ওহিদের চাকরি চলে গেছে। এই ৬০ বছর বয়সে চাকরি চলে গেলে হয়? এখন সে কী করবে? কোথায় থাকবে? কোথায় খাবে? ওহিদ বেশ চিন্তিত বোধ করে। কিন্তু সব খারাপেরও একটা ভালো দিক আছে। বয়সকালে ওহিদ যদি বিয়ে করত, তাহলে তার ছেলেমেয়ে থাকত, তাদের এখন কী হতো! গভীর জলে পড়তে হতো। ওহিদ লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ওহিদ বসে আছে কমলাপুর স্টেশনে। তার আশা, হঠাৎ যদি পরিচিত কাউকে পায়, তার কাছে সাহায্য-সহযোগিতা কি পাবে না একটু। কত মানুষেরই তো আসা–যাওয়া এই পথে, দেশগ্রামের কাউকে যদি পাওয়া যায়।
এই তো কিছুদিন আগেও ওহিদ এক ধনী ব্যবসায়ীর বাড়িতে মালির চাকরি করত, তিনতলা ডুপ্লেক্স বাড়ির পেছনে বিশাল বাগান। সেখানে বেশ ভালোই কাটছিল তার দিনকাল। থাকা–খাওয়া ফ্রি, মাস শেষে বেতন। হোক খুব কম, তাতে কী! তখনই একদিন বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন তাকে।
তুমি ওহিদ?
জি।
আমার এখানে মালির কাজ করো?
জি।
তুমি নাকি বাগানের আগাছার একটা আলাদা বাগান করেছ?
জি
কেন?
স্যার, ওরাও তো অক্সিজেন দেয়, ওদের ফেলে দিতে মায়া লাগে। তাই পেছন দিকে একটা খালি জায়গায় একটু...
স্টপ! হঠাৎ বড় স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন, গাছ অক্সিজেন দেয়? বিরাট বিজ্ঞানী দেখছি তুমি! জগদীশচন্দ্র হয়েছ? ফাজিল কোথাকার। আসল গাছের যত্ন নেই, আগাছার যত্ন। গেট আউট...গেট আউট!
তারপর আর কী, এককথায় বিদায়। টুকটাক কিছু শখের জিনিস কিনেছিল টাকা জমিয়ে। সেগুলো ড্রাইভারটা রেখে দিয়েছে। বলেছে, বড় স্যার কিছু নিতে নিষেধ করেছে...ড্রাইভার যে মিথ্যা বলছে বোঝাই যাচ্ছে। কী আর করা, এক বস্ত্রেই বের হয়ে এসে হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর স্টেশনে।
সে রাতে ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল ওহিদ। যেন সে খোলা মাঠে শুয়ে আছে, তার চারদিকে ধোঁয়ার মতো অনেকগুলো খাম্বা এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠছে...ওপরে গিয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে গোল হয়ে, যেন সব ধোঁয়ার গাছ; দেখতে বেশ লাগছে। এই সময় কে যেন কথা বলে উঠল। গলাটা একটু ভাঙা ভাঙা।
ওহিদ?
জি।
আমরা তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই।
কেন জনাব? আপনি কে?
আমরা গাছ।
গাছ? গাছ কীভাবে কথা বলে?
গাছ কথা বলে না। কিন্তু কখনো কখনো প্যাটার্ন ভেঙে আমরা কথা বলি।
প্যাটার্ন কী?
প্যাটার্ন হচ্ছে...আচ্ছা তোমাকে সহজ করে বোঝাই। গাছে যে পাতা গজায়, তা কিন্তু ফিবোনাক্কি রাশিমালা অনুসরণ করে গজায়। ১ ১ ২ ৩ ৫ ৮ ১৩...আগের দুই সংখ্যার যোগফল পরেরটা। এই ফিবোনাক্কি রাশিমালা সংখ্যাতত্ত্বের একটি বিখ্যাত প্যাটার্ন।
ফিবোনাক্কি রাশিমালা কী?
এটা একটা সংখ্যার সিরিজ। প্রকৃতি সর্বক্ষেত্রে এই রাশিমালার প্যাটার্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে কোটি কোটি বছর ধরে। সূর্যমুখী ফুলে দেখবে এই প্যাটার্ন আছে, সমুদ্রের শামুকের খোলসেও দেখবে এই প্যাটার্ন আছে...মোটকথা, প্রকৃতি প্যাটার্ন ভাঙে না সহজে। বুঝলে?
ওহিদ আসলে কিছুই বুঝল না। তারপরও মাথা ঝাঁকাল। বলল, জি বুঝেছি।
কিন্তু তারপরও প্রকৃতি মাঝেমধ্যেই প্যাটার্ন ভাঙে, বড় রকম করে ভাঙে, ভাঙতে হয়, না ভাঙলে তোমাদের মানবসভ্যতা তৈরি হতো না। মিউটেশনের মাধমে প্রকৃতি শত–সহস্র কোটিবার প্যাটার্ন ভাঙে ...নইলে ইভল্যুশন হতো না!
এই পর্যায়ে এসে ওহিদের স্বপ্নটা ভেঙে যায়। রেলওয়ে পুলিশের লোক লাঠি দিয়ে পেটে গুঁতা দিয়ে তার ঘুম ভাঙায়, এই যে চাচা মিয়া, উঠেন। এখানে ঘুমানো যাবে না। বাইরে যান জলদি জলদি। ওহিদ উঠে পড়ে। তার সঙ্গের ছোট্ট পুঁটলিটা নিয়ে বাইরে আসে।
এবার ওহিদের জায়গা হয়েছে একটা পার্কে। এটাই বোধ হয় রমনা পার্ক।
কী আশ্চর্য, সেই রাতে আবার সেই স্বপ্ন!
ওহিদ?
জি।
যা বলছিলাম আমরা, তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। কারণ, তুমি আমাদের জন্য এখন কষ্ট করছ। কিন্তু উপহার নেওয়ার আগে তোমাকে প্যাটার্ন বুঝতে হবে। আমার হাতে এটা কী?
স্যার, একটা ঘড়ি।
কয়টা বাজে ঘড়িতে?
স্যার, সাড়ে এগারোটা।
এক ঘণ্টা পর কয়টা বাজবে?
স্যার, সাড়ে বারোটা।
তার এক ঘণ্টা পর কয়টা বাজবে?
স্যার, দেড়টা। হা হা করে লোকটা হাসল। মানে যে লোকটা স্বপ্নের মধ্যে কথা বলছিল ভাঙা ভাঙা স্বরে। তার হাসিটাও ভাঙা ভাঙা।
হাসলেন কেন, স্যার?
তুমি যে প্যাটার্ন ভাঙলে বুঝতে পেরেছ?
কখন ভাঙলাম?
তুমি সাড়ে বারোটার পর বললে দেড়টা, কেন? সাড়ে একটা বললে না কেন? সাড়ে একটার এক ঘণ্টা পর কয়টা বাজবে?
স্যার আড়াইটা।
এই যে তুমি আবার প্যাটার্ন ভাঙলে। সাড়ে দুইটা বলতে সমস্যা কী? আচ্ছা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে তোমাকে আরও সহজ করে বোঝাই এবার। যেমন ধরো, তুমি বা তোমরা বলো একচল্লিশ বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ চৌচল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ছয়চল্লিশ সাতচল্লিশ আটচল্লিশ...তারপর কী বলবে?
স্যার, উনপঞ্চাশ।
এই তো আবার প্যাটার্ন ভাঙলে। কেন নয়চল্লিশ বললে সমস্যা কী?
স্যার, বুঝলাম।
কী বুঝলে?
স্যার, এই যে আপনার প্যাটার্ন ভাঙার ব্যাপারটা।
শাবাশ।
স্যার, উপহারটা কখন দেবেন?
উপহার তোমাকে আমরা দিয়েছি। যেই মুহূর্তে তুমি প্যাটার্ন বুঝেছ, প্যাটার্ন ভাঙার ব্যাপারটা বুঝেছ, তখনই আমরা তোমাকে উপহার দিয়েছি। তারপর হঠাৎ সব চুপ।
স্যার? স্যার? ...ও স্যার?? আর কোনো সাড়াশব্দ নেই চারদিকে। আশপাশে ধোঁয়ার গাছগুলোও আর নেই। ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে যায়। এবারও লাঠির গুঁতা খেয়ে ঘুম ভাঙে ওহিদের।
এই যে বুড়া মিয়া, পার্কে কী করেন? খারাপ মেয়েছেলে নিয়া মৌজ করার ধান্দা? বুড়া হইছেন, রস তো কমে নাই...অ্যাঁ? যান, যান, রাতে পার্কে ঘুমানো নিষেধ। জলদি বাইরান। নাইলে পুলিশে ধরায়া দিমু কইলাম।
ওহিদ উঠে বসে। তারপর লোকটার দিকে গভীরভাবে তাকায়—
আচ্ছা আপনি খারাপ মেয়েছেলে বললেন, খারাপ ব্যাটাছেলে হয় না?...আপনি যে একটা খারাপ ব্যাটাছেলে, এইডা বোঝেন? পার্কের লোকটা হঠাৎ কেমন যেন ভড়কে যায়। হাতের লাঠিটা পেছনে লুকিয়ে ফেলে। ফ্যাকাশে ভাবে হাসে, তারপর ঠোঁট চাটে।
ওহিদ পার্ক থেকে বের হয়ে আসে। কী আশ্চর্য, ঢাকা শহরে কেউ তাকে শান্তিমতো ঘুমাতেও দেবে না নাকি একটা রাত! কী মনে করে ওহিদ হাঁটা দিল সেই বড় সাহেবের বাড়ির দিকে। রাত দুটোর সময় গিয়ে তাদের গেটের সামনে হাজির। গেট বন্ধ। ওহিদ বিড়বিড় করে বলল, প্যাটার্ন ভাঙতে হবে, প্রকৃতি মাঝেমধ্যেই প্যাটার্ন ভাঙে! গেটের কর্কশ বেলটা বাজাল। একটু পর গেট খুলল ড্রাইভার হানিফ। তার চোখেমুখে ঘুম। অবাক হয়ে ওহিদের দিকে তাকাল।
কী হানিফ, দেখো কী? দরজা খোলো।
হানিফের চোখেমুখে কেমন একটা ভয় কাজ করল। সে গেট খুলে সরে দাঁড়াল। ওহিদ হাসিমুখে তাকাল হানিফের দিকে। বলল, সারা দিন না খাওয়া, খানার ব্যবস্থা করো হানিফ।
এত রাতে কে এল? বড় সাহেব উঠে বসলেন। কলবেল বাজছে। কাজের লোকগুলো সব কই? ওরা শোনে না নাকি! তিনি নিজেই ঘুম ঘুম চোখে গিয়ে দরজা খুললেন।
কী হয়েছে হানিফ?
স্যার, ওহিদ আসছে। বড় সাহেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি ঘুরে তাকালেন, পেছনে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে, তার মুখেও ভয়। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, নীলু, টেবিল লাগাতে বলো, ও নিশ্চয়ই সারা দিন খায়নি। ও আজ এখানেই খাবে।
*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত