দূরের অতিথি

সবুজ রঙের প্রাণী দুটির শারীরিক গঠন অনেকটা মানুষের মতোই। বিরাট মাথায় চুলের বদলে কিলবিল করছে অনেকগুলো শুঁড়।

জামশেদুর রহমানের হাঁসের খামারের সামনে ভেসপা স্কুটার দাঁড় করিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল রাশেদ রাব্বি। কী আশ্চর্য! ভিড় দূরের কথা, কোনো লোকজনই চোখে পড়ছে না আশপাশে! অথচ পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস আর উত্সুক দর্শকে সরগরম হয়ে থাকার কথা জায়গাটার!

বিস্মিত রাব্বি টোকা দিল খামারবাড়ির লোহার ফটকে।

খানিক পরই প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক উঁকি দিলেন ফটকের ফাঁক দিয়ে। মুখে কাঁচা-পাকা চাপ দাড়ি তাঁর। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাইছেন, প্লিজ?’

‘জি, আমার নাম রাশেদ রাব্বি। সময়ের খবর পত্রিকা থেকে এসেছি।’

‘সময়ের খবর?’

বুঝল রাব্বি, সময়ের খবর-এর নাম শোনেননি ভদ্রলোক। বলল, ‘আমাদের অফিসে একজন ফোন করে জানিয়েছেন, এ বাড়ির আশপাশে কোথাও অদ্ভুত ধরনের এক প্লেন ক্রাশ করেছে। সেটার ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্যই এসেছি আমি।’

‘প্লেন ক্রাশ?’ অনিশ্চিত শোনাল জামশেদুর রহমানের গলাটা। কপালে চিন্তার ভাঁজ। ‘কই, এ রকম কিছু ঘটেছে বলে তো জানি না আমরা!’

‘ভেতরে আসুন, রাব্বি সাহেব,’ একটা নারীকণ্ঠ শোনা গেল এবার জামশেদ সাহেবের পেছন থেকে।

খামারমালিক গেটটা মেলে ধরতেই এক প্রৌঢ় ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেল রাব্বি। চোখে তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমা।

‘না না, ঠিক আছে,’ বলে উঠল ও। ‘অনর্থক সময় নষ্ট করতে চাই না আপনাদের। প্রায়ই এ রকম উড়ো খবর আসে পত্রিকা অফিসে।’

প্রথম যখন আসে এখানে, ওরাও ডিম নিয়ে এসেছিল আমাদের জন্য। ডিমগুলো দেখতে তারা মাছের মতো।

হাসলেন প্রৌঢ়া। ‘খবরটা কিন্তু মিথ্যা নয়। তবে ক্রাশ করেনি প্লেনটা, নিজ থেকেই নেমেছে ওটা এ বাড়ির পেছনের আঙিনায়।’

‘বলেন কী?’

‘জি। কিন্তু ওটাকে প্লেন বলা যায় কি না, জানা নেই আমার। কারণ, ওটার কোনো ডানা নেই।’

‘ডানা নেই? তাহলে কি ওটা হেলিকপ্টার?’

‘হেলিকপ্টারের তো পাখা থাকে। ওটার তা–ও নেই। একদম অন্য ধরনের আজব বিমান ওটা। চাইলে পেছনের আঙিনায় গিয়ে দেখে আসতে পারেন আপনি। জামশেদ, ওনাকে নিয়ে যাও তো!’

‘আসুন, মি. রাব্বি,’ আমন্ত্রণ জানালেন ভদ্রলোক।

জামশেদ সাহেবের সঙ্গে খামারবাড়ির পেছনে এসে হাজির হলো সময়ের খবর-এর প্রধান প্রতিবেদক। এসেই চোখ ছানাবড়া ওর!

ঠিকই বলেছেন মহিলা। প্লেনও নয়, হেলিকপ্টারও নয়, সামনের জিনিসটাকে দেখতে লাগছে বরং হলিউডের সায়েন্স ফিকশন সিনেমায় দেখা মহাকাশযানের মতো! ওটার জায়গায় জায়গায় জাহাজের পোর্টহোলের মতো গোল জানালা।

দারুণ এক প্রতিবেদন হবে, ভাবল ও। শিরোনামটাও ঠিক করে ফেলল মনে মনে।

‘আচ্ছা, প্লেনটা চালাচ্ছিল কে?’ জিজ্ঞেস করল ও জামশেদ সাহেবকে। ‘আর কোনো লোকজন ছিল না ওতে?’

‘না। দুজন এসেছে প্লেনে করে। দুজনই চালাচ্ছিল প্লেনটা।’

‘কোথায় ওরা?’

‘বাড়িতেই আছে। দেখা করতে চান?’

‘প্লিজ।’

‘চলুন তাহলে।’

‘দাঁড়ান একটু। প্লেনটা ভালোভাবে দেখে নিই আগে।’

কিন্তু ওটার ১০ ফুটের মধ্যে আসতেই কিসের সঙ্গে যেন বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়াতে হলো রাব্বিকে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে ও। দেয়ালে ধাক্কা খাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা হলো এইমাত্র, অথচ চোখে দেখতে পাচ্ছে না দেয়ালটা!

‘ওহ্-হো!’ আন্তরিক লজ্জিত হলেন জামশেদ সাহেব। ‘একদমই খেয়াল ছিল না বলতে। প্লেনের চারপাশে এনার্জি ব্যারিয়ার দিয়ে রেখেছে ওরা। ওটা না তুললে কাছে যেতে পারবেন না আপনি। চলুন, ঘরে যাই।’

বিমূঢ়ের মতো ভদ্রলোককে অনুসরণ করল রাব্বি।

‘সাত বছর আগে প্রথম এসেছিল ওরা এখানে,’ বলে চলেছেন জামশেদুর রহমান। ‘যাওয়ার সময় কিছু হাঁসের ডিম নিয়ে গিয়েছিল এখান থেকে। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রায় ডিমগুলো গেল সব নষ্ট হয়ে। সে জন্যই আবার এসেছে ওরা ডিম নেওয়ার জন্য। বিশেষভাবে তৈরি ইনকিউবেটরে করে নিয়ে যাচ্ছে এবার ডিমগুলো। নষ্ট তো হবেই না, উল্টো প্লেনেই ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোবে। দারুণ না? কি–না–কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে ওরা হাঁসগুলো নিয়ে।’

বলতে বলতে বৈঠকখানায় ঢুকে পড়লেন তিনি। পেছন পেছন রাব্বিও। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ও। সামনে সোফায় বসে আছে এক জোড়া এলিয়েন!

সবুজ রঙের প্রাণী দুটির শারীরিক গঠন অনেকটা মানুষের মতোই। বিরাট মাথায় চুলের বদলে কিলবিল করছে অনেকগুলো শুঁড়।

টিভি দেখছিল এলিয়েন দুটো। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকাল একবার রাব্বিদের দিকে।

উত্তেজিত হয়ে পড়েছে রাব্বি। জামশেদুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি! ওদের নাম কী, কোত্থেকে এসেছে—সবকিছু জানতে চাই!’

‘সরাসরি তো কথা বলতে পারবেন না ওদের সঙ্গে। না, ভাষা কোনো সমস্যা নয়। আসলে কথাই বলে না ওরা। টেলিপ্যাথির সাহায্যে যোগাযোগ করে অন্যদের সঙ্গে। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কাছে গিয়ে ডান হাতের তর্জনী উঁচু করে ধরুন।’

কিলবিলে চুলগুলো দেখে বিজাতীয় অনুভূতি হচ্ছে রাব্বির পেটের মধ্যে। তারপরও সাহস করে এগিয়ে গেল ও। তর্জনী খাড়া করে মনে মনে বলল, ‘নাম কী তোমাদের?’

আগন্তুক দুজন ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সহসা রাব্বির মাথায় ভেসে উঠল সবুজরঙা এক মানুষের ছবি...মানুষটা ও নিজে!

এদের নাম কি তাহলে সবুজ মানব? ভাবল ও। মনে মনে জিজ্ঞেস করল এবার, ‘কোত্থেকে এসেছ তোমরা?’

সঙ্গে সঙ্গে রাব্বির মনে হলো, নিঃসীম মহাশূন্যের মাঝ দিয়ে উড়ে চলেছে ও। গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কাপিণ্ড, ধূমকেতু শাঁই শাঁই করে পেছনে পড়ছে। শেষমেশ হাজির হলো সে দুই নক্ষত্রের বিচিত্র এক গ্রহে।

দৃশ্যটা অদৃশ্য হতেই উত্তেজনায় ছটফট করে উঠল রাব্বি। সাংঘাতিক ঘটনা! বাংলাদেশের মাটিতে এলিয়েন! পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম ঘটনা কি ঘটেছে আর কখনো? খবরটা ওর মাধ্যমেই সবার আগে জানতে পারবে দেশবাসী, এরপর সেটা ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়াজুড়ে!

প্রমোশন ইত্যাদির সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতে পকেট থেকে সেলফোন বের করল রাব্বি। কিন্তু বার কয়েক টেপাটেপি করেই বুঝতে পারল, ডেড হয়ে আছে ফোনটা।

আশ্চর্য! অবাক না হয়ে পারল না ও। অফিস থেকে বেরোনোর সময় দেখেছে ফুল চার্জে রয়েছে এটা, অথচ...।

‘আপনার ফোনটা একটু দেবেন?’ অনুরোধ করল ও জামশেদ সাহেবকে। ‘এক্ষুনি একটা খবর পাঠাতে হবে অফিসে!’

‘সরি, ভাই। ওরা ল্যান্ড করার পর থেকেই সব কটি ফোন অকেজো হয়ে আছে।’

‘তাহলে ল্যান্ডফোন?’

‘নাহ্‌, ল্যান্ডফোন নেই আমাদের। অবশ্য একটু দূরেই ফোন-ফ্যাক্সের দোকান আছে, সেখান থেকে ফোন করতে পারবেন। তবে নাই–বা গেলেন এ মুহূর্তে। ওদের যাওয়ার সময় হয়ে এল প্রায়। যেকোনো মুহূর্তে উড়াল দেবে সবুজ বন্ধুরা।’

‘না!’ চাঁদ হাতে পেয়েও হারানোর আশঙ্কায় আঁতকে উঠল রাব্বি। ‘এক্ষুনি যেতে পারবে না ওরা! অফিস থেকে ফটোগ্রাফার না আনা পর্যন্ত থাকতেই হবে এলিয়েনগুলোকে! আপনি, প্লিজ, বলুন ওদের!’

‘সেটা তো সম্ভব নয়, ভাই। মহাজাগতিক জোয়ার টাইপের কিছু একটা শুরু হলেই যাত্রা করবে ওরা। তা না হলে পরবর্তী জোয়ারের আগপর্যন্ত আটকা পড়ে থাকতে হবে পৃথিবীতে। এসব জোয়ার নাকি খুব তাড়াতাড়ি আসে না।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা!’ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে রাব্বি। ‘ক্যামেরা তো নিশ্চয়ই আছে আপনাদের, নাকি সেটাও নেই? যেকোনো ধরনের ক্যামেরা হলেই চলবে।’

‘না, তা আছে, কিন্তু নষ্ট।...ওই দেখুন, বিদায় নিচ্ছে বন্ধুরা।’

বেলুনের মতো বাতাসে ভেসে উঠেছে গ্রহান্তরের আগন্তুকেরা। উড়ে চলেছে ড্রয়িংরুম লাগোয়া খোলা বারান্দার দিকে।

একছুটে খামারবাড়ির পেছন দিকে চলে এল রাব্বি। ততক্ষণে মহাকাশযানে উঠে বসেছে ভিনগ্রহবাসীরা। ধীরে ধীরে শূন্যে ভাসল স্পেসশিপ, রকেটের মতো নীল আগুন বেরোচ্ছে ওটার পেছন দিয়ে; চোখের পলকেই উঠে গেল আকাশে, উধাও হয়ে গেল পরমুহূর্তে। যেন এই ছিল, এই নেই।

মাথার চুল ছেঁড়ার দশা হয়েছে রাব্বির। এই বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কোনো প্রমাণই রইল না ওর হাতে!

ছুটে এল প্রৌঢ় খামারির কাছে।

‘আচ্ছা, ডিমের বদলে কি কিছু দিয়েছে ওরা আপনাকে?’

‘হ্যাঁ, দিয়েছিল। প্রথম যখন আসে এখানে, ওরাও ডিম নিয়ে এসেছিল আমাদের জন্য। ডিমগুলো দেখতে তারা মাছের মতো। চার পাওয়ালা অদ্ভুত কিছু পাখির ছানা বেরিয়েছিল ডিমগুলো ফুটে। ডানা ছিল না ওগুলোর।’

‘আহ্...পেয়েছি প্রমাণ! কোথায় সেই পাখি?’

‘তিনটা পাখি শুধু বেঁচে বড় হয়েছিল। গেল ঈদে সেগুলো আমরা খেয়ে ফেলেছি।’

‘ইশ্‌...খেয়ে ফেলেছেন? আর ওগুলোর হাড়গোড়গুলো?’

‘সেগুলো কি আর থাকে? ওগুলো গেছে আমাদের বিড়ালটার পেটে। মাস দুয়েক হলো সেই বিড়ালও তো মরে গেছে!’

বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে