে মনে রুষ্ট। তিনি ঘরের মধ্যে একটা ঝামেলা তৈরি করতেই এসব পাঠিয়েছেন।

ঝামেলা কিন্তু সত্যিই বেধে গেল। ভ্যানটা অমনি ফেরত পাঠানো হলো না কেন, এ নিয়ে রাগারাগি করতে লাগলেন ইউসুফ।

রুনাও পাল্টা খেপে গেলেন। বললেন, ‘কেউ খুশিমনে উপহার পাঠালে ফেরত দেওয়া যায়! আর উনি তোমার বাল্যবন্ধু না?’

এভাবে লেগে গেল দুজনের। মা–বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে একসময় হাল ছেড়ে দিল জারা। কথায় কথায় অনেক রাত হলো। ইউসুফ মাস্টার না খেয়েই ঘুমাতে গেলেন। রুনাও খেলেন না।

ইউসুফের মন স্বচ্ছ সাদা সরোবর। রাগ যত কঠিন হোক, এখানে জমাট থাকতে পারে না। বরফের মতো গলে যায়।

পরদিন ভোরে নরম মেজাজ নিয়ে জেগে উঠলেন তিনি। আজ শুক্রবার। ছুটি। সারা সপ্তাহে নিজের মতো করে কাটানোর জন্য একটা মাত্র দিন। তাই কোনো গোলমাল নয়।

রুনা যেই গুড়–মুড়ি আর চায়ের কাপ নিয়ে এলেন, সুবোধ বালকের মতো নিলেন তিনি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে পুরোনো দিনের গানের একটা সুর ভাঁজতে লাগলেন, ‘পোড়া চোখ, কেন তুই অন্ধ থাকিস না...’

বাড়ির সামনে একটা শোরগোল ইউসুফের গুনগুন থামিয়ে দিল। চা-গুড়–মুড়ি রেখে বেরোলেন তিনি। বেশ কয়েকজনের জটলা। ইউসুফকে দেখে ঘিরে ধরল তারা। সবাই নিম্নশ্রেণির মানুষ।

একজন বলল, ‘এইটা কি ইউসুফ উদ্দিন হুজুরের বাড়ি?’

‘কেন?’

আরেকজন বলল, ‘দয়া কইরা হুজুররে একটু ডাকেন।’

তার কথা বলার ঢঙে একটু খেপে গেলেন ইউসুফ। ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, ‘এত হুজুর হুজুর করছেন কেন? আমিই ইউসুফ উদ্দিন। কী বলবেন, বলেন?’

কানাঘুষা শুরু হলো তাদের। এই লোককে মোটেও ইউসুফ উদ্দিন হুজুর মনে হচ্ছে না। তার টুপি আর দাড়ি কই?

ইউসুফ ধমকের সুরে বললেন, ‘ইউসুফ উদ্দিনকে দিয়ে আপনারা আসলে কী করবেন, বলেন? কী দরকার তাকে?’

একজন বড় কাতর কণ্ঠে বলল, ‘শুনলাম তাইনে স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞান অর্জন করছেন। আমরা হুজুরের দোয়া পড়া পানি নিতে আইছি।’

ইউসুফ এতক্ষণে খেয়াল করলেন, সবার হাতেই ছোট-বড় বোতল আর কন্টেইনার। কোনোটা কাচের, কোনোটা প্লাস্টিকের। কী সর্বনাশ ঘটেছে, ভালো করেই টের পেলেন তিনি। আক্রোশবশে বিড়ম্বনায় ফেলতে তার নামে কেউ এসব রটিয়েছে। মেম্বার হতে পারে, আবার হেড স্যারও হতে পারেন। জাভেদকেও বিশ্বাস নেই।

ইউসুফ গলার রগ ফুলিয়ে একটা হুংকার দিলেন, ‘আমি কোনো হুজুর-টুজুর না। একজন স্কুলটিচার। দোয়া আমি জানি না।’

এই বলে দড়াম করে বাড়ির টিনের গেটটা বন্ধ করে দিলেন। এতে কোনো কাজ হলো না। বরং সময় যত গড়াতে লাগল, বাড়ির সামনে লোকজনের চাপ আরও বাড়তে লাগল। স্বপ্নে প্রাপ্ত জ্ঞান বলে কথা। কত কষ্ট করে কত সমস্যা নিয়ে এসেছে তারা। হুজুরের দোয়া পড়া পানি না নিয়ে আজ কেউ ফিরবেই না!

ইউসুফ তো বটেই, রুনা আর জারা পর্যন্ত চরম বিরক্ত। একসময় মনে হলো, লোকজনের চাপে টিনের গেট ভেঙে যাবে। রীতিমতো ঘামতে লাগলেন ইউসুফ। এখানকার থানার ওসির ছেলে তার স্কুলে পড়ে। সেই সূত্রে ওসির সঙ্গে পরিচয়। তাকে ফোন দিয়ে নিজের দুরবস্থার কথা জানালেন তিনি।

মিনিট পনেরো পর একজন এএসআই দুজন কনস্টেবল নিয়ে হাজির। তারা লোকজনকে সরাতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। ডাণ্ডা মারলেও কাজ হবে না। হুজুরের পানিপড়া চাই। পুলিশ তিনজন গুঁতোগুঁতি করে লোকজনকে লাইনে দাঁড় করাতে সক্ষম হলো।

এএসআই আজিম ভেতরে এসে বললেন, ‘আপনি এক কাজ করেন, স্যার। এরা যখন এত আশা নিয়া আসছে, আজকের মতো ফুঁ দিয়া দেন। কালকে ব্যাপারটা আমরা দেখব। কাল এক বেটাও আপনার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারবে না।’

মানুষ বুজরুকি করে দুপয়সার ধান্ধায়, আর ইউসুফকে করতে হচ্ছে নিজেকে রক্ষায়। কপালে এ–ও ছিল!

উঠানে একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন তিনি। এক কনস্টেবল তার মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরল। বাইরে দাঁড়ানো লোক সব একে একে হৃষ্ট চিত্তে পানিপড়া নিয়ে যেতে লাগল। কারও সন্তান হয় না, কারও বউ টেকে না, কারও মেয়ের বিয়ে হয় না, কারও ছেলের চাকরি হয় না—এই সব। এ ছাড়া শারীরিক আর মানসিক নানা সমস্যা তো আছেই।

পানি পড়া দিতে দিতে হয়রান ইউসুফ। একপর্যায়ে খয়রাতি জীবন কাটানো মাজারের ফকিরের মতো মনে হলো নিজেকে। ‘ধুত্তোরি’ বলে উঠে পড়লেন তিনি।

এএসআই আজিম একতাড়া নোট নিয়ে রুনার কাছে হাজির। বললেন, ‘চাচিআম্মা, এইখানে ১১ হাজার ৫০০ আছে। প্রথম দিন হিসেবে মন্দ না। স্যারে একটু ধৈর্য ধইরা চালাইয়া যাইতে পারলে এই বছরই ইনশাল্লাহ আলিশান দালান তুলতে পারবেন।’

রুনার দাঁত বেরিয়ে পড়ল। মাথায় আঁচল টেনে নোটগুলো নিয়ে গুনতে শুরু করলেন।

আজিম বাইরে এসে ঘোষণা দিলেন, হুজুর এখন বিশ্রাম নেবেন। আজ আর দোয়া পড়া হবে না। ফেরার সময় একজন কনস্টেবল উসখুস করতে করতে বলেই ফেলল, ‘এত্তগুল্যা টেকা, স্যার। আমরা তো...’

আজিম তার মুখের ওপর হাতচাপা দিলেন। বললেন, ‘সব জায়গায় এই সব চলে না। স্বপ্নে জ্ঞান পাওয়া মানুষ। এক্কেরে ছারখার হইয়া যাইবি!’

এদিকে ইউসুফের মাথা ভোঁ ভোঁ। কাল রাতে খাওয়া হয়নি। সকালে যাও–বা গুড়–মুড়ি ও চা খাচ্ছিলেন, বাগড়া দিয়েছে পানিপড়া নিতে আসা হতভাগারা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে নির্ঘাত তাকে পালাতে হবে।

বাবার বেগতিক অবস্থা দেখে জারা চট করে কয়েকটা সেদ্ধ আলু পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে চটকে ভাত নিয়ে এল। সঙ্গে একটা ডিমও ভেজে দিল। ক্ষুধার্ত ইউসুফ গাপুস-গুপুস করে নিমেষে সব সাবাড় করে দিলেন।

রুনা বারবার টাকা গুনছেন। এএসআই আজিম যে অঙ্ক বলেছেন, এর চেয়ে কিঞ্চিৎ কম দেখা যাচ্ছে। দু-একটা নোট কোথাও পড়ে গেছে নাকি? তিনি যে খুঁজে দেখবেন, সে সুযোগ দিল না তার ছোট ভাই মোকাদ্দেস। ফোন করে বলে, ‘তোদের ওদিকে নাকি এলিয়েন পাওয়া গেছে, ছোটপা?’

‘এলিয়েন! সেটা আবার কী রে?’

‘আরে, জাভেদ নামে কোন এক মাস্টরের পোস্টে আছে। খবরটা দুনিয়াজুড়ে ভাইরাল হইয়ে গেল, তুমি এখনো এলিয়েনই চিনো না! কোন দুনিয়ায় আছ?’

‘আমার এত চিননের কাম নাই। তুই জলদি আইসা পড়। তোর দুলাভাইয়ের মধ্যে কী য্যান নাজিল হইছে। সবাই কয় স্বপ্নে পাওয়া জ্ঞান। পানিপড়ার লাইগা আইজ লাইন পইড়া গেছিল। তুই জলদি আইসা পড়। এই সব সামলাইতে হইব।’

ভ্যাগাবন্ড মোকাদ্দেস নম্বর ছাড়া বেকুব। বাবার ধরিয়ে দেওয়া ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বেলে বেকার জীবন কাটাচ্ছিল। কাঁচা টাকার গন্ধ পেয়ে তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কিছু না ভেবেই ব্যাগে কয়েকটা জামাকাপড় ভরে ট্রেনে করে রওনা হয়ে গেল।

ভোররাতে টিনের গেটে ঠং ঠং আঘাতে ঘুম ভেঙে গেল সবার। ইউসুফ ভাবলেন, অপোগণ্ডের দল আবার জ্বালাতে এসেছে। রুনা দ্রুতপায়ে গেলেন গেট খুলতে। কে আর? মোকাদ্দেস!

রাতভর নির্ঘুম থেকে মোকাদ্দেস ক্লান্ত। কিন্তু কে করে কেয়ার? ছোট আপার কাছে পুরো ঘটনাটা আগে জেনে নিল সে। নিমেষে তার ভোলাভালা দুলাভাই ‘পানিপড়া হুজুরে’ পরিণত হলো। আর এ হুজুর মানে টাকার খনি, কাঁচা টাকার বিরাট ব্যবসা।

কিন্তু এ হুজুর তো যেখানে-সেখানে বসে পানিপড়া দিতে পারেন না। উঠানের কোথায় তার ‘তখত-তাউস’ হবে, এ নিয়ে ভাইবোনের সলাপরামর্শ চলতে লাগল। বাইরে বিশাল একটা শামিয়ানা লাগবে। অপেক্ষমাণ লোকদের বসাতে হবে না? সাজসজ্জায় একটা ভালো ডেকোরেটর লাগবে। হুজুরের আচকান-পাগড়িও তো লাগবে। মুখে মুখে খরচার বহর হাজার বিশেক ছাড়িয়ে গেল।

রুনা এ পর্যায়ে রুষ্ট হয়ে ছোট ভাইকে একটা ধমক দিলেন। বললেন, ‘বাবা মিছা বলে না, তুই আসলেই একটা ভাদাইম্যা! ইনকাম না হইতে হইতে খরচার ফর্দ! দূর অ!’

মোকাদ্দেসও দমবার ছেলে নয়। এক কিপটে বন্ধুর কাছ থেকে শ চারেক টাকা ধার করে এত দূর কি আর এমনি এমনি এসেছে? এদের গাঁট না খসালে পকেট ভরবে কী করে?

মোকাদ্দেস বলল, ‘দুনিয়ার কোনো ব্যবসাই ইনভেস্ট ছাড়া হয় না। টেকা ঢালবা না, তো ইনকামও গরিবি থাকব। মালদার আদমি পাইবা না।’

বোনকে অনেক বুঝিয়ে গেটের বাইরে একটা শামিয়ানা টাঙাতে রাজি করাতে পারল মোকাদ্দেস। দিনের আলো ফুটতে না–ফুটতে কিছু টাকা নিয়ে ডেকোরেটরের খোঁজে রওনা দিল সে।

শিগগিরই মোকাদ্দেস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। গোটা এলাকা রেইড করেছে পুলিশ। এলিয়েনের খোঁজে এসেছে সরকারের একটি বিশেষ দল। এই এলাকা থেকে কেউ বেরোতে পারবে না। ঢুকতেও পারবে না। লকডাউন।

ওদিকে জাভেদ মাস্টার পড়ে গেছে বড্ড বেকায়দায়। ইউএনওর নেতৃত্বে পুলিশসহ পুরো একটা দল সাতসকালে তার বাসায় গিয়ে হাজির। ঢাকা থেকে বিশেষ ফরেনসিক দল এসে অনুসন্ধান চালাচ্ছে সেই কড়ইগাছতলে। ডিসি সাহেব সশরীরে থেকে সব তত্ত্বাবধান করছেন। সেখানে জরুরি তলব পড়েছে জাভেদের।

মুখ না ধুয়েই ইউএনওর গাড়িতে চেপে কড়ইতলে গেল জাভেদ। ডিসি সাহেব বললেন, ‘আপনার পাঠানো ছবির সঙ্গে প্রাথমিক মিল পাওয়া গেছে জাফনার সেই জঙ্গলের ছবির। এখানকার ঝোপঝাড় বলে দিচ্ছে, অচেনা কেউ এসেছিল। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে তা–ই মনে করছেন।’

এটুকু বলে ডিসি সাহেব এলিয়েনের বিষয়ে খোঁজখবর নিলেন। ওটা দেখতে কেমন, কথা কীভাবে হলো, কী বলে গেল। বিভিন্ন বই ঘেঁটে এলিয়েন সম্পর্কে ভালোই জানে জাভেদ। তাই আন্দাজে মেরে দিতে অসুবিধা হলো না। কিন্তু ডিসি সাহেব যেই নাসার বিষয়টা তুললেন, জাভেদের পেটের ভেতর গুড়গুড় করতে লাগল।

এখান থেকে সে রকম রিপোর্ট গেলে শিগগিরই নাসা থেকে একটা টিম আসবে। এখানে তাঁবু ফেলবে তারা। তাদেরকে সর্বোতভাবে সহায়তা করতে হবে জাভেদকে। ডিসি সাহেব জাভেদের সঙ্গে বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন। ঠিক হলো, বেলা ১১টায় ডিসির অফিসে সংবাদ সম্মেলন হবে, সেখানে জাভদকে সামনে রেখে পুরো বিষয়টা তুলে ধরবেন ডিসি সাহেব।

চতুর জাভেদ টের পেল, তার থলের বিড়ালের এবার আর রক্ষা নেই। ডিসি সাহেবের কাছ থেকে কোনোমতে উতরে এসে পালাল সে। একেবারে পগারপার।

জাভেদের কেলেঙ্কারি রটতে সময় লাগল না। কিসের নাসার টিম আসবে, প্রতারণার অভিযোগে জাভেদের বিরুদ্ধে বরং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো। কিন্তু সে এখন দূর গাঁয়ে আত্মগোপন করেছে। মুসাফির সেজে আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধ এক কৃষকের ঘরে। কৃষকের এক মেয়ে বিধবা। তিন সন্তানের জননী। জাভেদের সঙ্গে তার বিয়ের আয়োজন করল কৃষক। নিরুপায় জাভেদ দেখল, আপৎকালীন সময়ে এ ছাড়া তার উপায়ও নেই। কোথায় যাবে?

সপ্তাহ দুয়েক পুলিশ আর গোয়েন্দাদের আনাগোনায় একরকম লকডাউন হয়ে রইল ওই এলাকা। বিপদে পড়ার ভয়ে এলিয়েন নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না। মাঝখান থেকে ইউসুফ বেঁচে গেলেন। হুজুরের দোয়া পড়ার জন্য আর কেউ এদিকে পা দিল না।

বেকার মোকাদ্দেস বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠল। একদিন সে রসিকতা করতে ইউসুফকে বলল, ‘আপনে তো সব দেখতে পান, দুলাভাই। আমার পেটের ভেতর কী আছে, দেখেন তো।’

ইউসুফ না তাকিয়েই বললেন, ‘তোর পেটের ভেতর ১০০টা শয়তান ঘুচুর ঘুচুর করতেছে। এইগুলা তোরে ধ্বংস করব।’

সেদিনই ভাগল মোকাদ্দেস।

দিন বসে থাকে না। বহতা নদীর মতো বয়ে যায়। কিছুদিন পর সব থিতু হয়ে গেল। ইউসুফ মাস্টার তার চোখের কেরামতি নিয়ে আর কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। নীরবে দেখেন, নীরবেই রেখে দেন সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। কিন্তু তাকে ঘাঁটানোর মতো লোকের কী অভাব?

সেদিন সাপ্তাহিক ছুটি। সকালের দিকে বাজারে গেছেন ইউসুফ মাস্টার। এক জায়গায় প্রচণ্ড হল্লা। কঠিন জটলা। ভাবলেন, গোল্লায় যাক, কী দরকার। পরে ভিড় ঠেলে ঠিকই আবার মাথা গলালেন। একেবারে সদু মেম্বারের চোখে চোখ।

মেম্বার ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘কী চান্দু, তুমি তো আন্ডারওয়্যারের ভেতরও টেকা দেখো। এইবার বলো, নুরা চোরা চেইনটা কোথায় লুকাইছে?’

এ তল্লাটের কুখ্যাত চোর নুরাকে ধরে আনা হয়েছে। অভিযোগ, সদ্য ইতালিফেরত যুবক মোস্তফার গলা থেকে সোনার চেইনটা ছিনতাই করেছে সে। বিদেশ থেকে এসে ফুরফুরে মেজাজে বাজার করছিল মোস্তফা, ভিড়ের মধ্যে আচমকা গলায় হ্যাঁচকা টান। নিমেষে চেইনটা গায়েব। কে নিয়েছে, কোনো চিহ্নই নেই।

ঘটনাচক্রে মেম্বারও এখন বাজারে। কিন্তু নুরা চেইনটা দিচ্ছে না। এই বেটার ওপর ইউসুফেরও রাগ রয়েছে। তার বাড়িতে হানা দিতে গিয়ে ধরা পড়েছিল বটে, তবে শাস্তিটা সেভাবে হয়নি। পুলিশের কবজা থেকে অল্পেই ছাড়া পেয়েছে। আজ বেটাকে একহাত নেওয়া যাবে।

মেম্বার সদু বললেন, ‘কী মাস্টার, চুপ কইরা আছ ক্যান? দেখো, চেইন কোথায় রাখছে?’

স্বর্ণের দামি চেইন খুইয়ে বেকুব বনে গেছে মোস্তফা। ফরসা চেহারাটা লালচে দেখাচ্ছে। মেম্বারের সমর্থনে তার গলায়ও বেশ জোর, ‘জলদি চেইন ফালা, বেটা। নইলে একটা কিলও মাটিতে পড়ব না।’

নুরা কাতর সুরে বলল, ‘চেইন আমি নিই নাই, ভাইজান। বিশ্বাস করেন, চুরিদারি ছাইড়া দিছি। মাইয়াডা বড় অইছে। অর বিয়া দিতে অইব না?’

একটা হাসির ঝড় উঠল। এর সঙ্গে একগাদা কটুকাটব্য যোগ হলো।

এ সময় ইউসুফ মাস্টার সরব হলেন। বললেন, ‘নুরাকে ছাইড়া দেও, মেম্বার। চেইন আসলে সে নেয় নাই।’

‘কে নিছে?’

‘আমার সাথে একটু দূরে আসো, কানে কানে বলছি।’

সদু মেম্বার ইউসুফের পিছু পিছু এগোলেন। খানিকটা দূরে গিয়ে বললেন, ‘আর রঙ্গ কইরো না, মাস্টার। বলো, কী বলতে চাও।’

‘চেইন তো দেখলাম তোমার পেটের ভিতর জ্বলজ্বল করতেছে। এই রকম আস্ত চেইন গিললা ক্যামনে? ধিক তোমারে, জনপ্রতিনিধি হইয়া সামান্য একটা স্বর্ণের চেইনের লোভও সামলাইতে পারো না! যাও, বাইর কইরা দিয়া আসো।’

চার্জ ফুরানো রোবটের মতো স্থির হয়ে গেলেন সদু মেম্বার। তার দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ইউসুফ মাস্টার। লোকটার গায়ে এত সুন্দর পোশাক, তবু যেনো কিছু নেই। মেম্বারের সবই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তিনি। এমন মানুষের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ সরিয়ে ঘুরে রওনা হয়ে গেলেন ইউসুফ মাস্টার।