সেই ছেলেটি

ছোটখাটো ঘড়ি সারাইয়ের দোকান আমার। বাবা গত হওয়ার পর উত্তরাধিকারসূত্রে এই যা পেয়েছি। ঘড়ি মেরামত করাই আমার কাজ। দোকানটা জাঁকালো না হলেও কাস্টমারের কোনো অভাব হতো না। শহরের বাইরের এক কোণে এর অবস্থান। তাই রাত নয়টার এদিকে পা পড়ে না কারও। তবু আমি আশায় থাকি। একটু বেশি রোজগারের জন্য এগারোটার আগে বাড়ি ফিরি না।

সেই রাতটা ছিল কৃষ্ণপক্ষের। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। রাত মোটে দশটা। সেদিন একটু আগেভাগে দোকান বন্ধ করব বলে ভাবছিলাম। ঠিক তখনই একজন কাস্টমার এসে হাজির। বালক। বছর সাতেক হবে বয়স। এইটুকু এক শিশু এই রাতে এসেছে ঘড়ির দোকানে! বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, ‘ভাইয়া, ঘড়ি ঠিক করতে এসেছ?’

‘না।’ জবাব দেয় ছেলেটি।

‘তাহলে? তুমি কি হারিয়ে গেছ?’

এবারও উত্তর এল ‘না।’

বলল, ‘বাবা, তোমার ইয়া বড় দাড়ি ছিল, সেটা কোথায় গেল? কত্ত ইয়াং দেখাচ্ছে তোমাকে! কেন?’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ছোড়া বলে কী! আমি তার বাবা! আমি তো বিয়েই করিনি! ভাবলাম আমার সঙ্গে ওর বাবার চেহারায় মিল আছে হয়তো।

‘একটু ভুল হচ্ছে ভাই। আমি তোমার বাবা নই, বুঝলে!’

উত্তর এল, ‘বাবা, তুমি আমাকে ভাই বলছ! মা জানলে কী বলবে ভেবেছ?’

ইঁচড়ে পাকা ছেলে, এর সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, ‘কিছু খাবে?’

মাথা ওপর-নিচ করে ‘হ্যাঁ’–বোধক শব্দ করল।

রাতের খাবারটা দোকানেই করে নিয়েছিলাম। কিছু খাবার বেঁচে গিয়েছিল। সেগুলোই দিলাম আমার ছেলেটাকে। মোবাইল ফোনে তুলে রাখলাম ছেলেটার ছবি। কোনো ব্যতিক্রমী বা উদ্ভট কাণ্ড ঘটলে আমি এ রকমটাই করি—তুলে রাখি ঘটনার ছবি।

ছেলেটার খাওয়া শেষ। তখন একটু স্নেহমেশানো কণ্ঠে বললাম, ‘ভাইয়া, তুমি আমাকে “বাবা” বলে যে ডাকলে, তোমার বাবার নামটা কী বলো তো?’

‘রূপম ইসলাম।’ জবাব দিল ছেলেটা।

আমি তো থ! আমার নামও তো রূপম ইসলাম। অবাক হওয়ার মতো সাহসও অবশিষ্ট ছিল না তখন আমার। গা-টা ছমছম করে উঠল। এটা কী করে হয়?

এটা কি স্বপ্ন। নাকি বাস্তব? নাকি ছেলেটা মিথ্যে বলছে? নাকি কাকতালীয় কোনো ঘটনা।

‘কে পাঠিয়েছে তোমাকে?’

প্রশ্নটা শেষ হতে না হতেই বালকের হাতের একটা ঘড়ি বিপবিপ শব্দ করে উঠল। অমনি সে এক দৌড়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেল। এতটাই ক্ষিপ্র যে আটকানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। রহস্য রহস্যই রয়ে গেল।

বিশ বছর পর

ভুলে গিয়েছিলাম সেদিনের ঘটনা। পরিবারকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলাম। হঠাৎ একটা ঘটনা আমার বিশ বছরের পুরোনো স্মৃতিটাকে আবার জাগিয়ে তুলল।

ছুটির দিন চা খাচ্ছি। পুরোনো এক বন্ধু ফোন দিল। কুশল শেষে বলল, ‘কয়েক দিন পর কলেজে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হবে। রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফর্মটা ডাউনলোড করে নিস।’

সঙ্গে দিল একটা ওয়েবসাইটের লিংক।

‘আচ্ছা,’ বললাম আমি।

‘আরেকটা কথা, তোর একটা পুরোনো ছবির কপি লাগবে কিন্তু। কথাটা মনে রাখিস।’

কথাটা আমাকে এমনভাবে বলল, যেন সে আমাকে শাসন করছে! যা–ই হোক, এখন কলেজ লাইফের ছবি কোথায় পাই?

পুরোনো একটা স্যুটকেস খুললাম। ধুলো ঝেড়ে উল্টোতে উল্টোতে দেখতে লাগলাম কোনো ছবি আদৌ এখানে পড়ে আছে কি না। কিছুক্ষণ দেখার পর একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল।

আরে তন্বী। ওর ছবি এখানে কীভাবে? ছবির কোণে তো লেখা আছে সাল ২০২০; তবে এখন তো ২০৪০! হঠাৎ মনে পড়ে গেল পুরোনো ঘটনাটা। ২০ বছরের পুরোনো একটা বালক অর্ক কীভাবে হয়?

‘না এটা হতে পারে না। না, এটা হতে পারে না।’ মনে মনে জপতে লাগলাম। প্রমাণের উদ্দেশ্যে অর্ককে ডেকে পাঠালাম। খুঁটিয়ে দেখলাম। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম ছবির সঙ্গে ওর অমিল খোঁজার। কিন্তু হুবহু সব এক! ওই স্মৃতিটা আমার মাথা ঘোলাটে করতে শুরু করল। দিনের বেলাতেও জেঁকে ধরল ভয়। বারবারই নিজেকে বলছি, এগুলো নিছকই স্বপ্ন ছিল; কিন্তু পরমুহূর্তেই এই ছবির বাস্তবতা আমাকে কাঁদিয়ে ছাড়ছে!

উত্তেজনায় ছটফট করতে করতেই তন্বীকে এলোমেলোভাবে ডাকতে শুরু করলাম আমি। উচ্চস্বরের বিদ্‌ঘুটে আওয়াজ শুনে দৌড়ে এল সে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছবিটা দেখালাম। সঙ্গে সঙ্গে কাহিনিটার পুরো বর্ণনা দিলাম। অবাক হলাম। সে কোনোরকম উত্তেজিত হয়নি।

পরক্ষণেই হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমার ছেলেকে চিনতে পারোনি?’

রেগে গেলাম আমি! মাথাটা কি গেছে নাকি তোমার! বিশ বছর আগে আমি নিজেই কিশোর ছিলাম। তখন ছেলে কোথায় পাব। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।

আমাকে জোর করে থামিয়ে তন্বী চাপা হাসির সুরে বলল, ‘ও অর্কই ছিল। জেদ ধরেছিল সময় ভ্রমণ করবে। আমিই পাঠিয়েছিলাম ওকে।’

‘কিন্তু কীভাবে...?’

লেখক: শিক্ষার্থী, বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল