নীল

আমার জন্ম এক মায়াবী শহরে।

এতবার সে বলেছে কথাটা, তার মায়াবী শহরকে এত দিন আমরা শুধু মায়ার শহর মনে করে নিয়েছি। যেকোনো অর্থেই মায়ার।

‘পাহাড় আছে তোদের শহরে?’

‘আছে। দূরে। নীল রঙের।’

‘নদী আছে?’

‘আছে। ছোট। নীল রঙের।’

‘আর কী কী আছে?’

‘যা যা আছে, সব নীল রঙের। শহরের মাঠ, ঘরদোর, মানুষজন...’

‘মানুষজন নীল রঙের!’

‘হ্যাঁ।’

‘তবে তুই এ রকম কেন? আমাদের মতো কেন? নীল রঙের নয় কেন?’

‘আমিও নীল রঙের। আমাদের শহরে গেলে দেখবি, আমিও নীল রঙের হয়ে গেছি।’

আমরা তার কথা বিশ্বাস করি, কারণ, কেন সে মিথ্যা কথা বলবে? অদরকারে? আমরা তার কথা বিশ্বাস করি, কারণ, সে–ও আমাদের মতো একজন। পৃথিবীটাকে রং করে রঙিন রাখতে চায়। যদিও সে যা যা আঁকে, সবই নানা শেডের নীল রং দিয়ে। তার আঁকা মানুষ নীল রঙের, পাখি নীল রঙের, গাছ নীল রঙের, জমিন নীল রঙের। কেন সে আঁকে এ রকম? আঁকে, কারণ, তার মায়াবী শহর, নীল রঙের শহর কখনো তার মাথা থেকে যায় না। সে বলে, তার ক্যানভাসে, কাগজে নীল রঙের সেই শহরের স্মৃতি আঁকে সে। ভালো কথা। তবে আমরা ভাবি, আমরা তার নীল রঙের শহরে যাব একবার। নিয়ে যাবে সে?

কেন নয়?

সে প্রস্তুত।

সম্ভবত গতকাল সন্ধ্যার ঘটনা। আমরা কজন ছিলাম শাহবাগ চত্বরে। বাক্‌ হচ্ছিল, বিতণ্ডা হচ্ছিল। অমুককে মাথায় তোলা হচ্ছিল, অমুককে খারিজ করে দেওয়া হচ্ছিল। এসব যেমন যেমন হয়ে থাকে আর কী। সে হঠাৎ সবই খারিজ করে দিল। কথা নাই, বার্তা নাই, বলল, ‘তোরা কি যাবি?’

একজন বলল, ‘কী? কোথায়?’

একজন বলল, ‘আমি নারিন্দায় যাব না।’

একজন বলল, ‘আমি পোস্তগোলায় যাব না।’

সে বলল, ‘নারিন্দা, পোস্তগোলা নয়, আমাদের শহরের কথা বলছি। তোরা যাবি আমাদের শহরে?’

‘যাব! যাব! যাব! যাব!’

সেই শহর কোথায়, আমরা কেউ জানি না। সে আমাদের কখনো বলেনি।

সে বলল, ‘বাসে যেতে হবে।’

‘যাব। কবে নিয়ে যাবি, বল আগে। এত দিন ধরে বলছিস।’

‘অদ্য রাত্র বারো ঘটিকায়, ভাইসব।’

‘কী!’

সে হাসল। বলল, ‘জিরো আওয়ার। বাস ছাড়বে ঠিক জিরো আওয়ারে।’

‘কোত্থেকে?’

‘মায়াকাটরা।’

‘পুরান ঢাকার মায়াকাটরা?’

‘আর কোনো মায়াকাটরা কি আছে?’

বার বারোটা। মায়াকাটরা। বাসের নাম ‘বাবা কদম পীর পরিবহন।’ পুরোনো বাস, তবে বোঝা যায়, মহা রঙিন জিনিস ছিল এককালে। চলমান রাস্ট আর্ট হয়ে গেছে এখন।

‘বাবা কদম পীর পরিবহন’ স্টার্ট নিল ঠিক জিরো আওয়ারে। শীতকাল বোঝা গেল বাস ঢাকা ছাড়াতেই। কনকনে ঠান্ডা এবং কুয়াশা। রাস্তাঘাট ডুব মেরে আছে কুয়াশায়। বাস চলছে। তবে চলছে বলে মনে হচ্ছে না। বাসে গান বাজছে—

দয়াল বাবা কেবলা কাবা

আয়নার কারিগর

আয়না বসাইয়া দে মোর

কলবের ভিতর...

ঘুম ধরে গেল আমাদের।

ঘুমন্ত আমাদের নিয়ে বাস কতক্ষণ চলল? কিংবা আমরা কতক্ষণ ঘুমালাম? ছয়, বারো, আঠারো ঘণ্টা? আমাদের ঘুম ভাঙল বিকেলে। মানে আমাদের মনে হলো বিকেল। লক্কড়ঝক্কড় বাস থেমে আছে কুয়াশায়। সে বলল, ‘নামো ভাইসব।’

নামব? কেন?

‘স্বাগত আমাদের মায়াবী শহরে।’ সে বলল।

ও। ও-ও-ও। আমরা বাস থেকে নামলাম। আমরা ছাড়া আর যাত্রী ছিল না, আমাদের রেখে চলে গেল বাস, ‘মা আকলিমা পরিবহন।’ রংবেরঙের রাস্ট আর্টের নিদর্শন না, এই বাস শুধুই নীল রঙের। আমরা কি এই বাসে উঠেছিলাম নাকি?

তাড়া দিল সে। দেরি করা যাবে না। গেট বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

গেট। কিসের?

সে বলল, ‘শহরের।’

তাদের শহরের আবার গেটও আছে নাকি? সেই গেট সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়?

সে হাসল। বলল, ‘তোমরা মনে করছ বলে সন্ধ্যা।’

ও, আমরা যদি সকাল মনে করতাম, তবে এখন সকাল থাকত তার মায়াবী শহরে? আমরা সন্ধ্যা কেন ভাবলাম? এই ভাবনার অবকাশ মিলল না। আমরা গেট দেখলাম তার মায়াবী শহরের। মস্ত সে গেট। আকাশে উঠে গেছে। কিসের বানানো? আমাদের একবার মনে হলো পলিমারের, একবার মনে হলো আরও বিশেষ কোনো ধাতুর। এ রকম একটা গেট কি পৃথিবীর আর কোনো শহরে আছে?

সে বলল, ‘নেই। পৃথিবীর আর কোনো শহরে।’

পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও আছে আর কী, এমন রহস্যময়ভাবে সে বলল। তাতে কী? আমরা তবে তার শহরে এখন। তার, তাদের মায়াবী শহর।

বিকেল কি সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে না? স্থির হয়ে আছে?

আমরা হাঁটছি।

কুয়াশা কি অল্প হালকা হচ্ছে নাকি?

আবছাভাবে আমরা প্রথম একটা নীল রঙের গাছ দেখলাম। শূন্যে ঝুলে আছে শিকড়বাকড়সুদ্ধ। ঝুলে আছে না, ভেসে চলে যাচ্ছে।

সে বলল, ‘পাহাড়ে যাচ্ছে।’

আমরা কিছু নীল ঘরদোর দেখলাম। ঘুমন্ত ঘরদোর। মানুষজন ঘুমাচ্ছে। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই রাস্তায়। নীল রঙের রাস্তায়। আমরা খুব বিস্মিত হলাম না। এই রাস্তা আমরা তার ছবিতে দেখেছি। কিন্তু তার এই শহরটা কোথায়? দেশের কোন অঞ্চলে পড়েছে—এমন একটা গেট আছে যে শহরে!

কিছু নীল রঙের পাখি উড়ে গেল। দূরে নীল রঙের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। কুয়াশাও নীল রঙের দেখি। সে?

নীল হয়ে গেছে। আমরা দেখলাম। সে এখন একজন নীল রঙের মানুষ। তার শরীর নীল রঙের, চোখের মণি নীল রঙের। আমাদের জানা দৃশ্য, তবে আগে দেখা দৃশ্য নয়। দেখে এখন আমরা কি ভয় পেয়ে গেলাম? কেন? আমাদের মনে হলো আমরা জমে যাচ্ছি ঠান্ডায়। শীতকালের নয়, ভয় এবং ত্রাসজনিত ঠান্ডা। পৃথিবীর কোন প্রান্তে এই শহর? তার শহর? এই শহর থেকে আমরা কি আর ফিরে যেতে পারব?

‘তোর শহর এই পৃথিবীর কোথায়?’

তার নীল রঙের চোখের মণি ঠান্ডা। হাসল সে। মৃত কিছু নক্ষত্রের মতো ঠান্ডা গলায় নিয়ে বলল, ‘তোমাদের পৃথিবীতে নয়, ভাইসব।’

সে যা বলল, তা কি নীল রঙের? বুক ঝিম নীল রঙের? ‘তোমাদের পৃথিবীতে নয়, ভাইসব’—আমাদের মনে হলো এই বাক্যটা নীল রঙের, শব্দগুলো নীল রঙের। এবং ঠান্ডা। এত ঠান্ডা, যে পার্থিব নয়!