যেভাবে আমজাদ আলী নাই হয়ে গেল

লোকটা বলল, ‌‘আগে খেতাম দুধ–চিনি বেশি দিয়ে। ওই ঘটনার পর থেকে লিকার খাই। টেস্ট বদলে গেছে।’

সামনে বসে থাকা সাদাসিধে সাধারণ চেহারার লোকটার কথা প্রথমে বুঝতে পারল না সাজিদ। সত্যি বলতে কি, প্রথমে ওর মনে হলো, আমজাদ আলী নামের লোকটি বোধ হয় তামাশা করতে এসেছে। কিন্তু তরুণ হলেও আইনজীবী হিসেবে সাজিদের এখন বেশ নামডাক। তার পরামর্শ নিতে হলে মোটামুটি ভালো অঙ্কের ফি গুনতে হয় যে কাউকে। গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ নিশ্চয় তামাশা করতে আসবে না তার কাছে। কিন্তু লোকটা এসব আবোলতাবোল কী বলছে?

সাজিদ সকাল থেকেই কোর্টে ছিল। একটা কোম্পানির হিসাব-নিকাশের গোলমাল নিয়ে কেস চলছে দুই মাস ধরে। পুরো ব্যাপারটা যখন প্রায় গুছিয়ে এনেছে, তখন কোম্পানির কিছু কাগজ জাল বলে অভিযোগ ঠুকে দিয়েছে বাদী। প্রায় জেতা কেসটা একেবারে কেঁচে গেছে আজ। এ নিয়ে সারা দিন এত কথা বলতে হয়েছে যে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। চেম্বারে আজ এই লোকই শেষ দর্শনার্থী। এর সঙ্গে কথা শেষ হলেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আগামীকাল কেসটা নিয়ে আবার খাটতে হবে। সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘আমজাদ আলী সাহেব, আসেন, চা খাই। মাথাটা কাজ করছে না। চা দিতে বলি?’

লোকটি হেসে মাথা নাড়ল। সাজিদ বেল টিপে তার পিয়নকে দুই কাপ চা দিতে বলল। তার নিজেরটা কড়া লিকারের, দুধ থাকবে কিন্তু চিনি ছাড়া—পিয়নকে এটা বলার দরকার নেই। সে লোকটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি দুধ–চা, না লিকার?’

লোকটা বলল, ‌‘আগে খেতাম দুধ–চিনি বেশি দিয়ে। ওই ঘটনার পর থেকে লিকার খাই। টেস্ট বদলে গেছে।’

‘আপনি বলতে চাইছেন, ২০ সেপ্টেম্বরের আগের আপনি আর পরের আপনার মধ্যে অনেক তফাত?’

‘উফ্!’ দুই হাত দিয়ে কপালের দুই দিক চেপে ধরল সাজিদ। কী এক ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে এই লোক। ২০ সেপ্টেম্বরের আগে আর পরে। আগে সে কী কী করত, আর এখন কী করে। সে প্রসঙ্গে ফিরতে চেষ্টা করল, ‘আপনি বলতে চাইছেন, ২০ সেপ্টেম্বরের আগের আপনি আর পরের আপনার মধ্যে অনেক তফাত?’

লোকটি মাথা নাড়ল, ‌‘জি। আকাশ-পাতাল।’

সাজিদ নোটবুকে লিখল, ‘২০ সেপ্টেম্বর ২০২০। তাই না? ঠিক কয়টায় ঘটল ঘটনাটা, বলেন তো?’

লোকটা সোজা তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে বলল, ‘একটু আগেই বলছি। আপনি ভুলে গেছেন। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট। আমি দোকানে ঢুকছিলাম। কম্পিউটারের দোকানে, এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের তিনতলায় দোকান। আমি হিসাবরক্ষক ওই দোকানের। সেলস ম্যানেজারও। আমার হাত দিয়েই সব লেনদেন হয়। কর্মচারীদের বেতন–বোনাস হয়। দোকানটা আমার এক চাচাতো ভাইয়ের। তবে আমারও শেয়ার আছে। উনি খুব একটা আসেন না। মাস শেষে হিসাব বুঝে নেন। বলতে পারেন আমার হাতেই সবকিছু।’

সাজিদ একটু বিরক্ত হলো। এত ডিটেইলস দরকার ছিল না। লোকটা একটু বেশি কথা বলে। সে বিরক্ত মুখে বলল, ‘হুম্, তারপর কী হলো?’

লোকটা একটু কেশে শুরু করল, ‘আমিই সেদিন দোকানে প্রথম আসি। চাবি আমার কাছে আছে, আবার কর্মচারী জামিলের কাছেও একটা ডুপ্লিকেট আছে। তবে সেদিন আমিই আগে গেছি। শাটার উঠিয়ে কাচের দরজা খুলে দোকানে ঢুকে বাঁ দিকের দেয়ালে সুইচবোর্ড। প্রথম সুইচটাই টিউবলাইটের। আধো অন্ধকারে ঠাহর করে যে-ই না সুইচ টিপতে গেছি, অমনি একটা বিরাট ঝাঁকুনি। সুইচবোর্ডটাতে আগুন ঝলকে উঠল একমুহূর্তের জন্য। সেই ধবধবে সাদা আলোয় চোখ অন্ধকার হয়ে এল আমার। একটা তীব্র ঝাঁকুনি মাথা থেকে পা পর্যন্ত অনুভব করার পর আমি ঠাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।’

চা এসে গেছে। সাজিদ লোকটার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে হাসপাতালে নিল কে?’

‘পাশের দোকানের ওরা ছুটে এসেছিল। মাথায়–মুখে পানি দিতে দিতে জামিলও চলে আসে। জামিল ও আরেকটা ছেলে আমাকে ল্যাবএইড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারি যে আমি ইলেকট্রিক শক খেয়েছিলাম। ডাক্তার বলল, তেমন কিছু হয়নি। কোনো কিছু পোড়েওনি। কারেন্টের শক খেলে নাকি হার্টবিটে সমস্যা হয়, তাই মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার ইসিজি করল। তেমন কিছু না পেয়ে ছেড়ে দিল। আমি বাসায় চলে এলাম।’

চায়ে দুধ বেশি হয়েছে। পাউডার দুধের গন্ধ চায়ে। মুখ বিকৃত করে চুমুক দিয়ে সাজিদ বলল, ‘আপনার সমস্যাটা কীভাবে বুঝতে পারলেন?’

‘বাসায় ফিরে দুপুরে খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ওঠার পর আমার ওয়াইফকে চা দিতে বলে বারান্দায় পেপার পড়ছিলাম। ওয়াইফ চা নিয়ে এসে অবাক হয়ে বলল, তুমি চশমা ছাড়া পেপার পড়ছ? তুমি না চশমা ছাড়া কিছু দেখো না? শুনে আমিও অবাক হলাম। তাই তো! সাধারণত আমি চশমা ছাড়া কাছের কোনো অক্ষর পড়তেই পারি না। অথচ দিব্যি এখন সব স্পষ্ট দেখছি। ব্যাপারটা তখন পাত্তা দিইনি। পরদিন দোকানে গিয়ে খেলাম প্রথম ধাক্কাটা। কারণ, একটা চেকে সই করতে গিয়ে দেখি সইটা আমার নয়। অন্য কারও। আমি এভাবে সই করি না। তার চেয়ে বড় কথা, আমি চিরকাল ডানহাতি। এখন দেখি ডান হাতে ভালো করে লিখতে পারছি না। বাঁ হাতে দিব্যি সুন্দর লিখছি। আমি সেদিন থেকে বাঁহাতি হয়ে গেলাম! আমার হাতের লেখাও বদলে গেল।’

সাজিদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নোটবুকে কলম ঠুকতে ঠুকতে বলল, ‘আপনি ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?’

আমি মানুষটা আগের আমি থাকলেও অফিস–আদালত, ব্যাংক, কোম্পানি আমাকে আর চিনতে পারছে না।

‘জি। দেখিয়েছি। ডাক্তার আমাকে নিউরোলজিস্টের কাছে রেফার করেছিলেন। উনিও এই সব শুনে আকাশ থেকে পড়লেন মনে হয়। এ রকম নাকি কখনো শোনেননি। তারপর আমার মাথার এমআরআই করলেন। কিছু পাননি। দুটো ভিটামিন দিলেন।’

সাজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকে বোধ হয় তার কপালে বিশ্রাম নেই। ঘুমে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু এই আজব ক্লায়েন্টকে নিয়ে সে কী করে? সে চা শেষ করে বলল, ‘এখন বলুন, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?’

লোকটাও চা শেষ করেছে। বাঁ হাতে চায়ের কাপটা পিরিচের ওপর রেখে বলল, ‘বুঝতেই পারছেন। আমার চেহারা–ছবি সব আগের মতোই আছে। চিনতে কারও ভুল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার হাতের লেখা, সই বদলে গেছে। আমি মানুষটা আগের আমি থাকলেও অফিস–আদালত, ব্যাংক, কোম্পানি আমাকে আর চিনতে পারছে না। কোনো টাকাপয়সা তুলতে পারছি না। সই মেলে না। টিপসইও মেলে না। সব উল্টাপাল্টা। কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। দোকানের কিছু পেমেন্ট দেওয়ার ছিল, সেটাও আটকে আছে। কাগজপত্রে আমি পাল্টে গেছি। এই আমার এখন কোনো দাম নেই। আমার দোকান, ফ্ল্যাট, গ্রামের জমিজমা—কোনো কিছুই আর আমার বলে দাবি করতে পারছি না। এমনকি পাসপোর্ট, এনআইডি। এখন আপনিই বলেন, আমি কী করব!’

সেদিনকার মতো লোকটাকে বিদায় করে সাজিদ ঘুমাতে গেল। কিন্তু তার ঘুম এল না। সারা রাত এপাশ-ওপাশ করেই কাটল তার। সকাল থেকে সে নানা জায়গায়, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিতে শুরু করল, এর সমাধান কী হতে পারে। কেউ যদি নিজের সই পরিবর্তন করতে চায়, তবে তাকে আর্থিক লেনদেনের জায়গাগুলোতে দরখাস্ত করতে হবে। নতুন সই আর পুরোনো সইয়ের তিনটি করে নমুনা জমা দিতে হবে। কিন্তু সে যদি পুরোনো সই না করতে পারে, মানে নমুনা দেখাতে না পারে? ব্যাংকের কর্মকর্তা মাথা নেড়ে জানালেন, তাহলে তো বেশ মুশকিল। উন্নত বিশ্বে চোখের রেটিনার স্ক্যান দিয়ে মানুষের আইডেনটিটি নিশ্চিত করা যায়। অনেক সময় ডিএনএও মেলানো যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে তো এগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয় না। তাই হাতের সই বা টিপসই–ই ভরসা। তা হাতের সই না হয় বদলাতে পারে, কিন্তু আঙুলের ছাপ তো আর কারও বদলায় না! তাহলে আর চিন্তা কী? সাজিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই লোকের যে আঙুলের ছাপও গেছে পাল্টে। টিপসইও মেলে না। কয়েক দিন পর এসে লোকটি আরও আজব কথা শুনিয়ে গেল। ২০ সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত নাকি তার রক্তের গ্রুপ ছিল এ পজিটিভ। আর এখন তার রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ! কৌতূহল থেকেই নিজের রক্তের গ্রুপ আবার পরীক্ষা করেছে সে। তার ফল এই।

‘কেউ আর বিশ্বাস করছে না যে আমি আসলে আমি।’ মন খারাপ করে বলল লোকটা, ‘আপনাকে বলতে বাধা নেই, আমার চাচাতো ভাই কাম বিজনেস পার্টনারও সন্দেহ করতে শুরু করেছে। তার ধারণা, আসল আমজাদ আলী কারেন্টের শক খেয়ে মারা গেছে। আমি ভুয়া। সম্পত্তি আর টাকাপয়সা প্রতারণা করে দখল করার পাঁয়তারা করছি। সে নাকি প্রতারণার মামলাও করতে চায়। ভাই, সে মামলা করলে আমি নিশ্চিত হারব। আমার পরিবার বা সন্তান দোকানের হিস্যা থেকে বঞ্চিত হবে।’

‘আচ্ছা, আমজাদ আলী সাহেব, আপনার কি সন্তান আছে?’ সাজিদ প্রশ্ন করল।

‘জি। আমার একটাই ছেলে। বয়স সাড়ে সাত বছর। রাইফেলস পাবলিক স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে।’

সাজিদ উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়, ‘ইয়েস। এই তো। আপনার ছেলেকে দিয়েই আমরা কোর্টে প্রমাণ করব যে আপনিই আমজাদ আলী। আপনার ডিএনএ টেস্ট মেলানো হবে ছেলের সঙ্গে। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে আপনি এই ছেলের পিতা, তার মানে আপনিই আমজাদ আলী।’

লোকটা মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘মিলবে তো?’

সাজিদ হেসে বলল, ‘আর তো কোনো উপায় দেখছি না। একজন মানুষের আর যা–ই বদলাক, ডিএনএ বা জিন তো আর পাল্টাবে না। তবে এটা একটা ঝামেলার ব্যাপার বটে। ফরেনসিক ল্যাবরেটরির সাহায্য নিতে হবে। তারা কত দিনে রিপোর্ট দেয়, কে জানে। আমি স্থানীয় থানার মাধ্যমে আবেদন করে রাখছি।’

আমজাদ আলী কিছুদিন ধরে দোকানে যায় না। হিসাবপত্রেই সব গন্ডগোল লেগে আছে, জট পাকিয়ে গেছে, এখন গিয়ে কী লাভ! তার চেয়ে কিছুদিন না যাওয়াই ভালো। সে তার ভূতের গলির ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে দিনভর সামনের গলির রিকশা চলাচল দেখে। কখনো ছেলেকে নিয়ে পড়তে বসায়। ছেলের খাতা কারেকশন করতে গিয়ে নিজের পাল্টে যাওয়া হাতের লেখার দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে থাকে। ছেলের জন্মের দিন ঢাকা শহরে ভূমিকম্প হয়েছিল। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে সেকি ছোটাছুটি! কারা যেন গুজব রটিয়েছিল, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ফাটল ধরেছে। ক্রেতা–বিক্রেতা সবাই হুড়মুড় করে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। হইচই থামার পর স্ত্রীর খবর নিতে ফোন করে আমজাদ আলী শোনে, তার পানি ভেঙে গেছে। প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে স্কুটারে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল সেদিন। সময়ের আগেই পানি ভেঙে যাওয়ায় সিজার করে বের করতে হলো বাচ্চা। ছোট্ট ফুটফুটে গোলাপি একটা বাচ্চা। প্রথম কোলে নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছিল সে। এই সবকিছু তো তার মনে আছে। তাদের দাম্পত্য জীবন, সন্তানের জন্ম, জন্মের পর প্রথম হাঁটার গল্প, প্রথম কবে বাবা ডাকল, প্রথম স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিনটির কথা—কেউ জিজ্ঞাসা করলে গড়গড় করে সব বলে দিতে পারবে। তারপরও ডিএনএ টেস্ট করে প্রমাণ করতে হবে সে এই ছেলের বাবা? সেই হলো আমজাদ আলী? পৃথিবীটা কী আশ্চর্য জায়গা! একজন জলজ্যান্ত মানুষের চেয়ে এখানে সই–সাবুদ হাতের লেখাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেকে বেগুনি ভেজে দিয়ে গেছে তার মা, মুচমুচে গরম বেগুনি মুখে দিয়ে মুখ পুড়ে যাওয়ার দশা হলো আমজাদ আলীর। চেঁচিয়ে ডাকল স্ত্রীকে, ‘আরে, একটু পানি দিয়ে যাও। এত গরম বেগুনি দিয়েছ কেন বাচ্চাকে?’

স্ত্রীর কথা শুনে থমকে গেল আমজাদ আলী। তাই তো। বেগুন খেলে গোটা গোটা চাকা ওঠে শরীরে, তাই সে ইলিশ মাছ, বেগুন—এসব খায় না।

তার কথা শুনে এ ঘরে এসে স্ত্রী বলল, ‘তুমি তো বেগুন খাও না কখনো, তোমার না বেগুনে অ্যালার্জি? খেতে গেলে কেন?’

স্ত্রীর কথা শুনে থমকে গেল আমজাদ আলী। তাই তো। বেগুন খেলে গোটা গোটা চাকা ওঠে শরীরে, তাই সে ইলিশ মাছ, বেগুন—এসব খায় না। কিন্তু আজ এতগুলো বেগুনি খেয়ে ফেলল, কিছু হলো না যে! তার এত দিনের অ্যালার্জির রোগ ভালো হয়ে গেল নাকি? আমজাদ আলীর স্ত্রী সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

মাস তিনেকের মধ্যে সাজিদ মোটামুটি অসাধ্য সাধন করে ফেলল। সব ডকুমেন্ট, কাগজপত্র, ব্যাংকের হিসাব, দলিলপত্র ক্লেইম করে আমজাদ আলীর কেসটা কোর্টে উঠিয়ে ফেলল সে। নানাভাবে সাক্ষী-সাবুদ হাজির করে প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে ইনিই আমজাদ আলী, একটা দুর্ঘটনার কারণে তার কিছু কিছু পরিচয় বহনকারী সত্তা পরিবর্তিত হয়েছে কেবল। এমনকি ফরেনসিক ল্যাবে পুত্র ও পিতার ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থাও করে ফেলল সে। আমজাদ আলীর কেসটা প্রত্যক্ষ করতে কোর্টে রীতিমতো ভিড়। সাংবাদিকেরাও এসেছে কভার করতে। সাজিদ আদালতে আমজাদ আলীর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের ফটোগ্রাফ, বিয়ের ছবি জমা দিয়ে চেহারার মিল দেখিয়ে দিয়েছে। সন্দেহ নেই যে এই চেহারার অধিকারী ব্যক্তিটি আমজাদ আলীই। অপর পক্ষের উকিল জেরা শুরু করলেন—

‘আপনার নাম?’

‘আমজাদ আলী।’

‘জন্মতারিখ?’

‘২২ মার্চ ১৯৮০ সাল।’

‘আপনার বিয়ের তারিখ? আপনার সন্তানের জন্মতারিখ? আপনার স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম কবে দেখা হয়েছিল, মনে আছে? আচ্ছা, আপনারা বিয়ের পর প্রথম কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন, বলেন তো? আপনার বাবার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল?’ সব কটি প্রশ্নের জবাবই আমজাদ আলী নির্ভুল দিতে পারল। সাজিদ মনে মনে খুশি। কেসটা জিতে যাবে মনে হচ্ছে। আমজাদ আলীকে হাসপাতালে যে ডাক্তার দেখেছিলেন, দোকানের যে ছেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল—সবারই সাক্ষ্য নেওয়া হলো। সেদিনকার তারিখের পর সাজিদ আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, ‘ভাববেন না আমজাদ সাহেব, আপনি জিতে যাবেন। সবাই আপনার পক্ষেই সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর বাকি রইল ডিএনএ টেস্ট।’

কোর্ট থেকে ফেরার পথে খুশিমনে আমজাদ আলী ছেলের জন্য আইসক্রিম আর বেলুন কিনল। বাড়ি ফিরতেই ছুটে এল ছেলে। আইসক্রিম পেয়ে খুশিতে আত্মহারা, ‘আম্মু দেখো, দেখো, আব্বু আইসক্রিম এনেছে। আব্বু কত ভালো হয়ে গেছে।’

আমজাদ আলীর স্ত্রী ভ্রু কুঁচকে রইল অনেকক্ষণ। ছেলের টনসিলের সমস্যার জন্য আমজাদ আলী কখনো ছেলেকে ঠান্ডা কিছু খেতে দিত না। এমনকি অন্য কেউ ঠান্ডা ড্রিংকস বা আইসক্রিম দিলে রাগ করত খুব। লোকটা সত্যি অনেক বদলে গেছে। মাঝেমধ্যে স্বামীকে যেন চিনতে পারে না সে।

‘আপনার নাম জান্নাত বেগম?’ আইনজীবী প্রশ্ন করলেন।

‘জি।’

‘আমজাদ আলী সাহেব আপনার স্বামী?’

‘জি।’

‘কত দিন হয় বিয়ে হয়েছে আপনাদের?’

‘সাড়ে ৯ বছর।’

‘আপনাদের সন্তান?’

‘একটি।’

একজন রক্ত–মাংসের জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে একদিন সবার চোখের সামনে থেকেও এ শহরে নাই হয়ে গেল।

‘মিসেস জান্নাত, এই ভদ্রলোকই কি আপনার স্বামী? ভালো করে দেখে–শুনে–বুঝে বলেন।’

জান্নাত অস্বস্তি নিয়ে চেয়ে রইল। আমজাদ আলী দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় চোখে তাকিয়ে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে সে। কিন্তু এই লোক কি সত্যি তার স্বামী? তবে তাকে আজকাল এত অচেনা লাগে কেন?

‘মিসেস জান্নাত, আদালত আপনার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। প্লিজ, বলুন, ইনি আপনার স্বামী আমজাদ আলী কি না! ভালো করে ভেবে বলুন।’

জান্নাতের শরীর কাঁপছে। ঠোঁট দুটোয় যেন আঠা লেগে গেছে, খুলতে পারছে না সে। আজ সকালেই অপর পক্ষের উকিল ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট দাখিল করেছেন আদালতে। সন্তানের সঙ্গে এই আমজাদ আলীর ডিএনএ মেলেনি। তাহলে কে এই লোক? কে ওপারে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে? সে কি অন্য কেউ? কিন্তু তা কী করে হয়? তার সন্তান যে আমজাদ আলীর, জান্নাতের চেয়ে এটা কে আর বেশি জানে?

জান্নাতের নীরবতায় আদালতজুড়ে হট্টগোল শুরু হলো। জজ সাহেব হাতুড়ি পিটিয়ে ঠান্ডা করলেন জনতাকে। সাজিদ ঘামতে শুরু করেছে। কী করছে এই মহিলা? নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছে কেন? চট করে বলে ফেললেই হয়।

‘মিসেস জান্নাত, বলুন। এই লোক আপনার স্বামী আমজাদ আলী কি? আপনি নিশ্চিত?’

জান্নাত এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল, ‘জানি না, জানি না।’

আবার আদালতজুড়ে গুঞ্জন শুরু হলো। অপর পারে হতবাক হয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমজাদ আলী। নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

২০ সেপ্টেম্বর ২০২০। ওই দিনের পর থেকে কোনো কিছুই আর তার নেই। ব্যাংকের টাকাপয়সা, দোকানের মালিকানা, ফ্ল্যাট, গাজীপুরের জমি। তার পাসপোর্ট। রক্তের গ্রুপ। তার সই–সাবুদ, হাতের লেখা। এমনকি তার স্বভাব–চরিত্র। কোনো কিছু্ আর তার নয়। এখন দেখা যাচ্ছে, এই সন্তানও তার নয়। আর জান্নাত, তার স্ত্রী, যার সঙ্গে গত সাড়ে ৯ বছর এক ছাদের নিচে কাটিয়েছে, সে–ও আর তার নয়। এই অদ্ভুত পৃথিবীতে আমজাদ আলী বেঁচে আছে কেবল বদলে যাওয়া এক শরীর আর মনের মালিক হয়ে, কিন্তু তার আসলে কোনো পরিচয় নেই। একজন রক্ত–মাংসের জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে একদিন সবার চোখের সামনে থেকেও এ শহরে নাই হয়ে গেল।