‘খবরের কাগজে পড়লাম, স্ট্যানফোর্ডের নতুন টাইম মেশিনটা দুই দিন ভবিষ্যতে পাঠানো হয়েছিল।’
আমি বিয়ারের গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে বললাম, ‘একটা সাদা ইঁদুর নাকি ছিল ভেতরে। ভবিষ্যৎ থেকে ফেরত আনার পরও ওটার নাকি একটুও ক্ষতি হয়নি।’
জ্যাক ট্রেন্ট গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, ‘এসব না করে বরং টাইম মেশিনটা ব্যবহার করে কয়েক মিলিয়ন বছর পেছনে ফিরে যাওয়া দরকার ছিল। দেখা দরকার ছিল, ডাইনোসরদের সঙ্গে আসলে কী ঘটেছিল।’
পাশের টেবিলে বসে আছে হর্নবি। কয়েক মিনিট ধরেই ওকে দেখছিলাম। ঠিক তখনই সে–ও আমার দিকে তাকাল। একা বসে আছে সে, সামনে একটা বোতল, প্রায় খালি। ভাবলাম, হয়তো এ কারণেই সে আমাদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
হর্নবি হেসে জ্যাকের দিকে তাকাল, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, বন্ধু। আমি নিজেই সেটা ১০ বছর আগে করে এসেছি। সত্যটা জানতে পেরেছি। এখনকার বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী বলে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই নাকি ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়েছে। আসলে তা ঠিক নয়।’ আমাদের উদ্দেশে নীরবে গ্লাস তুলল সে, শেষ করে ফেলল এক চুমুকে।
আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। আমরা কেউ ওকে তেমন একটা চিনি না। বেশ কবার সামনাসামনি দেখা হয়েছে, এ–ই যা। জ্যাক ওকে দেখে হালকা মাথা নাড়াল। আমিও হাসলাম। ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজেদের জন্য আরও দুই গ্লাস বিয়ার অর্ডার দিলাম।
হর্নবির হঠাৎ রেগে ওঠা দেখে আমার মনে হলো সে প্রায় মাতাল হয়ে পড়েছে। ‘বললামই তো, আমি তাদের দেখেছি!’ প্রতিবাদে ফেটে পড়ল লোকটা। ‘ওগুলো ডাইনোসরই ছিল। তবে আকারে খুব একটা বড় না।
জ্যাক গম্ভীরভাবে হর্নবির দিকে তাকাল। ‘তুমি টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছিলে?’
‘হ্যাঁ, অনেক আগে।’ হর্নবি একটু হেসে আবার তার গ্লাস ভরে নিতে লাগল। ‘স্ট্যানফোর্ডের ওই বোকাগুলোর বানানো যন্ত্রের চেয়ে ভালো ছিল আমারটা। তবে আমি সেটা অনেক আগেই ধ্বংস করে দিয়েছি। ও নিয়ে আর তেমন আগ্রহ ছিল না।’
‘তুমি বললে জলবায়ু পরিবর্তন নয়, অন্য কিছু ডাইনোসরদের শেষ করেছিল?’
‘তা নয়তো কী?’ আবার জ্যাকের দিকে ফিরল সে। ‘মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে ওরা ওই জলবায়ুতেই বেঁচে ছিল, কই তখন তো তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো যে একবারের জন্য খরা এসে তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিল? অথচ অন্য অনেক প্রাণী কিন্তু তারপরও বেঁচে ছিল আরামসে।’ তাচ্ছিল্যভরে আঙুল চটকানোর চেষ্টা করল সে, কিন্তু সফল হলো না। শেষে শুধু বিড়বিড় করে বলল, ‘জলবায়ু পরিবর্তনকে দোষ দেওয়া মোটেও যুক্তিসংগত নয়!’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে ওরা নিশ্চিহ্ন হলো কীভাবে?’
হর্নবি চুপ করে রইল, যেন খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত। তারপর বোতলটা দোলাতে দোলাতে বলল, ‘যে জিনিসটা বাইসনদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, সেই একই জিনিস—বুদ্ধিমান প্রাণী!’
‘মঙ্গল গ্রহের মানুষের কথা বলছ নিশ্চয়?’ আমি ব্যঙ্গ করে বললাম।
হর্নবির হঠাৎ রেগে ওঠা দেখে আমার মনে হলো সে প্রায় মাতাল হয়ে পড়েছে। ‘বললামই তো, আমি তাদের দেখেছি!’ প্রতিবাদে ফেটে পড়ল লোকটা। ‘ওগুলো ডাইনোসরই ছিল। তবে আকারে খুব একটা বড় না। মাত্র চার ফুট লম্বা। দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটত। অস্বাভাবিক তো নয়। খোদ ডাইনোসররাই তো মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে অনেকখানি অভিযোজিত হয়েছে। হামাগুড়ি দিয়েছে, গাছে চড়েছে, আকাশে উড়েছে, সাঁতারও কেটেছে। বৈচিত্র্য আর আকার-আকৃতিতে একেক প্রজাতি ছিল একেক রকম। তাহলে এর কোনোটার কেন মস্তিষ্ক বিকশিত হবে না? একটা বুদ্ধিমান প্রজাতি কি বাকি প্রজাতিগুলোকে মেরে ফেলতে পারে না?’
তারপর সে উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘এখন আমাকে আবার জিজ্ঞেস করে বোসো না যে কেন তাদের সভ্যতার কোনো নিদর্শন খুঁজে পাই না। আমার মনে হয় না তারা কোনো সভ্যতা গড়তে পেরেছিল।
‘হ্যাঁ, হতে পারে।’ আমি বললাম, কিন্তু এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত যতগুলো ফসিলাইজড ডাইনোসরের মাথার খুলি পাওয়া গেছে, তাতে সামান্য বিড়ালের মাথায় থাকা গ্রে ম্যাটার রাখারও জায়গা নেই।’ জ্যাক আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতা দিল—সে চাইছে হর্নবি তার গল্প চালিয়ে যাক, কিন্তু আমি আবার এসব আজগুবি কথাবার্তা একদম পছন্দ করি না।
হর্নবি আমার দিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকাল। ‘বুদ্ধিমান প্রাণীদের ফসিল খুব একটা পাওয়া যায় না। তারা কিন্তু অন্য বোকা ডাইনোসরদের মতো কাদায় আটকে মরত না, বুঝলে? তা ছাড়া এদের মস্তিষ্ক ক্ষুদ্র হলে কীই-বা এসে–যায়? তুমি তোমার মস্তিষ্কের কতটুকু ব্যবহার করো? পাঁচ ভাগও তো নয়। আর যতটুকু করো, বাকিটা তো অব্যবহৃত থেকে যায় বা কী হয় কে জানে! ওই ডাইনোসরদের মস্তিষ্ক বিড়ালের চেয়েও ছোট ছিল বটে, কিন্তু তারা সেটার পুরোটাই ব্যবহার করত।’
তারপর সে উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘এখন আমাকে আবার জিজ্ঞেস করে বোসো না যে কেন তাদের সভ্যতার কোনো নিদর্শন খুঁজে পাই না। আমার মনে হয় না তারা কোনো সভ্যতা গড়তে পেরেছিল। তাদের বুদ্ধিমত্তা কিন্তু আমাদের মতো ছিল না। একেবারে ভিন্ন রকমের ছিল। তাদের জীবন কেমন ছিল, তা তারা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। তবে এতটুকু বুঝেছি যে তাদের সবচেয়ে বড় বিনোদন ছিল বড় বড় শিকার করা।’
‘তাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কীভাবে হলো?’ জ্যাক জিজ্ঞাসা করল। ‘টেলিপ্যাথির মাধ্যমে?’
‘আমার তো তা-ই মনে হয়। বলেছি তো, ছোট হলেও তাদের মস্তিষ্ক ছিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। আমি শুধু তাদের দিকে তাকালাম, আর তারা আমার দিকে তাকাল। এতেই আমি সব বুঝে গেলাম। কিছু শুনিনি বা অনুভব করিনি। কিন্তু সবই জানতাম। যদিও আমি এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না। হয়তো কোনো দিন এই রহস্য সমাধান করার চেষ্টা করে দেখব।’ তার দৃষ্টি খালি গ্লাসটার ওপর স্থির। গভীর চিন্তায় ডুবে রইল কিছুক্ষণ। ‘আরেকটু সময় সেখানে থাকতে পারলে ভালো হতো। হয়তো আরও কিছু জানতে পারতাম।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল সে।
ওরা সব ফেলে ছোট ছোট ধাতব দণ্ড হাতে ওটার দিকে ছুটে গেল। বুঝলে তো এবার, ওগুলোই ছিল ওদের ব্যবহৃত অস্ত্র। তোমাদের প্রশ্নের উত্তরও তোমরা পেয়ে গেলে।
‘তাহলে থাকলে না কেন?’
আমার প্রশ্নের জবাবে সে বলল ‘ওখানে থাকা নিরাপদ ছিল না। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। ওদের কাছে কিন্তু আমি একটা অদ্ভুত জিনিস। ওরা আমার ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। আমার শরীর নিয়ে নয়, এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বরং আমার মস্তিষ্ক নিয়েই তাদের যত আগ্রহ।’ সে আমাদের দিকে বাঁকা হাসি ছুড়ে দিল। ‘বুঝলে, আমার মস্তিষ্ক তাদের তুলনায় অনেক বড়। এই মস্তিষ্ক দিয়ে আমি কী কী করতে পারি, তা নিয়ে তারা ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল। আমাকে কেটেকুটে দেখতে চেয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে পালালাম।’
‘কীভাবে পালালে ওখান থেকে?’
‘যদি ঠিক তখনই ওরা একটা ট্রাইসেরাটপসের দেখা না পেত, তাহলে পালাতে পারতাম না। ওরা সব ফেলে ছোট ছোট ধাতব দণ্ড হাতে ওটার দিকে ছুটে গেল। বুঝলে তো এবার, ওগুলোই ছিল ওদের ব্যবহৃত অস্ত্র। তোমাদের প্রশ্নের উত্তরও তোমরা পেয়ে গেলে। ওই বুদ্ধিমান ছোট ডাইনোসরগুলো বড় বড় ডাইনোসরদের শিকার করত, ঠিক যেমন দক্ষ শিকারি হিংস্র সিংহ শিকার করে। পেট ভরার চেয়ে তাদের একটা টিরানোসরাস মারতেই বেশি আগ্রহ! হবে নাই-বা কেন? ওই বিশাল দানবগুলো নিশ্চয়ই তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে দুর্দান্ত ছিল। অন্য ডাইনোসররাও—প্টেরোডাকটাইল থেকে ইকথিওসরাস পর্যন্ত,’ ডাইনোসরগুলোর নামগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পারলেও আমরা ঠিকই বুঝতে পারছি ওর কথা, ‘তাদের কেউই টিকতে পারেনি ওই ক্ষুদ্র বুদ্ধিমান শিকারিদের বিরুদ্ধে, যারা নিছক আনন্দের জন্য শিকার করত। আর সবকিছু ঘটছিল খুব দ্রুত। আমরা কি মাত্র ৩০ বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন বাইসন নিশ্চিহ্ন করে
যদিও আমি এটার উত্তর জানতে আর কখনো সেই সময়ে ফিরে যাইনি, কিন্তু তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা আমি জানি। তাদের জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল বড় বড় শিকার করা।
ফেলিনি, বলো?’
আবার আঙুল চটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। তারপর তিক্ত স্বরে বলল, ‘আর আমরা কিনা জলবায়ুর পরিবর্তনের ওপর দায় দিচ্ছি? ধুর! কিন্তু কে এই সত্যিটা বিশ্বাস করবে?’
ওকে চুপ হয়ে যেতে দেখে জ্যাক প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, এখন তুমি আমাকে বলো, ওই ছোট ডাইনোসরগুলোই-বা কীভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? তাদের তো এখনো বেঁচে থাকার কথা ছিল!’
হর্নবি মাথা তুলে জ্যাকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। ‘যদিও আমি এটার উত্তর জানতে আর কখনো সেই সময়ে ফিরে যাইনি, কিন্তু তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা আমি জানি। তাদের জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল বড় বড় শিকার করা। আগেই বলেছি, আমি তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে এটা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই যখন ব্রন্টোসরাস আর ডিপ্লোডোকাস সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেল, তখন তারা সবচেয়ে বড় শিকারের দিকে ঝুঁকল—তাদের নিজেদের দিকেই! এবং তারা ঠিক আগের মতোই নৃশংসভাবে পরস্পরকে শেষ করার খেলায় মেতে উঠল।’
তারপর সে রুক্ষস্বরে বলল, ‘আমরা মানুষেরাও কি এখন ঠিক একই কাজ করছি না?’