অ্যান্টিসেল

২০৫০ সাল। ভোর রাত। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে নীরা। শরতের মেঘমুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে তার ভালো লাগে। ওই ধোঁয়াটে আকাশগঙ্গার ফাঁকে কোনো এক গ্রহে গেছে ফামিদ—তার জীবনসঙ্গী।

নভোচারী ফামিদের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে আজ পাঁচ বছর। বিয়ের পরের মাস ওদের কেটেছিল অপার ভালোবাসায়। এরপরই নববধুকে রেখে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে ফামিদ। বলেছিল,  

-         পাঁচটা বছর ধৈর্য ধরো, তোমার নতুন ফামিদ হয়ে ফিরে আসব।  

-         তুমি তো নতুনই, ফামিদ।

-         তাই তো! হেসে বলেছিল ফামিদ, আচ্ছা, তাহলে নতুনের চেয়ে নতুন হয়ে ফিরে আসব!

-         আমার কথা ভেবে তোমার খারাপ লাগবে না? অভিমানী কণ্ঠে জানতে চেয়েছিল নীরা।

-         লাগবে না মানে? খুব খারাপ লাগবে! কিন্তু, ওকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে রোমান্টিক কণ্ঠে ফামিদ বলেছিল, আমাদের প্রেমের কথা আমি তারায় তারায় রটিয়ে দিতে যাচ্ছি!

ওর বুকে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে বলেছিল নীরা, দুষ্টু! পরমুহুর্তে সিরিয়াস হয়ে ফামিদ বলেছিল, কী করব বল, নীরা? সুদিন কিংবা দুর্দিন যে কোনো সময় পেশার প্রয়োজনে নিজেকে সঁপে দেওয়াই যে পেশাজীবির ধর্ম। আর এই হতচ্ছাড়া গ্রহটার খোঁজ কেন যে এমন সময় পেলাম! তাছাড়া—

নীরা ওর মুখে হাত রেখে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, কোনো তাছাড়া নেই! যেতে যখন হবেই এখনই ওঠ, অনেক কিছু রেডি করতে হবে।

ফামিদের বলতে চাওয়া কথাগুলো বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই শুনে আসছে নীরা; ফোনে, পার্কের বেঞ্চে। যেদিন ফামিদের টেলিস্কোপে গ্রহটি ধরা পড়ে তার পরদিনই সরাসরি ওর বাসায় গিয়েছিল ভীতু ছেলেটা। ওর বাবার সামনে সাহস করে বলেছিল, আঙ্কেল, আমি নীরাকে বিয়ে করতে চাই।

গর্ব করার মতো ব্যাপারই ছিল বটে ফামিদের আবিষ্কারটা—ভাবে নীরা। বাংলাদেশ অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রিশন (BASA)-এর সবচেয়ে তরুণ এই জ্যোতিঃপদার্থবিদ কাম নভোচারী কিনা আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন একটি গ্রহ, যার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে অ্যান্টিম্যাটার ও অ্যান্টি-এনার্জির আলামত। শতাব্দীর তো বটেই, সর্বকালের অন্যতম সেরা আবিষ্কার কিনা, তা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানীমহলে।

গ্রহটি আবিষ্কারের পর পরই সে ছুটে গিয়েছিল বাসা প্রধান ড. শরাফত করিমের চেম্বারে।

-         কী ব্যাপার, ফামিদ! বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে তোমাকে?

-         স্যার, স্যার... বড় বড় শ্বাস ফেলে বলেছিল ফামিদ, আমি স্যার একটা অ্যান্টিপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছি!

-         মানে! চোখ থেকে চশমা খুলে বলেছিলেন বাসা প্রধান।

-         মানে স্যার, স্পেকট্রাম অ্যানালাইসিস বলছে গ্রহটি থেকে অ্যান্টি-ফোটন বের হয়। তার মানে হয়তো সেখানে অ্যান্টিম্যাটার অথবা অ্যান্টি-এনার্জি আছে, অথবা দুটোই!

-         হুম, চশামাটা চোখে পরতে পরতে জিজ্ঞেস করেছিলেন প্রবীণ বিজ্ঞানী, গ্রহটি কোথায়?

-         আমাদের গ্যালাক্সির পাশেই স্যার, অ্যান্ড্রোমিডায়।

-         আরে বলো কী? টেবিলে চাপড় মেরে বলেছিলেন ড. শরাফত, একেবারে পড়শী দেখি! এতদিন লুকিয়ে ছিল কীভাবে? তা একবার মোলাকাত করে আসতে হয়! একদল রোবটের সঙ্গে অন্তত একজন জলজ্যান্ত মানুষ পাঠাতে পারলে এসেসমেন্ট ভালো হয়। কারণ মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয়ের বাইরেও যে একটা ইন্দ্রিয় আছে, তা অজানা পরিবেশকে রিড করতে সাহায্য করে। কিন্তু নতুন পরিবেশে মানুষ পাঠানোও তো রিস্ক!

-         রিস্ক নেব স্যার, আমি নিজেই যাব!

-         কিন্তু...অজানা একটা গ্রহ, যদি কোনো বিপদ হয়?

-         নভোচারীদের কি বিপদের ভয় করলে চলে? এই চাকরিতে ঢোকার সময়ই জীবনটা ওয়াকফ করে দিয়েছি!

-         আচ্ছা, মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তা কী নামে ডাকা যায় গ্রহটাকে, ভেবেছ কিছু?

-         হিসাব অনুযায়ী তো তার নাম FR-9837A হয়, স্যার। কিন্তু আমি ওর ডাক নাম রেখেছি নীরা।

-         বাহ! সুন্দর নাম তো! তা এই নামের কি কোনো বিশেষত্ব আছে?

-         নীরা আমার বাগদত্তা, স্যার!

-         ও আচ্ছা! জোরে হেসে উঠে বলেছিলেন ড. শরাফত করিম, তাহলে যদি যেতেই হয়, তাকে বিয়ে করে রেখেই যেতে পার। লম্বা বিরহের আগে অন্তত কিছুদিন একত্রে কাটাতে পারবে!

-         জ্বি স্যার! লাজুক হেসে বলেছিল ফামিদ।

-         আরে! বিরহ চাওনা বলেই গ্রহটির নাম নীরা রাখনি তো? যেন নীরার কাছ থেকে নীরার কাছেই যাওয়া হয়? হাহাহা!

তাঁর সঙ্গে হেসে উঠেছিল ফামিদও।

কথাগুলো মনে পড়তেই ভালোলাগার এক অদ্ভূত শিহরণ জাগে নীরার বুকে—আস্ত একটি গ্রহ আছে তার নামে। চোখের পানি মোছে সে। কল্পনার চোখে দেখতে পায়, ফামিদ পাগলটা সেই বিজন গ্রহে চিৎকার করে রটিয়ে দিচ্ছে—আমি তোমাকে ভালোবাসি, নীরা! 

আর মাত্র দুই দিন...। এরপরেই ফিরে আসবে পাগলটা—ভাবতেই খুশিতে উথলে উঠছে মন।

দুই

মিসেস নীরা, আপনি কি একটু ফামিদের রুমে যেতে পারবেন? সে কথা বলছে না কেন বুঝতে পারছি না। তাকে কথা বলাতে হবে! হন্তদন্ত হয়ে গেস্টরুমে এসে বললেন ড. আবুল কায়েস, বাসা-র চিফ মেডিকেল অফিসার।

ফামিদকে রিসিভ করতে বাসা-র উৎক্ষেপন কেন্দ্রে এসেছে নীরা। কিন্তু আপাতত তাকে গেস্টরুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু এনকোয়ারি ও রুটিন চেকআপ শেষে ফামিদকে ছাড়া হবে। তাই এখনো তাকে একনজর দেখা সম্ভব হয়নি নীরার।

ফামিদ! ব্যগ্র কণ্ঠ নীরার।

কিন্তু কোনো জবাব দিল না ফামিদ।

ফামিদ! ফামিদ! কী হয়েছে তোমার? কথা বলো প্লিজ! কপট রাগ দেখিয়ে নীরা বললো, নাকি নীরা গ্রহকে পেয়ে আসল নীরাকে ভুলে গেছ? গ্রহটির উপর একটু হিংসা লাগলো যেন নীরার।

ফামিদ কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল। কিন্তু কথা বের হলো না মুখ দিয়ে। দেখে মনে হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। ফামিদের জিভটা দেখে চিৎকার করে উঠল নীরা—অস্বাভাবিক ওটা!

ফামিদ! এ কী অবস্থা তোমার? কান্নায় ভেঙে পড়ে ওকে জাপটে ধরল নীরা।

গুড়ম!

সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল দুটি দেহ।

তিন

রিপোর্টটা দেখে চমকে উঠলেন বিজ্ঞানী শরাফত করিম।

-         এসব আপনি কী লিখেছেন, ড. জামিল?

-         জ্বী স্যার, আমার ল্যাবে ফামিদ-নীরার লাশের স্পেসিমেন এনালাইসিস করে যা পেয়েছি তার আলোকেই লিখেছি। বললেন বাসা-র বায়ো অ্যানালিস্ট ড. হাসনাত জামিল। আমার ধারণা দুটি। প্রথমটি হলো: নীরা গ্রহে গিয়ে ফামিদ অ্যান্টিম্যাটার ও অ্যান্টি-এনার্জির সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু সেখানকার ম্যাটার, এনার্জি, গ্রাভিটি—সবই যেহেতু অ্যান্টি, তাদের সংস্পর্শে এসে ফামিদের শরীরের সেলেও পরিবর্তন শুরু হয়। ফলে তার সব সেল অ্যান্টিসেলে পরিণত হয়!

-         কিন্তু, অ্যান্টিসেল বলতে কী বোঝাচ্ছেন আপনি?

-         ওয়েল! আগে বলুন তো স্যার, পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে অ্যান্টিম্যাটার ও অ্যান্টি-এনার্জি বলতে আপনি কী বোঝেন? পালটা প্রশ্ন করলেন হাসনাত জামিল।

-         মানে? ম্যাটারের পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রন। এই প্রোটন ও নিউট্রনের চারপাশে ঘোরে ইলেকট্রন। কিন্তু যদি এর উল্টো হয় অর্থাৎ, কেন্দ্রে থাকে অ্যান্টি-প্রোটন ও অ্যান্টি-নিউট্রন আর চারপাশে ঘোরে অ্যান্টিইলেকট্রন বা পজিট্রন, তাহলে তাকে বলি অ্যন্টিম্যাটার। আর অ্যান্টিএনার্জি এনার্জির ঠিক বিপরীত। যেমন: আলো একটা এনার্জি, যার পার্টিকেল হলো ফোটন। এর বিপরীত এনার্জি বা অ্যান্টিলাইট থেকে থাকলে তা হয়তো গঠিত হবে অ্যান্টিফোটন পার্টিকেল দিয়ে।

-         ইয়েস! তো একইভাবে কোষের ক্ষেত্রে যদি বলি, কোষের প্রায় কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, আর তাকে ঘিরে থাকে প্রোটোপ্লাজম।

বিজ্ঞানী শরাফত করিমের হাইস্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। জীববিজ্ঞানের স্যার ক্লাসে চক দিয়ে প্রাণীকোষ এঁকে বিভিন্ন অংশের নাম চিহ্নিত করে দেখাতেন।

-         হ্যাঁ! শরাফাত করিম বললেন।

-         কিন্তু ফামিদের বডির ছিন্নভিন্ন অংশগুলো মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে আমি তাজ্জব বনে গেছি!  দেখি তাঁর কোষটা ঠিক উলটো—বড়সড় একটা নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রে ছোট্ট করে প্রোটোপ্লাজম। তার ভেতরেই মাইটোকন্ড্রিয়া শক্তি উৎপাদন করে যাচ্ছে, রাইবোজোমের প্রোটিন সংশ্লেষ কিংবা গলজি বডির কার্বোহাইড্রেট সংশ্লেষণ সবই হচ্ছে! বিস্ফোরণের প্রায় পরপরই স্পেসিমেন সংগ্রহ করার ফলে দেহকোষগুলো তখনও জীবন্ত ছিল। সেলের সম্পূর্ণ বিপরীত গঠন বলে, এটাকে অ্যান্টিসেল বলতে পারি আমরা।

-         কিন্তু এর সঙ্গে বিস্ফোরণের সম্পর্ক কোথায়?

-         ম্যাটারের সঙ্গে অ্যান্টিম্যাটারের মিললে যেমন প্রচণ্ড শক্তি উৎপন্ন হয়। তেমনি—

-         বুঝেছি! তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ড. শরাফত, তার মানে সে হয়ত তার স্ত্রীকে স্পর্শ করেছে। নীরার সেলের মাইটোকন্ড্রিয়া উৎপন্ন করছে এনার্জি, আর ফামিদের সেলের মাইটোকন্ড্রিয়া উৎপন্ন করছে অ্যান্টি-এনার্জি! যেই না সেল আর অ্যান্টিসেল পরস্পরের সংস্পর্শে এসেছে ওমনি বিস্ফোরণ ঘটেছে!

-         এক্সাক্টলি স্যার, আমার রিপোর্টে সেই কথাই লিখেছি।

-         কিন্তু... কিন্তু কথা হলো, ফামিদের সেলে এমন পরিবর্তন ঘটল কেন?

-         এখানেই তো আমার দ্বিতীয় সন্দেহটা স্যার। যেটা আমি রিপোর্টে উল্লেখ করিনি সেটা হলো—হতে পারে ওটা আসলে ফামিদ নয়!

ঘরে যেন বোমা ফাটালেন ড. হাসনাত জামিল।

-         কী বলছেন জামিল সাহেব!

-         জ্বী স্যার, কারণ এই জিভটার হিসাব মেলাতে পারছি না!

-         বুক পকেট থেকে ফয়েল পেপারে মোড়া একটি জিভ বের করে দেখালেন ড. জামিল—টকটকে লাল, তার অগ্রভাগটা সাপের জিভের মতো চেরা।