ডাইসন সময়

পারভেজের ব্যবসা খারাপ। করোনার এই সময়ে কমবেশি সবার ব্যবসাই খারাপ। পারভেজের ব্যবসা যেন একটু বেশি খারাপ। তার ব্যবসা বলতে একটা বড়সড় গাড়ির গ্যারেজ আছে, সেখানে পাশাপাশি তিন-চারটা গাড়ির জায়গা হয় মেরামতের জন্য। সে মাঝেমধ্যেই পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি কিনে আনে, তারপর সময় নিয়ে সেটা মেরামত করে। প্রায় নতুনের মতোই করে ফেলে, তারপর কাগজপত্র ঠিক করে সেই গাড়ি বিক্রি করে দেয়। হয়তো দেড় লাখ টাকায় একটা গাড়ি কিনল। পঞ্চাশ–সত্তর, কখনো কখনো লাখ টাকা খরচ করে ঠিক করল। তারপর তিন–চার লাখে বিক্রি করল। আগে মাসে–দুমাসে একটা–দুটো গাড়ি বিক্রি হতো, এখন ছয় মাসেও কোনো গাড়ি পায় না।

গাড়ির টুকটাক খুচরা কাজেও কেউ আসে না আজকাল। শেষ পর্যন্ত হেলপার ছেলে দুটোকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, ‘যা বাড়ি যা, ক্ষেতির কাজ কর বরং। অবস্থা স্বাভাবিক হলে খবর দিবনে।’ তারা খুশি মনে বিদায় হয়েছে, কত দিন বাড়ি যায় না।

এর মধ্যে একদিন আজম ফোন দিল। আজম হচ্ছে গাড়ির দালাল।

ওস্তাদ একটা গাড়ি পাইছি।

কী গাড়ি?

পিকআপ ভ্যান, ডজ গাড়ি, সিক্স সিলিন্ডার, ফোর হুইল।

ডজের পিকআপ তো ভালো হবে না।

নিলে কন...।

কত চায়?

দুই লাখ।

অরে...!

আপনি কইলে দেড় লাখে রাজি করাইতে পারি। কিন্তু একটা ঝামেলা আছে।

কী ঝামেলা?

পিকআপে কিছু মালসামানা আছে মনে হয়, ওটাসহ কিনতে হইব।

ওই সব হাবিজাবি দিয়া আমি কী করব? কী আছে?

দেখি নাই তারপুলিনে ঢাকা। ওই সব আনলোড করতেও খরচা আছে, তাই ওগুলোসহ কিনতে কয়।

আচ্ছা, দেখি নিয়া আস।

ওস্তাদ, আনতে কিন্তু খরচা আছে। রেকার দিয়া টাইনা আনতে হইব, রেকারের ভাড়া...

ভাড়া কত?

হাজার–পনেরো শ।

আচ্ছা, নিয়ে আস তো আগে।

ওই দিন সন্ধ্যাবেলায়ই আজম রেকারে টেনে নিয়ে এল পিকআপটা।

পারভেজের পছন্দ হলো গাড়িটা। এটাকে ঠিকমতো সাইজ করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে। মুখে অবশ্য সেটা প্রকাশ করল না। আজমকে একটা বেয়ারার চেক দিল, তার কমিশনসহ। আর রেকার ভাড়া দেড় হাজার। আজমকে বিদায় করে দিয়ে গ্যারেজের ঝাঁপ ফেলে পিকআপের তারপুলিনটা খুলল এবং খুলে চমকে উঠল! পিকআপের পেছনে একটা গোল বেশ বড় চাকতি কাত হয়ে আছে। মাঝখানে বলের মতো উঁচু। সেটা মনে হচ্ছে শক্ত কাচের বা ওই জাতীয় কিছু, তবে ময়লার জন্য ভেতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর জিনিসটার বডিটা লোহা, স্টিল বা নিকেল বলে মনে হচ্ছে না। অন্য কিছু, অন্য কোনো ধাতুতে তৈরি, কিন্তু অসম্ভব মসৃণ। পারভেজের খটকা লাগল কী এটা?

সে টিটনকে ফোন দিল। টিটন তার ছেলেবেলার বন্ধু। বুয়েট থেকে পাস করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। মাঝেমধ্যে তাকে টেকনিক্যাল ব্যাপারে হেল্প করে।

টিটন?

বল।

কাল একটু আসতে পারবি, তোকে একটা জিনিস দেখাব।

কী জিনিস?

আয় তো আগে।

আচ্ছা, আসব। দুপুরের পর, লাঞ্চ খাওয়াবি তো?

খাওয়াব...।

গোল চাকতির মতো জিনিসটাকে যতটা ভারী মনে হয়েছিল, ততটা না। বরং আকার এবং ওজন অনুযায়ী বেশ হালকাই। জিনিসটাকে কপিকল আর জ্যাক দিয়ে পিকআপের ক্যারিয়ার থেকে নিচে নামাল, তারপর সারা রাত ধরে ঘষেমেজে পরিষ্কার করল পারভেজ। জিনিসটা এখন মাটিতে স্থির হয়ে আছে। অদ্ভুত একটা পিরিচের মতো জিনিস, মাঝখানে গোল একটা ভারী কাচের বল, যেন অর্ধেকটা কেটে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। জিনিসটার ব্যাস হবে ৮ ফিটের মতো। রাত চারটা পর্যন্ত পারভেজ একাই কাজ করল। মানে জিনিসটাকে ঘষেমেজে পরিষ্কার করল। তারপর গ্যারেজের বেঞ্চে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুম দিল। আজ আর বাসায় যাওয়া হলো না।

সকালে মফিজের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল। সে একসময় পারভেজের গ্যারেজে কাজ করত। এখন ভাঙারির ব্যবসায়ী। মাঝে মাঝে হাবিজাবি কিনতে আসে পারভেজের গ্যারেজ থেকে।

ওস্তাদ, রাইতে গ্যারেজেই ছিলেন?

হুঁ।

ওস্তাদ, আমার লাইগা আছে কিছু?

না।

দেহেন না বিছরায়া, কিছু যদি থাকে। লোহার কেজি কইলাম বাড়তি আছে।

নাই নাই। এক কাম কর। পাশের টং থেকে চা আর পুরি নিয়া আস আমার কথা বলে।

আচ্ছা।

মফিজ চা খেতে খেতে আবার বলে, স্যার, দেখেন না হাবিজাবি কিছু যদি থাকে। হঠাৎ তার চোখ গেল ডজ গাড়ির পেছনে গোল চাকতিটার ওপর।

স্যার ওইটা কী?

পারভেজ উত্তর দিল না। জিনিসটা ঢেকে রাখা দরকার ছিল। বলল, ‘কিছু না।’

পুলাপাইনের খেলনা মনে হইতাছে।

হতে পারে।

স্যার, এইটাই দিয়া দেন। দুই হাজার দিমুনে।

না না, যাও এখন।

স্যার, আড়াই হাজারে দিয়া দেন।

আরে, এটা নিয়ে তুমি কী করবে?

স্যার, এইডা খুললে ভেতরে কিছু খুচরা যন্ত্রপাতি পাওয়া যাইতে পারে। বাইরের চাক্কিডাতো বেকার। লোহাও না, মনে হয় হার্ড পেলাস্টিক। এই সব পেলাস্টিক চলে না।

আচ্ছা, এখন যাও। বেচলে তোমার কাছেই বেচব।

পুরান টায়ার-মায়ার আছেনি?

নাই

আচ্ছা স্যার যাই। কিছু পাইলে খবর দিয়েন।

দিব। মফিজ চলে গিয়েও ঘুরে আসে। ‘স্যার, এই করোনায় তো শেষ হয়া গেলাম। ব্যবসা–বাণিজ্য নাই। ভাবতাছি গেরামে যামুগা। মাছের চাষ করুম। আপনে কী কন?’

বুদ্ধি খারাপ না। নতুন কিছু করার সময় হইছে এখন।

কিন্তু স্যার, পুঞ্জি নাই। ব্যাংক থাইকা একটা লোনের ব্যবস্থা কইরা দেন না। আপনের তো জানাশোনা আছে।

আচ্ছা দেখবনে। আগে তুমি ডিসিশন নাও কী করবা, কৃষি করবা, না মাছ চাষ করবা। সরকার এসব লাইনে টাকা দেয়।

দেহি স্যার ভাবি। বিষয়ডা কইলাম মাথায় রাইখেন।

আচ্ছা। মফিজ একটু গিয়ে আবার ফিরে এল।

আবার কী হলো?

স্যার, একটা জায়গা পাইছি, বড় জায়গা। আপনের মতো একটা গ্যারেজ দিলে কেমন হয়? গাড়ি মেরামতের কিছু কাম তো আপনের কাছে শিখছি।

জায়গা কোথায়?

নয়াপল্টন মোড়ে আফতাব টাওয়ারের চারতলায়...

চারতলায় গাড়ির গ্যারেজ দিবা? মফিজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে থেমে যায়। আর কথা বাড়ায় না, বের হয়ে যায়।

দুপুরের কিছু আগে টিটন এল। জিনিসটা দেখে সে আঁতকে উঠল!

ও গড, এটা তো মনে হচ্ছে একটা সসার।

সসার?

মানে ইউএফও...আন আইডেনটিফাইড অবজেক্ট। কোথায় পেলি?

পুরোনো ডজ পিকআপ কেনার পুরো কাহিনি খুলে বলল পারভেজ। রাতভর যে সে বসে বসে সসারটা ঘষেমেজে পরিষ্কার করেছে, সেটাও বলল। তারপর গ্যারেজের ঝাঁপ ফেলে দুজনে মিলে জিনিসটার পেছনে লাগল। জিনিসটা খোলা যাচ্ছে না। তবে ওপরের গোল জিনিসটার ভেতর দিয়ে উঁকি মেরে যা বোঝা গেল, সামনে একটা গোল স্ক্রিনের মতো। মাঝখানে সম্ভবত বসার জন্য একটা অর্ধচন্দ্রকার আসন। পেছনে ছোট ছোট বাঁকা পাইপের মতো জিনিস বের হয়ে আছে।

কনফার্ম, এটা একটা ইউএফও। টিটন যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘আমি টানেলের অন্য পাশে আলো দেখতে পাচ্ছি।’

টিটন ছেলে ভালো, জ্ঞান রাখে। কিন্তু একটাই সমস্যা, সে ঘন ঘন টানেলের অন্য পাশে আলো দেখে। এটা তার একটা মুদ্রাদোষ।

তার মানে পারভেজ বুঝতে পারছিস?

কী বুঝব?

ওরা এসেছিল।

কারা?

আরে, এলিয়েন, এলিয়েন! অন্য গ্রহের মানুষ।

সত্যি বলছিস? টিটনের কথায় অবশ্য ভরসা করা যায়। পারভেজ করে। ‘তাহলে তো এটা দারুণ আবিষ্কার!’

তা আর বলতে। কিন্তু বিষয়টা গোপন রাখতে হবে আপাতত।

সেদিন পুরোটাই তারা দুজন ওই জিনিসটার পেছনে লেগে রইল। ধারণা করা হলো, যদি এটাতে করে সত্যিই এলিয়েনরা এসে থাকে, তাহলে তাদের আকার–আকৃতি খুব বেশি হলে একটা রোগা-পাতলা বারো–তেরো বছরের ছেলের বয়সী হবে। নইলে ভেতরে বসতে পারবে না। যেহেতু ভেতরে কোনো হুইল গিয়ার টাইপের কিছু নেই, তার মানে সামনের স্ক্রিনটাই ওদের সবকিছু, ওটা খুব সম্ভব টাচস্ক্রিন টাইপের কিছু হবে; আর পেছনের ছোট ছোট বাঁকা টিউবগুলো সম্ভবত নানা ধরনের ছোট–বড় আইসি!

ফুয়েল?

ভালো কথা বলেছিস। ফুয়েলের কোনো জায়গা দেখছি না, তার মানে...আমি টানেলের শেষ প্রান্তে আবারও আলো দেখছি...তার মানে এই যে মসৃণ চাকতিটা, এটার মধ্যে দেখ ছোট ছোট ফুটকির মতো দাগ। খুব সম্ভব...আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না। এটাকে এখানে না রেখে রোদে রাখি। হয়তো সোলার প্যানেলের মতো কিছু একটা আছে এতে। ওরা দুজনে ধরাধরি করে জিনিসটাকে পেছনে নিয়ে গেল, এখানে এক টুকরা খোলা জায়গা আছে, সেখানে রাখল। রোদ এসে সরাসরি পড়ছে জিনিসটার ওপর। থাকুক এখানে।

সন্ধ্যার কিছু আগে টিটন বিদায় হলো। কাল আবার সকাল সকাল আসবে বলে। ওকে বিদায় দিয়ে পারভেজ টংয়ের দোকানে চা খেল এক কাপ, তখনই দেখল একটু সামনে বেশ বড় একটা সাদা ক্যারাভ্যান দাঁড়িয়ে। তার ওপর ছোট্ট একটা রাডারের মতো জিনিসটা ঘুরছে। ক্যারাভ্যানের ড্রাইভিং সিট থেকে একজন বিদেশি নেমে এল, সুন্দর ঝাঁকড়া সোনালি চুল লোকটার। এদিক–ওদিক তাকাল। পারভেজের সঙ্গেও চোখাচোখি হলো একবার। লোকটা ক্যারাভ্যানের সামনে চাকায় দুটো লাথি দিল। বোধ হয় চাকার হাওয়ার প্রেশার দেখল, তারপর ফের ক্যারাভ্যানে উঠে ক্যারাভ্যান নিয়ে চলে গেল।

সে রাতে বাসায় চলে গেল পারভেজ। ঘুমানো দরকার। গ্যারেজ থেকে তার বাসা খুব দূরে না।

পরদিন সকাল সকাল চলে এল গ্যারেজে। টিটনও সকাল সকাল চলে আসবে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু গ্যারেজ খুলতে গিয়ে পারভেজ হতভম্ব। গ্যারেজের তালা ভাঙা। মানে গ্যারেজ খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখে সব ঠিকঠাক আছে, শুধু সসারটা নেই। হায়! হায়!! চুরি হয়েছে, সসারটা চুরি হয়েছে। আর্তনাদ করে উঠল পারভেজ। তখনই টিটন ঢুকল।

টিটন সর্বনাশ হয়েছে, সসারটা চুরি হয়েছে।

কী বলছিস?

ঠিকই বলছি, আমি এসে দেখি তালা ভাঙা।

এ কাজ কে করল? কাউকে সন্দেহ হয় তোর?

কাল একটা বিদেশি লোককে দেখলাম রাস্তার ওপর বিশাল ক্যারাভ্যান নিয়ে...ওপরে ছোট্ট রাডার ঘুরছিল।

বলিস কী? তাহলে তো ওরা খোঁজ পেয়ে গেছে। আমাকে বলিসনি কেন?

তখন কি আর ভেবেছিলাম চুরি হবে...।

উফ।

এখন কী হবে? পারভেজ মাথার চুল খামছে ধরে। দাঁড়া, একজনকে ফোন করি, বলে পারভেজ ফোন দিল একটা নম্বরে।

হ্যালো, সগীর?

বলেন ওস্তাদ।

আমার গ্যারেজ থেকে একটা জিনিস চুরি হইছে গত রাতে।

গোল চাক্কির মতো, মাঝখানে বলের মতো উঁচা?

তুমি জানলে কীভাবে?

আরে ওস্তাদ, এই জিনিস যে আপনার গ্যারেজে, আমারে একটু আওয়াজ দেবেন না? এই জিনিস নেওয়ার লাইগা ঢাকায় দুইটা পাট্টি নাইমা গেছে। আম্রিকার পাট্টি আপনার গ্যারেজ থাইকা চুরি করছে। আরেকটা পাট্টি আইছে ইন্ডিয়া থাইকা।

বলো কী?

স্যার, জিনিসটা কী?

সেটা পরে বলব। জিনিসটা এখন কোথায়?

স্যার, আমারে হায়ার করছে ইন্ডিয়ানরা। আমারে তো আপনি জানেন, আমার কানেকশনও জানেন, এই ঢাকা শহরে গ্যারেজ থাইকা জিনিস চুরি হইব, আর আমি জানুম না, এইটা হয় না। খোঁজ পাইসি ভোররাতেই। দুই আম্রিকান পাবলিক ওই মাল ক্যারাভ্যানে গায়েব করছে। আমি মগবাজার রেলক্রসিংয়ে দুই আম্রিকানের চক্ষে মরিচ ডলা দিয়া ক্যারাভ্যানের দখল নিলাম।

বলো কী? তুমি আজকাল মরিচ ডলাও দেও?

কী করুম, সব ব্যবস্থাই রাখতে হয়, কখন কোনডা লাগে।

তারপর?

তারপর কী, ওই দুই আম্রিকান ওখন মগবাজার চক্ষু হাসপাতালে ড্যাডি ড্যাডি কয়া চিক্কুর পারতাছে... মার্টিন সাবে বেশি চিক্কুর দিতাছে।

মার্টিন কে?

হেগো লিডার।

ক্যারাভ্যানটা কোথায় আগে বলো।

স্যার জিনিসটা রাখতে পারি নাই। ইন্ডিয়ান পাট্টি আমার লগে চিট করছে। হেরা আমারে ভরকি দিয়া ক্যারাভ্যান নিয়া উধাও! তয় আমি লোক লাগাইছি ...স্যার, কন তো জিনিসটা আসলে কী?

তোমাকে পরে বলছি।

মগবাজার আই হসপিটালের ৬ নম্বর কেবিনে পাশাপাশি বেডে দুজন, দুই বিদেশি। দুজনেরই চোখ আপাতত ব্যান্ডেজ করা।

এতক্ষণ কথাবার্তা লাউড স্পিকারে হচ্ছিল। টিটনও সব শুনেছে, সে চেঁচিয়ে উঠল, তার মানে ডক্টর জন মার্টিন এখন ঢাকায়, টানেলের শেষ প্রান্তে আবার আলো জ্বলে উঠেছে। এখনই মগবাজার আই হাসপিটালে চল।

কেন? জন মার্টিনটা কে?

পৃথিবী বিখ্যাত এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল সায়েন্টিস্ট। তবে ওয়াইজক্রেক। তোর একটা গাড়ি বের কর জলদি। এখনই যেতে হবে ওর কাছে।

মগবাজার আই হসপিটালের ৬ নম্বর কেবিনে পাশাপাশি বেডে দুজন, দুই বিদেশি। দুজনেরই চোখ আপাতত ব্যান্ডেজ করা। ডাক্তার বলছে, একটু পরেই খুলে দেবে। বোম্বাই মরিচ ডলে দিয়েছে বলে একটু ঝামেলা হচ্ছে। টিটন এগিয়ে গেল। কথাবার্তা ইংরেজিতেই হলো—

ডক্টর জন মার্টিন আমি সাইদুল আলম টিটন, আপনার একজন ভক্ত। আমি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আপনার লেখা স্ট্রেনজারস ইন মাই ওউন প্ল্যানেট বইটা পড়েছি, দারুণ একটা বই।

ধন্যবাদ, আমার কাছে কী চাও?

আপনারা যে সসারটা চুরি করেছেন আমার বন্ধুর গ্যারেজ থেকে...।

দেখো, ব্যাপারটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। আমরা চুরি করতে বাধ্য হয়েছি। তোমরা কি চাইলে এমনি এমনি দিতে? শোনো, যারা এই সসারে করে এসেছিল, তারা ডি টু সিভিলাইজেশনের এলিয়েন। তারা তাদের নক্ষত্রটাকে কেন্দ্র করে তাদের গ্রহটাকে একটা কৃত্রিম গোলকের মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। অসীম তাদের ক্ষমতা। আমার ধারণা, তারা আমাদের সোলার সিস্টেমটাকে ডাইসন গোলকের ভেতর নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে।

তাতে ওদের লাভ কী?

তারা যদি কমপক্ষে এক হাজারটা আমাদের মতো সোলার সিস্টেমকে এ রকম ডাইসন গোলকে নিয়ে আসতে পারে, মানে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তারা ডি থ্রি সিভিলাইজেশনে চলে যাবে...তখন তাদের কী ক্ষমতা হবে চিন্তাও করতে পারব না আমরা। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের যেকোনো মূল্যে ওই সসারটা ধ্বংস করতে হবে।

কিন্তু কেন? ওই সসারের ভেতরে তো কিছু নেই।

আছে! আছে!! ওই সসারের ভেতরে একজন চালক আছে। এই মুহূর্তে সে তার সব অ্যাটম বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তাই দেখতে পাচ্ছি না আমরা। যেকোনো সময় সে রি–অ্যারেঞ্জ করবে নিজেকে। আমাদের কোভিড–নাইনটিন ভাইরাসের মতো এরা মিউটেশন ছাড়াই ক্রমাগত নিজেদের বদলে ফেলতে পারে...প্লিজ, পৃথিবীর স্বার্থে ওটা ধ্বংস করো যেকোনো মূল্যে। ডক্টর জন মার্টিন উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে পড়লেন হাসপাতালের বিছানায়। ওই সসারটায় করে ডাইসন স্ফেয়ারের প্যাটার্নটা ওরা নিয়ে এসেছে...আমি ওভার শিওর...।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এসে তারা দুজনেই একটা টং দোকানে দুটো রং চায়ের অর্ডার দিল। এই কোভিড সময়ে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে চা খাওয়াও এক যন্ত্রণা। থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে চা খেতে হয়, পুলিশ থুতনিতে মাস্ক দেখলে নগদে ২০০ টাকা জরিমানা। এখন আবার লকডাউন চলছে; অবশ্য একটু ঢিলেঢালা লকডাউন।

এখন কী হবে রে টিটন? তোর টানেল কী বলে? আলো দেখতে পাচ্ছিস?

পাচ্ছি। কিন্তু এ তো মনে হচ্ছে অন্য আলো। বুঝতে পারছি না প্রফেসর মার্টিনের কথা বিশ্বাস করব কি না। তোর ওই সগীরকে একটা ফোন দে তো, জিনিসটা কোথায়? লাউড স্পিকারে দিস।

হ্যালো সগীর?

জি স্যার।

খবর কী?

স্যার আচানক কাণ্ড হইসে।

কী কাণ্ড?

ফোনের লাইন অফ করে পারভেজ তাকাল টিটনের দিকে। টিটন মাথায় হাত দিয়ে আই হসপিটালের সিঁড়িতেই বসে পড়েছে।

আমি তো আগেই কইছিলাম ইন্ডিয়ান পাট্টি আমার লগে পল্টি দিয়া ক্যারাভ্যানটা লইয়া গেছে। আমারে তো স্যার আপনি চিনেন, আমার লগে যে ভগিছগি করে, তারে আমি ছাড় দেই না, সে যত বড় মারকশাই হোক...আমি স্যার চারদিকে লোক লাগাইয়া যশোর রোডে গাড়িটা আটকাইছি। হেরা মনে হয় বেনাপোল দিয়া ভাগতে চাইছিল। গাড়িতে তিনজন ছিল, তিনটারে আচ্ছামতো ঘাড়াইছি। তারপর ক্যারাভ্যানটা লইয়া আইছি আমার পরিচিত এক লোকের গ্যারেজে। বুঝলেন স্যার, গ্যারেজে আইনা জিনিসটা বাইর করলাম। গোল চাক্কির মতো মাঝখানে উঁচা...

আচানক কাণ্ডটা কী?

স্যার, বিশ্বাস করবেন না আতকা দেখি, চাক্কির ভেতরে লাইট জ্বলে, ছোট ছোট জোনাক পোকার মতো লাইট। তারপর দেখি মাঝখানের গোল উঁচা জায়গাটার ভেতরে কী যেন লড়েচড়ে।

তারপর?

তারপর স্যার ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ পাইলাম একটা। হেরপর আতকা গ্যারেজের ছাদমাদ ভাইঙা জিনিসটা নাই হইয়া গেল। আচানক কাণ্ড!!

বলো কী?

জি স্যার। আমার মনে কয় এইগুলা সব আসমানি জিনের কায়কারবার! জানে বাইচা গেছি স্যার...ভাবতাছি একটা ছাগল ছদকা দিমু...

ফোনের লাইন অফ করে পারভেজ তাকাল টিটনের দিকে। টিটন মাথায় হাত দিয়ে আই হসপিটালের সিঁড়িতেই বসে পড়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার টানেলের অন্য পাশে আদৌ আর কোনো আলো জ্বলছে।

এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় একটি খবর খুব গুরুত্বের সঙ্গে বেরোল। ইলন মাস্কের কোম্পানির একটি প্রাইভেট স্পেসশিপ মঙ্গলের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু মঙ্গলে পৌঁছানোর আগেই সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা যেটা সন্দেহ করছেন, সেটা হচ্ছে ডাইসন স্ফেয়ার! বিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের সেই ডাইসন স্ফেয়ার থিওরি। কৃত্রিম ডাইসন গোলক তাদের বাইরে যেতে দেয়নি। স্পেসশিপটা ওখানেই ধ্বংস হয়েছে। কোনো সিভিলাইজেশন যদি ডি টু সিভিলাইজেশনে যায়, তাহলে তারা নিজের নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে তাদের গ্রহকে নিয়ে একটা কৃত্রিম গোলকের ভেতর নিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ তাদের নিজেদের নক্ষত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারা। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ ডি ওয়ান সিভিলাইজেশনে পৌঁছাতে পারেনি এখনো। তাহলে কারা এই কৃত্রিম গোলক তৈরি করল?

দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিয়ে পারভেজের দিকে তাকায় টিটন। তারা দুজনেই পারভেজের গ্যারেজে। টিটন ফিসফিস করে বলে:

বুঝলি পারভেজ?

কী বুঝব?

মহাবিশ্বে ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

তোর টানেল কী বলে? কোনো আলো দেখতে পাচ্ছিস? পারভেজের ঠাট্টা গায়ে মাখে না টিটন। কিন্তু সে নিশ্চিত, তার টানেলের শেষ প্রান্তে কোনো আলো নেই, গাঢ় অমানিশা...!