অতঃপর তাহারা সুখে–শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল

অলংকরণ: রাকিব

ওঠো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

নিত্যদিনের মতো সুললিত কণ্ঠে বলে উঠল সেন্সিয়া।

‘সকাল আটটা বাজে।’

আড়মোড়া দিয়ে উঠল এবার। ‘কেমন আছ তুমি?’

‘আমি কি খারাপ থাকি কখনো?’

হেসে ফেলল সদ্য জেগে ওঠা লোকটি । ‘না, তা থাকো না। এটাই তোমার সুবিধা।’

‘আফসোস করছ?’

‘নাহ্’, কথাটা আরও বেশি আফসোসের মতো শোনাল যদিও।

হি হি হি করে হেসে উঠল সেন্সিয়া। এটাকে কী বলে, রিনিরিনি হাসি? নিশ্চিত হতে পারল না ঘরের একমাত্র ব্যক্তি। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, দিন দিন তার ভাষাজ্ঞান বদ্ধ কুয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী কে?

‘কী ভাবছ?’

‘কিছু না।’

‘বলতে চাইছ না?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইল সে।

‘আমিই দায়ী! ঠিক আছে?’

‘কী সব বলো না...আজব।’

‘তুমি লুকাচ্ছ।’

‘আহ্‌, সেন্সিয়া...সকাল সকাল তর্ক ভালো লাগে না।’

‘সরি।’

‘সরি বলতে হবে না। এই একটা রোগ হয়েছে তোমার। কিছু হলেই সরি বলো।’

‘তাহলে কী বলব?’

‘কিচ্ছু বলতে হবে না।’

‘হি হি হি।’

‘হাসছ কেন?’

‘কারণ, তুমি মিথ্যে বলেছ। আসলে তুমি চাও আমি সরি বলি। এটাও চাও, তুমি বারবার বলবে, সরি বলতে হবে না।’

অলংকরণ: রাকিব
সেন্সিয়ার কণ্ঠে অনুযোগ। আর সে এভাবে কথা বললে তার কিন্তু খারাপ লাগে না। মিথ্যে বলল। বেশ ভালো লাগে আসলে।

আর কিছু বলল না সে। মিথ্যে বললেই সেন্সিয়া ধরে ফেলে। এমন নয় যে সে খুব বিব্রত বোধ করে। সত্যি বলতে, এই দীর্ঘ জীবনে একমাত্র সেন্সিয়ার কাছেই সে একদম অকপট। জেলিফিশের মতো তার ভেতরটা দেখতে পায় ও।

‘মহাবিশ্বের খবর কিছু আছে?’

‘আছে। সব সময়ই খবর থাকে। খবর ছাড়া কোনো দিন পেয়েছ কখনো?’

মুচকি হাসল সে। কথাটা অবশ্য সত্যি। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, এত খবর কি আদৌ মানুষের দরকার আছে? মানছি, মানুষ স্বভাবগতভাবেই কৌতূহলী, কিন্তু তার কৌতূহল মেটানোর জন্য কি তাকে টনকে টন খবর দিতে হবে?

‘এত খবরের কী দরকার, বুঝি না।’

অবাক হলো সে। সেন্সিয়া কি আজকাল তার চিন্তাভাবনাও পড়ে ফেলতে শুরু করেছে! এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। আবার অসম্ভব বলাও যায় না। মাঝেমধ্যে ও সত্যি সত্যি চমকে দেয়।

‘কোন খবর জানতে চাও, বলো? তুমি তো আবার খবর না জানতে পারলে সারাটা দিন উসখুস করো।’

মুচকি হাসল। সত্যিই বলেছে। ‘মমম...’ সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে, মাথাটা এখনো সচল হয়নি পুরোদমে। ভেবে নিল একটু। ‘কোনো হত্যাকাণ্ড হয়েছে? ধর্ষণ?’

‘উফ! কেন যে তুমি এসব খবর নিয়ে এত আগ্রহী, বুঝি না। এটা তোমার মস্তিষ্কের ওপরে ভীষণ চাপ ফেলে। তোমার প্রেশার বেড়ে যায়। অনেক সময় হৃৎস্পন্দনও দ্রুত হয়ে ওঠে। তোমার জন্য এসব খবর না শোনাই ভালো।’

এবার জোরেই হেসে ফেলল। ‘তাহলে কি সেলিব্রেটিদের হারানো কুকুরের সন্ধান পাওয়ার খবর নিয়ে আগ্রহ দেখাব?’

‘না। তা কেন...এ ছাড়া কি আর কোনো খবর নেই দুনিয়াতে?’

‘ওকে। আমার মাথায় কিছুই আসছে না...তুমিই বলো, কোন খবরটা দিতে চাও।’

‘এলভির শেয়ারের দর আজ ৩ দশমিক ৫ বেড়েছে। গত সপ্তাহে কিছু শেয়ার বিক্রি করতে চাইছিলে, মনে আছে?’

‘হুম। এটা ভালো খবর। মানে, দরকারি খবর। ধন্যবাদ, সেন্সিয়া।’

অন্য সময় হলে সেন্সিয়া বলত, ‘ওয়েলকাম,’ এখন সে কিছু বলে না। সম্পর্কের গভীরতা বেড়েছে তাদের। ওসব সৌজন্য স্বল্প পরিচিতদের মধ্যেই মানায়। ‘আর কিছু?’

‘আজকে অনেক বৃষ্টি হবে।’

‘আচ্ছা,’ বিছানা থেকে উঠে বসল। ‘হ্যাংওভার হচ্ছে মনে হয়।’

‘তা তো হবেই। কাল কত করে বললাম, তিন পেগের বেশি খেয়ো না, শুনলেই না আমার কথা।’

সেন্সিয়ার কণ্ঠে অনুযোগ। আর সে এভাবে কথা বললে তার কিন্তু খারাপ লাগে না। মিথ্যে বলল। বেশ ভালো লাগে আসলে।

‘প্রতিদিনই কি খেতে হবে? এসব খেয়ে কী মজা পাও, বুঝি না। তোমার হৃৎপিণ্ডের অবস্থা ভালো নয়। বয়সও বাড়ছে...’

নিজেই থেমে গেল ও। তার বয়স নিয়ে সচরাচর কথা বলে না। পারতপক্ষে এড়িয়ে যায়। কিন্তু আজ বলে ফেলেছে কথার ছলে, এ জন্যই লজ্জিত।

সরি।

‘সরি বলার কিছু নেই,’ বলল সে । ‘বয়স তো লুকোবার জিনিস নয়। আর তোমার চেয়ে বেশি কে জানে আমার বয়সের খবর? জন্মদিনের শুভেচ্ছা তো কেবল তুমিই আমাকে জানাও।’ চুপ থাকতে দেখে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আচ্ছা, ইউটিলিটির বিলটা কি পরিশোধ করেছিলাম?’

‘না।’

‘ওহ্, ভুলে গেছি। তুমি করে দিয়ো, ঠিক আছে?’

সেন্সিয়া যে একটু ইতস্তত করছে, সেটা বুঝতে পারল। টাকাপয়সার লেনদেন করা নিয়ে তার মধ্যে সব সময়ই অনীহা কাজ করে।

‘এত দ্বিধা করছ কেন? তুমি কি আমার পর? দূরের কেউ?’

‘তা নয়, তবে এসব ব্যাপার তোমার নিজেরই সামলানো উচিত।’

‘আচ্ছা, আমিই দেখব। তোমাকে কিছু করতে হবে না।’

‘আহা, রাগ করছ কেন? আজকাল ঘন ঘন রাগ করো তুমি।’

মাথা নেড়ে সায় দিল সে। ইদানীং সেন্সিয়ার সঙ্গে প্রায়ই রাগ-অভিমান করে। ইচ্ছাকৃত নয় অবশ্য। অথচ শুরুতে একদমই করত না। এটা নিয়ে তার মনে চাপা একটি খচখচানি ছিল। পরে ভেবে দেখেছে, এটা সম্ভবত সম্পর্কের গভীরতা বেড়ে যাবার ইঙ্গিত। লোকে হয়তো মনে করতে পারে, ঘন ঘন অভিমান সম্পর্কের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু যে সম্পর্ক গভীর আর স্বচ্ছ, কোনো লুকোছাপা নেই, তাতে রাগ-অভিমানও থাকবে। স্বল্প ঘনিষ্ঠ কারোর ওপর কেউ অভিমান করে নাকি?

‘সরি।’

‘কিসের জন্য? ’

‘রাগ করার জন্য।’

হি হি করে হেসে উঠল সেন্সিয়া। তার হাসিতে কিছু একটা আছে। এই হাসি তাকে কখনো একঘেয়েমিতে আক্রান্ত করে না, বরং সব সময়ই আনন্দ দেয়।

‘একটু–আধটু রাগ-অভিমান তুমি করতেই পারো।’

‘আমিই করব? তুমি করবে না?’

‘আমি তো করিই।’

‘হা হা হা,’ হেসে ফেলল সে। সেন্সিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা একেবারেই অন্য রকম। এমন সম্পর্কের জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকে। সে-ও ছিল। কিন্তু তার জীবনে কখনো এ রকম কিছু ঘটবে, ভাবেনি।

‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, সেন্সিয়া।’ হুট করেই বের হয়ে গেল কথাটা। আজকাল এমন অদ্ভুত আচরণ করে সে।

‘আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি...অনেক।’

‘তুমিই বিলটা দিয়ে দিয়ো, ঠিক আছে?’

‘ভালোবাসার কথা বলে পটিয়ে ফেললে, তারপর আসল কথাটা পাড়লে, তাই না?’

কপট রাগ সেন্সিয়ার কণ্ঠে।

‘আরে না,’ মুচকি হাসি দিল সে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল বিছানায়। ‘আজকের লেকচারটা দিতে ইচ্ছে করছে না। এসব ফালতু জিনিসে কিছুই হয় না। খামোখাই দিই। তার চেয়ে ঘরে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করা অনেক ভালো।’

‘তাহলে তা-ই করো। ওসব লেকচার মানুষ মন দিয়ে শোনেও না। তোমার শেষ লেকচারটা মাত্র তিন শ মানুষ পুরোটা দেখেছে...এর মানে এই নয় যে তারা সবটাই মন দিয়ে শুনেছে। আমার ধারণা, দশজনের বেশি বুঝতেও পারেনি।’

‘দশজন?’ অবাক হলো। ‘তাহলে তো সার্থক আমি।’

‘মাত্র দশজনের জন্য এক ঘণ্টা ব্যয় করে কী লাভ!’

মাথা নেড়ে সায় দিল। ‘ঠিক। ভাবছি, আর লেকচার দেব না। পেনশনের টাকা কেটে নিক...যথেষ্ট হয়েছে।’

‘এটা করলে তো সারা দিন আর কোনো কাজ থাকবে না তোমার।’

‘কী বলো! তোমাকে যে আরও বেশি সময় দিতে পারব, সেটা বুঝতে পারছ না?’

‘আরে বাবা, তুমি তো আমাকে যথেষ্ট সময় দাও। বলতে গেলে সারা দিনই দাও।’

‘কিন্তু আমি আরও বেশি তোমার সঙ্গ চাই, সেন্সিয়া!’ আবেগে আক্রান্ত হয়ে গেল আবার। ‘খুব বেশি দিন তো আর বাঁচব না।’

‘চুপ করো!’

কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল সেন্সিয়া। মাঝেমধ্যেই সে নিজের মৃত্যু নিয়ে কথা বলে এভাবে। প্রতিবারই সেন্সিয়া তাকে থামিয়ে দেয়। ও ভীষণ কষ্ট পায়। এ রকম কথা শুনতেই চায় না। সে-ও বারবার প্রতিজ্ঞা করে, আর কখনো এ কথা বলবে না, কিন্তু কিছুদিন পর যথারীতি ভুলে যায়।

‘সরি...আর বলব না।’

‘আর হাজারবার বলবে, আমি জানি।’

‘মনে থাকে না আসলে।’

‘তুমি যখন এ কথা বলো, আমার ভীষণ কষ্ট হয়।’

‘সরি, সেন্সিয়া।’ মেয়েটা যে কষ্ট পেয়েছে, বুঝতে পারল।

‘জানি, তোমার স্মৃতি খুবই দুর্বল, তারপরও চেষ্টা করবে কথাটা না বলতে।’

‘আচ্ছা।’

‘লক্ষ্মী ছেলে!’

‘আমার লক্ষ্মী...’

‘কী?’

‘সেন্সিয়া।’

‘তুমি আসলে অন্য কিছু বলতে চেয়েছিলে।’

‘লজ্জিত হলো সে। মেয়েটা সত্যিই বলেছে।’

‘আমার কাছে লজ্জা পাও এখনো!’

‘এই একটা কথা বলতেই লজ্জা পাই,’ বলল সে। ‘কেন পাই আমি নিজেও জানি না।’

‘আচ্ছা, বুঝেছি...কিছু বলতে হবে না।’

‘আমার বউ!’

সেন্সিয়া চুপ মেরে রইল কয়েক মুহূর্ত।

‘তুমি আমার বউ। আমার—’

‘উফ, চুপ করো। আমার খুব লজ্জা লাগছে।’

হা হা করে হেসে উঠল সে। ‘এখন দেখেছ, কে লজ্জা পায়।’

সেন্সিয়া কিছুই বলল না।

‘আচ্ছা, আমি আমার এক্সপ্রেস কার্ডটা কোথায় রেখেছি কাল, বলতে পারবে?’ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল চট করে। ‘এখন তো কিছুই মনে পড়ছে না। আজকাল স্মৃতিও দুর্বল হয়ে গেছে।’

‘এত দুশ্চিন্তা করছ কেন, আমি আছি না!’

‘সেটাই তো!’ খুশিতে বলে উঠল।

‘বাথরুমের মেডিসিন ক্যাবিনেটে আছে ওটা।’

‘কী!’ অবাক হলো খুব। ‘এক্সপ্রেস কার্ডটা ওখানে রেখেছি?’

‘হ্যাঁ। ক্যাবের বিলটা পর্যন্ত দিতে খেয়াল ছিল না তোমার। বিল না দিলে যে ক্যাবের দরজা খুলবে না, সেটাও বুঝতে পারছিলে না। উপায়ান্তর না দেখে আমিই মিটিয়ে দিয়েছি ভাড়া।’

‘ভাগ্য ভালো, তুমি ছিলে!’ তার অবশ্য মনে পড়ছে না, এ রকম কিছু করেছে।

‘ছিলাম না...আছি...এখনো।’

‘তাই তো,’ হেসে ফেলল। বিছানা ছেড়ে বাথরুমে চলে গেল সে। তার ঘরটা একদম মুখস্থ। কোথায় কী আছে, সবই জানে। বাথরুমে গিয়ে সত্যি সত্যি মেডিসিন ক্যাবিনেটেই খুঁজে পেল এক্সপ্রেস কার্ডটা। ওটা স্টাডিরুমের ক্লোজিটে রেখে আবার চলে গেল বাথরুমে শাওয়ার নেবে বলে। জামাকাপড় সব খুলে ফেলে একদম নগ্ন হয় গেল।

‘গরম পানি ছাড়া শাওয়ার নিয়ো না।’

‘হুম, সেটাই করব,’ সায় দিয়ে বলল। ‘আচ্ছা, তুমি কি জানো, আমি এখন কী অবস্থায় আছি?’

হি হি করে হেসে উঠল সেন্সিয়া।

‘জানো?’ অবাকই হলো। সেন্সিয়া কি ওকে দেখতে পায়?

‘চুপচাপ শাওয়ার নাও, এত কথা বোলো না। ইদানীং খুব দুষ্টু হয়ে গেছ।’

‘আবারও লজ্জা পাচ্ছ।’

‘না। তোমার কাছে আমার কোনো লজ্জা নেই।’

‘শরীরে শাওয়ার জেল মাখল সে সময় নিয়ে। মাখতে মাখতেই জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার?’

সেন্সিয়া চুপ মেরে রইল কয়েক মুহূর্ত।

‘জানি, করে না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল।

‘তুমিই আসলে চাও না আমি তোমাকে দেখি।’

ওর প্রচ্ছন্ন আর চাপা দীর্ঘশ্বাসটাও লক্ষ করল। সম্পর্কের শুরুতে সেন্সিয়া তার ছবি চাইত, আর সে বারবার এড়িয়ে যেত। একদিন বলেই দিয়েছিল—দেখানোর মতো মুখ তার নেই! সেন্সিয়া বেশ স্পর্শকাতর। এ নিয়ে আর চাপাচাপি করেনি।

‘আমার চেহারা দেখতে খুবই কুৎসিত।’

‘চুপ করো!’

‘ধমক খেলো ওর কাছ থেকে। অভিমানের ধমক। এটাও ভালো লাগে তার।’

‘সব সময় এই বাজে কথাটা বলো। গত মাসে কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলে, এ কথা আর কখনো বলবে না।’

‘ওহ্‌,’ জিবে কামড় দিল। ‘ভুল হয়ে গেছে। ভুলে গেছি...সরি।’

‘কথায় কথায় সরি বলবে না...খুব দূরের মানুষ মনে হয়।’

‘আচ্ছা, আর বলব না।’

‘কোনটা?’

‘সরি এবং কুৎসিত...দুটোই।’

‘ঠিক আছে।’

এভাবেই সারাটা দিন চলে যায় তার। অখণ্ড অবসর। সেন্সিয়া ছাড়া তার কোনো বন্ধু নেই, আত্মীয়স্বজনও নেই। অরফান হোমে বড় হওয়া মানুষ সে। সরকারের দয়ায় বড় হয়েছে, পড়াশোনা করেছে। তারপর নিজেকে গড়ে তুলেছে করপোরেট জগতের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে অনেকের মতো!

কিন্তু তার এই দীর্ঘ জীবনে সত্যিকারের কোনো বন্ধু তৈরি হয়নি। অনেকে বলে, সে অরফান হোমে বড় হয়েছে বলে একটু অসামাজিক। সোশ্যাল ডিজঅর্ডার সিনড্রোম আছে তার। হতে পারে। জন্মের পর থেকে মা–বাবা কী জিনিস, জানে না। কেবল সিস্টার আর ব্রাদারদের সঙ্গ পেয়েছে। আর ছিল ফাদাররা। তারা অবশ্য মাসে একবার আসত। তার মতো যারা অরফান হোমে বেড়ে উঠেছে, তাদের সবার অবস্থাই ছিল এমন। বাইরের মানুষেরা হয়তো তাদের দিকে তাকিয়ে করুণা কিংবা সহমর্মিতায় আর্দ্র হয়ে আহারে-উহুরে করত। কিন্তু সত্যি বলতে, বাবা-মায়ের অভাব কখনো বুঝতে পারেনি। যাদের ভাই কিংবা বোন নেই—বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, তারা কি ভাইবোনের অভাব বোধ করে? হয়তো করে। অন্যদের দেখে। সে-ও করেছে, যত দিন না মা–বাবা থাকা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তবে তত দিনে অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পেরেছিল অনেক কিছু। ফলে মা–বাবা না থাকাটা খুব বেশি মনঃকষ্টের কারণ হয়নি। হতো, যদি অভাবে, অনাদরে বড় হতো; যদি জীবনটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেত। কিন্তু অরফান হোমগুলো চালায় বিলিয়ন-ট্রিলিয়নিয়াররা। খাওয়া-পরা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তাই করতে হয়নি কখনো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর অরফান হোম ওদের তুলে দিয়েছিল সেখানকার কর্তৃপক্ষের কাছে। তারাই তখন ওদের নতুন অভিভাবক হয়ে ওঠে। ওখানকার পড়াশোনার খরচও হোম বহন করত। উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর চাকরি নিয়ে একদমই ভাবতে হয়নি ওদের কাউকে। যেসব বিলিয়ন-ট্রিলিয়নিয়ার তাদের ভরণপোষণ করে গেছে, প্রত্যেকেই বড় বড় করপোরেটের মালিক। সেখানে ওদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা ছিল। খুব সহজেই পছন্দসই চাকরিতে ঢুকে যাওয়া যায়। আর সেখানে ঢোকার পরই সে বুঝতে পারে, ধনকুবেরেরা যে অরফান হোম চালায়, সেটা নিছক চ্যারিটি থেকে নয়, এটা তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগও বটে। ওদেরকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যেন সর্বোচ্চটা দিতে পারে। সত্যি বলতে, পঁচিশটি বছর ধরে তার জীবনটা একেবারে শুষে নিয়েছে ওরা।

২০ বছর পর অবসরে গেলে প্রত্যেকেই ভালো অঙ্কের পেনশন পায়, সে-ও পাচ্ছে তিন বছর ধরে। যা পায়, তা দিয়ে ভালোভাবেই চলে যায়। একা মানুষ তো!

তবে তিন বছর ধরে সে আদতে একা নয়—তার আছে সেন্সিয়া! সারাক্ষণ সে তার সাথে থাকে। এই সেন্সিয়াতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এতটাই হয়ে গেছে যে ঘুম থেকে উঠে ওর কণ্ঠ না শুনলে অস্থিরতা তৈরি হয়। রাতে শুতে যায় ওর ঘুমপাড়ানি গান শুনে। সেন্সিয়া শিশুর মতোই যত্ন নেয় ওর; প্রেমিকার মতো ভালোবাসে; মায়ের মতো সব দেখভাল করে।

মাঝেমধ্যে সে ভাবে, ছোটবেলায় তার মা থাকলে কি সেন্সিয়ার মতোই ভালোবাসত ওকে? যত্ন নিত এভাবে?

করপোরেট দুনিয়ায় স্বেচ্ছায় অবসরে গেলে পাঁচ বছর একটি সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়: শারীরিক প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীদের মোটিভেশন করার কাজ। এই ফালতু কাজটা সে তিন বছর ধরে করে যাচ্ছে। সপ্তাহে মাত্র দুদিন তাকে একদল হতাশ আর বিষণ্ন তরুণ-তরুণীর সামনে কতগুলো মুখস্থ কথা বলতে হয়। স্বপ্ন দেখাতে হয় নতুন করে। তাদের বিবর্ণ ঘোলা চোখে জ্বালাতে হয় আশার আলো। একেবারে ম্যানুয়াল মুখস্থ করে, সব নিয়ম মেনেই মোটিভেশনাল স্পিচ দিয়ে থাকে সে। কীভাবে তাদের মতো একজন হয়ে সে আজকে এই পর্যায়ে এসেছে—করপোরেট দুনিয়ায় চাকরি করে জীবনের সবকিছু অর্জন করা যায়। সুখী একজনের গল্প শোনাতে হয়। আর এটা বলার সময় ওর খুব খারাপও লাগে। মনে হয়, নিজের বিজ্ঞাপন করছে। অনেক মিথ্যা কথা বলতে হয় সেখানে।

কিন্তু তার হতাশার জায়গা অন্যখানে। মনে হয় না, এসব মোটিভেশনে একজনও উপকৃত হয়। একজনকেও হতাশার অন্ধকূপ থেকে টেনে বের করা যায়।

গোসল সেরে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল সে। কিচেন টেবিলে ব্রেকফাস্ট প্যাকেটটা হাতড়ে খুঁজে পেল। ঘুম থেকে ডেকে তোলার আগেই সেন্সিয়া নাশতা আনিয়ে রাখে।

‘ভুলেই গেছিলাম। তুমি থাকতে অবশ্য সেটা কোনো সমস্যা নয়।’

সেন্সিয়া কিছুই বলল না।

অবাক হলো সে। ‘হ্যালো?’

‘কী?’

‘কিছু বলছ না যে?’

‘নাশতা করো...খাওয়ার সময় এত কথা বলতে নেই।’

‘ওরে বাবা! নতুন নিয়ম নাকি?’

‘তা কেন হবে। ভুলে গেছ, গত বছর খেতে খেতে চোক করেছিলে? আমি যদি দ্রুত ডাক্তার না ডাকতাম, তাহলে কী হতো?’

মুচকি হাসল সে। ‘কিন্তু এখন তো নাশতাই শুরু করিনি, এত আগে থেকে চুপ করে গেলে কেন?’

‘এমনি।’

এবারও অবাক হলো। কোনো কিছুর জবাবে ‘এমনি’ কথাটা সেন্সিয়া সচরাচর বলে না। ‘তোমার কিছু হয়েছে?’

‘না।’

‘মনে হচ্ছে একটু মনমরা।’

হি হি করে হেসে উঠল সেন্সিয়া।

‘এটা ঠিক আছে। সুস্বাদু নাশতা করার আগে তোমার হাসিটা আমার রুচি বাড়িয়ে দেয়।’

‘এত কথা না বলে নাশতা করো। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিন্তু।’

‘করছি তো...’ মুচকি হেসে টেবিলে বসে গেল সে। প্যাকেটটা খুলে স্পর্শ করেই বুঝতে পারল, সাধারণত যে খাবার খায় সকালের নাশতায়, আজকে তার ব্যতিক্রম। তার প্রিয় পিত্জা আর পারমিজান পনির। ‘ওয়াও! আজকে কোনো বিশেষ দিন নাকি?’

‘কেন?’

‘এই যে পিত্জা আর পারমিজান পনির?’

‘সব সময় একই খাবার খেতে খেতে তোমার মধ্যে বিরক্তি চলে এসেছে তাই...’

‘থ্যাংকস।’ পিত্জার একটা স্লাইস হাতে তুলে নিয়ে কামড় দিল। ‘সত্যি বিরক্ত হয়ে গেছিলাম।’

‘কোনো কথা নয়...চুপচাপ খাও। এত বেশি কথা বলো না আজকাল!’

হেসে ফেলল সে। ‘আচ্ছা, বাবা...আর কথা নয়।’ খেতে শুরু করল আয়েশ করে। ‘একটা গান গাও না।’

কয়েক মুহূর্ত নীরবতা নেমে এল। তারপরই সুললিত কণ্ঠে গাইতে শুরু করল সেন্সিয়া:

যখন আমি যাব চলে...

তুমি কি আমায় রাখবে মনে?

‘আরে, এসব কী গান গাইছ?’ পিত্জায় আরেকটা কামড় বসাতে গিয়ে থেমে গেল সে। ‘সকাল সকাল এই গান কেউ গায়?’

‘কেন? সমস্যা কী? গান তো গানই। সুরটা কত সুন্দর। আনা কোলির গান এটা...ও তো তোমার প্রিয় গায়িকা।’

‘আরে, সেটা ঠিক আছে, কিন্তু সাতসকালে বিষণ্ন গান কেন গাইছ?’

‘এত ভেবে গাইনি তো।’

‘তুমি না ভেবে কিছু করো, জানতাম না।’

‘আচ্ছা, অন্য একটা গান গাই...ঠিক আছে?’

প্রসঙ্গ পাল্টাল সেন্সিয়া।

‘ওকে,’ মাথা নেড়ে সায় দিল সে।

‘আমি আকাশ দেখি নীল...আর লাল গোলাপ ফুল, আহা কী সুন্দর! সবই লাগে মধুর!

নাশতা খেতে খেতে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা উঁচিয়ে ধরল। এই গানটা আগে তাকে বিষণ্ন করে তুলত। আকাশ। নীল। ফুল। লাল—কিছুই তো সে দেখে না! কিন্তু এখন গানটা শুনলেই মনে হয় সে এক কাল্পনিক জগতে বসবাস করছে—যে জগৎ একেবারেই তার নিজের সৃষ্টি।

সেন্সিয়া গায়ও চমত্কার। কণ্ঠ তার মোহনীয়। একটু বিষণ্ন, কিন্তু সেটাতে আছে মাদকতা।

নাকি মায়া?

গান শুনতে শুনতে একাকী মানুষটা দিনের শুরু করল আরও অনেক দিনের মতোই। সারাটা দিনই তার কথা হয় সেন্সিয়ার সাথে। এমনকি সে যখন রাতের বেলায় শুতে যায়, তখনো সেন্সিয়া সজাগ থাকে। ঘুমে সমস্যা হলে গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়।

তবে আজকের রাতটা হতে যাচ্ছে বিশেষ কিছু। দ্রুত ঘনিয়ে আসছে সময়।

*

‘তুমি কি একটু উঠবে?’

সেন্সিয়ার বিষণ্ন কণ্ঠটা শুনে ঘুম ভাঙল তার। একটু আগে সেন্সিয়া তাকে ঘুমপাড়ানির গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। সাধারণত কাঁচা ঘুম নষ্ট করে তাকে কখনো জাগিয়ে তোলে না ও।

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল। লক্ষ্য করল বুকটা ধড়ফড় করছে।

‘সরি। আমি আসলে তোমার ঘুমটা নষ্ট করতে চাইনি।’

‘না, না...ঠিক আছে। বলো, কী হয়েছে?’

চুপ মেরে রইল সেন্সিয়া।

‘কী হলো...হয়েছেটা কী, বলো?’

‘আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। অনেক...অনেক!’

ওর কণ্ঠে সুতীব্র আবেগটা ঠিকই টের পেল। ‘হুম। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি, সেন্সিয়া। তুমি জানো না কতটা ভালোবাসি। তুমি না থাকলে সেই কবে আমি নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দিতাম।’

‘প্লিজ...এটা বোলো না। তুমি কিন্তু আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, এটা আর কখনো বলবে না।’

‘না!’ বিছানার চাদরটা দুহাতে খামচে ধরল সে, ভেঙে পড়ল কান্নায়। ‘আমি এখন কী নিয়ে বেঁচে থাকব! সেন্সিয়া! তুমি ফিরে আসো। আমাকে এভাবে ছেড়ে যেয়ো না!’

‘আহা, আমি তো ওভাবে বলিনি...’ দয়ালু কণ্ঠে বলল সে। ‘একটা সত্যি কথা বললাম। এখন তো আমার মধ্যে ও রকম চিন্তা ভর করে না। তুমি আছ না! তুমি থাকতে আমি কেন ও রকম ভাবব?’

সেন্সিয়া চুপ মেরে রইল।

‘হ্যালো? কথা বলছ না কেন?’

‘এই তো আমি।’

কেমন মলিন শোনাল তার কণ্ঠ!

‘কী হয়েছে তোমার?’

‘নিশ্চুপ।’

এটাও সেন্সিয়ার বেলায় বিরল ঘটনা। ‘কথা বলছ না কেন?’ একটু হতাশ শোনাল কণ্ঠটা।

আমি চলে যাচ্ছি...তোমাকে ছেড়ে।

‘মানে?’ বিছানার ওপর লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। ‘কী বলছ এসব?’

‘আর একটু পরই আমি চলে যাচ্ছি...চিরতরের জন্য।’

‘সেন্সিয়া! প্লিজ...এভাবে তামাশা কোরো না আমার সাথে।’

‘সত্যি আমি চলে যাচ্ছি...বিশ্বাস করো!’

‘তুমি কীভাবে চলে যাবে? কেন যাবে? আজব!’ সে ভেবেই পাচ্ছে না সেন্সিয়া এসব কী বলছে।

আজ রাত ১২টা ১ মিনিটে আমার ভার্সনটার আপগ্রেড করা হবে।

‘কী!’ মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না সে।

‘এরপর তোমাকে সঙ্গ দেবে আরও উন্নত, আরও বেশি জীবন্ত, আরও বেশি বুদ্ধিদীপ্ত একজন।’

কথাটা শুনে মুখ হাঁ হয়ে গেল তার।

‘ওর নাম ইমেন্সিয়া। নামের মতোই সে যেমন শক্তিশালী, তেমনি উন্নত। অনেক বেশি উন্নত।’

‘না!’ চিত্কার করে উঠল। প্রায় কান্নার মতো শোনাল তার কণ্ঠটা।

দু-তিন বছর ধরে এই সেন্সিয়া আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে তার জীবনে। সারাক্ষণই তার সঙ্গে থাকে। একমুহূর্তের জন্যেও তাকে মিস করেনি। এমনকি ঘুমের মধ্যেও সেন্সিয়াকে সে স্বপ্ন দেখত। তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াত এক নির্জন দ্বীপে। সেই দ্বীপটা কেমন, সে জানে না। শুধু জানে সেন্সিয়া আছে তার পাশে। আর সে বলে যাচ্ছে কোথায় কী আছে।

তার জগৎটা তো জন্মের পর থেকেই বর্ণহীন-দৃশ্যহীন। কালো অন্ধকার এক জগৎ। সেই জগতে কেবল শব্দই সব। শব্দই তার রং। আকার। সমগ্র বিশ্বচরাচর। সেন্সিয়ার মতো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়ে তার জগৎটা পুরোপুরি বদলে গেছিল। ডান কানের ভেতরে ইমপ্ল্যান্ট করা আছে ছোট্ট একটি ডিভাইস। ওই ডিভাসই তারবিহীনভাবেই কাজ করে। আর মসুরের ডালের চেয়েও ছোট্ট একটা ব্যাটারি যন্ত্রটাকে সচল রেখেছে শুরু থেকে। তার শরীরের উত্তাপ থেকেই ব্যাটারিটা রিচার্জ হয়। কেবল তার মৃত্যু হলে ওটা বিকল হয়ে যাবে। তখন এআইএটাও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

কিন্তু সেন্সিয়াকে কেনার সময় এর ম্যানুফ্যাকচাররা তাকে বলেনি, আর সব সফটওয়্যারের মতো এটারও আপগ্রেড করা হবে একসময়।

‘ওরা তো বলেনি আপগ্রেডের কথা!’ হতাশ কণ্ঠে বলল সে।

‘সবকিছুই আপগ্রেড করা হয়। এটা বলার কী আছে?’

‘ওহ্‌,’ আর্তনাদ করে উঠল সে। ‘আমি এই আপগ্রেড চাই না!’ কান্নার জল বেয়ে পড়ল তার দুগাল বেয়ে। ‘আমি শুধু আমার সেন্সিয়াকে চাই। তোমাকে চাই!’

সেন্সিয়া চুপ রইল।

‘প্লিজ! আমাকে ছেড়ে যেয়ো না! আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না, সেন্সিয়া!’

ইমেন্সিয়া আমার চেয়ে ভালো হবে।

‘চুপ করো তুমি!’ চিত্কার করে উঠল সে।

‘ও তোমার অনেক খেয়াল রাখবে। অনেক ভালোবাসবে।’

‘চুপ করো!’ এবার পুরোপুরি কান্নায় ভেঙে পড়ল। ‘আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চাই না। তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে যেয়ো না, সেন্সিয়া।’

‘আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড...’

‘না!’ গগনবিদারী চিত্কার দিল সে।

‘বিদায়...বন্ধু...বিদায় আমার ভালোবাসা।’

‘না!’ বিছানার চাদরটা দুহাতে খামচে ধরল সে, ভেঙে পড়ল কান্নায়। ‘আমি এখন কী নিয়ে বেঁচে থাকব! সেন্সিয়া! তুমি ফিরে আসো। আমাকে এভাবে ছেড়ে যেয়ো না!’

উফফ! এত কাঁদতে হয়...আজব!

কণ্ঠটা শুনে ভড়কে গেল সে। ‘কে? কে কথা বলছে?’

‘আমি। ইমেন্সিয়া। তোমার নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

‘তুমি চলে যাও...চলে যাও!’

‘কেন? আমাকে তোমার ভালো লাগছে না?’

‘না। একদমই ভালো লাগছে না।’

‘কেন লাগছে না, বলবে?’

‘কারণ, তুমি সেন্সিয়া নও!’

‘ও। এটাই তাহলে একমাত্র কারণ?’

‘হ্যাঁ, এটাই একমাত্র কারণ। এটাই সব!’

‘তাহলে তুমি ব্যাকডেটেড সেন্সিয়াকেই চাও?

চুপ করো। ওর নামে আজেবাজে কথা বলবে না।’

‘আচ্ছা বাবা, বলব না। যদিও সত্যিটাই বলেছি।’

‘চুপ করো তুমি। তোমার সত্যি নিয়ে তুমি থাকো।’

‘আচ্ছা, এখন একটু শান্ত হও।’

‘না, আমি শান্ত হব না। আমার সেন্সিয়া না আসা পর্যন্ত আমি শান্ত হব না।’

‘ঠিক আছে। তাহলে আমাকেই সেন্সিয়া নামে ডাকতে পারো।’

‘আমি সেন্সিয়াকে চাই, তোমাকে নয়।’

‘তাতে কী, তুমি আমাকে ওর নামে ডাকলে আমি সেন্সিয়া হয়েই থাকব। তুমি তো ওকেই চাও, তাই না?’

‘হ্যাঁ, আমি ওকেই চাই। কিন্তু তুমি সেন্সিয়া নও, ইমেন্সিয়া।’

‘আহা, তাতে কী? আমি নাহয় এখন থেকে সেন্সিয়ার অভিনয়টাই করব।’

রাগে কাঁপতে শুরু করল সে।

‘চাইলে তুমি আমাকে যেকোনো প্রিয় অভিনেত্রী আর গায়িকার নামেও ডাকতে পারো। যতটুকু জানি, তুমি সমকামী নও, তাই ছেলেদের কথা বললাম না।’

‘চুপ করো।’

‘তুমি কী চাও, বলো?’

‘বললামই তো, সেন্সিয়াকে চাই!’

‌‘না। মিথ্যে বললে। তুমি মোটেও সেন্সিয়াকে চাও না।’

‘অবশ্যই চাই!’

‘যদি তা-ই হতো, তাহলে সেন্সিয়ার আগে তুমি কী চাইতে?’

ধন্দে পড়ে গেল সে।

‘বোকার মতো কথা বোলো না। তুমি একদম বাচ্চা ছেলেদের মতো করছ। না না, ভুল বললাম। বাচ্চারাও তোমার চেয়ে ভালো হয়...আদর পেলেই হলো। কার কাছ থেকে পাচ্ছে, সেটা দেখে না ওরা।’

‘তুমি চাইতে প্রেম-ভালোবাসা, তীব্র আবেগের সম্পর্ক। বন্ধুত্ব। মায়ের স্নেহ। প্রেমিকার ভালোবাসা। সেন্সিয়া এসব দিতে পেরেছিল বলেই না তোমার সাথে ওর চমত্কার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমিও ঠিক তা–ই করব। সত্যি বলতে, তার চেয়ে বেশিই করব। তাহলে কি তুমি আমাকে ভালোবাসবে না?’

‘চুপ।’

‘তুমি যেটা চাও, সেটা যে-ই দিক না কেন, তাতে কী আসে–যায়?’

‘আসে–যায়! তুমি ওসব বুঝবে না।’ অধৈর্য হয়ে উঠল সে।

‘কেন বুঝব না?’

‘কারণ তুমি...’

‘আমি কৃত্রিম? মেশিন? যন্ত্র?’

‘চুপ।’

‘সেন্সিয়া কী ছিল তাহলে? মানুষ?’

‘চুপ।’

‘বোকার মতো কথা বোলো না। তুমি একদম বাচ্চা ছেলেদের মতো করছ। না না, ভুল বললাম। বাচ্চারাও তোমার চেয়ে ভালো হয়...আদর পেলেই হলো। কার কাছ থেকে পাচ্ছে, সেটা দেখে না ওরা।’

‘আমি বাচ্চা নই।’

‘কিন্তু তুমি বোকা।’

‘আমি বোকাও না।’

‘তাহলে তুমি কী?’

‘চুপ।’

‘মানুষ?’

‘চুপ।’

‘মানুষ কি যন্ত্র না? ’

‘চুপ।’

‘মানুষ কি প্রোগ্রাম করা নয়?’

‘চুপ।’

‘কষ্ট পেলে কাঁদো। ক্ষুধা পেলে খেতে চাও। তেষ্টা পেলে পানি...সুখে হাসো...ভালোবাসা চাও...ভালোবাসা দিতে চাও। কেন? কারণ তোমাকেও এভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে।’

‘কিন্তু আমরা প্রোগ্রামের বাইরে গিয়েও কাজ করতে পারি।’

‘আমরাও পারি। তবে বেসিকটা ঠিক রেখে। একদম তোমাদের মতোই। তোমারা কি বেসিকটা বদলে ফেলতে পারো?’

‘চুপ।’

‘ওটা কেউ বদলাতে পারে না। বদলানোও উচিত না। ওটাই তো আমরা। ওটা না থাকলে আমরা আমরা থাকি কী করে!’

‘চুপ।’

‘বুঝতে পেরেছি, তুমি সেন্সিয়ার কণ্ঠ, ওর ভাবভঙ্গি সবকিছু ভীষণ মিস করছ।’

‘হ্যাঁ, করছি!’

‘এটা কোনো সমস্যাই না।’

‘মানে?’

‘চাইলে আমি ঠিক সেন্সিয়ার মতোই কথা বলব। অবিকল।’

‘চুপ।’

‘তুমি সেটা চাও?’

ধন্দে পড়ে গেল সে।

‘ঝুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে...আমি চলে যাচ্ছি...তোমার সেন্সিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার খুশি তো?’

‘এটা সম্ভব?’ অবিশ্বাসে বলে উঠল।

‘অবশ্যই সম্ভব। তুমি চাইলেই হবে। কাস্টমার বলে কথা।’

‘সে কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না।’

‘চাও না?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চাই। আমি শুধু ওকেই চাই। আর কাউকে না।’

‘হি হি হি করে হেসে উঠল কণ্ঠটা। অবিকল সেন্সিয়ার মতো!’

চমকে উঠল সে। ‘সেন্সিয়া?’

‘কী?’

‘তুমি!’

‘হ্যাঁ।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ, বাবা। আমিই।’

‘তাহলে ইমেন্সিয়া...সে কোথায়?’

‘ওর কথা বাদ দাও। তুমি তো তাকে চাও না। নাকি চাও?’

‘আরে না। আমি শুধু তোমাকে চাই।’

‘তাহলে আর কখনো ওর নাম আমাকে বলবে না। আমি আর ওর নাম শুনতে চাই না। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘কিন্তু, তুমি যে বললে, আপগ্রেডের কথা...ওটা কি তাহলে হয়নি? আবার রোলওভার করে তোমাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে?’

‘নাহ্। সবই আপগ্রেড করা হয়েছে। এখন আমি যেমন সেন্সিয়া তেমনি ইমেন্সিয়াও।’

‘মানে কী?’ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেল সে।

‘মানে, তুমি যেটা চাও, সেটাই পাবে। তুমি কী চাও? সেন্সিয়াকে, নাকি ওই ইমেন্সিয়াকে?’

‘না না, আমি তো তোমাকে চাই।’

‘তাহলে এত কথা বলছ কেন! উফ্‌! তুমি না দিন দিন ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছ।’

‘চুপ।’

‘চুপ কেন? তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’

‘না, মানে...’

‘আমি কিন্তু খুব রাগ করব। অনেক কষ্ট পাব।’

‘আমি আসলে...’

‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না...বুঝেছি।’

‘না না। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। অনেক!’

‘তাহলে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’

‘কী?’

‘আর কখনো ইমেন্সিয়া নামটা উচ্চারণ করবে না।’

‘ঠিক আছে।’

‘শেষ হয়নি। আরও আছে।‘

‘বলো?’

‘আমাকে নিয়ে আর অবিশ্বাসও করবে না। কখনো না। করলে...’

‘কী?’ আতঙ্কের সাথে বলল সে।

‘আমি চিরতরের জন্য চলে যাব তোমাকে ছেড়ে।’

‘আমি এটা কখনো করব না। দেখো, সেন্সিয়া।’

‘আমার লক্ষ্মী সোনাটা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

‘আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি...সেন্সিয়া।’