স্টারডাস্ট

‘অ্যানাফোরা, তুমি কি নিশ্চিত, তোমার এই কনভার্টার কাজ করবে?’ ফেডারেশন চিফদের একজন জিজ্ঞাসা করলেন।

‘ইয়েস চিফ। আমার নিজের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে,’ সাহস নিয়ে জবাব দিল অ্যানা।

‘কিন্তু আমরা আর্নল্ডের কাছে শুনেছি, তোমার এই আবিষ্কার এখন পর্যন্ত অসফল। তুমি কেন এমন অসম্ভব মিশনে যেতে চাচ্ছ? আর তুমি যাবেই-বা কীভাবে? আমাদের কাছে কেবল একটি জাম্প পয়েন্ট আছে,’ আরেকজন ফেডারেশন চিফ বলেন।

‘আমার যুক্তি দিয়ে বোঝানোর সময় নেই, তবে এটুকু বলতে পারি, আপনাদের মতো হাল ছেড়ে আমি পিছিয়ে থাকব না।’

‘তোমার কথায় জোর আছে। কিন্তু এই অবাস্তব জেদ মেনে নিয়ে আমরা আমাদের সেরা অফিসারকে অকারণে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। আমরা তোমার কষ্ট অনুভব করতে পারছি, কিন্তু আমরা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমাকে এ মিশনের জন্য অনুমতি দেওয়া হবে না।’

‘কিন্তু চিফ...’

‘যথেষ্ট হয়েছে, অ্যানাফোরা। তুমি কম্পাউন্ডে ফিরে যাও। আমরা শুনেছি, তুমি তোমার আবিষ্কারের সফলতার জন্য আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছ। আমরা শিগগিরই তোমাকে সাহায্য করার জন্য কাউকে নিয়োগ দেব, ঠিক আছে?’

অ্যানা কিছু বলতে পারল না। তার চোখ দুটো পানিতে ভিজে গেছে। অল্প করে মাথা নাড়িয়ে সে বেরিয়ে এল।

অ্যানা ফেডারেশন হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে আসার সময় লঞ্চপ্যাডের কাছে নিজের জুনো ১১ শিপটি দেখতে পেল। ফেডারেশন কর্মীরা শিপটিকে হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাচ্ছে। সে শিপটির দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ সে লঞ্চপ্যাডের ব্যারিকেডগুলো টপকে দৌড়াতে শুরু করল শিপটির দিকে। কাছাকাছি আসতেই তাকে দেখে ফেডারেশনের কর্মীরা থমকে গেল খানিকটা। অ্যানাকে স্যালুট করে জিজ্ঞাসা করল, ‘জি, ম্যাম। কিছু বলবেন?’

‘কন্ট্রোলারটি দাও। আমাকে একটি টেস্ট ফ্লাইটের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

‘কিন্তু ম্যাম, আমরা একটু আগেই খবর পেলাম এই ফ্লাইট ক্যানসেল করা হয়েছে।’

‘আমি বলছি তো, কন্ট্রোলারটি দাও। আমি ফেডারেশন থেকে নির্দেশ পেয়েই...’

‘সরি, ম্যাম। আমরা আপনাকে কন্ট্রোলারটি এভাবে দিতে পারব না।’

‘শেষবারের মতো বলছি, কন্ট্রোলারটি আমাকে দাও। আমি তোমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যেতে চাই না।’

‘সরি, ম্যাম। আমাদের সেন্সর ডিটেক্ট করেছে, আপনি মিথ্যে বলছেন। আমরা আপনাকে কন্ট্রোলার দিতে পারব না।’

‘ঠিক আছে। তোমাদের বলে রাখি, এটা করার আমার একদমই ইচ্ছা ছিল না,’ বলেই অ্যানা একজনের ওপর লাফিয়ে পড়ল। মাটিতে ফেলে ওর গলার পেছনের চিপটি নিষ্ক্রিয় করে দিল সে। আরেকজন কাছাকাছি আসতেই নিজের ডার্ট টিজার দিয়ে ওকে শক দিল। অ্যানা তাড়াতাড়ি কন্ট্রোলারটি হাতে নিয়ে ‘ওউনার মডিউল’ বাটনে চাপ দিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘জুনো স্টার্ট!’ সঙ্গে সঙ্গে শিপটি গর্জন করে উঠল বাঘের মতো। ইতিমধ্যে পেছন থেকে আরও কিছু ফেডারেশন গার্ড অ্যানার দিকে লেজার গান থেকে লেজার ছোড়া শুরু করেছে। অ্যানার স্বয়ংক্রিয় ডায়নামিক প্রটেকটিভ শিল্ডটি সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল পেছনে। শুষে নিতে লাগল সব তাপ।

‘এয়ারলক খোলো, জুনো,’ চেঁচিয়ে বলল অ্যানা। শিপের এয়ারলকগুলো খোলার পরপরই সে শিপের ভেতর ঢুকে পড়ল। ‘এয়ারলক বন্ধ করে দ্রুত ওপরে নিয়ে চলো।’

‘নিশ্চয়ই, অ্যানা,’ বলে জুনো এয়ারলক বন্ধ করে শূন্যে ভেসে উঠল।

‘জুনো, আউটার রিংয়ে নিয়ে যাও, আর পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করো।’

‘ওকে, বস।’

অ্যানার কাছে একটি বিশেষ ধরনের চতুর্মাত্রিক পকেট আছে। সেই পকেটের ভেতর থেকে সে নিজের বিশেষ ধরনের স্যুটটি বের করে পরে নিল। একই পকেট থেকে নিজের বানানো কনভার্টারটি বের করে পে-লোড সেকশনে জুড়ে দিতে শুরু করল। একসময় জুনো বলে উঠল, ‘অ্যানা, আমরা আউটার রিংয়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি। এখন কী করব?’

অ্যানা তখনো কনভার্টারটি পে-লোডে যুক্ত করতে ব্যস্ত। ওপরে উঠে এসে বলল, ‘চেক পে-লোড স্ট্যাটাস।’

‘আমি একটি নতুন পে-লোড শনাক্ত করেছি,’ জবাব দিল জুনো।

‘দারুণ। মেইন কমস ও হাব কমসগুলো অ্যাকটিভেট করো।’

জুনো কমসগুলো অন করার সঙ্গে সঙ্গে একাধিক মেসেজ পপ-আপ করে উঠল। সব কটিই ফেডারেশন থেকে পাঠানো হয়েছে। অ্যানাকে বিদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব দেখে সে একটু মুচকি হাসল।

‘আমরা কিসের মধ্যে আছি, অ্যানা?’ কিছুটা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করল জুনো।

‘সে এক লম্বা কাহিনি। টেলাসের জন্য জাম্প পয়েন্টের লোকেশন চেয়ে ফেডারেশনের কাছে আবেদনের বার্তা পাঠাও।’

‘ঠিক আছে।’

‘আমি ক্যাপ্টেন অ্যানাফোরা ক্লেমেনসন, জুনো ১১-এর কমান্ডার বলছি। টেলাসের নিকটবর্তী জাম্প পয়েন্টের অবস্থান জানার জন্য আবেদন করছি।’

জুনো এই বার্তা পাঠিয়ে দিল।

‘অ্যানাফোরা, স্কাই মার্শাল বলছি। তুমি এক্ষুনি লঞ্চপ্যাডে ফিরে এসো। আমরা তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দিইনি।’

‘আমি আর ফিরছি না। দয়া করে কো–অর্ডিনেটগুলো দিন,’ বলে অ্যানা নিজের হাতের টাইমারের দিকে তাকাল। ওখানে ধূমকেতুটির টেলাসের সেফটি লাইন পেরোনোর সময়টি দেওয়া। সে ওই টাইমারের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, ‘অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে, দয়া করে আমাকে কো–অর্ডিনেটগুলো দিন।’

‘অ্যানা, প্লিজ, তুমি ফিরে এসো। পাগলামি কোরো না,’ ওপাশ থেকে আর্নল্ড বলল।

‘আমি দুঃখিত, প্রফেসর। কিন্তু আমি এই কালিমা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব না। এটি শুধু আমার না, সমগ্র জাতির জন্যও...’

‘ঠিক আছে, আমরা তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি,’ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন স্কাই মার্শাল। ‘তবে একটি কথা মনে রেখো, তুমি যদি কোথাও বিপদে পড়ে যাও, আমাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাবে না। এই নাও কো–অর্ডিনেটস। এখন থেকে তোমার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ। শুভকামনা ও বিদায়!’

‘ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু চিন্তা করবেন না; আমি যদি টেলাসকে বাঁচাতে না পারি, তবে আর ফিরব না,’ জোর গলায় বলল অ্যানা।

‘জাম্প পয়েন্টের কো–অর্ডিনেটগুলো ট্রেস হয়ে গেছে, অ্যানা,’ বলল জুনো।

‘ঠিক আছে। কো–অর্ডিনেটগুলোর দিকে আগাও, আর সব মেইন ও হাব কমসগুলো নিষ্ক্রিয় করে ফেলো। আর প্রফেসর আর্নল্ডের পারসোনাল কমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করো।’

‘নিশ্চয়ই,’ জবাব দিল জুনো, ‘কমস সফলভাবে সংযুক্ত হয়েছে।’

‘প্রফেসর, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’ জিজ্ঞাসা করল অ্যানা।

‘তোমার এমন করা একদমই উচিত হয়নি,’ রেগে বললেন আর্নল্ড।

‘আমার আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু আপনাকে আমার পাশে দরকার। তা...আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?’ নম্রভাবে আবেদন করল অ্যানা।

‘তুমি আর কোনো উপায় রেখেছ?’

‘ধন্যবাদ, প্রফেসর,’ মুচকি হেসে বলল অ্যানা।

‘অ্যানা, আমরা জাম্প পয়েন্টের কাছে চলে এসেছি,’ বলে উঠল জুনো।

‘প্রফেসর, আমরা জাম্প পয়েন্টের কাছে চলে এসেছি। কমস আবার জাম্পের পর চালু হবে। আপনার সঙ্গে তখন আবার কথা হবে,’ বলল অ্যানা।

‘দাঁড়াও, অ্যানা। তুমি কীভাবে একটি সিঙ্গেল জাম্পের মাধ্যমে টেলাসের কাছে পৌঁছাবে? জুনো ১১ সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টার জাম্প করতে পারে। তাহলে সে তোমাকে প্রায় এফওয়াই ৯৫ প্লেনেটয়েডের কাছে নিয়ে যাবে। বাকি ৮৫ এইউ তুমি অতিক্রম করবে কীভাবে?’ প্রশ্ন করল আর্নল্ড।

‘চিন্তা করবেন না, প্রফেসর। আমি কনভার্টারটি পে-লোডে সেট করে দিয়েছি। এফওয়াই ৯৫-এ পৌঁছানোর পর আমি নিজেকে আলোয় পরিণত করে টেলাসের দিকে ছুড়ে দেব,’ জবাব দিল অ্যানা।

‘তুমি সত্যিই পাগল।’

‘বেশ, আবার পরে দেখা হবে, প্রফেসর।’

‘ঠিক আছে। তিন ঘণ্টা পর আবার দেখা হবে,’ বলল আর্নল্ড।

‘জুনো, জাম্পের জন্য তৈরি হও। সব প্যারামিটার সেট করো,’ বলল অ্যানা।

‘ইয়েস বস,’ জবাব দিল জুনো। জাম্প শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নভোযানটি জোরে কেঁপে উঠল। এরপর সেটি একটি গর্তের ভেতর দিয়ে অকল্পনীয় বেগে ছুট দিল। অ্যানা চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। নিজের অজান্তেই সে জ্ঞান হারাল।

wallpapercrafter

‘ওঠো অ্যানা, উঠে পড়ো,’ বলল জুনো, ‘আমরা এফওয়াই ৯৫-এর কাছে এসে পৌঁছেছি।’

অ্যানার নিজের চোখ দুটো খুলতে বেশ কষ্ট হলো। চোখ খুলে চারদিক একবার দেখে নেওয়ার পর সে হাতের টাইমারের দিকে তাকাল। সেখানে T-11h 56min লেখা। লাফিয়ে উঠল সে। মাত্র ৮ মিনিট বাফার টাইম রয়েছে। সে নিজেকে ওই ছোট্ট কনভার্টারটির মধ্যে এঁটে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করল। কনভার্টারটি ট্যান্টালাম-টাংস্টেন কার্বাইডের অ্যালয়ে তৈরি একটি সিলিন্ড্রিক্যাল টিউব। সিলিন্ডারের ওপরে একজনের শোবার জায়গা আছে। নিচে বসানো হয়েছে একটি শক্তিশালী পার্টিক্যাল ডিফ্লেক্টর, যা ওই ধূমকেতুটির দিক বদলে দেবে।

অ্যানা প্রচুর পরিমাণে পানি, গ্লুকোজ সলিউশন আর কিছু এনার্জি বুস্টার পান করল। তার পরনের স্যুটে বাইসন পার্টিক্যালের অনেক অ্যাম্পুল, অ্যাড্রিনালিন শট ও বিভিন্ন সিরামের ভায়াল লাগানো। কনভার্টারটির ভেতর শোবার আগে অ্যানা নিজের দেহে কিছু ইনজেকশন দিল। সবশেষে লিকুইড ডাইসন পার্টিক্যাল সিরিঞ্জের মাধ্যমে নিজের দেহে ইনজেক্ট করে বলল, ‘জুনো, আমি যদি বেঁচে যাই, তাহলে তুমি আমার লোকেশন ট্রেস করে আমাকে নিতে আসবে কিন্তু। ঠিক আছে?’

‘অবশ্যই অ্যানা। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। গুড লাক।’

‘আর হ্যাঁ, প্রফেসর আর্নল্ডকে জানিয়ে দিয়ো, আমি রওনা দিয়েছি। তার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই।’

‘নিশ্চয় অ্যানা। গুডবাই।’

‘বিদায়!’ বলে অ্যানা টিউবের ভেতর শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা লেগে গেল। ডাইসন পার্টিক্যালের প্রভাব শুরু হতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনে হলো, কেউ যেন তার পুরো দেহে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে। সারা দেহে প্রচণ্ড ব্যথা। চিৎকার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেও মুখ থেকে একটি শব্দও বের হচ্ছে না। তার মনে হতে লাগল, একই সঙ্গে তার প্রচণ্ড পিপাসা পাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে, পুড়ে যাচ্ছে সব। কেউ যেন তার দেহে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, ছেঁচে ফেলা হচ্ছে যেন তাকে। আর সহ্য করতে পারছে না। নিজের চেতনা হারানোর আগে তার মাথায় একটি বিষয়ই ঘুরছিল—টেলাসকে বাঁচাতেই হবে।

হঠাৎ চোখ খুলে গেল অ্যানার। এক বিশাল বরফের চাঁইয়ের ওপর শুয়ে আছে সে। ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে মাথায় ও মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা টের পেল। তাই বুকের ওপর শুয়ে চারদিক দেখার চেষ্টা করল সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।

চারদিক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন। বিকট উগ্র গন্ধে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। গন্ধটি মিথেনের। তখনই সে বুঝতে পারল, এই বরফের চাঁইগুলো পানির না, কঠিন মিথেনের। তার পোশাকে লাগানো একটি সেন্সর ৪০ কেলভিন তাপমাত্রা শনাক্ত করছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার একদম ঠান্ডা লাগছে না। অনেক কষ্টে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল অ্যানা। চারদিক ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করল। বুঝতে পারছে না সে কোথায়। ঠিক সেই মুহূর্তে সে আবিষ্কার করল, তার একটি হাত নেই। কিন্তু তার একটুও ব্যথা হচ্ছে না। চোখে না দেখলে হয়তো বুঝতেই পারত না, একটি হাত একদম উধাও হয়ে গেছে। রক্তের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। তবু অ্যানার মুখে এক ফোঁটাও ঘাবড়ানোর চিহ্ন নেই। সৌভাগ্যবশত তার কাছে চতুর্মাত্রিক পকেটটি ছিল। সে ওটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল। সেখান থেকে একটি বায়োনিক আর্ম বের করে নিজের কাঁধের ক্লাভিক্যাল ও স্ক্যাপুলার সঙ্গে যুক্ত করে নিল দ্রুত। এক অজানা কারণে সে নিজের মিশন প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎ কী মনে করে নিজের আসল হাতে লাগানো টাইমারের দিকে তাকাতেই তার সব কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে T-6h 43min দেখাচ্ছে।

তখন সে মরিয়া হয়ে আশপাশে তাকাল নিজের কনভার্টারটি খোঁজার জন্য। কিন্তু ঘন অন্ধকার আর কুয়াশার জন্য কিছুই দেখতে পেল না। পকেট থেকে ট্র্যাকার বের করে কনভার্টারটি খোঁজার চেষ্টা করল সে। কনভার্টারটি আছে তার বর্তমান অবস্থান থেকে প্রায় এক মাইল দূরে। একই সঙ্গে সে নিজের অবস্থানও জানতে পারল। ভিএক্স ৪৭ নামে এক বামন গ্রহে রয়েছে সে; টেলাসের বাসিন্দারা এর নাম দিয়েছে মাকেমাকে। টেলাসের কাছে পৌঁছাতে আরও সাড়ে সাত ঘণ্টার মতো লাগবে। সে বুঝতে পারছে না, এখন কী করবে। জানে, সে টেলাসকে বাঁচাতে পারবে না, তবু হার মানতে চায় না। সে কনভার্টারটির দিকে এগোতে লাগল। কনভার্টারটি দেখতে পেয়ে দৌড়ে গেল ওটার কাছে। অ্যানা দেখার চেষ্টা করল, ওটার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কি না। ঠিক সেই মুহূর্তে সে পেছন থেকে কিছু একটা আওয়াজ শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে সে তার পকেট থেকে অস্ত্র বের করে পেছনে ঘুরে তাকাল। দেখল, কিছু থোলিনের গুঁড়া পাহাড় বেয়ে নিচে পড়ল। তার হাতে থাকা ডিভাইসটি জিরো হিট সিগনেচার ডিটেক্ট করলেও মোশন সেন্সরে বেশ কিছু নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। তখনই সে বুঝতে পারল, সে এখানে একা না। তাই সে তাড়াতাড়ি কনভার্টারটির ভেতর ঢুকে পড়ল। অ্যানা কনভার্টারটি অন করতেই বহু রহস্যময় জীব তার কনভার্টারটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খামচানো শুরু করল। অ্যানা তার হাতের বন্দুকটি বের করার আগেই ওরা কনভার্টারটির এয়ারলক ভেঙে তাকে বের করে শূন্যে তুলে ফেলল। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা অ্যানার শরীরের সব কটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধরে টানতে লাগল জোরে। সে যন্ত্রণায় চিৎকার দেওয়ার আগেই ওরা তার পুরো দেহ টেনে ছিঁড়ে ফেলল।

লাফিয়ে উঠল অ্যানা। তার পুরো শরীর ঘেমে গেছে। পানিশূন্যতার ফলে সুগার লেভেল অনেকটা ড্রপ করেছে। ভয়ংকর ব্যথা করছে মাথার পেছনটা। চোখ দুটো খুলে সে নিজেকে কনভার্টারটির ভেতর আবিষ্কার করল। তাহলে সে এতক্ষণ কী দেখছিল? দুঃস্বপ্ন? সে নিজেকে নিজে এই প্রশ্ন করল। ঠিক তখনই অ্যানার কনভার্টারটি কিছুটা বিপ্ শব্দ করে উঠল। সে তার হাতের ডিভাইসে নিজের লোকেশন দেখে অবাক হয়ে গেল। টেলাসের কাছে এসে পড়েছে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে আসতে কিছুটা দেরি করে ফেলেছে। ধূমকেতুটি টেইলাসের সেফটি লাইন পেরিয়ে এসেছে। অ্যানা বুঝতে পারছে, এত কষ্ট সহ্য করার পরও শেষমেশ অসফল হলো সে। তার আর কোনো উপায় নেই। কান্নার চেষ্টা করলেও পানিশূন্যতার জন্য চোখ দিয়ে কিছুই বের হলো না। হঠাৎ সে লক্ষ করল, তার পকেটে এখনো কিছু ডাইসন পার্টিক্যাল রয়েছে। কনভার্টারটিতেও কিছুটা শক্তি অবশিষ্ট আছে। সেই মুহূর্তেই অ্যানা ডাইসন পার্টিক্যাল নিজের দেহে ইনজেক্ট করে আবার আলোয় পরিণত হয়ে ধূমকেতুটির দিকে ছুটে গেল। ধূমকেতুটির সঙ্গে তার ভয়ংকর সংঘর্ষ হলো। ফলে ধূমকেতুটির বেশির ভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে আলোকোজ্জ্বল গ্যাসে পরিণত হলো। বাকি অংশগুলো বেরিয়ে গেল টেলাস গ্রহের পাশ দিয়ে।

কয়েক দিন পর টেলাসে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা ফেডারেশনের এক এজেন্ট একটি ভয়েস ক্লিপ পাঠায়। ভয়েস ক্লিপটি ওদের ভাষায় একটি ঘোষণার অংশবিশেষ। সেটি রূপান্তর করলে দাঁড়ায়—

‘আজ মানবতা তাদের নিশ্চিত ধ্বংস থেকে মুক্তিলাভ করেছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবার প্রার্থনা গ্রহণ করেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, ধূমকেতুটি আমাদের এত কাছে এসেও নিজেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণটি আমরা এখনো বের করতে পারিনি। আপনারা কয়েক রাত ধরে যা দেখছেন, তা কিছু আলোকোজ্জ্বল গ্যাসের সমাহার, যা এই রাতের আকাশকে দিনের মতো উজ্জ্বল করে রাখে। আর ধূমকেতুটি ধ্বংসের পর যে ছাইয়ের কণা মাটিতে পড়ে ছিল, সেগুলো আসলে স্টারডাস্ট। সেই সঙ্গে আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, নাসার ‘অ্যাপোলো ১১’ মিশন যেটা চাঁদের পৃষ্ঠে প্রথম মানুষকে পৌঁছে দেবে, সেটি দীর্ঘদিন ধরে ধূমকেতুর বারবার হামলার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা আবার চালু হতে যাচ্ছে...’

রাত প্রায় দুইটা বা তিনটা। ক্লিন্ট কোথাও একটা গানের আওয়াজ শুনতে পেল। সে এসে দেখল, প্রাচীরের ওপর বসে একটি মেয়ে নিচু স্বরে গান গাইছে। মেয়েটির কাছে যেতেই সে বুঝতে পারল, মেয়েটি এক উষ্ণ আলোয় জ্বলছে। ‘তু... তুমি কে?’ কিছুটা ভিতু স্বরে জিজ্ঞসা করল ও।

‘আমি অ্যানা,’ জবাব দিল মেয়েটি।