অগ্নিপুত্র

হারমিয়োনির পঞ্চম সিম্ফনির সুরে কসমিক ফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে ওটা কানে ঠেকাল কুনিল কুশোনুক। ‘হ্যালো কে, আব্বু?...কী খবর? কেমন আছ তুমি?...এই তো, ভালোই আছি সবাই। কাজকর্ম কেমন চলছে তোমাদের?...কী বললে, আগামী সপ্তাহে আসছ? সত্যি?...হুররে! দারুণ খবর শোনালে, আব্বু! কত্ত দিন পর কাছে পাব তোমাকে! আম্মু শুনলে তো...। বাসায়ই আছে আজ আম্মু, ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। রান্নাঘরে আছে বোধ হয় এখন। ডেকে দেব? কথা বলবে? ...আচ্ছা, ঠিক আছে, বলব আমি আম্মুকে।...কী বলছ, এক্ষুনি ছাড়তে হবে ফোনটা?...মাত্র তো শুরু হলো কথা, এত তাড়াতাড়ি ছাড়াছাড়ি কিসের?...ধুর, জরুরি কল আসার টাইম পেল না আর! যাকগে, কী আর করা! ভালো থেকো তুমি। দেখা হচ্ছে সামনের সপ্তাহে।’

লাইনটা কেটে যেতেই খাঁ খাঁ অনুভূতিটা আবার ফিরে এল কুনিলের বুকে। এখন পুরোপুরি নিশ্চিত ও, কোনো দিনই আর দেখা হবে না নিজের জন্মদাতার সঙ্গে। দুই বছর আগের দেখাটাই পিতা-পুত্রের শেষ দেখা।

ব্রোটন সাইবারডাইন সিস্টেমের অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কৌশলে হত্যা করা হয়েছে ড. রিশিল কুশোনুককে। ওপেন নেটওয়ার্কে ধামাচাপা দিয়ে রাখা গেলেও এরই মধ্যে ডিপওয়েবে ছড়িয়ে পড়েছে খবরটা। লং ডিসট্যান্স কলটা আসার খানিক আগেই দুঃসংবাদটা জানতে পেরেছে কুনিল।

রিমোট কন্ট্রোলারের মতো একখানা যন্ত্র তুলে নিল সে কোমরের খাপ থেকে। কুনিলের দিকে তাক করে ধরে যন্ত্রের লাল বোতামে চাপ দিতেই মুহূর্তের মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ল সে

সাইবারডাইনের হর্তাকর্তারা ভেবেছিল, ড. রিশিলের রেকর্ড করা গলার স্বর থেকে স্পিচিং প্রোগ্রাম তৈরি করে ধোঁকা দেওয়া যাবে তার পরিবারকে। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করে অভ্যস্ত কুনিলকে বোকা বানাতে পারেনি ওরা।

অনেকক্ষণ থ মেরে বসে থাকার পর রান্নাঘরে উঁকি দিল ও।

চিংড়ি ধুচ্ছিলেন মিসেস কুশোনুক। ছেলের উপস্থিতিতে কাজ থামিয়ে মুখ তুলে চাইলেন। ‘কী রে, বলবি কিছু?’

‘না মানে দেখতে এলাম আরকি, তোমার কিছু লাগবে নাকি।’

‘হ্যাঁ, গ্যাসটা মনে হচ্ছে কমতির দিকে।’

‘আচ্ছা আম্মু, দেখছি আমি ব্যাপারটা।’

ট্যাকিনগান হাতে বাসার পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল কুনিল। এখানেই ডাম্প করা হয় রোজকার ময়লা-আবর্জনাগুলো। সেগুলোই আবার প্রক্রিয়াজাত হয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে গ্যাস হিসেবে। বেশুমার অপচয়ের কারণে বেশ কয়েক বছর হলো ফুরিয়ে গেছে পৃথিবীর প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত।

ট্যাকিনগানের বাটন চেপে স্তূপ করা জঞ্জালের একটা অংশ অদৃশ্য করে দিল ও। এরপর চাপ দিল আরেকটি বোতামে। ব্যস, বাড়ির বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে চলে গেল ময়লাগুলো। রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস এবার উত্পন্ন হবে ওখানে।

নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল কুনিল। দুপুরের পাত পড়ার আগেই শেষ করে ফেলতে চায় রোবটের অবশিষ্ট কাজটা। মেমোরি সেলটা লাগানো হয়ে গেলেই...।

‘উহ আম্মু,...মনে হচ্ছে বেহেশতের খানা খাচ্ছি! একদম অমৃত! জাদু আছে নাকি তোমার হাতে?’

ছেলের প্রশংসা শুনে প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ল মিসেস কুশোনুকের চেহারায়। ওর আবদারেই কাজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন আজ। দিনের পর দিন ফুডপিল খেতে খেতে ছেলের নাকি অরুচি ধরে গেছে মুখে। সে জন্যই কুনিলের পছন্দের চিংড়ির মালাইকারি রেঁধেছেন আজ নিজ হাতে। সিনথেটিক চিংড়ি নয়, আসল চিংড়ি। কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি এগুলো জোগাড় করতে গিয়ে। কেউ তো আর আজকাল রান্নাবান্নার ঝামেলায় যেতে চায় না। সে কারণে চিংড়ির মতো আরও অনেক কিছুই দুর্লভ হয়ে উঠেছে বাজারে। শেষমেশ অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনতে হয়েছে দরকারি জিনিসগুলো।

অলংকরণ: রাকিব

চিংড়ির মাথা চিবোতে চিবোতে সিদ্ধান্ত নিল কুনিল, এখনই মাকে দেবে খারাপ খবরটা। মুখের খাবারটুকু গলায় পাঠিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়েছে, এ সময় আচমকা খুলে গেল সদর দরজাটা।

নিরাপত্তা বাহিনীর উর্দি পরা একঝাঁক সৈন্য উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। ভয়ংকর কোনো টেররিস্টকে পাকড়াও করতে এসেছে যেন।

‘একদম নড়বেন না কেউ!’ চিত্কার করে সতর্ক করল একজন। ‘নড়লেই গুলি!’

দলটা দুদিকে ভাগ হয়ে দাঁড়াতেই মাঝখান দিয়ে সামনে এগিয়ে এল ওদের কমান্ডার। ক্রূর দৃষ্টি কুনিলের দিকে। বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘তাহলে কিছুই তোমার অজানা নেই, তাই না খোকা? ট্রেভর!’

‘স্যার!’ এক কদম আগে বাড়ল এক সৈন্য। চেহারায় ইস্পাতের কাঠিন্য। রিমোট কন্ট্রোলারের মতো একখানা যন্ত্র তুলে নিল সে কোমরের খাপ থেকে। কুনিলের দিকে তাক করে ধরে যন্ত্রের লাল বোতামে চাপ দিতেই মুহূর্তের মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ল সে। খাবারের প্লেটের ওপর লুটিয়ে পড়ল মাথা।

এবার আরেকটা বোতাম টিপে ইউনিভার্সাল অ্যাসাইলামে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ওকে টেলিপোর্টের মাধ্যমে। ওখানে ওর ব্রেইন ওয়াশ করা হবে।

যেমন ভোজবাজির মতো উদয় হয়েছিল, সেভাবেই উধাও হয়ে গেল দলটা।

বিমূঢ়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন শুধু মিসেস কুশোনুক, ঘর ফাঁকা হতেই ভেঙে পড়লেন কান্নায়। কী থেকে কী হলো এসব, কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।

ছেলেহারা মায়ের কষ্টে সমব্যথী হয়েই যেন অন্ধকার হয়ে এল বাইরেটা। খানিক পরই বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙে।

হঠাৎ কাঁধের ওপর কারও হাত পড়তেই চমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা। পেছন ফিরে তাকাতেই বিস্ফারিত হয়ে উঠল তাঁর চোখ জোড়া। ‘কুনিল!’

‘হ্যাঁ আম্মু, আমি।’

‘কিন্তু...তুই কীভাবে...?’ বিস্ময়ে কথা শেষ করতে পারলেন না মিসেস কুশোনুক।

‘বুদ্ধি করে, আম্মু। রোবট অলিম্পিয়াডের জন্য আমার চেহারার আদলে বানিয়েছিলাম বায়োবটটা। ওটার সাহায্যেই ঘোল খাইয়েছি ওদের। এখন জরুরি কয়েকটা কথা বলছি, শোনো! আজই এখান থেকে গা ঢাকা দিতে হবে আমাদের! আব্বু...বিনা দোষে আব্বুকে মেরে ফেলেছে ওরা! তবে আমিও দেখে নেব অমানুষগুলোকে! নিরাপদ একটা ডেরা দরকার প্রথমে, এরপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হচ্ছি আমি ব্রোটনের পথে...!’