প্যারালাল লাইফ

অলংকরণ: রাকিব

ডিরেক্টর হাসান পারভেজ উঠে এলেন। আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন, ক্যামেরা, লাইট, ডিরেক্টর সব ভুলে যান। অ্যাকশন বলার পর আপনি যেভাবে বেটার ফিল করেন, সেটাই দেবেন। কোনো টেনশন নেবেন না। অভিনয়ের কথাও ভুলে যাবেন। আপনি বিশাল এক কোম্পানির এমডি। আপনার মতো কথা বলে যাবেন। ডায়ালগ নিয়েও ভাববেন না। যা করার আমি করব।

হাসান পারভেজ বিজ্ঞাপনচিত্র বানাচ্ছেন। আমি তাতে অভিনয় করছি। তিনি তার চেয়ারে বসে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বললেন, রোল ক্যামেরা। ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান অ্যাকশন।

আমি অভিনয়ের কথা ভুলে গেলাম। ক্যামেরা, লাইট উধাও হয়ে গেছে সামনে থেকে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, কাস্টিং ডিরেক্টর, কস্টিউম ডিজাইনার, প্রোডাকশনের কাউকে আশপাশে দেখছি না। টেবিল ঘিরে কোম্পানির ডিরেক্টররা বসে আছেন। তারা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উঠে দাঁড়ালাম। উষ্ণ গলায় বললাম, এ কোম্পানি আপনাদের। আপনারা কোম্পানির প্রাণ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে কোম্পানি আজ এখানে এসেছে। আশা করি, আমাদের ওয়াশিংটন প্রেজেন্টেশন ভালো হবে। ফিরে এসে ব্রিফিং দেব। আপনারা ভালো থাকবেন।

মিটিং শেষ হয়েছে। কাচে ঘেরা মিটিংরুম। সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। ডিরেক্টরের অর্ডারের অপেক্ষা করছিলাম। ডিরেক্টর কাট কিংবা ওকে শট কিছু বলেননি। একজন এসে আমার চেয়ার খানিকটা পেছনে সরিয়ে হাতের ইশারা করল। মিটিংরুম থেকে বেরোনোর পথ ওদিকে।

বেরিয়ে এসেছি। আশপাশ পুরো অপরিচিত লাগছে। শুটিংয়ের অন্য কোনো ফ্লোর মনে হচ্ছে। বিশাল অফিস। এত বড় সেট সাজানো হয়েছে খেয়াল করিনি। আমার ব্যাগ কোথায় রেখেছি, বুঝতে পারছি না। কস্টিউম পরার সময় আমার শার্ট, প্যান্ট, মুঠোফোন, মানিব্যাগ, ঘড়ি—সব ব্যাগে রেখে দিয়েছি।

দুটো ঘটনা যখন ন্যানো সেকেন্ড মিলিয়ে অবিকলভাবে একটা আরেকটার ওপর প্রতিস্থাপিত হয়েছে, ঠিক তক্ষুনি আমি এক জীবন থেকে আরেক জীবনে চলে এসেছি।

যে সঙ্গে এসেছিল সে বলল, আপনার লাগেজ গাড়িতে। স্যার, আপনার পাসপোর্ট আর টিকিট। গাড়ি উত্তরের গেটে। কী ঘটছে কিছু বুঝতে পারছি না। আমার ভেতর খানিকটা হতভম্ব ও দিশাহারা ভাব চলে এসেছে। মিটিং শেষে ওয়াশিংটন যাওয়ার কথা, সেটা ছিল অভিনয়কে প্রাণবন্ত করার জন্য ডিরেক্টরের বানানো গল্প। এখন দেখছি ঘটনা সত্য হয়ে গেছে। দোহা হয়ে ওয়াশিংটন যাচ্ছি। ১২টা ৩৫ মিনিটে ফ্লাইট। এখন বাজে সোয়া ৯টা।

হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম, এটা নাইন অ্যান্ড হাফ স্টুডিও না। সম্পূর্ণ আলাদা এক জায়গায় চলে এসেছি। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড। এক জগৎ থেকে আরেক জগতে ঢুকে পড়েছি। ব্যাপারটা ঘটেছে অতি স্বাভাবিক ও সূক্ষ্মভাবে।

অভিনয়ের ওখানে আমি ছিলাম বিশাল এক কোম্পানির এমডি। কেতাদুরস্ত পোশাকে যে ওয়াশিংটন যাওয়ার আগে ডিরেক্টরদের সঙ্গে মিটিং করছিল। ঠিক সেই একই সময়ে একই পোশাকে আরেক আমি অন্য জগতে হুবহু একই কথা বলছিলাম। এখানে আমি বিশাল এক কোম্পানির এমডি। মিটিং শেষে ওয়াশিংটন যাচ্ছি প্রেজেন্টেশনের জন্য। সেটা ছিল আমার এক জগৎ থেকে আরেক জগতে প্রবেশের চাবি বা লুকানো দরজা, যাকে বলে ট্র্যাপডোর।

দুটো ঘটনা যখন ন্যানো সেকেন্ড মিলিয়ে অবিকলভাবে একটা আরেকটার ওপর প্রতিস্থাপিত হয়েছে, ঠিক তক্ষুনি আমি এক জীবন থেকে আরেক জীবনে চলে এসেছি। আয়নায় পাখি নিজেকে দেখে গ্লাসে ঠোকরাতে থাকে। দুই জগতের হুবহু দুজন এক হয়ে মিলে যায়, সেখানে থাকে প্রতিফলন আর এখানে দুজন আমিই বাস্তব।

এ ব্যাপারে আমার আগ্রহ থেকে কিছুটা জানা আছে। ধরা যাক, স্বচ্ছ কাচের টেবিলের ওপর একটা লাটিম বনবন করে ঘুরছে। টেবিলের ঠিক উল্টো পাশেও আরেকটা লাটিম একইভাবে বনবন করে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে দুটো লাটিমের আল যখন একই বিন্দুতে মিলিত হবে, তখন লাটিমের দুই আলের মাথা হবে এক জগৎ থেকে আরেক জগতে প্রবেশের সংযোগপথ। দুই পাশে দুটো আলাদা জগৎ ঘুরছে। যেখানে সাইক্লোনের মতো ফানেল আকৃতির ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। সেই ব্রিজ যখন একটি অন্যটির সঙ্গে মিলে যাবে, তখন সেটা হবে এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যাওয়ার সেতু। চেহারা অনেকটা লম্বা গলার দুটো ফুলদানির গলা মসৃণভাবে কেটে একটা ফুলদানির গলার ওপর উল্টোভাবে আরেকটা ফুলদানি বসানোর মতো।

দুই জগতে বাস করা একই মানুষ দুজন যদি ট্র্যাপডোর খুঁজে পায়, আর তাদের একজন তখন অন্য জগতে যাওয়ার সংযোগপথে ঢুকে পড়ে, তাহলে অতি সহজে সে এক জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যাবে।

অসুবিধা হচ্ছে, এটা অনেকটা ওয়ান ওয়ে জার্নির মতো। অর্থাৎ এক জগৎ থেকে আরেক জগতে গেলেও সেখান থেকে ফেরার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। দুই জগতের সংযোগপথ বা দুই বিশ্বের ফানেলের মুখ কতক্ষণ একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে থাকবে, তা অনিশ্চিত। আবার সংযোগপথের যে তীব্র ঘূর্ণন গতি, তাতে মানুষের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

আমি কীভাবে যেন বেঁচে আছি এবং সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। ট্র্যাপডোর দিয়ে আরেক জগতে চলে এসেছি। আসার সময় আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, অন্য জগৎ হলেও দেশেই আছি। পরিচিত রাস্তা।

গাড়ি আমাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে যাচ্ছে। গাড়িতে আমি একা। গাড়ি ড্রাইভ করছে সুন্দর দেখতে একজন ছেলে। তার বয়স ৩০ বা ৩৫ বছর হবে। নাম জানি না। তাকে এ মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না মনে হলো। যা করার এয়ারপোর্টে গিয়ে করব। পাসপোর্ট খুলে এ জগতে দেখলাম আমার নাম নাবিল সেবাস্তিন। অদ্ভুত ব্যাপার, দুই জগতে আমার একই নাম।

ড্রাইভার এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমার লাগেজ নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কী করব! ওয়াশিংটন যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সেখানে কোনো বিষয়ে প্রেজেন্টেশন কিছু জানি না। এয়ারপোর্টের বাইরে লাগেজ রেখে আশপাশে তাকালাম। মানুষের ভিড়। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্যকে দেখার ফুরসত নেই। আমি উদাসভাবে হাঁটা শুরু করলাম। বাসায় ফিরব।

কাছে বাসভাড়া দেওয়ার মতো টাকা নেই। কোনো দোকানে গিয়ে রিকোয়েস্ট করে বাসায় কল করব। ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে উত্তরার দিকে আসতে বলতে হবে। ওদিকে কোথাও গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। এয়ারপোর্টে কারও কাছ থেকে মুঠোফোন চেয়ে ড্রাইভারকে কল করা যেত। এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে পারতাম। নিরাপদ বোধ হয়নি। এত বড় কোম্পানির এমডিকে নিশ্চয় অনেকে চেনে। তারা এসে অহেতুক আলাপ জমিয়ে দিত। বাসায় ফেরার আগপর্যন্ত নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছি।

বিপত্তি বাধল এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে হেঁটে কিছু দূর আসতেই। খানিক সামনে রাস্তার পাশে একটি প্রাইভেট কার থেমেছে। সেখান থেকে একজন মেয়ে নেমে এল। মুখে স্বল্প কারুকাজ করা পার্পেল কালারের মাস্ক। শুধু তার চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে। গভীর, মায়াময় ও সুন্দর। বয়স বোঝা যাচ্ছে পঁচিশ–ছাব্বিশ বছর।

মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে আমার কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি তাকে উপেক্ষা করে সামনে হাঁটতে থাকলাম। সে ছুটে এসে খপ করে আমার হাত আঁকড়ে ধরল। ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, অ্যাই নাবিল। আর ইউ ওকে?

এই মেয়ে এ জগতে নাবিলের পরিচিত। আমি তার নাম জানি না। এ জগতের নাবিলের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, তা–ও জানি না। আগের জীবনে আমি বিবাহিত। আমাদের সুখের সংসারে আড়াই বছরের কন্যা আছে। তার নাম পদ্ম। এ জগতের নাবিল বিয়ে করেছে কি না, সে তথ্য আমার কাছে নেই।

মেয়েটির দিকে তাকালাম। তার চোখে বিস্ময়। বললাম, ঠিক আছি।

হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাচ্ছ?

সামনে।

তোমার ওয়াশিংটন যাওয়ার কথা!

করোনার থার্ড ওয়েভে ইউএস সব ফ্লাইট ক্যানসেল করেছে।

তোমার লাগেজ?

ভাবতে চাইলাম এটা বাস্তব হতে পারে কি না! অন্য জগৎ মানে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে চলে আসা। মনে হলো, সত্য হতে পারে। আমার জন্মের আগে মায়ের একবার অ্যাবরশন হয়েছিল।

পাঠিয়ে দিয়েছি। ড্রাইভারকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাসায় ফিরব না। কাজের চাপে অস্থির হয়ে গেলাম। শুনছি এখানেও লকডাউন ঘোষণা করবে। কদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখব। আমার বিশ্রাম দরকার।

স্বাভাবিক হয়ে এসেছি। অনর্গল বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে যাচ্ছি। কোনোভাবে এই মেয়েকে এড়াতে পারলেই সরে পড়ব।

সে বলল, ওয়ান্ডারফুল। আমার বাসায় চলো।

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। কোথায় তার বাসা, সেখানে আর কে থাকে, কিচ্ছু জানি না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হচ্ছে, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী, সে বিষয়ে এখনো ধারণা স্পষ্ট হয়নি। তার নাম জানি না।

মেয়েটি আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে হিড়হিড় করে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল। গাড়ি ড্রাইভ করছে সে। আমি তার পাশে বসে আছি। যাচ্ছি তার বাসায়।

ভাবতে চাইলাম এটা বাস্তব হতে পারে কি না! অন্য জগৎ মানে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে চলে আসা। মনে হলো, সত্য হতে পারে। আমার জন্মের আগে মায়ের একবার অ্যাবরশন হয়েছিল। হয়তো মহাজগৎ থেকে আসা কসমিক রে ভ্রূণের ডিএনএর গভীরে আঘাত করেছিল। তাতে জেনেটিক মিউটেশন ঘটেছিল। সে জন্য মায়ের গর্ভপাত হয়। তাতে কোয়ান্টাম ঘটনা দুটো জগৎকে আলাদা করে ফেলে। এর একটাতে আমি নাবিল জন্মেছি, আরেক জগতে জন্মেছে আরেক নাবিল। সবকিছু হুবহু একই আছে।

ঘটনার সূত্র ধরতে পেরে মন ভালো লাগছে। এখন আমি ঘটনার সঙ্গে যেতে চাই। নতুন জগতের নতুন জীবনে আমাকে সুস্বাগত।

বাড়ির গেটে এসে গাড়ি থেমেছে। দোতলা সুরম্য বাড়ি। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বিশাল বিত্তশালী মানুষ তারা। গেটের একপাশে পিতলের নেমপ্লেটে নাম লেখা, আতিকুর রহমান।

অনুমান করলাম আতিকুর রহমান নামের মানুষটি মেয়েটির বাবা হবেন। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি রেখে আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। একজন ভদ্রলোক ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। পরনে স্যুট, চোখে চশমা। হাতে কাগজ, খোলা কলম। পাশে সাদা ধবধবে কুকুর শুয়ে আছে। ভদ্রলোক চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন। আমাকে দেখে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছেন মনে হলো।

বিস্মিত হয়ে বললেন, নাবিল, তোমার ইউএসএতে যাওয়ার কথা ছিল আজ!

আদুরে গলায় মেয়েটি বলল, বাবা, অস্থির ঘটনা ঘটেছে। তোমাকে বলব। তুমি স্টাডিতে না বসে ড্রয়িংরুমে কেন?

তোর জন্য ওয়েট করছি। লাঞ্চ সেরেই যেতে হবে। জরুরি মিটিং আছে। চল খেয়ে নিই। চলো নাবিল।

মেয়েটি দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল। বুঝলাম ইনি আতিকুর রহমান। মেয়েটির বাবা। মেয়েটির নাম জানা হয়নি।

আতিক সাহেব ঘরের ভেতর তাকিয়ে খানিকটা জোরে বললেন, তন্বী, নাবিলকে নিয়ে টেবিলে বস। আমি পেপারস গুছিয়ে আসছি।

কুকুর গলার ভেতর ঘাউউ-জাতীয় শব্দ করল। আশঙ্কা করেছিলাম সে আমাকে দেখে হাউকাউ করবে। চিত্কার চেঁচামেচি করবে অনেক বেশি। দুই জগতের দুজন নাবিলের গায়ের গন্ধ আলাদা হওয়ার কথা। কুকুর গন্ধের ব্যাপারে সংবেদনশীল। গন্ধ শুঁকে তার বুঝে ফেলা উচিত, আমি অন্য কেউ।

কুকুর উঠে এসে দুই পা আমার কোমরের কাছে তুলে দিল। আমি তার কানে আর মাথায় আদর করে দিলাম। সে দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে গেল।

একসঙ্গে দুটো বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে, মেয়েটির নাম তন্বী আর নাবিল এ বাড়িতে নিয়মিত আসে। কুকুর তাই আমাকে দেখে ডাকাডাকি করেনি। আদর নিতে এসেছিল। আমাকে শুঁকেছে কিন্তু কুকুর বিভ্রান্ত হয়নি।

ভেতর থেকে তন্বী বলল, আসি বাবা। বুয়া খালাকে টেবিল সাজাতে হেল্প করছি।

তার মানে বাড়ির ভেতর আরেকজন মানুষ আছেন, তিনি হচ্ছেন বুয়া খালা। তন্বীর মা কোথায়, সে বিষয়টা স্পষ্ট হলো না।

খাওয়ার আয়োজন বিশাল। এক বেলায় এক পরিবারের মানুষ এত কিছু খেতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। টেবিলে আমরা তিনজন ছাড়া আর কাউকে খেতে বসতে দেখলাম না। শাড়ি পরা একজন নারী টেবিলে খাবার গোছাচ্ছেন। তন্বী তাকে বুয়া খালা বলে ডেকেছে। তার মানে সে এ বাড়ির বুয়া।

আরেকজন লোক টেবিলের ওপাশে দাঁড়ানো। সে বাড়ির সাহায্যকারী নাকি আতিক সাহেবের বডিগার্ড, নিশ্চিত হতে পারলাম না। দেয়ালে ফটোফ্রেমে কিশোরী মুখের একজন নারীর ছবি। দেখলেই মনে শ্রদ্ধা আসে। মায়ের মতো দেখতে। চোখের পলক না ফেলে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

তন্বী বলল, তুমি সব সময় মায়ের ছবির দিকে অমনভাবে তাকিয়ে থাকো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় মা যেন তোমাকে কিছু বলছেন আর তুমি বাধ্য ছেলের মতো মন দিয়ে শুনছ। মা বেঁচে থাকলে যে কী খুশি হতেন!

বুঝলাম তন্বীর মা বেঁচে নেই। ছবির দিক থেকে চোখ নামিয়ে বললাম, মায়ের চোখ দুটো ভীষণ জীবন্ত। সত্যি মনে হয়, তিনি কথা বলছেন।

তোমার সঙ্গে ছোটবেলায় পরিচয় হলে ভালো হতো তাই না? এই ধরো আমার বয়স যখন চৌদ্দ বা পনেরো বছর। মা যখন মারা গেলেন, তখন তো আমার বয়স সতেরো।

বুয়া খালা এসে বললেন, আপা ভাত খান। খালুজান আসতেছে।

তন্বী মন খারাপ করা গলায় বলল, মা কেন মরে গেল, নাবিল! এত অল্প বয়সে মানুষের কেন হার্ট অ্যাটাক করবে!

ভাত তুলে তন্বীর প্লেটে দিলাম। হেসে উঠল তন্বী। তাকে দেখাল বিস্মিত। সে হাসিমুখে বলল, বাব্বা, তোমার দেখি বিরাট উন্নতি হইছে। ভাত তুলে দিতেছো প্লেটে!

আতিক সাহেব এসেছেন। পাশে দাঁড়ানো লোকটা ছুটে এসে টেবিলের পাশ থেকে চেয়ার টেনে দিল। আতিক সাহেব চেয়ারে বসলেন।

তন্বী বলল, বাবা, ঘটনা শুনে আমি তো টোটালি তবদা খেয়ে গেছি।

আতিক সাহেব বললেন, তোকে বলেছি এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করবি না।

ইংরেজি বললে বলো, বাঙালির সন্তান বাংলাতে কথা বলবি। বাংলায় কথা বললে বলো, এ ধরনের শব্দ বলবি না।

বল, ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছি।

তার চেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সহজ শব্দ, বাবা।

ঘটনা বল।

বাসায় ফিরতেছিলাম এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে। মনে হইল ফুটপাতে নাবিল হাঁটতেছে। মুখে মাস্ক বলে পাশ থেকে বুঝতে পারছিলাম না। সামনে গিয়ে গাড়ি থামায়ে উল্টো পথে হেঁটে এসে দেখি নাবিল! আমি তো পুরো টাস্কিড।

মানে কী?

আতিক সাহেবের খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি এখন অফিসে যাবেন। সুযোগ পেলে দুপুরে খাওয়ার পর আমার ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস। তন্বী ঘুমুতে দেবে কি না, জানি না।

তুমি আস্ক করো নাবিলকে। অমিক্রনের ভয়াবহ অ্যাটাকে ইউএসএ গভর্নমেন্ট সব ফ্লাইট ক্যানসেল করসে। এই খবর নাবিল চেপে গিয়ে হাঁটা শুরু করছে দুচোখ যেদিকে যায়, সেদিকে। কদিন বাসা, কাজ থেকে দূরে থাকবে। মনে হয় কোনো রিসোর্ট বা হোটেলে থাকবে বলে ভাবতেছিল। মনস্থির করতে পারতেছিল না কোথায় যাবে। তাকে জোর করে নিয়ে আসছি। এই কদিন সে এখানেই থাকবে। তুমি দয়া করে তার কথা কাউকে বলবে না। সে মুঠোফোন, নেট কিচ্ছু ইউজ করবে না। শুধু চিল করবে।

কী করবে?

ও, সরি, ঘুমুবে।

আতিক সাহেব প্লেটে ভাত নিয়েছেন সামান্য। বেশির ভাগ সালাদ আর সবজি। তিনি সালাদ চিবিয়ে গিলে নিলেন। ঘাড় কাত করে ডাকলেন, আলম।

পাশে যে লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল, সে এগিয়ে এল।

আতিক সাহেব বললেন, আমরা খেতে খেতে তুমি ওপরের দক্ষিণের ঘরটা রেডি করো। স্যার থাকবেন।

আলম নামের লোকটা চলে গেল।

টেবিলে কয়েক পদের তরকারি। সব আমার পরিচিত না। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। অবশ্য রাতের আগে আমাকে বাড়ি থেকে ফোন করবে না। কুসুম, মানে আমার স্ত্রী জানে শুটিং শেষ হতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। সে ফোন করবে সন্ধ্যার পর। শুটিং ইউনিটের গাড়িতে ফিরতে অনেক রাত হয়। আর্টিস্ট, ক্রুদের নামাতে নামাতে যায় গাড়ি। তাই শুটিং লোকেশনে আমি নিজের গাড়ি নিয়ে যাই। ড্রাইভার ছেলেটা খাওয়াদাওয়া করল কি না, তা–ও বুঝতে পারছি না। আমার কাছে ফোন নেই। তার খোঁজও নিতে পারছি না। কারও ফোন নম্বর মনে থাকে না। কুসুমের ফোন নম্বর মনে আছে। কোনো এক সময় কিছু বলে তন্বীর ফোন থেকে কুসুমকে কল করব। এ জগৎ থেকে ওই জগতে ফোন যাবে কি না, সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।

তন্বী আমার প্লেটে কিছু তুলে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী এটা?

তন্বী বলল, ছুরি শুঁটকি।

বললাম, আমি শুঁটকি খাই না।

অবাক হয়ে তন্বী বলল, যাহ্ ইয়ার্কি করতেস ক্যান? শুঁটকি তোমার ফেবারিট।

বুঝলাম এ জগতের নাবিল শুঁটকি খায়। আমি শুঁটকি খাই না। কিছু বললাম না। শুঁটকি দিয়ে ভাত মাখালাম। সেগুলো একপাশে রেখে দিয়ে কই মাছের তরকারি নিয়েছি। ফুলকপি, মটরশুঁটি আর টমেটো দিয়ে রান্না করা কই মাছের ঝোল। খেতে হয়েছে অসাধারণ। বুয়া খালার রান্না ভালো।

তন্বী বলল, তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত? বাসার কথা ভাবতেছ কিংবা অফিসের?

বললাম, না। খেতে দারুণ লাগছে সবকিছু। খাবারে বেহেশতি ভাব আছে।

মনে হচ্ছে বেহেশত থেকে ঘুরে এসেছ কয়েকবার।

হাসলাম। হেসে চুপচাপ খেতে থাকলাম। তন্বী বলল, শোনো এটা তোমার অফিস না। তোমাকে এ রকম গোমড়া মুখে চুপচাপ থাকা মানায় না। এত কথা বলো তুমি। আজ এ রকম সাইলেন্ট মেরে গেলা ক্যান? কী হইসে?

আতিক সাহেব তাকালেন তন্বীর দিকে। কথা ঠিক করে তন্বী বলল, এ রকম চুপ হয়ে আছ কেন? কী হয়েছে?

আতিক সাহেবের খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি এখন অফিসে যাবেন। সুযোগ পেলে দুপুরে খাওয়ার পর আমার ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস। তন্বী ঘুমুতে দেবে কি না, জানি না। গল্প করতে শুরু করলে ঘুমানো যাবে না। সে যথেষ্ট চঞ্চল।

আমাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেটা অতি মনোরম। সিনেমা-নাটকে দেখা ধনী ব্যক্তিদের ঘরের মতো। দুধের চেয়ে অধিক সাদা বিছানার চাদর। জানালার পর্দা ফিনফিনে সাদা। পাখির পালকের নরম বালিশ।

গা থেকে ব্লেজার আর টাই খুলে ক্লজেটের হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখলাম। তন্বী আসেনি। নিশ্চিন্ত মনে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেলাম। আমার ভেতর হয়তো টেনশন কাজ করছে। টেনশনে কখনো মানুষ অস্থির থাকে, কখনো শরীর ভেঙে আসে। প্রবল ঘুম পায়।

গ্রিন টি খেয়ে আরাম পাই না। তন্বী আরাম করে গ্রিন টি খাচ্ছে। সঙ্গে বাঁধাকপির পাকোড়া আর কুকিজ। আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। ছোট ছোট চুমুকে চা খেতে থাকলাম। বেহুঁশের মতো ঘুমিয়েছি। তন্বী আমাকে সন্ধ্যার পর ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে।

তন্বী বলল, বাসায় ফিরে যেতে চাইছ? এ রকম মনমরা হয়ে আছ ক্যান?

মোশারফকে কাজে বিশেষ মনোযোগী মনে হলো না। ঘনঘন চা খাচ্ছে। অযথাই ল্যাপটপ অন করে কাজের ভান করছে

মনে হচ্ছে তন্বীকে সব বলে দিই। সে যে নাবিলকে চেনে, আমি সেই নাবিল না। অন্য জগৎ থেকে এখানে চলে এসেছি। সেই জগতে আমি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। অডিট ফার্মে চাকরি করি। একসময় থিয়েটার করতাম। এখন সময় পাই না। থিয়েটারে একবার ঢুকলে সেখান থেকে বেরোনো যায় না। তাই থিয়েটার করার শখ মেটাই টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে অভিনয় করে। এক দিনের শুটিং। খুব বেশি যে করি, তা–ও না। সময় ম্যানেজ করতে পারি না বলে ইচ্ছা থাকলেও টেলিভিশন নাটক বা ফিল্মে অভিনয় করা হয় না।

মনে হচ্ছে ঘটনা বলে দিলে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। কিছু বললাম না। চা শেষ করে বললাম, চলো লনে হাঁটি।

রাতে খেতে বসে পদ্মর কথা মনে হলো। সে হয়তো বাবা-বাবা বলে কাঁদছে। তাতে আরও বেশি অধৈর্য হয়ে পড়েছে কুসুম। কী খাচ্ছি বুঝতে পারছি না। খেয়ে আরাম পাচ্ছি না। যন্ত্র বোধ হচ্ছে। শরীরে গরম অনুভব করছি। এখন যন্ত্র আসা ভালো না। করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত, অমিক্রন। এখন আবার করোনাভাইরাসের নতুন আরেক ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। তার নাম ডেলমিক্রন। ডেলটা আর অমিক্রনের প্রোটিন স্পাইকে গড়া এই ডেলমিক্রন। শুটিংয়ে এসে শুনলাম করোনার লেটেস্ট ধরন হচ্ছে নিওকভ। এতে প্রতি তিনজনে একজনের মৃত্যু হতে পারে।

তন্বী বলল, খেয়ে চলো ছাদে যাই। তোমাকে গান শোনাব। কত দিন গিটার বাজানো হয় না। তোমার অনারে আজ গিটার বাজাব।

মোশারফ নামের একজনের সঙ্গে দেখা হলো পরদিন দুপুরের পর। আতিক সাহেবের সঙ্গে সে এসেছে। রাফায়েল বলে একজন বেশ কিছু কাগজ রেখে চলে গেল। শুনলাম কোম্পানির হাফ ইয়ারলি ব্যালান্সশিটে ১৫০ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না।

ইচ্ছা করে নিচে যাইনি। মোশারফ আমাকে নাবিল বলে এখানে দেখুক, সেটা চাইছিলাম না। লিভিংরুমে বসে মোশারফ কাজ করল বিকেল পর্যন্ত। সে কোম্পানির ফাইন্যান্স ডিরেক্টর।

লিভিংরুমের দিকে পিঠ দিয়ে চেয়ারে বসে বই পড়ছিলাম। জানালার গ্লাসে মোশারফকে দেখা যাচ্ছে। আতিক সাহেব তাকে রেখে অফিসে চলে গেছেন। টাকা লোপাটের ঘটনা অফিসের আর কেউ এ মুহূর্তে জানুক, তিনি চাচ্ছেন না। তাই বাসায় বসে মোশারফকে দিয়ে গরমিলটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

মোশারফকে কাজে বিশেষ মনোযোগী মনে হলো না। ঘনঘন চা খাচ্ছে। অযথাই ল্যাপটপ অন করে কাজের ভান করছে।

আগামীকাল আসবে বলে কাজ শেষ করল। ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল।

রাত। ডিনারের পর কেন জানি তন্বী বসল না। তার ঘরে চলে গেল। আতিক সাহেব স্টাডিরুমে। তিনি ঘুমানোর আগে বই পড়েন। আমি লিভিংরুমে মোশারফের রেখে যাওয়া কাগজপত্র মেলে বসলাম।

প্রথমত, কাগজপত্র পড়ে বুঝলাম এরা এনার্জি প্রডিউস করে। ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটারের সংঘর্ষে এনার্জি তৈরি হয়। তাই দিয়ে ফুয়েল, ইলেকট্রিসিটি সব কাজ চলে। এ জগতের মানুষেরা প্রকৃতিতে রক্ষিত অ্যান্টিম্যাটার খুঁজে পেয়েছে। তারা সেই অ্যান্টিম্যাটার ইলেকট্রোম্যাগনেটিক কনটেইনারে সংরক্ষণ করে। আমার মনে হলো এ ব্যাপারে জানা জরুরি। যদি আগের জগতে ফিরে যেতে পারি, তাহলে অ্যান্টিম্যাটার কাজে লাগিয়ে এনার্জি বানানোর ব্যাপারটা দারুণভাবে কাজে লাগবে।

দ্বিতীয়ত, কাগজপত্রের কয়েক পাতা ওল্টাতেই ঘটনা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল। পেনসিল দিয়ে সেগুলো দাগ দিয়ে রাখলাম।

স্টাডিরুমে গেলাম। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে আতিক সাহেব তাকালেন। তার মুখ শুকনা। তিনি বললেন, এসো নাবিল। তোমার বুঝি ঘুম আসছে না? নাকি তোমারও আমার মতো ঘুমানোর আগে বই পড়ার অভ্যাস আছে।

বললাম, মোশারফ সাহেবের এমপ্লয়ি নম্বর কত?

আতিক সাহেব চমকালেন। তিনি আমার কাছ থেকে এমন প্রশ্ন আশা করেননি। হকচকানো দৃষ্টিতে বললেন, তুমি সেটা জানতে চাইছ কেন?

দেড় শ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সম্ভবত ধরতে পেরেছি।

কীভাবে?

আমি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ফাইন্যান্স ভালো বুঝি।

আমার জানা ছিল, তুমি সোশ্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স।

আন্তরিক গলায় বললাম, আপনি আমার বাবার মতো। সে আলোচনা পরে করব। মোশারফ সাহেবের এমপ্লয়ি নম্বর আর তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড আমার দরকার।

তিনি তাকিয়ে আছেন সরাসরি আমার চোখের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি তার চোখে। মনে হলো আমার সামনে দাঁড়ানো নাবিলের চোখ কিছুটা নীল রঙের।

আমার কথায় আতিক সাহেবের খটকা লেগেছে। তিনি হকচকিয়ে গেছেন। তবে মানুষ ডুবে যাওয়ার সময় ভাঙা হালকা কাঠের টুকরাও চেপে ধরে বাঁচার জন্য। আতিক সাহেব নিজের পামটপ থেকে তথ্য নিয়ে আমাকে মোশারফ সাহেবের এমপ্লয়ি নম্বর আর তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড জানিয়ে দিলেন।

ল্যাপটপ খুলে নিশ্চিত হয়ে গেলাম ঘটনা মোশারফ সাহেব ঘটিয়েছেন। ভেবেছিলাম আতিক সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন। বেশ রাত হয়েছে। স্টাডিরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আলো জ্বলছে। গিয়ে দেখি আতিক সাহেব জেগে আছেন। তিনি বললেন, কিছু পেয়েছ?

বললাম, পেয়েছি। কোম্পানির ১৫০ কোটি টাকা সরিয়েছেন মোশারফ সাহেব। আর তা সরিয়েছেন খুব অল্প সময়ে। তাকে সাহায্য করেছে কালাম আর জসিম নামে দুজন। তারা আলাদাভাবে নিজেরা এনার্জি প্ল্যান্টের কাজ করছে। তাদের সঙ্গে বাইরের আরও কেউ কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে।

কালাম ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার। জসিম হেড অব অ্যাকাউন্টস।

ভাউচার আর চালানে পেনসিল দিয়ে দাগ দেওয়া জায়গাগুলো দেখালাম। তার সঙ্গে মিলিয়ে ল্যাপটপে ব্যালান্সশিট দেখালাম। আতিক সাহেব গরমিলটা বুঝতে পারলেন এবং মোশারফ এ কাজ করেছে দেখে তিনি দুঃখ পেলেন।

পরদিন লাঞ্চে আতিক সাহেব জানালেন মোশারফকে পনেরো দিন সময় দেওয়া হয়েছে। এটা বড় ধরনের কেলেঙ্কারি। কোম্পানির গুডউইলের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই এক্ষুনি থানা-পুলিশ করতে চাইছি না। এই সময়ের ভেতর মোশারফ টাকা ফেরত দিলে তার নামে কোম্পানি কেস করবে না। আর না দিতে পারলে তাকে জেলে যেতে হবে। আগামী পনেরো দিন তাকে সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছে। একজন স্পাই আর দুজন সিকিউরিটি তার ওপর নজর রাখবে, যাতে সে এ সময়ে দেশের বাইরে যেতে না পারে। তাকে দেশের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।

আমার প্রবল কৌতূহল শুরু হয়েছে অ্যান্টিম্যাটার কাজে লাগিয়ে এনার্জি প্ল্যান্ট বানানোর ব্যাপারে। সে সম্পর্কে কীভাবে জানা যেতে পারে, ভাবতে থাকলাম। তবে তাড়াহুড়ো করলাম না। নিজেকে সময় দিলাম।

সন্ধ্যার পর তন্বী এল আমার রুমে। তখন সবে চা শেষ করে বেরোব ভাবছি। তন্বী আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ থমথমে। গম্ভীর গলায় বলল, একটা সত্যি কথা বলবে?

বললাম, আমি কখনো মিথ্যা বলি না।

অ্যাকাউন্টস তোমার সাবজেক্ট নয়। তুমি বলেছিলে অঙ্কে ভীষণ ভয় পাও। তুমি কে?

স্থির চোখে তন্বীর দিকে তাকিয়ে আছি। কী বলব ভাবছি। তন্বী বলল, বলবে না তুমি আমাকে?

তন্বী হাসছে। তার মুখের হাসি আমাকে রীতিমতো বিভ্রান্ত করল। সে বলল, তুমি অন্য কেউ। সত্যি কি না বলো!

তাজ্জব হয়ে গেছি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তোমার সে রকম কেন মনে হচ্ছে!

মানুষ নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। চোখ মানুষকে আড়াল হতে দেয় না। তোমার চোখ বলছে।

চোখের পলক পড়ছে না তন্বীর। সে স্থির তীক্ষ্ণ ও কাতর চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। তার আকুল চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম।

তন্বী কাঁদছে। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল গালে। চোখ ভরা পানি নিয়ে তন্বী হাসল। তার ঠোঁট হাসছে। সে বলল, তুমি নাবিল।

প্রবল তেষ্টা পেয়েছে। ম্রিয়মাণভাবে হাসলাম। হেসে বললাম, হ্যাঁ আমি নাবিল।

সকাল। নাশতা খেয়ে আতিক সাহেব অফিসে চলে গেছেন। তন্বী চায়ের কাপ হাতে তার ঘরে গেছে। আমি ঘরে গিয়ে ব্লেজার গায়ে দিলাম। জুতা পায়ে দিলাম। ইচ্ছা করে টাই নিলাম না। মনে হলো আমার অন্তত একটা স্মৃতি থাক এ বাড়িতে। অন্য কোথাও চলে যাব। এখানে আর থাকা যাবে না। অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে এনার্জি তৈরির ব্যাপার সন্ধান করতে হবে।

বাইরের দরজা ঠেলে বের হয়ে এসেছি। পোর্চে দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে বের হয়ে ডান দিকে নাকি বাঁ দিকে যাব ভাবছি।

গাড়ি বারান্দার শেডের নিচে কালো রঙের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে স্যুট পরা একজন ভদ্রলোক নামলেন। তার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। আমার সামনে অবিকল আমি দাঁড়িয়ে আছি। আয়নায় যেমন দেখা যায়। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তার ভেতরেও আচমকা বিস্ময় খেয়াল করলাম।

তিনি তাকিয়ে আছেন সরাসরি আমার চোখের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি তার চোখে। মনে হলো আমার সামনে দাঁড়ানো নাবিলের চোখ কিছুটা নীল রঙের। চোখের মণি থেকে বাইরের দিকে সবুজ রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে।

আমরা সামনাসামনি দুজন কেউ চোখের পলক ফেলছি না। আমার মাথার ভেতর কটকট করছে। একসঙ্গে অজস্র বিষধর কীট কামড়াচ্ছে মনে হচ্ছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছি। মাথার ভেতর কটরকটর করে কাঠবিড়ালি ডাকছে। কাঠঠোকরা ঠোকরাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য মাথার ভেতরটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। চোখের সামনে ঝাপসা কুয়াশার মতো দেখাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

আমার সামনে এ জগতের নাবিল। সে এগিয়ে আসছে। নাবিল আমার ভেতর দিয়ে গিয়ে তন্বীদের বাড়িতে ঢুকল। যেন আমি না, আমার ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। তাকে মাড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ছায়া খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি।

একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে এসেছি। নিজেকে থিতু লাগছে। আমাকে আবিষ্কার করলাম রাস্তার ধারে, ফুটপাতে। সামনে চওড়া রাস্তা। পেছনে তাকালাম, লেক। বাঁ দিক থেকে এসে এই লেক ডান দিকে চলে গেছে। জায়গাটা আমার পরিচিত। এখানে আগেও এসেছি। বুঝতে পারছি আমি আগের জগতে ফিরে এসেছি। দুই জগতের সংযোগপথ দিয়ে এসে ট্র্যাপডোর পেয়ে গেছি। একেবারে অবিশ্বাস্যভাবে ঘটনা ঘটেছে। শুধু অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে এনার্জি তৈরির ব্যাপারটা জেনে আসতে পারিনি।

অন্য জগতের সঙ্গে এই জগতের সময়ের ফারাক ধরতে পারছি না। আমার হাতে ঘড়ি নেই। তবে এখানেও সকাল এখন। আজ কোন মাসের কত তারিখ বুঝতে পারছি না।

ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কিছু দূর আসতেই পরিচিত গলায় একজন আমার নাম ধরে ভাই বলে ডাকল। থেমে ঘুরে দেখি শিবলু। পাশে শিবলুর অফিস। কুসুমের সঙ্গে শিবলুর যথেষ্ট ভাব। কুসুমের তিন বছরের জুনিয়র। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। সে এখন আমাদের পারিবারিক বন্ধুর মতো।

শিবলু বলল, ভাই এদিকে?

কী বলব ভাবছি। বললাম, কাজ ছিল। তোর খবর কী?

আরে না। গাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নামার সময় সঙ্গে নিতে ভুলে গেছি। উজবুক ড্রাইভার। খেয়াল করেনি। গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে গেছে।

শিবলু আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ভাই, আপনাকে সেই লাগছে। স্যুটটা চমত্কার। আপার পছন্দ আছে। টাই হলে দারুণ মানাত। ইজিপ্ট থেকে টাই নিয়ে এসেছি। আপনাকে দেব।

হাসলাম। হেসে বললাম, আচ্ছা দিস।

শিবলু হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, নাকি সারা রাত শুটিং করেছেন ভাই? এসব নাটকের কস্টিউম!

বললাম, শোন, খারাপ ঘটনা ঘটেছে।

হাসি থামিয়ে আতঙ্কিত গলায় শিবলু বলল, কী হয়েছে, ভাই?

তোর ব্রেনে বুদ্ধি আছে। জিনিয়াস। রাতে শুটিং ছিল। ফিরতে ভোর হবে দেখে ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যাও। শুটিং শেষ করে দেখি মানিব্যাগ, মুঠোফোন কিছু নেই।

মানে কী! চুরি হয়ে গেছে?

আরে না। গাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নামার সময় সঙ্গে নিতে ভুলে গেছি। উজবুক ড্রাইভার। খেয়াল করেনি। গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে গেছে।

এখন কি হেঁটে বাসায় ফেরার প্ল্যান করেছেন?

কী বলব ভাবছি। শিবলুর কাছ থেকে কিছু টাকা নেওয়া দরকার।

ফাঁকা অটোরিকশা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। শিবলু ডাকল। জিজ্ঞেস করল, মোহাম্মদপুর যাবেন?

অটোচালক মোহাম্মদপুর যেতে রাজি হয়েছে। ভাড়া চায় তিন শ টাকা।

শিবলু মানিব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, ভাংতি নেই। তাকে বলবেন ভাঙিয়ে দিতে।

তোর মুঠোফোন নম্বর কি রকেট, বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্ট করা?

আপনি ওসবে টাকা পাঠাবেন না। দেখা করে আমাকে টাকা দেবেন।

ভাবলাম শিবলুকে জিজ্ঞেস করি, এদিকে আতিকুর রহমান বলে কেউ থাকেন কিনা! বড় এক এনার্জি প্রডিউস কোম্পানির মালিক। বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি। রুফটপে সুইমিংপুল। জানি, আতিকুর রহমান অন্য জগতের বাসিন্দা। এ তল্লাটে তার খোঁজ পাওয়া যাবে না।

শিবলুকে বাই বলে অটোরিকশায় উঠে বসলাম।

সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না ঘটনা কাউকে জানাব কি না। কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না। ঘটনা শোনার পর মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে আমাকে। সময় যদি বেশি পার না হয়ে থাকে, তাহলে বলব শুটিং ইউনিটের সঙ্গে ছিলাম। সময় অনেক বেশি পার হয়ে গেলে মুশকিলে পড়ব।

রাস্তা ফাঁকা। অটোরিকশা যাচ্ছে জোরে। হু হু করে বাতাস ঢুকছে। তন্বীর কথা মনে পড়ছে। তন্বী কী করছে এখন! নাবিলকে দেখে নিশ্চয় খুশি হয়েছে।

বাড়ি ফিরছি। কুসুম আমাকে দেখে খুশি হবে। পদ্ম বাবা-বাবা বলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে। তার জন্য কিছু কেনা দরকার। অটো ভাড়া দিয়ে ২০০ টাকা বাঁচবে। ২০০ টাকা দিয়ে পদ্মর জন্য কিছু কিনে ৫০০ টাকার নোট ভাঙানো যাবে।

অটোরিকশা থামিয়ে দোকানে গিয়ে পদ্মর জন্য পুতুল কিনেছি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পুতুল দেখতে তন্বীর মতো। হুবহু একই চেহারা।

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত