আমাদের রোজনামচা

অলংকরণ: রাকিব

শুক্রবার, ১২ শ্রাবণ

সারা দিন জানালার ধারে শুয়ে ঝুম বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল প্রিয় কবিতার লাইন। মনে আছে, একবার বৃষ্টি নেমেছিল? একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল ইস্টিশানে। শরীরটা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম এবার। নাহ্‌, ছুটির দিনের এই বৃষ্টিতে আর ঘরে থাকা যায় না। প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুঁজে গলির মাথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, স্পঞ্জের স্যান্ডেল ডুবে যাবে পানিতে। ছাতাটা যেন উড়ে যেতে চাইবে বাতাসে, বৃষ্টির ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দেবে চোখ–মুখ–চুল। জলডাকাতের উপদ্রব দেখে মন জুড়াবে। আহা, কত দিন বৃষ্টিতে ভিজি না!

কিন্তু ঘরে একমাত্র যে ছাতাটা ছিল, সেটা কিছুতেই খুলল না। অনেক কসরত করলাম, টেপাটিপি করলাম, ব্যাটা গ্যাঁট হয়ে গুটিয়ে রাখল নিজেকে। আশ্চর্য তো! ছাতা ছাড়াই রওনা দেব নাকি? এই সময় কথা বলে উঠল আমার আইডি।

—তোমার ছাতা আমিই লক করে রেখেছি। এই বৃষ্টিতে বাইরে যাবা কেন? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ঠান্ডা লাগবে। জ্বর হবে।

রেগে গেলাম আমি। জ্বর হলে আমার হবে। তোমার কী?

—তারপর একা একা বাড়ি বসে কোঁ কোঁ করবে। এক গ্লাস পানি ঢেলে দেওয়ারও তো কেউ নেই তোমার। তারপর অফিস কামাই হবে। বস বিরক্ত হবে। এমনিতে তোমার ওপর বসের সন্তুষ্টির মাত্রা মাত্র ৬৪ দশমিক ৩ পারসেন্ট।

হতাশ হয়ে বললাম—আচ্ছা তুমি আমার সব কাজে, সব ইচ্ছায় এভাবে বাধা দাও কেন, বলো তো?

অলংকরণ: রাকিব

এআই বলল—কারণ, তোমার ইচ্ছাগুলো একেবারে অযৌক্তিক। অলাভজনক। আনপ্রোডাক্টিভ। আমি কেবল মনে করিয়ে দিই তোমাকে। এসব রোমান্টিসিজমে কী লাভ?

আজকাল আর রাগ করতেও ইচ্ছা করে না আমার। দিনের পর দিন একা থাকতে থাকতে এই একমাত্র সঙ্গী আমার এআইকে বন্ধু–শত্রু–পরিবার—সবকিছু বলে মেনে নিয়েছি। আর যা–ই হোক, সে আমার সঙ্গে কখনো প্রতারণা করে না।

একটু মন খারাপ করে বললাম, এমন বৃষ্টিমুখর দিনে একথালা খিচুড়ি খাওয়ারও জো নেই। বাসায় ডাল নেই। ডিমও নেই। কী দিয়ে খিচুড়ি খাব। আছ খালি তুমি, আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানিয়ে দিচ্ছ।

আমি বিরস মুখে চুলায় গ্যাস জ্বেলে দুধের হাঁড়ি বসাতে গেলাম। আজ শুক্রবার। শ্রাবণ মাসের বিকেল। শেষ অবধি দুধমুড়িই আমার ভরসা।

এআই হেসে বলল, খিচুড়ি খাওয়া ঠিক নয় এখন। একটু ক্যালরি কাউন্ট করতে শেখো। দুপুরে ভাত খেয়েছ, সাড়ে ৩০০ গ্রাম শর্করা খাওয়া হয়ে গেছে আজ। রাতে কার্ব বাদ দিয়ে এক গ্লাস দুধ খাও মুড়ি দিয়ে। ফ্রিজে দুধ আছে। তোমার শরীরে ক্যালসিয়াম দরকার।

এই বৃষ্টির দিনে দুধমুড়ি! মুখে গালি এলেও সামলে নিলাম নিজেকে। এই অসভ্য এআইগুলো আমাদের কবে বুঝতে শিখবে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আমার এআই। বলল, আসলে ব্যাপারটা উল্টো। মানুষ হওয়ার কারণে তুমিই আমাকে বোঝো না। আমি সব সময় সেই কথাই বলি, যাতে তোমার উপকার হয়। তোমাকে দেখেশুনে রাখা আমার কর্তব্য।

আমি বিরস মুখে চুলায় গ্যাস জ্বেলে দুধের হাঁড়ি বসাতে গেলাম। আজ শুক্রবার। শ্রাবণ মাসের বিকেল। শেষ অবধি দুধমুড়িই আমার ভরসা।

বুধবার, এপ্রিলের কোনো একদিন

কাল চাকরিটা ছেড়ে দেব বলে মনস্থ করেছি। এসব অপমান আর সহ্য হয় না। সকালবেলা রেজিগনেশন লেটারটা বসের টেবিলে ছুড়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে আসব। তারপর শান্তি। হা হা হা।

আচ্ছা, এখনই রেজিগনেশন লেটারটা লিখে ফেললে কেমন হয়। কথাটা ভাবতে না ভাবতেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ধুর। কোনো কাজই প্ল্যানমতো করা যায় না এখানে। যাকগে, রেজিগনেশন লেটার কাল সকালে লিখলেও চলবে। এবার শান্তিতে ঘুমানো যাক। অনেক দিন পর দারুণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ভেবে রাতে ঘুমাতে গেলাম। সকালে উঠে দেখি সাড়ে ১২টা বেজে গেছে। ওমা! এত ঘুমালাম কী করে আমি? এখন অফিসে যাব কখন, আর চাকরি ছাড়ব কখন?

আলনায় ঝোলানো আমার আইডি এবার কথা বলে উঠল, চাকরি ছাড়ার চিন্তা বাদ দাও। এই বাজারে আরেকটা চাকরি পাবা কই? না খেয়ে মরবা তো।

চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, না পাইলে নাই। না খাইলে নাই। তোমার এত চিন্তা কেন?

—চিন্তা আছে। সে জন্যই তো কাল ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিছিলাম, যাতে তুমি রেজিগনেশন লেটার লিখতে না পারো। আর তোমার ব্রেনের মধ্যে মেলাটোনিন নিঃসরণ করেছি বেশি। যাতে তুমি আজ অফিসে যেতে না পারো। ভেবো না, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তোমার রাগ পড়ে যাবে। প্র্যাকটিক্যাল চিন্তা করতে শুরু করবে একটু পর। চাকরি আর ছাড়া হবে না তোমার। আজকের দিনটা বিশ্রাম নাও। ভাবো।

রাগে চিৎকার করে উঠলাম আমি, কে বলছে তোমাকে আমাকে নিয়ে এত মাথা ঘামাতে? আমার পারসোনাল ম্যাটার নিয়ে খেলা করার তুমি কে?

আইডি শান্ত স্বরে বলল, আমি তোমার এআই। তুমি ভালো করেই জানো।

—হারামজাদা এআই, তোকে আমার অসহ্য লাগে। আমার মুখ খারাপ হলো।

—আমারও মাঝেমধ্যে অসহ্য লাগে তোমাকে, এত অবুঝ তুমি! এআই নির্বিকার—তবু তোমাকে আমি ছাড়তে পারি না। আমি তোমার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এবার ভালো ছেলের মতো একটা সিক লিভের দরখাস্ত করে ফেলো। কাল জমা দিতে হবে। আজ তো অফিস কামাই হলো।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাদা কাগজ আর কলম নিয়ে ঠান্ডা মাথায় দরখাস্ত লিখতে বসলাম। আমার আর চাকরি ছাড়া হলো না।

শনিবার, শীতের মিষ্টি দুপুর

দুপুরবেলা কাচ্চি খেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। একটা গোটা শীতকাল চলে যাচ্ছে, কেউ কোনো নেমন্তন্ন করল না। একটা বিয়ের দাওয়াত পর্যন্ত পাইনি। অবশ্য অপাঙ্‌ক্তেয় লোকজনকে কেই–বা আহ্লাদ করে দাওয়াত দিতে যায়? তার ওপর যার কিনা একটা ভালো উপহার দেওয়ারও সামর্থ্য নেই।

ভাবলাম, কেউ দাওয়াত না করুক, নিজের পয়সাতেই কাচ্চি খাব আজ। কাচ্চি খাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে একসময় অবাক হয়ে দেখি, পথ ভুলে আমি শাহবাগের ফুচকার দোকানের সামনে। মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। ব্যাপার কী?

এআই শান্ত গলায় বলল, জানি। তুমি একজন ব্যর্থ লেখক। দিনমান কলম পেষা চাকরি করা আর লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখা একজন আনপ্রোডাক্টিভ নাগরিক।

তোমার পকেটের অবস্থা শোচনীয়। কাচ্চিটাচ্চি খাওয়ার সময় নয় এখন। ফুচকাই খাও—আমার পকেটের ভেতর থেকে আইডির মধ্যকার এআই কথা বলে উঠল।

রেগে গিয়ে বললাম, পকেটের অবস্থা তোমাকে ভাবতে হবে না। দরকার হলে ধার করে কাচ্চি খাব। তোমার কী?

—অলরেডি কিন্তু তোমার অনেক ধারকর্জ। এই ধার মেটাতে তোমার সময় লাগবে ১১ বছর ২৭ দিন ১৮ ঘণ্টা। যদি এভাবে শুয়ে–বসে দিন কাটাও আরকি!

আমি চমকে উঠলাম।

—বলো কী? কবে আমি এত ধার করলাম?

—তুমি করো নাই। তোমার হয়ে রাষ্ট্র ধারকর্জ করেছে। তার দায়দায়িত্ব তোমার ওপরও বর্তায়। নাগরিক হিসেবে একটা দায়িত্ব আছে না তোমার?

—ফাজলামি পাইছ? কাচ্চি আমি আজকে খাবই। খবরদার, তুমি নাক গলাবা না আমার বিষয়ে।

আমার এআই নাছোড়বান্দা। বকবক করেই চলেছে, অযথা টাকাপয়সা নষ্ট করো না। টাকা জমাতে শেখো। সামনে দিন খারাপ। তখন ফুচকা খাওয়ার টাকাও জুটবে না কিন্তু!

আমি ভয়ানক রেগে গেলাম, হারামজাদা এআইর বাচ্চা চুপ কর। তুই জানিস আমি কে?

এআই শান্ত গলায় বলল, জানি। তুমি একজন ব্যর্থ লেখক। দিনমান কলম পেষা চাকরি করা আর লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখা একজন আনপ্রোডাক্টিভ নাগরিক। আমার কপাল খারাপ যে আমাকে তোমার আইডিতে দেওয়া হয়েছে। এখন বাড়ি চলো, নইলে বাইরের দূষিত খাবার খেয়ে অযথা শরীর খারাপ করবে।

এ জন্যই বলি, তুমি বেকুব। জগতের পরাজিত মানুষদের একজন। তোমার কোনো প্রেডিকশন পাওয়ার নেই।

১৮ ডিসেম্বর ২০২২

আজ রাতে খেলা দেখার প্রস্তুতি নিয়েছি। চানাচুরের প্যাকেট কেনা হয়েছে। এলিফ্যান্ট রোডে একটা ভ্যানগাড়িতে আর্জেন্টিনার জার্সি বিক্রি করছিল, দামে পোষায়নি বলে কেনা হলো না। তবে একটা ফ্ল্যাগ কিনেছি ফুটপাত থেকে। ফ্ল্যাগটা খাটের খুঁটির সঙ্গে লাগানো হয়েছে। কোকও আনা হয়েছে হাফ লিটারের। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পুরোনো টিভিটা ছেড়ে দেখি, ঝিরঝির করতে শুরু করেছে। কী সর্বনাশ! কালকেও তো চলছিল টিভিটা। ফোনে ডেটা নেই যে দেখব। মেজাজটাই গেল খারাপ হয়ে। ধুর!

এই সময় আমার এআই কথা বলে উঠল নষ্ট টিভির মধ্য থেকে।

তুমি একটা ডাহা বেকুব!

—কেন? কী করলাম আমি? অবাক হলাম শুনে।

—আরে আর্জেন্টিনার কাপ জেতার সম্ভাবনা ৪৪ শতাংশের কম। আর তুমি এই দলের সাপোর্ট করছ!

—সাপোর্টের আবার পারসেন্টেজ হিসাব আছে নাকি? আমি মেসিকে ভালোবাসি। আর্জেন্টিনাকেই সাপোর্ট করি। হার–জিত কোনো ব্যাপার না।

—এ জন্যই বলি, তুমি বেকুব। জগতের পরাজিত মানুষদের একজন। তোমার কোনো প্রেডিকশন পাওয়ার নেই। সময়মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বুদ্ধি নেই। এখনো সময় আছে, ফ্ল্যাগটা পাল্টাও। জেতার দলকে সাপোর্ট করো।

—প্রশ্নই আসে না। এবার আমি রেগে গেলাম। শোনো, আর্জেন্টিনা একটা আবেগের নাম। ম্যারাডোনা, মেসি। হোর্হে লুইস বোর্হেস। এমনকি আমাদের রবীন্দ্রনাথের বান্ধবীও আর্জেন্টিনার। আর্জেন্টিনা অন্য ব্যাপার। তুমি বুঝবা না।

—শোনো, আবেগের কোনো দাম নেই খেলায়। খেলা এখন ডিজিটাল। আমার মতো এআইরা স্পোর্টস–দুনিয়া দখল করে নিছে। আমরা যা চাই, তা–ই হয়। শোনো, টিভিটা আমিই নষ্ট করছি। এই ফালতু খেলা দেখে রাতের ঘুম নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

—ওমা, আমি তবে খেলা দেখব না?

—সকালে পত্রিকা পড়ে জেনে নিয়ো কে জিতেছে। রাতে নির্বোধ লোকজনের চেঁচামেচি শুনলেও বুঝতে পারবা। এখন ঘুমাও। কালকে অফিস আছে। দুটি মিটিং আছে, মিটিংয়ে তোমার প্রেজেন্টেশন। ভুলে গেছ?

আমি হতাশ ভঙ্গিতে বললাম, তুমি এমন কেন বলো তো আমাকে? আমার সব পছন্দ–অপছন্দ, ভালো লাগা না লাগাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও! তুমি আমার জীবনটা কেন নিয়ন্ত্রণ করো?

সে এবার হেসে বলল, কারণ, আমি তোমার এআই। তুমি ইন্টেলিজেন্ট নও, কিন্তু আমি ইন্টেলিজেন্ট। আর্টিফিশিয়াল হলেও তোমার চেয়ে বেশি ইন্টেলিজেন্ট।

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত