হোমানকুলাস

টেলিফোন বাজার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো বেজে গেছে। এত রাতে কে ফোন করল। রিসিভার তুললাম।

‘শেষ পর্যন্ত ঘুমটা ভাঙল!’ স্মিরনোভের উত্তেজিত গলা শুনতে পেলাম। ‘যত তাড়াতাড়ি পারো এখানে চলে এসো!’

‘কী হয়েছে?’

‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। হোমানকুলাস পালিয়ে গেছে। ওর ভেতর এখন ভাঙার নেশায় পেয়েছে এবং আমি ভাবতেও ভয় পাচ্ছি শহরজুড়ে কী অঘটনটা না করে বেড়াচ্ছে।’

‘আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম...’ বলতে শুরু করেছিলাম কিন্তু লাইনটা কেটে গেল।

সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই হাতে।

হোমানকুলাস! স্মিরনোভের মাথায় যখন এক অদ্ভুত আইডিয়া এল যে নিজের মতো চিন্তাভাবনা করতে পারে এমন রোবট বানাতে হবে, আর আমি তখনই এই নাম দিয়েছিলাম। মলিকিউলার ফিজিকসে একসময় যেসব করেছিল, সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ব্রেনের মতো একটা নকল ব্রেন তৈরি করার চেষ্টা করছিল।

আমার অবশ্য নিজের কখনোই ব্যাপারটা খুব একটা কাজের মনে হয়নি। এটা আমার কাছে ঠিক প্রয়োজনীয় মনে হয়নি। আমার কাছে সব সময় মনে হতো সাইবারনেটিক্স নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করে, তারা মানুষের কাজে সাহায্য করতে পারে এমন সব সিনথেসাইজিং অটোমশনটা তৈরি করতে ব্যস্ত থাকুক এবং এর বাইরে না গেলেই ভালো। অর্গানিক প্রাণীদের মতো বহু যান্ত্রিক মডেল তৈরি করা যায়, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইলেকট্রনিকসের মডেল তৈরি করা, এটা আবার আমার সহ্য হয় না। স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, আমি সত্যি সত্যি ভয় পাই, যখন মানুষ এবং মানুষের মতো যান্ত্রিক, যা মানুষই তৈরি করেছে, যাদের নিজেদের ইচ্ছাশক্তি আছে, যারা শুধু মেকানিক্যাল নিয়ম মেনে চলে, তাদের ভেতর একটা বিরাট বিরোধ দেখা দিতে পারে। আমার মনে হতো, অটোমশনটা যত নিখুঁত হবে, যত মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করতে পারবে, তত বেশি অমানুষিক ব্যবহার করবে নিজের মতো করে চলাফেরার জন্য।

এই কথাগুলো আমি স্মিরনোভকে আগেই খোলাখুলি বলেছিলাম।

‘তোমার কথাগুলো হিপোক্রেটদের মতো শোনাচ্ছে।’ জবাবে ও বলল, ‘মানুষের ভ্রূণ পরীক্ষা নিয়ে নীতির প্রশ্নে হইচই করেন যাঁরা, তাঁদের বক্তৃতা শুনলে আমার একই কথা মনে হয়। একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে তোমাদের এই আবেগগুলোকে বেশি পাত্তা দেওয়া সম্ভব নয়।’

‘হোমানকুলাস!’ বলেই সে হো হো করে হাসতে লাগল। ‘আমার এটারই অভাব ছিল! আমি রোবটটাকে “হোমানকুলাস” নামটাই দেব।’

স্মিরনোভ আমার জন্য সিঁড়িতে অপেক্ষা করছিল।

‘দেখো গিয়ে যাও!’ ঘরের দরজাটা খুলে ধরে বলল।

প্রথম দেখাতেই আমাকে হতবাক করে দিল। ঘরে ঢোকার মুখেই টিভিটা ছড়িয়ে ছিল মেঝেতে টুকরো টুকরো হয়ে। দেখে মনে হলো কোনো পাগলের কাজ ওটা।

গ্যাসের গন্ধ নাকে আসছিল। আমি দৌড়ে বাথরুমে গেলাম। গিজারটার কোনো চিহ্ন নেই। বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি পড়ে আছে।

ট্যাপটা বন্ধ করে আমি স্মিরনোভের পড়ার ঘরে গেলাম। এই ঘরটার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। শুধু শেলফের বই এবং টেবিলের ওপরের কাগজগুলো এলোমেলোভাবে ঘরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। ‘কীভাবে হলো ঘটনাটা,’ ডিভানের ওপর ধপ করে বসে পড়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘তোমাকে বলার মতো আমার আর কিছুই নেই,’ কাগজপত্রগুলো গোছাতে গোছাতে বলল সে। ‘তুমি তো জানোই, গত বছর আমি হোমানকুলাসকে ল্যাবরেটরি থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম ওর ওপর বেশি মনোযোগ দিতে পারব বলে। দুই সপ্তাহ ধরে সে কেমন যেন বেশি মনমরা হয়ে পড়েছিল। মৃত্যুভাবনা তার মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছিল। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সে আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করতে থাকত। তিন দিন আগে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, মানুষ আর তার ভেতরে তফাতটা কী। তারপর সে জানতে চাইল, আমি কোনো দিন তার সব পার্টস খুলে ওকে ধ্বংস করে ফেলার কথা ভাবছি কি না। এখানেই ভুলটা করে বসলাম আমি। ওর ঘ্যানঘ্যানিতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম বলেই আমি তাকে বললাম, এসব আজেবাজে চিন্তা ছেড়ে নিজের কাজে মন না দিলে তার সব পার্টস খুলে ফেলা হবে।

‘এবং তারপর শুধু নিষ্প্রাণ পার্টসগুলো পড়ে থাকবে?’ সে জিজ্ঞেস করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। আমি জবাব দিলাম যা বলেছি তা-ই।

‘তারপর সে চুপ করে গেল। সারা দিন কিছু একটা নিয়ে ভেবে গেল। আর আমি যখন আজ রাতে বাড়ি ফিরে এলাম, দেখলাম আমার ফ্ল্যাটে দরজা হাট করে খোলা এবং ফ্ল্যাটের ভেতরটা দেখলে মনে হচ্ছে যেন একপাল বুনো হাতি দাপাদাপি করে গেছে। হোমানকুলাসের কোনো পাত্তা নেই।’

‘কোথায় যেতে পারে ও?’

‘সত্যি কথা বলতে কী, আমার জানা নেই। ও রাস্তায় একবারই বেরিয়েছিল, যখন ল্যাব থেকে ওকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। এমনও হতে পারে সেই রাস্তাটাই ওর মনে আছে, হয়তো সোজা ওই রাস্তা ধরে ল্যাবের দিকেই গেছে। কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়া রাস্তায় ওকে খুঁজতে যাওয়া—অসম্ভব। আমার মনে হয় একবার ল্যাবটায় দেখে আসা যেতে পারে।’

আবার আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। লক্ষ করে দেখলাম, সিঁড়ির পাশের স্টিলের রেলিংটাও দুমড়ানো। তার ভেতর একটা স্টিলের রড উধাও। বুকের ভেতর ধড়ফড় করে উঠল। দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে একটি খ্যাপা রোবট নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হাতে একটা স্টিলের রড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দালান ছেড়ে রাস্তার মোড় ঘুরলাম প্রথমে। একটা বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরের সামনে মিলিশিয়া গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে স্টোরের ভাঙা জানালার সামনে ডজন দুয়েকের মতো লোক জমা হয়ে গেছে।

স্টোরটার দিকে একপলক তাকাতেই কী ঘটেছে বুঝতে আর বাকি রইল না। ফ্ল্যাটে যেমনটা দেখেছিলাম, এখানেও তেমনটা দেখলাম। টেপ রেকর্ডার এবং রেডিও সেটগুলোকে কেউ যেন অনেক আক্রোশে ভেঙে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে রেখেছে।

স্মিরনোভ আঙুল দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা একটা বড় সাইজের পুতুল দেখাল, যার মাথাটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে আজ রাতে হোমানকুলাসের সামনে যা পড়বে, তার কী অবস্থা হবে।

দুজন মিলিশিয়া একটা কুকুর নিয়ে স্টোরটা থেকে বেরিয়ে এল। কুকুরটা সোজা এসে ফুটপাতের ওপর বসে পড়ল।

‘কুকুরটা কোনো গন্ধ পাচ্ছে না,’ একজন মিলিশিয়া বলল।

স্মিরনোভ একটা ট্যাক্সি থামাল। সেটায় চড়ে আমরা ল্যাবের উদ্দেশে রওনা হলাম।

গিয়ে অবাক হলাম। সন্ধ্যা থেকে পাহারায় থাকা ল্যাবের দারোয়ান আরাম করে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। না সে কোনো রোবট দেখেনি এদিকে আসতে। আমরা চারপাশ ঘুরে দেখলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলাম না।

হোমানকুলাস হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

স্মিরনোভ হতাশ হয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

‘ওর অ্যাকুমুলেটরে দুই দিন চলার মতো শক্তি মজুত আছে,’ ও কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল। ‘এই দুই দিনে সে যে কী করে বেড়াবে, তা তো জানাই আছে! তা ছাড়া, অ্যাকুমুলেটরে চার্জ শেষ হয়ে গেলে কী করে চার্জ করতে হয় সেটাও তার জানা আছে।’

বুঝতে পারলাম, এখন আমাদের কী করতে হবে।

আমরা মিলিশিয়া অফিসের দিকে রওনা দিলাম।

ডিউটি অফিসার একজন লেফটেন্যান্ট, যিনি আমাদের কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারপরও একটি স্টিলের তৈরি দৈত্য মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এটা শুনে তাঁর ভেতর কৌতূহল হলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে শহরের সব মিলিশিয়া স্টেশনে ফোন করে জানিয়ে দিলেন। এখন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো কাজ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের হাতে যখন দায়িত্ব পড়েছে, তখন আমাদের আর কী করার আছে।

কিছুক্ষণের ভেতর খবর চলে এল। তেমন কোনো খবর নয়, বড় শহরে রাতের বেলা যেসব অপরাধ ঘটে সেসব খবর। অপরাধীর ‘হাতের কাজ’—তার কোনো চিহ্নও পাওয়া গেল না।

এটা পরিষ্কার যে রোবট লুকিয়ে আছে কোথাও, যতক্ষণ পর্যন্ত না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের শ্যেনদৃষ্টি শিথিল হয়।

ভোরবেলা আমরা ক্লান্ত এবং উদ্বিগ্ন মনে লেফটেন্যান্টের অফিস ছেড়ে স্মিরনোভের বাসার দিকে রওনা দিলাম। কফি খেতে খেতে পরবর্তী পরিকল্পনা করা যাবে সেখানে বসে। কিন্তু আমাদের কফি খাওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হবে না সে কথা কে ভেবেছিল?

সিঁড়ি দিয়ে ফ্ল্যাটে উঠে দেখি, কে যেন দরজাটা ভেঙে উপড়ে ফেলেছে এবং প্রতিটা ঘরে আলো জ্বলছে।

আমি স্মিরনোভের দিকে তাকালাম, ওর চেহারা ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে।

‘হোমানকুলাস আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এসেছে,’ দেয়ালে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলল। ‘এর চেয়ে ভালো লেফটেন্যান্টকে খবর দিই, তা না হলে আমাদের দুজনের কোনো আশা নেই।’

কয়েক মিনিটের ভেতর তিনজন মিলিশিয়াকে নিয়ে একটা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে।

‘ক্রিমিনালটা কি বাড়ির ভেতর আছে?’ সার্জেন্ট জিজ্ঞেস করলেন হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করতে করতে। ‘ঘরগুলোর লেআউট কার জানা আছে?’

‘পিস্তল দিয়ে আপনি কিছুই করতে পারবেন না,’ স্মিরনোভ তাঁকে বলল। ‘রোবটের দেহটা ক্রোম-মলিবডেনাম স্টিলের তৈরি। একটু দাঁড়ান আমি গাড়ি থেকে টারপুলিন নিয়ে আসি। এটাই একমাত্র উপায় হোমানকুলাসকে ধরার।’

কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পেলাম স্মিরনোভের সঙ্গে বিশালদেহী এক ঝাড়ুদার, দুজনে মিলে টানতে টানতে নিয়ে আসছে একটা ভারী টারপুলিন।

এবার আমরা সংখ্যায় ছয়জন। ছয়জনই ইলেকট্রনিক দানবকে থামানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারপরও সবার মনে একটা ভয় হচ্ছিল।

‘আমার মনে হয় ও পড়ার ঘরে আছে।’ ফিসফিস করে স্মিরনোভ বলল দরজার ভেতর দিয়ে উঁকি মারতে মারতে। ‘আমাকে অনুসরণ করুন। আমি ওকে কিছুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে দিতে পারব, তখন আপনারা টারপুলিনটা ওর ওপর ছুড়ে দেবেন। ইতস্তত করবেন না, কারণ, ওর হাতে একটা স্টিলের রড আছে!’

নীরবে-নিশ্চুপে, দম বন্ধ করে, আমরা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চললাম। স্মিরনোভ প্রথমে ঢুকল ঘরে, তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম, যেন কেউ তার গলায় ইস্পাতের সাঁড়াশি চেপে ধরেছে।

আমরা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম।

স্মিরনোভ দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো হাসছিল। হাসির দমকে বারবার দম আটকে যাচ্ছিল।

ঘরের মেঝেতে একগাদা রেডিওর পার্টস এবং ধাতব টুকরোর মাঝখানে পা ছড়িয়ে হোমানকুলাস বসে আছে। মনিবের কাগজপত্রগুলো সামনে নিয়ে গুনগুন করে একটা গানের কলি আওড়াতে আওড়াতে আরেকটা ছোট্ট রোবট বানাচ্ছিল। আমরা যখন ঘরে ঢুকলাম, তখন বড় দোকানটা থেকে নিয়ে আসা পুতুলের মাথাটা রোবটের ধড়ের ওপর যত্ন করে বসাচ্ছিল হোমানকুলাস।