পড়ন্ত বিকেলে স্কুল থেকে একলা হেঁটে বাড়ি ফিরছেন ইউসুফ মাস্টার, এ সময় ঝুপ করে বৃষ্টি। অথচ খানিক আগেও আকাশে একচিলতে মেঘ ছিল না।
মফস্বলের এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ান ইউসুফ মাস্টার। থাকেন শহরতলিতে। বড় রাস্তা থেকে এবড়োখেবড়ো সুরকি ঢালা যে সরু পথ তার বাড়ি পর্যন্ত গেছে, গোসলে এখনো কুসুম কুসুম গরম পানি লাগে। বৃষ্টির ফোঁটা তেরছা হয়ে নেমে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে তার পাঞ্জাবির অর্ধেকটা ভিজিয়ে দিল।
‘মরার বৃষ্টি আর সময় পেলি না!’
এই বলে একটা ঝাঁকড়া কড়ইগাছের নিচে দাঁড়ালেন মাস্টার। বেশ বয়স এই কড়ইগাছের। অনেক মোটা গুঁড়ি। এর গা ঘেঁষে কয়েকজন বড় মানুষ গোল হয়ে দাঁড়াতে পারবে। কড়ইগাছের ডালপালা উদার বাহুর মতো ছড়ানো। তবে পাতা ঝরে প্যাঁকাটি হয়ে গেছে। নতুন পাতা গজাতে শুরু করলেও আগের চেহারায় ফিরে যেতে সময় লাগবে। তাই বৃষ্টির ছাঁট ঠিকই লাগছে গায়ে। পেছনে মরা খালটার কাদাজলে ছন্দ তোলার চেষ্টা করছে বড় বড় ফোঁটা। বুনো ঝোপ থেকে মন উতলা করা সোঁদা গন্ধ আসছে।
ঠান্ডার দোষ আছে ইউসুফ মাস্টারের। একটু ভিজলেই বুক বসে যায়। বিড় বিড় করে নিজেকে বকতে লাগলেন তিনি। আজকাল খুব অল্পেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার।
স্কুল থেকে রওনা হওয়ার আগে অবশ্য জাভেদের সঙ্গে একচোট বাতচিত হয়েছে। এতে মেজাজ এমনিতেই বেশ খাট্টা ইউসুফের। দুজনই বিজ্ঞানের শিক্ষক। জাভেদ কয়েক বছরের ছোট। একধরনের নাক উঁচু ভাব আছে ওর। মুরব্বি বলে তাকে মানতে চায় না।
প্রসঙ্গটা অবশ্য ইউসুফই পেড়েছিলেন। হালের আলোচিত বিষয়। ভিনগ্রহের একটা প্রাণী নাকি এসেছে পৃথিবীতে। পত্রপত্রিকা আর অনলাইন পোর্টালগুলোতে কয়েক দিন ফলাও করে খবর ছাপা হয়েছে। দুনিয়াজুড়ে রীতিমতো হইচই। তবে তা থিতু হতেও সময় লাগেনি। কারণ, পুরোনো সেই প্রশ্ন—কে দেখেছে?
চাক্ষুষ প্রমাণ ছাড়া এসব খবর একসময় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চুপসে যায়। কাল রাতে বিজ্ঞানবিষয়ক এক টিভি চ্যানেল এই পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটেছে। এতে অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে ওই এলিয়েনের পায়ের ছাপ দেখানো হয়। জাফনার জঙ্গলে পাওয়া গেছে এই পায়ের ছাপ। সেখানে কিছু ঝোপঝাড় পোড়াতে এমন জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছে, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এই এলিয়েন অনেক বেশি বুদ্ধিমান। গতিও খুব বেশি। একটা জেট ফাইটারের মতো চলতে পারে সে। একজন খ্যাতিমান ফরেনসিক শিল্পী দিয়ে ওই এলিয়েনের ছবিও আঁকা হয়েছে, যা প্রতিবেদনে দেখানো হয়।
ফেরার সময় মনটাকে একটু সতেজ করতে এই প্রসঙ্গটা টেনেছিলেন ইউসুফ মাস্টার। সেই ১১টা থেকে ৪টা—তিন-চারটা ক্লাসে বকবক করে মাথায় কিছু থাকে?
কাউকে উদ্দেশ করেও গল্পটা ছাড়েননি ইউসুফ। শিক্ষকদের কমন রুমে তিন-চারজন বসে ছিলেন টেবিলে। সবারই উঠি উঠি ভাব। এমন সময় ইউসুফ শুরু করলেন, ‘কাল রাতে এলিয়েনের ওই জিনিসটা তোমরা দেখেছ নাকি?’
সবাই সাগ্রহে তার দিকে তাকালেন। ইউসুফ তাদের ছাত্র বানিয়ে বেশ একটা লেকচার দিয়ে চললেন। আচমকা বাগড়া দিল জাভেদ। ফস করে বলে বসল, ‘স্যার, বয়স হয়েছে তো, তাই অবসর কাটানোর কাজ আর খুঁজে পান না। এলিয়েন বলে আসলে কিছুই নেই। ওটা একদল বাটপার আর মিডিয়ার কারসাজি। দুপয়সা কামানোর ধান্ধা! আর আমরাও আছি, স্যার। হাভাইত্যা সব! ছাতামাথা যা পাই, গোগ্রাসে গিলি!’
নিমেষে চোঁ করে ইউসুফের চাঁদি গরম। মেজাজ ফোরটি নাইন। ব্যস, লেগে গেল সিনিয়র-জুনিয়র বাগ্যুদ্ধ। সে কথা মনে করে সজোরে একটা নিশ্বাস ফেললেন ইউসুফ। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘আহাম্মক!’
কটাক্ষটা নিজেকে না জাভেদকে করলেন, নিজেই ঠাওরাতে পারলেন না ইউসুফ। এমন সময় একটা অচেনা কণ্ঠ বলে উঠল, ‘আমাকে এভাবে বকবেন না, স্যার!’
চমকে উঠলেন ইউসুফ মাস্টার।
‘কে? কে কথা বলে?’ ভয়ে গলাটা কেঁপে ওঠে তার।
কোনো সাড়া নেই। তবে যা শুনেছেন, মনের ভুল? হতে পারে। বয়স তো কম হয়নি। ৫৪ চলছে। তবে চোখ-কানের বেতাল হওয়ার সময় এখনই শুরু হওয়ার কথা নয়। চোখ দুটো অবশ্য এর মধ্যে বেঁকে বসেছে। বছর তিনেক হয় ডায়াবেটিস বাগিয়েছেন। তাই বলে লুকিয়ে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া কমেনি। বিশেষ করে পাঁচআনি বাজারের জিলিপি দেখলে আর হুঁশ থাকে না।
ছয় মাস আগের ঘটনা। সেদিন কাশীনাথের দোকান থেকে ভরপেট জিলিপি খেয়ে ফিরেছেন। গভীর রাতে তলপেটের চাপে জেগে উঠে দেখেন, ডান চোখের সামনে কালো বিন্দুর মতো কী যেন নড়াচড়া করে। দৃষ্টি ঝাপসা।
এমন ঘোর বিপদে বউকে না ডেকে পারা যায়? ওই গোটা তিনেক গাল হজম করতে হলো। তা রাগ যতই দেখান না কেন, রুনা আবার সাড়া দেন। স্বামীর সমস্যার কথা শুনে তার চক্ষু চড়কগাছ। ভাবলেন, গভীর রাতে যম বুঝি খাড়া! চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুললেন, ‘ও সারা, ও জারা, তোদের বাপ তো যায়!’
তড়াক করে জেগে উঠল মেয়ে দুটি। চোখ ডলতে ডলতে ছুটে এল ওরা। ছোটটা জারা। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আবেগ এমনিতেই ছলকায়, তার ওপর বাপের বড় বিপদ। হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করল সে।
সারার মাত্র সেদিন বিয়ে হয়েছে। নববধূর ঘোর এখনো কাটেনি। যেদিকে তাকায়, শুধু স্বামী আমিরকে দেখে। দুনিয়ার বাকি সবাই মিছে। ওর কাছে এ যেন রাতদুপুরের নাটক। বরকে নিয়ে এটা দ্বিতীয়বারের নাইওর। এ সময় এসব ভালো লাগে?
এদিকে আমির বাবাজির জামাই আদর ভালোই চলছিল। নতুন নতুন এসবে অন্য রকম মজা। আচমকা শ্বশুরবাড়ির রসের হাঁড়ি ফটাস! এখন এই অসময়ে শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটো।
হাসপাতালে অবশ্য কাজের কাজ কিছু হলো না। ডিউটিতে থাকা চ্যাংড়া ডাক্তার বিরক্তির সঙ্গে হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘ওনার হার্টে কিছু হয়নি। সমস্যাটা চোখেই। সদরে নিয়ে আই স্পেশালিস্ট দেখান।’
রুনা বিড় বিড় করতে লাগলেন, ‘মাসের শেষে এইটা কী তামাশা!’
সারা পড়ে গেল অস্বস্তিতে। খোঁয়াড়ের বড় মোরগটা এখনো ধরাই হলো না, এর মধ্যে এ কী রঙ্গ! আমিরের সামনে মুখ কাঁচুমাচু করে সে বলতে লাগল, ‘বাবাটা না, কী যে একটা
মানুষ!’
আমির ভাবল ‘শ্বশুর কা জামাই’ প্রমাণ দেওয়ার এ–ই সুযোগ। সে বুক ফুলিয়ে বলল, ‘আহা–হা, আব্বাকে দোষ দিচ্ছ কেন? ওনার বয়স হয়েছে। এখন তো এমন দু-চারটা শারীরিক সমস্যা হতেই পারে।’
ইউসুফ মাস্টারকে নেওয়া হলো সদরের এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে।
রুনা পিঁপড়ের সঞ্চয় টিনের কৌটা কেঁচে ৫০০ আর ১০০ টাকার কিছু নোট মিলিয়ে জামাইয়ের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন, আমির কেয়ারই করল না। বরং নিজের হিপ পকেটের মানিব্যাগে মৃদু চাপড় মেরে আত্মবিশ্বাস জোগাল। আমিরি চালে মনে মনে বলল, ‘এ আর এমন কী, বড় জোর চশমাটা বদল হবে আর কয়েক দিনের জন্য আই ড্রপ!’
কিন্তু চক্ষু বিশেষজ্ঞ ইউসুফের চোখ পরীক্ষা করে যা বললেন, জামাই বাবাজির আমিরি খসে পড়ল। শ্বশুরের চোখে রক্তক্ষরণ হয়েছে। অ্যাভাস্টিন পুশ করতে হবে। পরে আবার লেজার। ওষুধের দাম শুনে টং করে একটা ঘা যেন পড়ল আমিরের চাঁদিতে। কিসের ‘শ্বশুর কা জামাই’, ঠ্যাং বড় করে পালাতে পারলে বাঁচে! কিন্তু শ্বশুরবাড়ির ল্যাঠা মানেই জিগার আঠা। এত সহজে ছোটা যায়? ভাগ্যিস, প্রযুক্তির কল্যাণে এটিএম বুথটা এসেছিল, নইলে কী যে হতো!
এদিকে স্বামীর চোখে ইনজেকশন পুশ করা হবে শুনে রুনা এমন হাঁ করলেন, আমির দিব্যি দেখতে পেল অবহেলায় শাশুড়ি আম্মার মাড়ির দাঁতগুলোর কী করুণ অবস্থা। কিন্তু তার নিজেরই গলা শুকিয়ে কাঠ, শাশুড়িকে সান্ত্বনা দেবে কী!
ইউসুফ কেঠো হাসি ছেড়ে বউকে বললেন, ‘আহা-হা, ছেলেটার বড় দয়ার শরীর! ওকে এভাবে বিচলিত করে দিয়ো না!’
রুনা ঝাঁজিয়ে ওঠেন, ‘কী বলো তুমি! আস্ত একটা সুঁই ঢোকালে চোখ তোমার থাকবে!’
ইউসুফ নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছিলেন বটে, তবে ওই সুঁইয়ের কথা শুনে তারও কলিজায় ধরে গেল। ভাবলেন, ওই সুঁই খাওয়ার চেয়ে কানা থাকাই ভালো। বউ যখন মানা করছে, তখন হাসপাতাল থেকে ফসকাতে সমস্যা নেই।
কিন্তু ইউসুফ মাস্টার যেখানে ‘হ্যাঁ’ বলেন, রুনার সেখানে ‘না’। দু-একটা জায়গায় মাথা এক করা ছাড়া ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে এটাই চলে আসছে।
স্বামীর কথায় ক্যাঁ করে উঠলেন রুনা, ‘এই লোক বলে কী রে! ছেলেটা তো সব টাকা জমা দিয়ে এসেছে। এখন তার আবার পালানোর শখ!’
সেকালের জমিদারের পেয়াদারা যেমন করে দুর্ভাগা প্রজাকে ধরে নিয়ে যেত, দুজন নার্স এসে সেভাবে বগলদাবা করল ইউসুফ মাস্টারকে। তারপর অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার ডান চোখে পিচিক করে ঢুকিয়ে দিলেন অ্যাভাস্টিন।
ইউসুফ মাস্টার হাসপাতাল ত্যাগ করার সময় নিরেট দালানটার উদ্দেশে মনে মনে বললেন, ‘ও বাবা, তোকে লাল সেলাম।’
এরপর আর ছয় মাসে ওমুখো হননি তিনি। ইনজেকশন পড়ার পর ডান চোখে কয়েকটা দিন ঘোলাটে দুনিয়া ছাড়া কিছুই দেখতে পাননি। তারপর দৃষ্টি খুলেছে বটে, তবে ঝাপসা ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি। এখন বাঁ চোখই ভরসা। অবশ্য এটাতেও সমস্যা আছে। রুনা নামতা আওড়ানোর মতো রোজই একবার করে সদরে যেতে তাগিদ দেন। বিশেষ করে তিনি হাতড়ে কিছু খোঁজার সময়। লেজার করাটা আসলে জরুরি। কিন্তু ইউসুফ মাস্টার গা করেন না। রুনারও যেন গরজ নেই। ওই বলা পর্যন্তই।
ইউসুফ মাস্টারের পাতলা চুলভরা চাঁদিতে গাছ থেকে ছোট একটা কুটো পড়তেই ভাবনার সাগর থেকে উঠে এলেন। বৃষ্টি থেমে গেছে। ফাল্গুনের বৃষ্টিতে জোর না থাকারই কথা।
রাগে গরগর করে বৃষ্টিকে তিরস্কার করলেন তিনি। বললেন, ‘ফাজিলের ফাজিল! আমারে ভিজাইয়া দিতেই আসছস, বেটা!’
একটু একটু করে ভালোই ভিজেছেন তিনি। পাঞ্জাবিটা ভিজে বড়ই অস্বস্তিকর অবস্থা। যে ব্যাগটায় খাবার নেন, সেটা ভিজে ভারী বোঝার মতো হয়েছে। শরীর কাঁপিয়ে প্রচণ্ড জোরে গোটা তিনেক হাঁচি দিলেন তিনি। লক্ষণ ভালো না। রুনার বকুনি খেতে হবে। মুশকিল হলো, একবার ওই মুখ ছুটলে আর থামে না। যত হাঁচি, তত বকুনি।
‘আমাকে ফাজিল বলছেন, স্যার?’
আবার সেই অচেনা কণ্ঠ। আগের চেয়ে খানিকটা জোরালো। ইউসুফ মাস্টার সাহসী মানুষ। একবার গভীর রাতে টিনের বেড়া কেটে ঢোকা চোর পাকড়েছিলেন। যে সে চোর নয়, দাগী নুরা চোরা। পুলিশ অবশ্য বেশি দিন আটকে রাখতে পারেনি তাকে।
সে যা–ই হোক, এখন এই অচেনা স্বরে গা ছমছম করছে। ছোটবেলায় অবশ্য ভূতের ভয়টা ছিল। তা তো সেই কবেই দূর হয়েছে। তা ছাড়া এখনো দিনের আলো মুছে যায়নি। বরং বৃষ্টিধোয়া আকাশ থেকে মায়াবী একটা বেগুনি আলো ফুটেছে। এর মধ্যে অশরীরী কিছু আসবে কোত্থকে?
অনেকটা আনমনে গলা বাড়িয়ে ইতিউতি তাকালেন ইউসুফ মাস্টার। ঘাড়টা পেছন দিকে ফেরাতেই তার চোখ দুটো আটকে গেল অদ্ভুত একটা কায়ার মধ্যে। একটা বরফের টুকরা যেন ইউসুফ মাস্টারের ঘাড় থেকে মেরুদণ্ডের শেষ অবধি চেলচেলিয়ে নেমে গেল। চোখে ভালো না দেখলেও এটা পরিষ্কার যে এমন চিজ আর কখনো দেখেননি। ছোটখাটো কায়াটা অদ্ভুত, অপার্থিব, অবাস্তব। মনে হচ্ছে চেনা, তবু যেন চেনা নয়।
বছর বিশেক আগে এমন কায়া দেখলে ঝেড়ে দৌড় লাগাতেন ইউসুফ মাস্টার। এখন সে বয়স নেই। সে সামর্থ্যও নেই। দৌড় দিলে পাঁচ-ছয় কদম যেতে না–যেতে চিতপটাং হবেন। পা বা কোমরে বড় চোট পাওয়ার ভয় আছে। এ বয়সে শরীর বিগড়ে গেলে সামলানো কঠিন। সে কথা ভেবে মনে সাহস আনার চেষ্টা করলেন ইউসুফ মাস্টার। টের পাচ্ছেন জিবে জড়িয়ে আসছে কথা, তবু বললেন, ‘তুই কি কোনো ভূতের বাচ্চা নাকি?’
বিং করে একটা শব্দ হলো। কানে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পেলেন তিনি। একটা তরঙ্গ যেন তার মস্তিষ্কে ঢেউ খেলে গেল। কানে বাজল, ‘আমি এই পৃথিবীর কেউ নই, অন্য গ্রহের। আপনারা যাকে এলিয়েন বলেন।’
স্যাঁত করে টিভিতে দেখা সেই চেহারাটা মনে পড়ে গেল ইউসুফ মাস্টারের। আরে, এ মুখ তো ফরেনসিক শিল্পীর আঁকা এলিয়েনের ছবির সঙ্গে অনেকটাই মিলে গেছে! ইস, এখন যদি জাভেদকে এনে এখানে দাঁড় করানো যেত, তাহলে বুঝত এলিয়েন নিয়ে তার ধারণা কতটা অমূলক!
পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ থেকে ভাবনা উদ্ধারের চেষ্টা করছে। গবেষণা এর মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। আর এই প্রাণী অবলীলায় তার মস্তিষ্কের তরঙ্গের ওপর প্রভাব ফেলে মনের ভাব প্রকাশ করছে, যা কথা আকারে বাজছে কানে।
অদ্ভুত একটা উত্তেজনা অনুভব করলেন ইউসুফ মাস্টার। ছোটবেলায় বুনো পাখির ছানা ধরে এনে খাঁচায় আটকে পুষতেন তিনি। এই আজব চিড়িয়াকে তেমন কোনো খাঁচায় আটকে দুনিয়াজুড়ে একটা ঘোঁটা দিতে ইচ্ছা করছে খুব। কিন্তু কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। শেষে বেকুবের মতো প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, জাফনার জঙ্গলে কী একটা তেল নাকি ব্যবহার করেছ, যা পৃথিবীতে নেই?’
আবার সেই বিং-ং-ং...ঝিঁঝি পোকার ডাক...! কানে বাজল, ‘ওটা তেল নয়, স্যার। আমার শরীরের ঘাম। এতে রেডিয়েশন আছে। এর সরাসরি প্রভাব অনেকটা জ্বালানির মতো। বৃষ্টি থেমে গেছে। এখন যাই, স্যার। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আপনার ক্ষতি হবে।’
উল্কার মতো ছুটে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল বিচিত্র কায়াটা। কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে রইলেন তিনি। এটা যে দৃষ্টিভ্রম বা দিবাস্বপ্ন, তা বলবেন কী করে? ওই জিনিস যেখানটায় ছিল, সেখানে কিছুটা জায়গা পুড়ে গেছে। কুঁকড়ে নেতিয়ে পড়া বুনো ঝোপ সাক্ষী।
তেলপোড়া ঝাঁজালো একটা কটু গন্ধ আসছে সেখান থেকে। টগবগে উত্তেজনা বুকে চেপে বাড়ির দিকে ছুটলেন তিনি।
উঠানে পা দিয়ে একেবারে বউয়ের সামনে পড়ে গেলেন ইউসুফ মাস্টার। রুনা বারান্দায় বসে আছেন তারই ফেরার অপেক্ষায়। বৃষ্টিভেজা স্বামীকে দেখে গলা চড়ালেন তিনি, ‘দেইখা যা, জারা। যা বলছি, তা–ই! উনি ভিজা বিড়াল হইয়া আসছেন।’
ইউসুফ মাস্টারের টগবগে উত্তেজনায় যেন এক বাটি বরফগলা জল পড়ল। কিসের মধ্যে কী? কোথায় তিনি সদ্য বয়ে নিয়ে আসা গপ্পের ছালাটা উপুড় করে ঢালবেন, তা নয়। সব মাটি! মনে মনে বউকে তিরস্কার করতে লাগলেন তিনি। এই মহিলার মধ্যে আসলে রসকষ বলে কিছু নেই। সারা দিন শুধু ক্যাটক্যাট। মেয়েটাকে যে বলবেন, সে সুযোগও এখন মিলবে না।
জারা জানে, বাবাকে কীভাবে এখন বাঁচাতে হবে। মায়ের কথায় কপট সায় দিয়ে বলে, ‘না ভিজলে তোমাকে জ্বালাবে কে, মা? দেখবা, এখনই হ্যাঁচ্চো-হ্যাঁচ্চো শুরু হবে। তোমার কাণ্ডজ্ঞান আর হইল না, বাবা!’
মেয়ের কথা শেষ হতে না–হতে দুটো হাঁচি মেরে দিলেন ইউসুফ মাস্টার। জারা তড়িঘড়ি বাবার হাতে গামছা আর লুঙ্গি ধরিয়ে দিয়ে ভেজা ব্যাগটা নিয়ে নিল। ইউসুফ মাস্টার চশমা খুলে মেয়ের হাতে দিয়ে চট করে ঢুকে গেলেন গোসলখানায়। রুনা চেঁচালেন, ‘আগেই শুরু কইরো না। গরম পানি দিতাছি।’
‘আরে, লাগব না।’ ঠকাস করে দরজা আটকে দিলেন ইউসুফ মাস্টার।
গোসলখানায় পাকা দেয়াল, ওপরে টিন। মেয়ের আবদার রক্ষা করে একটা এনার্জি বালব লাগিয়েছেন। সুইচ অন করতেই সারা ঘর ফকফকে সাদা আলোয় ভরে গেল। ইউসুফ মাস্টার হাঁ হয়ে গেলেন বিস্ময়ে। ডান চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তিনি। বাঁ চোখেও সমস্যা নেই। এটা কী করে সম্ভব? এ যেন অলক্ষে কোনো চোখের ডাক্তার তার চোখ দুটো পরিষ্কার করে দিয়ে গেছেন।
তবে কি অচিন সেই আজব প্রাণী কোনো কারিকুরি খাটিয়ে গেছে? তার ঘামে রেডিয়েশন আছে বলেছিল। ঝোপঝাড়ে প্রমাণও রেখে গেছে। লেজারেও তো রেডিয়েশন থাকে। এমন হতে পারে, তার ঘামের মধ্যে এমন কোনো বিকিরণ আছে, যা তার চোখের সমস্যার দাওয়াই হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু লেজার তো চোখ পরিষ্কার করে না। ক্ষতিকর টিস্যু আর নালি পুড়িয়ে ফেলে, যাতে আর রক্তক্ষরণ না হয়। এতে বরং দৃষ্টিশক্তি কিঞ্চিৎ কমে যেতে পারে। বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে বিষয়টাকে যুক্তির ওপর দাঁড় করাতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি।
গোসলখানার চারপাশে ভালো করে নজর বোলালেন ইউসুফ মাস্টার। হ্যাঁ, সব একদম পরিষ্কার। দেয়ালে প্লাস্টিকের একটা সাবানদানি লাগানো। অনেক বয়স। একটা কোনা ক্ষয়ে গেছে ওটার। আগে এই অংশটা কালো দাগের মতো দেখাত। এখন পরিষ্কার দেখছেন যে কোনাটা নেই। ইউসুফ মাস্টার ভালো করেই টের পেলেন, কী বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটে গেছে তার মধ্যে! কোনোমতে কয়েক মগ পানি ঢেলে গা ধুয়ে নিলেন তিনি।
জারার মধ্যে জাদু আছে। মা আর বাবার মনমেজাজ ভালো বুঝতে পারে ও। মন বুঝে কায়দা করে দুজনকে বাগেও আনতে পারে। বাবা ফিরে আসতে আসতে মাকে জারা এমন কিছু মিষ্টি কথা বলেছে, কটুকাটব্য হারিয়ে গেছে তার মুখ থেকে।
ইউসুফ মাস্টার ঘরে ফিরে দেখেন, তার টেবিলে চায়ের কাপ ভাপ ছড়াচ্ছে। পাশে একটা পিরিচে সদ্য ভেজে আনা এলোকেশী পিঠা। একটা লাল, আরেকটা গোলাপি। আগে এই পিঠা তিনি চিনি দিয়ে খেতেন, ডায়াবেটিস বাগানোর পর থেকে চিনি বাদ।
পিঠায় কামড় দিয়ে ইউসুফ মাস্টার টের পেলেন, কে ভেজেছে। রুনা ভাজলে মুচমুচে ভাবটা একেবারে মাপমতো হয়। অভিজ্ঞতা। জারা ভাজলে হয় একটু কড়া হবে, নয় তো একটু বাদ থাকবে। পিঠা দুটো এখন জারা ভেজেছে। তবে কাজ করার সময় দুহাত ভরা মমতা থাকে বলে ওর পিঠা খেতে অনেক মজা। চা অবশ্য ভালোই করে জারা।
চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বুজলেন ইউসুফ। বড় মেয়ে সারাকে বিয়ে দেওয়ার সময় মনে হয়েছিল, অচেনা একটা ছেলে এসে তার কলজের খানিকটা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। তবে সে কষ্ট দূর হতে সময় লাগেনি। কিন্তু জারার বিয়ের কথা তিনি কল্পনাই করতে পারেন না। এ মেয়ে চলে গেলে তিনি বাঁচবেন কী করে?
চোখের কোণ ভিজে ওঠে তার। দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি চোখ বুজেই আপ্লুত মনে চা পান করেন। ‘বাবা, এই যে তোমার চশমা।’ মেয়ের ডাকে চোখ খোলেন ইউসুফ মাস্টার। ডান হাতে কালো ফ্রেমের চশমাটা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে জারা। হ্যাঁ, এখন সময় এসেছে আসল কথা বলার। ‘চশমা বোধ হয় আর লাগব না রে, মা।’ ‘কেন?’ জারা খুব অবাক। ‘চশমা ছাড়াই সব পরিষ্কার দেখতেছি।’ ‘এটা কী বলছ?’ ‘হ্যাঁ, এই যে তোর মায়াভরা মুখটা একদম পরিষ্কার!’ এমন সময় মিঁউ করে বাড়ির মেনি বিড়ালটা উঠে এল বারান্দায়। জারা তিন বেলা ভাত আর এঁটোকুটো খাইয়ে ওটার পেটটাকে বেলুন বানিয়ে ফেলেছে। বিড়ালটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ইউসুফ মাস্টার। বোঁ করে ঘুরে উঠল তার মাথা। এ কী দেখছেন তিনি! বিড়ালের পেটের ভেতর আঁকুপাঁকু করে নড়ছে তিনটা ছানা। এই আজকালের মধ্যে বিয়াবে মেনি। ‘ইয়া মাবুদ, রক্ষা করো!’ বাবার আর্তনাদ শুনে ভড়কে গেল জারা। কাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘কী হয়েছে, বাবা?’ বারান্দায় বসে কান পেতে বাপ-বেটির কথা শুনছিলেন রুনা, স্বামীর বিচলিত কণ্ঠ শুনে ছুটে এলেন তিনি। চোখ ছানাবড়া করে বললেন, ‘কী হইছে?’ ‘এই মেনি বিড়ালটার পেটে তিনটা বাচ্চা। সব পরিষ্কার দেখতেছি। নড়ছে তিনটাই!’ ‘ও মা, কী কয় গো!’ এই বলে আঁতকে উঠলেন রুনা। জারা হাঁ করা মুখে হাত চেপে পিছিয়ে গেল দুই কদম। ঝট করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন ইউসুফ মাস্টার। দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ। রুনার শাড়ি-পেটিকোট সব স্বচ্ছ পাতলা পর্দার মতো লাগছে। এ কী কাণ্ড! এই পর্দার ভেতর সবই দেখতে পাচ্ছেন। চোখ দুটো নামিয়ে নিলেন তিনি। মাথা নিচু করেই খানিক আগের কড়ইগাছতলার সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন ইউসুফ মাস্টার। শেষে বললেন, ‘কাল রাতে টিভিতে যে এলিয়েনের ছবি দেখছি, ওই জিনিস দেখতে ঠিক সেই রকম।’ রুনা চট করে তার মেয়ের কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললেন, ‘এখন তো বুঝলি, পাগলের গুষ্টি ক্যান কই? এদের বায়ুচড়ার দোষ আছে। বয়স হইলে এইটা দেখা দেয়।’ জারা মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘দিব্যি সুস্থ একটা মানুষকে পাগল বলো, মা? ২৪ বছর সংসার কইরাও মানুষটারে চিনতে পারলা না?’ ‘চিনতে চিনতে জীবন কয়লা! তোর বাপ যা বলতেছে, এইটা কি সুস্থ মানুষের লক্ষণ?’ ‘আউলা বাতাসও তো লাগতে পারে? তুমি না বলো ছোট মামার একবার লাগছিল। ওই যে নানাভাই একবার তারে ন্যাড়া কইরা পাবনা থিকা ঘুরাইয়া আনল!’ ‘বাজে বকবি না। ওইটা ছোট মিয়ার ঘাড়ে বিয়ার ভূত চাপছিল। তোর বাপের ঘাড়েও কি সেই ভূত চাপছে?’ নগদে ‘এক্স-রে চোখ’ আবিষ্কার করে এমনিতেই ইউসুফ মাস্টারের মাথা ঘুরছে, তার ওপর স্ত্রী-কন্যার বাগ্যুদ্ধের মধ্যে কিংকর্তব্য হারিয়ে ফেললেন তিনি। কন্যা হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তিনি সুবোধ বালকের মতো কোলবালিশ টেনে পা তুলে দিলেন।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)