দুই শিল্পী

অলংকরণ : আরাফাত করিম

আমরা দুজন মিলে একটা ছবি আঁকছি। একটা ক্যানভাসে। আমরা দুই শিল্পী। আমাদের মধ্যে অমিলের শেষ নেই। দুটি ভিন্ন জগতে আমাদের অবস্থান। দুটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। দুটি মহাবিশ্বের মধ্যেই কোনো যোগাযোগ নেই। কোনো এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে না দুই জগতের মধ্যে। কোনো টেলিযোগাযোগব্যবস্থা নেই। কোনো ধরনের যোগাযোগ কোনো দিন সম্ভবও না।

দুটি মহাবিশ্ব ভিন্ন সংখ্যক মাত্রা বা ডাইমেনশনে গড়া। আমাদের মহাবিশ্বটা এগারো মাত্রার। অপরটা কত মাত্রার, আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, ছবি আঁকার এই ক্যানভাস ছাড়া দুটি জগতের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। এই ক্যানভাস যেনবা একটা সুড়ঙ্গ, একটা রজ্জু, দুটি জগৎকে যা বেঁধে রেখেছে। বেঁধে না রাখলে জগৎ দুটি ভেসে আরও দূরে দূরে চলে যেত কি না, আমি জানি না। কেননা অপর জগৎ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কেউই কিছু জানে না। কিছু জানা সম্ভবও নয়। আমাদের সকল বিবরণ কেবল আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্য প্রযোজ্য।

আমি শুধু এটুকু জানি, আমার স্টুডিওর একটা বিশেষ ক্যানভাসে এসে দুটি সমান্তরাল জগৎ একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। এ যেন দুই যমজ মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্তের আম্বিলিকাল কর্ড বা নাভিরজ্জু। কিন্তু এই নাভির মধ্য দিয়ে কিছুই বাহিত হয় না, কিছু রঞ্জক পদার্থ বা পিগমেন্ট আর কিছু অবয়ব ছাড়া।  

দেখতে অতি সাধারণ, অতি তুচ্ছ একটা ছবি আঁকার ক্যানভাস। আয়তাকার। আকারে খুব বড়ও নয়। তিন ফুট বাই সাড়ে চার ফুট। আমার স্টুডিওর বেশির ভাগ ক্যানভাসই তাই। বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকতে পারি না আমি।

আমার ক্যানভাসে আরেকজন কেউ আঁকছে—এটা বুঝতে আমার কয়েক দিন সময় লেগে গেছে। আমি আত্মভোলা, তন্ময় ধরনের শিল্পী না হলে হয়তো আরও আগে টের পাওয়া যেত। প্রথম দিকটায় কেমন একটা ভৌতিক গা ছমছম করা অনুভূতি হয়েছিল

কেরোসিন কাঠের ফ্রেমের ওপর মোটা মার্কিন কাপড় মুড়ে বানানো ক্যানভাসটাকে আলাদা করার জো নেই। কাপড়ের ওপর দু-দফায় সাদা কোটিং দেওয়া হয়েছে। সবগুলোতেই দেওয়া হয়। সেই একই দোকান থেকে এটা কিনেছি আমি, অন্যগুলো যেখান থেকে কেনা।

যেদিন প্রথম তুলি ছোঁয়াই ক্যানভাসে, মাস চারেক আগে, সেদিন এমন না যে আমার মাথায় বিশেষ কোনো চিন্তা কাজ করছিল। আনমনা ছিলাম আমি। একটা ধোঁয়াটে অবয়ব, একটা আকারহীন চিন্তা পাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। কিন্তু ঠিক সেটাকেই যে ক্যানভাসে আকার দেব, এমন ভেবে ঠিক করিনি। প্রথম কয়েকটা তুলির আঁচড় আমি পরিকল্পনাহীনভাবেই দিই। সেই আঁচড় থেকে জন্ম নিতে থাকে অবয়ব আর চিন্তা আর পরিকল্পনার বীজ। সব সৃজনশীল কাজের বেলাতেই নিশ্চয় তাই হয়। শুরুতে সব সৃষ্টি থাকে আকস্মিক, তারপর ধীরে ধীরে পরিকল্পনার পরত পড়তে থাকে তার ওপর। ঢাকা পড়ে যেতে থাকে আকস্মিকতা। একসময় মনে হয় পুরোটাই পরিকল্পনা, পূর্বনির্ধারিত।

আমি সাধারণত তেলরঙে আঁকি। অ্যাক্রিলিক ছুঁয়েও দেখি না। তেলরঙে আঁকার নানান ঝক্কি, নানান প্রস্তুতি। রঙের পিগমেন্টের সঙ্গে তার্পিন তেল, লিনসিড অয়েল মেশাও। এক পরত রং চড়ালে সেটা শুকানোর জন্য অপেক্ষা করো। এভাবে অতি ধীরে, একটু একটু করে ক্যানভাসে যা ফুটে ওঠে, সকলে তাকে বলে ছবি। আমি বলি, এটা একটা ধারণা।

আমার ক্যানভাসে আরেকজন কেউ আঁকছে—এটা বুঝতে আমার কয়েক দিন সময় লেগে গেছে। আমি আত্মভোলা, তন্ময় ধরনের শিল্পী না হলে হয়তো আরও আগে টের পাওয়া যেত। প্রথম দিকটায় কেমন একটা ভৌতিক গা ছমছম করা অনুভূতি হয়েছিল। কোথাও একটা কিছু যে ঠিক নেই, এটা সবার আগে টের পেয়েছিল আমার ঘ্রাণশক্তি। ছবি আঁকার সময় বিশেষ করে তার্পিন তেলের গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগে। একটা ঝাঁজালো গন্ধের নেশায় আচ্ছন্ন থাকি সারাক্ষণ। কিন্তু সেবার ছবি আঁকা শুরুর দ্বিতীয় দিন থেকে তার্পিন তেলের সঙ্গে আরেকটা কিছুর গন্ধ পেতে শুরু করি আমি। সেটাও ঝাঁজালো গন্ধই, তবে একেবারেই অন্য রকম। কোনো চেনা গন্ধের সঙ্গে সেটার কোনো মিল নেই। একটা বুনো ফুলের গন্ধ যেন পাচ্ছি। তবে ফুলের গন্ধ যেমন স্নিগ্ধ, নরম হয়, সে রকম নয়। উগ্র গন্ধ। ভেবেছিলাম, বাইরে থেকে হয়তো বাতাসে ভেসে আসছে কোনো শিল্পকারখানার গন্ধ। জানালা বন্ধ করার পর গন্ধটা আরও বেড়ে যায়। টের পাই, গন্ধের উত্স ঘরের ভেতরেই। আরও ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝতে পারি, ক্যানভাসের ভেতর থেকেই আসছে এই গন্ধটা। ক্যানভাসের রঙের পিগমেন্টের ভেতর থেকে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এল ক্যানভাসে অবয়বগুলোর আকার বদলে যাওয়ার ধরন দেখে। ক্যানভাসে আমি কোনো বৃত্ত আঁকতে পারছিলাম না। যখনই কোনো বৃত্ত আঁকছি, সেটা কখনও উপবৃত্তের আকার নিচ্ছে, কখনও হয়ে যাচ্ছে অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্ত

দ্বিতীয় যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলাম, তা হলো, ক্যানভাসে রঙের বদলে যাওয়া। আমি এক রং ক্যানভাসে চাপিয়ে ঘুমাতে যাই। পরদিন ঘুম থেকে এসে দেখি রং বদলে গেছে। আগের দিন হয়তো সবুজ রং চড়িয়েছি, পরদিন এসে দেখি সেটা বেগুনি বা ভায়োলেট হয়ে আছে। ভার্মিলিয়ন রেড বদলে হয়ে যাচ্ছিল কোবাল্ট ব্লু। কখনও কখনও আমার চোখের সামনেই রং বদলে যাচ্ছিল। প্রথমটায় ভেবেছিলাম, আমি বোধ হয় কালার ব্লাইন্ডনেস বা বর্ণান্ধতা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু চোখের ডাক্তার। সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল। চোখ ঠিকই আছে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এল ক্যানভাসে অবয়বগুলোর আকার বদলে যাওয়ার ধরন দেখে। ক্যানভাসে আমি কোনো বৃত্ত আঁকতে পারছিলাম না। যখনই কোনো বৃত্ত আঁকছি, সেটা কখনও উপবৃত্তের আকার নিচ্ছে, কখনও হয়ে যাচ্ছে অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্ত। কোনো সরল রেখাও আঁকতে পারছিলাম না আমি। সেগুলো ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছিল। তখনও এ সবকিছুকে আমার কোনো জটিল স্নায়বিক রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখছিলাম আমি। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। তখনও টের পাইনি নিরীহ এই ক্যানভাসের অতিনিরীহ তল আসলে দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাকে ধারণ করে আছে। যেকোনো জ্যামিতিক অবয়ব বা যেকোনো রঙের পিগমেন্ট এখানে প্রবেশ করামাত্র স্থানের জটিল কাঠামো তাকে শুষে নিচ্ছে নিজের মধ্যে।

সপ্তম দিন আমি একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যাই, এই ক্যানভাসে অন্য কেউ আঁকছে। একই সঙ্গে। আর সেই শিল্পী আমাদের মহাবিশ্বের বাসিন্দা নন। স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই, আমার একার পক্ষে এ রকম উন্মাদ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনো দিনই সম্ভব ছিল না। এ কাজে আমাকে প্রভাবিত করেছে আমার এক খেপাটে বন্ধু। বন্ধুটি গণিতের অধ্যাপক। বদমেজাজ ছাড়াও একাডেমিক চক্রে তার আরও নানা রকম কুখ্যাতি আছে। একদিন সে যখন আমার বাসায় বেড়াতে এল, কথাচ্ছলে ক্যানভাসের এই বিদঘুটে ভৌতিক আচরণের কথা আমি তাকে বলেছিলাম, আর সে তখন এসে দাঁড়িয়েছিল এই ক্যানভাসের সামনে। ইজেলে হেলান দিয়ে রাখা ক্যানভাসের দিকে সে চোখ কুঁচকে এমন করে তাকিয়ে ছিল, ঠিক যেমন করে লাল একফালি কাপড় হাতে মাতাদোর তাকিয়ে থাকে মাথা নিচু করা ষাঁড়ের দিকে।         

দুটি মহাবিশ্বের পরস্পর মিথস্ক্রিয়ার গাণিতিক অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে, আমার বন্ধু প্রথম দিনই সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতির বিবরণ যে প্রচলিত কোনো গাণিতিক কাঠামো দিয়ে সম্ভব নয়, এর জন্য যে নতুন আর অভিনব এক গাণিতিক কাঠামো প্রয়োজন, সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।

দুটি জগৎ যখন আপাদমস্তক ভিন্ন কাঠামোয় গড়া হয়, দুটি জগতের অভিজ্ঞতার যদি কোনো অভিন্ন রেফারেন্স বিন্দু না থাকে, সে ক্ষেত্রে দুই জগতের মধ্যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার বিনিময় ছাড়া আর কী-ইবা বিনিময় ঘটা সম্ভব?

কিন্তু আমি এর কিছুই আসলে ভাবছিলাম না। সম্পর্কহীন দুটি জগতের নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তির বিনিময় কীভাবে সম্ভব—আমি সেই চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলাম। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, দুই জগতের মধ্যে অভিজ্ঞতার কোনো অর্থপূর্ণ বিনিময় কোনো দিনও সম্ভব নয়। কেননা, দুটি অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো অভিন্ন রেফারেন্স বিন্দু নেই। বিনিময়ের এই অসম্ভাব্যতার খানিকটা নজির পাওয়া গিয়েছিল আমেরিকার ভূখণ্ডে কলম্বাসের প্রথম পা রাখার সময়।

হতে পারে, ক্যানভাসের এক ক্ষুদ্র অস্থায়ী জানালায় এসে দুটি জগৎ আছড়ে পড়ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতির অদ্ভুত কৌতুককর দিকটি এই ছিল যে, বিনিময়ের সবটুকু সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছিল দুজন শিল্পীর তুলির ভেতর দিয়ে। আমি নিশ্চিত, চিত্রকলার ইতিহাসে এর আগে আর কখনোই একজন শিল্পীর তুলি এতটা সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠেনি, একজন শিল্পীর কাঁধে কখনোই এতটা মহাজাগতিক দায় এসে চাপেনি এর আগে। টের পেলাম, ক্যানভাসের সঙ্গে উলম্বভাবে ধরে রাখা আমার তুলির ওপারেই আরেকটি তুলি একই কৌণিক বিন্যাসে ধরে রাখা আছে। দুটি তুলি এক অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

কিন্তু শিগগিরই বোঝা গেল, এই নাভিরজ্জুর ভেতর দিয়ে অতি সীমিত কিছু নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোনো কিছুরই বিনিময় সম্ভব নয়। আমি বলার চেষ্টা করলাম, সেটাই সম্ভবত সবচেয়ে উত্কৃষ্ট পরিস্থিতি। দুটি জগৎ যখন আপাদমস্তক ভিন্ন কাঠামোয় গড়া হয়, দুটি জগতের অভিজ্ঞতার যদি কোনো অভিন্ন রেফারেন্স বিন্দু না থাকে, সে ক্ষেত্রে দুই জগতের মধ্যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার বিনিময় ছাড়া আর কী-ইবা বিনিময় ঘটা সম্ভব?

আগেই বলেছি, আমার উন্মার্গগামী বন্ধু এই অভিজ্ঞতার গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টায় নিমগ্ন হলো। সে চাইছিল, এর ভেতর দিয়ে অপর মহাবিশ্ব সম্পর্কে যতটা পারা যায়, তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু আমাদের কাঁচামাল বড়ই সীমিত। আর এগুলো থেকে আমরা শেষ পর্যন্ত কোনো বোধগম্য বিবরণে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। অজন্তার মন্দিরগুহায় জ্যাকসন পোলকের চিত্র এঁকে রাখলে একজন পূজারি যেমন শূন্য চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকবে, আমাদের অন্তঃসারশূন্য গাণিতিক বিবরণগুলোর দিকেও আমরা সেভাবেই তাকিয়ে ছিলাম।

আরও পড়ুন

আমি অনুমান করলাম, সমস্যাটা কিছু পরিমাণে ভাষাতাত্ত্বিক হতে পারে, যদিও ভাষাতত্ত্বের মৌলিক স্বীকার্যগুলো সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা নেই। আমার অজ্ঞতাই এ ক্ষেত্রে বরং আমাকে সৃজনশীল করে তুলছিল। আমি বললাম, আমাদের পার্থিব ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার যে সম্পর্ক, সেটার কোনো গাণিতিক কাঠামো যখন দাঁড় করানো যাবে, তখন যেকোনো নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাই গাণিতিক কাঠামোয় রূপান্তরযোগ্য হবে। ভেঙে সহজ করে বললে, ক্যানভাসে ভেসে ওঠা ছবির সঙ্গে তুলি নামক বস্তু আর রঙের পিগমেন্টের নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্ককে গাণিতিক কাঠামোয় রূপ দিতে হবে। ছবি একটা চিন্তামাত্র, এটা এক পরিবর্তনশীল অস্থির প্রবাহ, যার ভেতরে অনবরত চিহ্ন আর অর্থের জটিল মিথস্ক্রিয়া চলছে। ছবি নামক এই চিন্তাপ্রবাহের সঙ্গে রঙের পিগমেন্ট, তার্পিন তেল আর ক্যানভাসের সুতার বুননের কোনো না-কোনো যোগসূত্র অবশ্যই আছে, তা যত পরোক্ষই মনে হোক না কেন। সেটাকে গাণিতিক কাঠামোয় রূপান্তর করতে পারলে আমরা সেখান থেকে ভিন্ন আরেক ধরনের রঙের পিগমেন্ট, ভিন্ন আরেকটা তুলি আর সেই সঙ্গে সেই তুলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভিন্ন আরেক শিল্পীকে পুনর্নিমাণ করতে পারব। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা সম্ভব হবে পুরো একটা মহাবিশ্ব, এমন একটা জগৎ যেটা আমাদের মতো নয়।

ছবিটা শেষ করে আমি ইজেল থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে তাকাই ক্যানভাসের দিকে। আমি নিশ্চিত অপর প্রান্তে, স্থানের জটিল, অপার নদীর ভিন্ন পাড়ে অবস্থানকারী সেই শিল্পীও একইভাবে তাকিয়ে আছে এই ক্যানভাসের দিকে। আমরা কি একই ছবি দেখছি? একই অবয়ব?
আরও পড়ুন

ক্যানভাসে তুলি চাপানোর তিন সপ্তাহ পর একদিন টের পেলাম, আমাদের ছবিটি আঁকা হয়ে গেছে। একজন শিল্পী কখন ঠিক করেন, তাঁর শিল্পকর্মটি পরিপূর্ণ হয়েছে, সেটা এক জটিল রহস্য বটে। কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে আমি এবং আমরা দুজনেই সম্ভবত একই সময়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই।

ছবিটা শেষ করে আমি ইজেল থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে তাকাই ক্যানভাসের দিকে। আমি নিশ্চিত অপর প্রান্তে, স্থানের জটিল, অপার নদীর ভিন্ন পাড়ে অবস্থানকারী সেই শিল্পীও একইভাবে তাকিয়ে আছে এই ক্যানভাসের দিকে। আমরা কি একই ছবি দেখছি? একই অবয়ব? তারও পাশে কি তার কোনো গণিতবিদ বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে? শিল্প-অভিজ্ঞতার ভিন্ন এক গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করানোর প্রাণান্ত চেষ্টা কি চালিয়ে যাচ্ছে সেই গণিতবিদও? আমরা সফল হইনি, কিন্তু যদি সেই গণিতবিদ সফল হয়ে যায়? আমরা কি কোনো দিনও জানতে পারব, তাঁর সাফল্যের বার্তা?

আমি আমার বসন্তকালীন প্রদর্শনীতে টাঙালাম এই ক্যানভাস। গ্যালারিতে আর দশটা ক্যানভাসের পাশে সাদামাটাভাবেই রাখা হলো এটা। দর্শকেরা যখন এটার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, আমি সাবধানে তাকাচ্ছি তাঁদের চোখের দিকে, বিস্ময়ের কোনো অচেনা অনুভূতির চিহ্ন খুঁজছি আমি সেখানে। আর তখন নিজের অজান্তে কল্পনা করছি ভিন্ন একটা গ্যালারির কথা, ভিন্ন একসারি দর্শক আর তাঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা কৌতূহলী এক শিল্পীর কথা।