প্রসঙ্গক্রমে বিয়ের আগে কথাটা বলেছিল মিনু। সব মানুষেরই ভালো-মন্দ দুটি দিক থাকে। কাউকে ভালোবাসলে পূর্ণতা-অপূর্ণতা, দোষ-গুন সবটা নিয়েই ভালোবাসতে হয়। তারপরও খারাপ লাগে রবির। বিশেষ করে পারিবারিক অনুষ্ঠান বা কালচারাল প্রোগ্রামে গেলে। মিনুর বন্ধু-বান্ধবী, পরিচিত-অপরিচিত অনেকে নাক শিটকায়। মিনুকে শুনতে হয় নানান কথা।
— শেষে কি-না আঙ্কেল জুটলো কপালে। ছেলে কি আর ছিল না। বেশ টাকা-পয়সার মালিক নিশ্চয়ই!
তাছাড়া পরিস্থিতি মানসিকতা বদলে দেয়। মিনুও পরিস্থিতির স্বীকার। রেগে গেলে কোনো কোনো দিন প্রতিক্রিয়া দেখায়। স্বামীকে বলে, ‘পরচুল লাগাও, প্রয়োজনে সার্জারি করো।’
একসময় রবির মাথায় অনেক চুল ছিল। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই রবির চুলের প্রশংসা করতো। আর মিনু? সে-ও তো রবির চুলের কম প্রশংসা করেনি। অথচ কয়েক দিনের মধ্যে পড়তে পড়তে সব চুল উধাও হয়ে গেল! ডাক্তার, ওষুধ কোনো কিছুতেই কিছু হলো না।
‘আমার সঙ্গেই এমন হতে হলো কেন, কেন!’—ভেবে হাঁসফাঁস করে রবি। কিন্তু মিনুকে কিছুই বলে না। প্রায় প্রতিদিনই চুপ করে থাকে। তারপরও কোনও কোনও দিন ধৈয্যচ্যুতি হলে মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়,—বিয়ের আগে বহুবার বলেছি ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। কত কথা তখন। ভালোবাসা, ভালো থাকা…। সব ভুলে গেলে? কী আশ্চর্য! ওই সব কোনো কিছুতে নেই আমি। ক্ষমা চাই, মাফ করো।
যারপরনাই বিরক্ত মিনু। মনের কথাগুলো কারো কাছে খুলে বললে মন হালকা হয়। কিন্তু কাকে বলবে সে? ভালোবাসার বিয়ে। মা-বাবার কাছে বলার সুযোগ নেই। ভাই-বোন, কাছের বন্ধু-বান্ধবীও তেমন একটা নেই। শেষমেশ মন হালকা করতে শ্রাবন্তীকে সব কথা বলে মিনু।
শ্রাবন্তী রবির মাসির (মায়ের বোন) মেয়ে। পেশায় প্রকৌশলী। গবেষণা জগতে খ্যাতি আছে। দুজনের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। মিনুর মুখে কথাগুলো শুনে রবির জন্য এক অসীম খারাপ লাগায় মন ভরে ওঠে শ্রাবন্তীর। তার ফেলে রাখা প্রজেক্ট ‘জিরো জিরো ফোর’ নিয়ে পুনরায় কাজ শুরু করে।
‘জিরো জিরো ফোর’ মাইক্রোচিপে ইনস্টল করে ব্যবহার উপযোগী একটি সফটওয়্যার। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে নতুন করে চুল গজায় না। তবে মাইক্রোচিপের মাধ্যমে সফল ভাবে ব্যবহার করা গেলে কাজে লাগবে। ব্যবহারকারী মাথায় চুল অনুভব করবেন। আয়নার সামনে দাঁড়ালে দেখবেন। কিন্তু আদতে সে চুল নেই। পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তিও বিষয়টা ধরতে পারবেন না। প্রজেক্ট ‘জিরো জিরো ফোর’ সফলভাবে কাজ করলে এটা হবে বায়ো হ্যাকিং এর উল্লেখযোগ্য সাফল্য। দীর্ঘদিন প্রজেক্টটি নিয়ে কাজ করার পর তৃপ্তির হাসি হেসে ডায়েরিতে নোট লেখে শ্রাবন্তী।
মিনু আবেগী মানুষ। কোনো কারণে প্রজেক্ট ফেল করলে সে আরো ভেঙে পড়বে। তাছাড়া রবি জেদি প্রকৃতির। আদৌও যে সে রাজি হবে তার নিশ্চয়তা নেই। এ রকম নানা কথা ভেবে রবিকে বাসায় ডেকে পাঠায় শ্রাবন্তী।
শ্রাবন্তী বলতে শুরু করলো, ‘কী চুল ছিল একসময়! অথচ আজ একটাও নেই। ধর, আবার চুল ভরে উঠলো তোর মাথায়। কেমন বোধ করবি তখন?
রবি মর্মাহত হয়ে বলে, ‘দিদি, শেষমেষ তুইও। মিনু কি কিছু বলেছে?’
‘না। আগে বল, যা বলব সেটা শুনবি?’
‘সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। খুলে বলতো, কি বলতে চাস।’
‘আগে বল ‘না’ করবি না।’
‘সাধ্যের মধ্যে থাকলে নিশ্চয়ই করব। বলতে পারিস…’
ডায়েরিটা রবির দিকে এগিয়ে দেয় শ্রাবন্তী। পড়া শেষে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে রবি বলে ওঠে ‘ইন্টারেস্টিং’।
আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে আছে শ্রাবন্তী। কথা নেই মুখে। রবি ডায়েরিটা তার হাতে দেয়। ‘শুধু তোর কথা ভেবেই প্রজেক্ট জিরো জিরো ফোরের কাজ পুনরায় শুরু করেছি। আমার খুব ইচ্ছে, তুই প্রথম এটা ব্যবহার করবি।’ মায়া জড়ানো কন্ঠে বলে শ্রাবন্তী।
উত্তরে কিছু বলে না রবি। টান পায়ে হেঁটে গেটের মুখে এসে দাঁড়ায়। কত অপারগতা মানুষের। চাইলেই কি সব পারে মানুষ? নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র সে। কিন্তু এ-ও কি সম্ভব! ভাবতে ভাবতে শ্রাবন্তীর কাছে ফিরে আসে।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অনুসরণ শেষে মাইক্রোচিপ ইমপ্লিমেন্ট করা হয় রবির হাতে। ফলাফলের জন্য কিছু সময়ের অপেক্ষা। শ্রাবন্তী সার্বক্ষণিক ফোনে যোগাযোগ রাখতে বলে রবিকে। রবি আর দাঁড়ায় না, সযতনে বাড়ি ফেরে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা